অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৪
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা পরদিন সকালে উঠেই নিজেকে জাঈদের পাশে দেখে ঘৃণায় উঠে বসে৷ নিজের পোশাকটা হাতে নিয়ে দ্রুত পরিধান করে নেয়৷ অতঃপর ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ছেড়ে কাঁদতে থাকে৷ এদিকে জাঈদেরও ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। অতঃপর গতকাল রাতের ঘটনা মনে করে সে বলে ওঠে,”ড্যাম ইট, এটা আমি কি করলাম? ঐ মেয়েটার সাথে এমনটা আমি কিভাবে করতে পারলাম? ওর সাথে তো এই বিয়েটা জাস্ট একটা..ওহ শিট৷ কাল রাতে একটু বেশিই নেশা করে ফেলছিলাম। এটা হয়তো তারই প্রভাব। কিন্তু এখন কি হবে? কিভাবে এর মোকাবিলা করব সেটাই বুঝতে পারছি না।”

কিছু সময় পর আরিশা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই জাঈদ তার দিকে একটা পিল বড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আমি চাই না, আর কোন বড় দূর্ঘটনা ঘটুক।”
“লাগবে না, সরান এটা।”
“কেন? তোমার কি আমার বাচ্চার মার হওয়ার খুব শখ হয়েছে নাকি?”
আরিশা জাঈদের শার্টের কলার ধরে বলে,”আপনার মতো শয়তানের বাচ্চার মা আমার শত্রুও না হোক এই কামনা করি। আমার এই পিল লাগবে না কারণ আমি কোনদিনও বাচ্চার মা হতে পারব না, বুঝলেন আপনি?”
বলেই সে অঝোরে কাঁদতে থাকে। একটু দম নিয়ে বলে,”কাল রাতে আপনি যা করলেন তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এর জন্য আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না, কখনো না। এর শাস্তি আপনি পাবেন একদিন না একদিন। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলেই আরিশা কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে ধরে। এমন সময় জাঈদ আরিশাকে আটকে বলে,”কাল যা হয়েছে তা মোটেই আমার ইচ্ছায় হয়নি। আমার কোন আগ্রহ ছিল না তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার..আমি তো নেশায় ছিলাম আর তোমাকে আফিফা ভেবে..”
জাঈদ নিজের পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই আরিশা তার গালে ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,”খবরদার আপনার এই পাপিষ্ঠ মুখে আমার আপ্পির নাম উচ্চারণ করবেন না।”
“তুমি আমায় মারলে..”

“হ্যাঁ, মারলাম। প্রয়োজনে আবারো মারব…কি করবেন আপনি? আবারো কাল রাতের মতোন..”
জাঈদ আরিশার মুখ চেপে ধরে বলে,”তোর মতো মেয়েকে স্পর্শ করতেও ঘৃণা লাগে..বললাম না, কালকের রাতে যা ঘটেছিল তা কেবলই একটা দূর্ঘটনা? বুঝলি না কেন তাহলে?”
বলেই আরিশাকে দূরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আরিশা ফ্লোরে পড়ে যায়। তার হাতে পায়ে বেশ চোট লাগে কিন্তু জাঈদ সেদিকে কোন দৃষ্টিপাত না করে বেরিয়ে যায়।
ফ্লোরে পড়ে থাকা আরিশা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেয়। চোখের কোন দিয়ে নেমে আসা অশ্রুর ধারা সে আর নিতে চায় না। তার ভেতরটা আগুনে পুড়ছে, তবুও তার নিজেকে সামলাতে হবে। নিজেকে দুর্বল দেখালে এই মানুষটা হয়তো ভাববে, সে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু না, সে ভাঙবে না!
কষ্ট আর ঘৃণার কাঁপুনি নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে জাঈদ চলে গেছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সেই শয়তানের উপস্থিতি এখনও ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে। নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে যেতে চায়, কিন্তু পা একদম জমে গেছে। অবশেষে নিজেকে জোর করে ওয়াশরুমে ঢোকে, আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আর নিজেকে চিনতে পারে না। চুল এলোমেলো, চোখ লালচে আর গাল দুটো ফুলে আছে। নিজেকে দেখতে এত ভয়ঙ্কর লাগছে যে, মনে হচ্ছে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে জানে, আয়না ভাঙলে চেহারা বদলাবে না, তার জীবনের ভয়ংকর সত্য বদলাবে না।
আরিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলে,
“তুই দুর্বল নস, আরিশা! তোর সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুই কাঁদবি না। তুই এখনো বেঁচে আছিস, তাই তোর যুদ্ধ করার সময় এসেছে।”
নিজেকে শক্ত করে বেরিয়ে আসে। এক মুহূর্তও এই ঘরে থাকা যাবে না। এখানকার প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি আসবাবে, বিছানার সেই রক্তের দাগে লেপ্টে আছে তার অসহায়ত্বের প্রমাণ। আর সে চায় না এই প্রমাণ আর কেউ দেখুক।

আরিশা মন খারাপ করে বসে ছিল ঘরের মধ্যে। এমন সময় কারো আসার শব্দ পেতেই সে চমকে ওঠে। দুচোখ তুলে তাকাতেই সে দেখতে পায় জাঈদের মা জামিলা শেখ কে। তাকে দেখে আরিশা বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ জামিলা শেখ হঠাৎ করে আরিশার পাশে বসে আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আরিশা জামিলা শেখের এমন আকস্মিক ব্যবহারে বেশ অবাক হয়। জামিলা শেখ সেটা বুঝতে পেরে বলেন,”জানি, তুমি আমায় দেখে বেশ অবাক হচ্ছ। হয়তো তুমি আমায় অনেক খারাপ ভাবো। তবে একটা কথা জানো কি? আমি আসলে ওতোটাও খারাপ মানুষ নই। আমারও একটা ভালো মন আছে। আমি আমার ছেলের ভালোর কথাই ভাবি৷ আর নিজের ছেলের স্বভাব সম্পর্কেও আমি ওয়াকিবহাল। আমি খোঁজ নিয়ে সব জেনেছি, জাঈদ কোন পরিস্থিতিতে আর কেন তোমায় বিয়ে করেছে৷ সবটা জেনে তোমার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগছে জানো! তুমি কোন দোষ না করেও শুধু শুধু এত কষ্ট পাচ্ছ।”

আরিশার অবাক হওয়া যেন কোন ক্রমেই কমছিল না। জামিলা শেখ আরো বলে ওঠেন,”আমি জানি, জাঈদ কিছুতেই তোমায় শান্তিতে থাকতে দেবে না। কিন্তু এই অশান্তিময় জীবন তুমি ডিজার্ভ করো না। তোমারও তো সুখে থাকার একটা অধিকার আছে, তাই না? আমি জানি তোমার কেমন লাগছে এখানে থাকতে। তাই তোমায় একটা পরামর্শ দেই। এখানে থেকে নরকের মতো জীবনযাপন না করে এখান থেকে চলে যাও।”
আরিশা অবাক স্বরে বলে,”চলে যাব?”
“হ্যাঁ, যাও এখান থেকে। তাহলেই তুমি সুখী হতে পারবে।”
আরিশা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”কিন্তু আমি যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে যে জাঈদ শেখ আমার আপ্পির ক্ষতি করতে।”

জামিলা শেখ আরিশাকে ভরসার সুরে আশ্বাস দেন,”তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি জাঈদকে বোঝাব যেন ও তোমার আপ্পির কোন ক্ষতি না করে। আমি বোঝালে ও ঠিকই বুঝবে। কিন্তু তুমি যদি এখানে ওর সামনে থাকো তাহলে ও তোমার জীবনটা একদম নরক বানিয়ে দেবে। তাই আমি বলছি, নিজের ভালো চাইলে তুমি চলে যাও এখান থেকে অনেক দূরে।”
জামিলা শেখ এত কথা আরিশাকে ভাবিয়ে তোলে। জামিলা শেখ আবারো জোর দিয়ে বলেন,”এত ভেবো না! তোমার হাতে বেশি সময় নেই। জাঈদ এখন বাড়িতে নেই কিন্তু যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ও বাড়িতে এলে তুমি আর পালানোর সুযোগ পাবে না। তাই এখনই পালিয়ে যাও।”
আরিশা উঠে দাঁড়ায়। বলে,”বেশ, আমি এখনই এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
জামিলা শেখ খুশি হয়ে বলেন,”এই তো বুদ্ধিমতীর মতো সিদ্ধান্ত”
বলেই তিনি আরিশার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেন,”এই টাকা টুকু রাখো, এটা দিয়ে বাসায় যেও।”
“লাগবে না, আন্টি।”

“আরে রাখো। রাস্তায় চলাফেরায় কাজে লাগবে। এখন জলদি যাও।”
আরিশা একটা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।
এদিকে আরিশা বেরিয়ে যেতেই জামিলা শেখ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,”যাক, ভুলভাল বুঝিয়ে এই আপদটাকে বিদায় করতে পারলাম! এখন আমি চাইলেই আমার জাঈদের সাথে আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যার বিয়ে দিতে পারব!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৩

এদিকে আরিশা জাঈদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই উদ্দ্যেশ্যহীন হয়ে পড়ে। এখন কোথায় যাবে সে? আফিফাদের বাড়ি? নাহ, আরিশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ওখানে আর ফিরবে না। যারা তার আপন নয় তাদের কাছে কেন যাবে? যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই এখন যাবে সে। এসব ভেবেই চোখের জল মুছে সামনের দিকে রওনা দেয় আরিশা।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৫