অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮২
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা নিজের ঘরে টাঙানো নিজের ছেলের সাথে এক ফ্রেমে তোলা একটি ছবির দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এই ছবিটি তার সাথে তার ছেলের একমাত্র স্মৃতি। আমিনা অসহায়ের মতো ছবির দিকে তাকিয়ে ছিল৷ তার মনের বেদনা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমন সময় সায়রা খান এসে আমিনার পাশে বসলেন৷ আমিনার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন,”কতক্ষণ আর এভাবে থাকবি মা? চল, কিছু খেয়ে নিবি।”
আমিনা বলে,”আমি কিভাবে খাব আম্মু? আমার কারণে আজ আমার বাবু হারিয়ে গেছে। আমি জানিনা, ও কোথায় আছে কি অবস্থায় আছে। জাঈদও আমার জন্য ১ মাস থেকে এই পরিবার থেকে দূরে আছে। কোথায় আছে সেটা আমরা কেউ জানি না। এই পরিস্থিতিতে কি আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে?”
সায়রা খান কিছু বলতে পারেন না। শুধু নীরবে কেঁদে ওঠেন। এমন সময় আকাশ এসে বলে,”কার জন্য তুমি নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছ আপু? যার কাছে তোমার অনুভূতির কোন মূল্য নেই। তুমি কি ভুল করেছিলে? নিজের মা ও সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়েছিলে। এটাই কি তোমার ভুল ছিল? জাঈদ ভাইয়া কিভাবে তোমায় দোষারোপ করতে পারে? আর উনি কিসের গোসায় পরিবার থেকে এভাবে দূরে সরে গেল? উনি কি একা নিজের ছেলেকে হারিয়েছে? তুমি নিজের বাবুকে হারাও নি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমিনা আকাশকে চোখ রাঙিয়ে বলে,”জাঈদের নামে কিছু বলিস না আমার সামনে। আমার জন্য ও নিজের জীবনে সবথেকে বড় কষ্ট পেয়েছে। কম কষ্টে ও পরিবার ছেড়ে যায়নি৷ আমাকে সামলানোর জন্য এখানে তোরা সবাই আছিস, তখন জাঈদকে সামলানোর জন্য কেউ নেই৷ ও আমাদের বাবুকে কত ভালোবাসত৷ না জানি এখন কি অবস্থায় আছে জাঈদ, কতোটা ডিপ্রেশনে আছে। আর আমি এই বাড়িতে থেকে এত সুযোগ সুবিধা ভোগ করব, এত আরাম আয়েসে থাকব..না সেটা হতে পারে না। অন্যায় যখন আমি করেছি তার শাস্তিও আমি ভোগ করব। আমার জন্য আমার বাবু ও স্বামীর জীবনে দূর্ভোগ নেমে এসেছে। তাই আমিও কষ্ট ডিজার্ভ করি।”
বলেই আমিনা উঠে দাঁড়ায়। সায়রা খান বলে ওঠে,”কি করতে চাইছিস তুই আমিনা? মাথা ঠান্ডা কর।”
আমিনা কোন কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে সটান নিচে নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ছিলেন আরহাম খান, আফিফা খান ও নির্ঝর খান। আমিনাকে দেখেই নির্ঝর খান উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,”আমিনা, তুমি এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?”
আমিনা ক্রন্দনরত স্বরে বলে,”আমার জন্য আমার বাবু নিখোঁজ হয়েছে, আমার স্বামী সেই শোকে পরিবারছাড়া, দেশছাড়া হয়েছে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এত গ্লানি আমি বয়ে বেড়াতে পারছি না বড় আব্বু। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমিও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। সবাইকে দুঃখ দিয়ে আমি নিজে সুখী জীবন কাটাতে পারব না।”
আরহাম বলে ওঠেন,”এসব কি বলছ তুমি? এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি?”
আমিনা বলে,”যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাব৷ তুমি দয়া করে আমাকে আটকিও না। তোমার নিজের মেয়ে যখন ভুল করেছিল তখন তুমি তাকে নিজে বের করে দিয়েছ৷ তাই আমাকেও আজ নিজের পাপের শাস্তি পেতে দাও।”
এমন সময় আকাশ এসে বলে,”আপু,,,তুমি এসব কি বলছ? তুমি কোন দোষ করো নি। নিজেকে অপরাধী ভাবা বন্ধ করো।”
আমিনা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”না, আমাকে আজ তোরা কেউ মানাতে পারবি না ভাইয়ু। তাই চেষ্টাও করিস না৷ আমার যা সিদ্ধান্ত নেবার আমি নিয়ে ফেলেছি৷ আমি আর এক মুহুর্ত এই বাড়িতে থাকব না।”
সায়রা খান বলে ওঠেন,”যদি তুই অপরাধী হয়ে থাকিস তাহলে আমিও সমান অপরাধী৷ তুই যদি সেদিন আমাকে বাঁচাতে ছুটে না আসতি তাহলে নিজের ছেলেকে এভাবে হারাতি না। তাই আমিও নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমিও যাব তোর সাথে।”
আকাশ করুণ স্বরে বলে,”আম্মু..তুমিও এসব কি পাগলামো শুরু করলে..”
আফিফা খান ও নির্ঝর খান এসব ভেঙে পড়েন। নির্ঝর খান বলেন,”জানিনা আফিফা, কোন পাপের ফল পাচ্ছি আমরা। আমাদের সাজানো গোছানো পরিবারটা এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না।”
আফিফা খানও শোক প্রকাশ করে বলেন,”প্রথমে আমানের মৃত্যু তারপর আরহা ও আরুর গৃহত্যাগ,জাঈদের বাচ্চা হারানো, জাঈদের বিদেশে চলে যাওয়া আর এখন আমিনা, সায়রার এই সিদ্ধান্ত। পরিবারটা সত্যিই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। অথচ আমরা শুধু অসহায়ভাবে এর সাক্ষী হলাম।”
আরহাম খান আকাশকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুমিও চলে যাও নিজের মা ও বোনের সাথে। এই বাড়িতে আমি একাই থাকি। মম, ড্যাড তোমরাও সিলেট চলে যাও। এই একাকীত্বই হয়তো আমার শাস্তি৷”
বলেই তিনি কাঁদতে শুরু করেন। আকাশ এগিয়ে গিয়ে বলে,”আম্মু,আপু আমিও তোমাদের সাথে যাব।”
আমিনা বলে,”নাহ, আকাশ। আমরা সবাই যদি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই তাহলে বয়স্ক মানুষদের কে সামলাবে? তুই ওনাদের সাথে থাক। ওনাদের দেখভাল কর। আর আম্মু তোমাকেও আসতে হবে না।”
সায়রা তবু জেদ করে বলেন,”নাহ, আমি যাবোই। আকাশ, তুই এখানে থেকে সবটা সামলা। এটা আমার আদেশ।”
আকাশ আর কিছু বলতে পারে না। সায়রা আমিনার হাত আলতো করে ধরে। ধীরে ধীরে বাড়ির মূল দরজার দিকে এগিয়ে যায় তারা। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের চোখে অশ্রু। আজ যেন খান পরিবার একেবারে খানখান হয়ে গেল।
আমিনা ও সায়রা বাইরে এসে সামনের দিকে এগোতে নেবে এমন সময় তাদের পথ আটকে দাঁড়ায় আরুশি ও আরহা। তাদের দেখে আমিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরুশি বলেন,”আমি খালাম্মা(আফিফা খান) এর কাছে সব শুনেছি। তোমরা যখন একবার চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ তখন তোমাদের আটকানোর সাধ্য আমার নেই। তবে একটা কথা বলতে চাই, নিজের মেয়েকে আমি করুণ পরিস্থিতিতে একা ছাড়িনি; আমিনাকেও আমি নিজের মেয়েই ভেবেছি সবসময়। তাই ওকেও আমি একা ছাড়বো না। আমিনা, সায়রা তোমরা আমার সাথে চলো। আশা করি, এতে আপত্তি রইবে না।”
আমিনা আরুশিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরহার সামনে হাতজোড় করে বলে,”তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আমি৷ তারই ফল পাচ্ছি বোধহয়।”
আরহা আমিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ছি ছি আপু! এমন কথা বলো না। তোমার প্রতি আমার রাগ নেই। তুমি যা করেছ তোমার পরিস্থিতি অনুযায়ী সেটাই স্বাভাবিক, আমি থাকলেও একই করতাম। কিন্তু ভাইয়া এটা বাড়াবাড়ি করল। এভাবে সবার সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করে বিদেশ চলে গেল, মানছি সন্তান হারিয়ে সে অনেক কষ্টে আছে কিন্তু তোমার কষ্টটাও তো একবার তার ভাবা উচিৎ।”
আমিনা বলে,”নাহ, সব দোষ আমার। আমার জন্য তোমার ভাইয়া আজ এত কষ্ট নিয়ে একা বিদেশে গেছে। তাকে দোষ দিও না তোমরা। তবে আমি হাল ছাড়বো না, আমার বাবুকে আমি খুঁজে বের করবোই এটা এক মায়ের প্রতিজ্ঞা।”
বলেই আমিনা মনে মনে জাঈদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”জানি, তুমি এখন খুব অসহায় অবস্থায় আছ। তোমার এই কষ্টের জন্য অনুশোচনা নিয়ে আমায় এখন বাঁচতে হবে; বিগত এক মাস থেকে এই কষ্টে আমি ঠিকমতো দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। সামনেও হয়তো পারব না। তবে একসময় আমি আমাদের ছেলেকে ফিরিয়ে আনবোই। তোমার ছেলেকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দেবোই আমি।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮১
জাঈদ নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে কানাডার টরেন্টো শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে। ছেলেটাও অবাক চোখে চারিদিকে তাকাচ্ছে। জাঈদ ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলে,”নিজের অতীতকে আমি পেছনে ফেলে এসেছি৷ কেউ কখনো জানবে না, আমার বাবু আমার কাছেই আসে। এখন আমাদের বাপ ছেলের এক দুনিয়া তৈরি হবে এই টরেন্টোতে। যেখানে আমি অতীতের আঁচ লাগতে দেব না।”