অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৯
ইয়াসমিন খন্দকার
জাঈদ আবরাজকে কোলে নিয়ে পা রাখলো ঢাকায়। বিমানবন্দর থেকে বাইরে এলো সে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে রিয়াশা। দীর্ঘ ৬ বছর পর নিজের দেশে পা রাখলো জাঈদ৷ রিয়াশাও বেশ অনেকদিন পর নিজের দেশের মাটিতে পা রাখলো৷ আবরাজ তো প্রথমবারের মতো নিজের দেশে এলো। সে অবাজ স্বরে জাঈদকে জিজ্ঞেস করলো,”পাপ্পা, এটাই কি আমার দেশ?”
জাঈদ মাথা নাড়ালো। আবরাজ খুশি হলো। রিয়াশা জাঈদের উদ্দ্যেশ্যে বললো,”এখন আপনার গন্তব্য কি?”
জাঈদ বললো,”চলো আমরা আগে আগে থেকে বুক করে রাখা হোস্টেলে গিয়ে উঠি। তারপর বলছি।”
রিয়াশা সম্মতি দেয়। অতঃপর তারা ঢাকা শহরের একটি স্বনামধন্য হোস্টেলে যায়। সেখানেই একটি রুম বুক করে রেখেছিল জাঈদ। রিয়াশা ও আবরাজকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিল সে৷ জাঈদ রিয়াশাকে বলল,”রাজের খেয়াল রেখো, আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”
আবরাজ বলে ওঠে,”তুমি কোথায় যাবে পাপ্পা? আমাকে নিয়ে যাবে না?”
জাঈদ বলল,”আমি কিছু জরুরি কাজে যাচ্ছি, রাজ। একটু পরই ফিরে আসব। তারপর তোমার সাথে অনেক মজা করব। তুমি ততক্ষণ তোমার রিয়ু আন্টির সাথে থাকো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আবরাজ ভদ্র ছেলের মতো জাঈদের কথা মেনে নেয়। তার দুচোখে মৃদু হাসি।
জাঈদ এরপর রওনা দেয় খান বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই জাঈদের দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। তার বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হতে থাকে। আজ থেকে ৬ বছর আগে তো সে চিরতরে এই বাড়ি ত্যাগ করেছিল৷ আজ আবার এতগুলো দিন পর সেই পুরাতন ঠিকানা, পুরাতন মানুষগুলো….জাঈদের মনে আজ অন্যরকম অনুভূতি। বাড়ির সামনে এসে দাড়াতেই জাঈদের অনুভূতি তীব্র হয়। কাপা কাপা পায়ে সে বাড়ির সামনেতে প্রবেশ করল। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,”আমাকে তাহলে এখানে ফিরতেই হলো..”
কলিংবেল বাজানোর কিছু সময় পর আফিফা খান এসে দরজা খুলে দিলেন। জাঈদকে দেখেই আবেগময় স্বরে বললেন,”এতদিন পর তুমি ফিরে এলে জাঈদ? এতদিন পর এই বুড়ি দাদি..নিজের বাবার কথা মনে পড়ল?”
জাঈদ কিছু বলল না। আফিফা খান রাস্তা ছেড়ে দিলেন। জাঈদ আনত স্বরে বলল,”তুমি কেমন আছ, দাদি?”
“তোমরা যেমন রেখেছ।”
জাঈদ আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। আফিফা খানের কন্ঠে অভিমান টের পাওয়া যাচ্ছিল। জাঈদ বলে ওঠে,”পাপা কোথায়?”
“এসো আমার সাথে। তোমার পাপা তার রুমেই আছেন।”
জাঈদ নিজের পাপার রুমের দিকে যায়৷ আরহাম খান তখন শুয়ে ছিলেন। তার দুচোখ বন্ধ ছিল। জাঈদ তার কাছে গিয়ে তার সামনে বসে পড়লো। আবেগময় স্বরে বলে উঠল,”পাপা!”
আরহাম চোখ খুলে তাকালো। দীর্ঘ ৬ বছর পর তার ছেলে তাকে পাপা বলে ডাকল। তার দুচোখ জলে ভরে উঠল৷ আরহাম খান উঠে বসে জাঈদকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”তুমি এসেছ জাঈদ! আমি তো ভাবলাম..তোমার অভিমান আর এ জনমে কমবে না। তোমাকে না দেখেই বুঝি আমায় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে।”
জাঈদ বললো,”এমন কথা বলো না, পাপা। কিছু হবে না, তোমার। আমি তোমাকে আমার সাথে কানাডায় নিয়ে যাব। ওখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
আরহাম বলে,”আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নেই..জাঈদ! কাদের জন্য বাঁচব আমি? নিজের ভুলে নিজের স্ত্রী ও মেয়েকে আমি নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। আর তারপর তুমি আর আমিনা..তোমাদের এই দীর্ঘ বিচ্ছেদ আমাদের পরিবারকে একদম ভেঙে রেখে দিয়েছে। এই একাকীত্ব আমার আর সহ্য হচ্ছে না। নিজের পাপের ফল যে এভাবে ভোগ করতে হবে সেটা আমি কখনো ভাবি নি।”
এমন সময় হঠাৎ করে দরজা থেকে এক নারীর কন্ঠ ফুটে ওঠে,”পাপা! তুমি কোন পাপ করো নি। প্লিজ এমন কথা বলো না”
আরহাম সেদিকে তাকায়। আরহা এসে উপস্থিত। তার কোলে তার এক বছর বয়সী মেয়ে নিঝুম। পাশেই মাশরাফি ও আরুশি দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে জাঈদ উঠে দাঁড়ালো। আরহাও নিজের ভাইকে দীর্ঘ ৬ বছর পর দেখে চমকে উঠলো। নিজের মেয়েকে মাশরাফির কোলে দিয়ে ছুটে এসে জাঈদকে জড়িয়ে ধরে বললো,”এত বছর পর তোমার আমাদের কথা মনে পড়লো ব্রো? কেন এতগুলো বছর আমাদের এত কষ্ট দিলে? আমাদের পরিবার আগে কতো হাসিখুশি ছিল..অথচ কোথা থেকে কি হয়ে গেল। আজ আমাদের পরিবার একদম ছিন্নভিন্ন। সব হাসিখুশি সব মিলিয়ে গেছে।”
আরহাম আরহার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”তুমি এসেছ আরহা..নিজের অপরাধী পাপাকে তাহলে এতদিন পর ক্ষমা করতে পেরেছ।”
আরহা আরহামের পাশে বসে বললো,”এভাবে বলো না, পাপা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি জানি,তুমি আমাকে যা বলেছিলে সব রাগের বশে। মন থেকে কখনো তুমি আমায় ঘৃণা করো নি। তোমার চোখে আমি এখনো আমার জন্য সেই আগের ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বাস করো, এই ৬ বছরে যদি তুমি একবারও আমায় ডেকে পাঠাতে নিজে থেকে,,,আমি সব অভিমান ভুলে ছুটে আসতাম।”
“কোন মুখে তোমায় ডেকে পাঠাতাম আমি আরহা? আমি একজন ব্যর্থ বাবা। একজন বাবার কর্তব্য তার মেয়েকে আগলে রাখা..অথচ আমি তা পারিনি। তাই তো আজ সব হারিয়ে বসে আছি।”
মাশরাফি সামনে এগিয়ে আসে। সে এসেই বলে,”আপনি চিন্তা করবেন না, আঙ্কেল। আমাদের কারো আপনার উপর আর কোন রাগ নেই।”
মাশরাফির কোলে থাকা নিজের নাতনী নিঝুমকে দেখে আরহাম আরো বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। আরহা মাশরাফির কোল থেকে নিঝুমকে নিয়ে আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই দেখো, আমার মেয়ে নিঝুম..ওর এবার ১ বছর হলো..ওকে কোলে নেবে না পাপা? নিজের নাতনীকে আদর করবে না?”
আরহাম নিঝুমকে কোলে নিয়ে তার কপালে আলতো করে চুমু খেল। জাঈদের দিকে তাকিয়ে তার চোখে আফসোসের সুরও ভেসে উঠল। তিনি বললেন,”আজ যদি আমার নাতিও হারিয়ে না যেত তাহলে এই শেষ সময়ে ওকেও আদর করতে পারতাম।”
কথাটা শুনে এই ৬ বছরে জাঈদের মনে প্রথমবারের মতো অপরাধবোধ জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারে,নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে সে এতবছর শুধু নিজের ছেলেকেই তার পরিবার থেকে বিছিন্ন করে রাখেনি, তার পরিবারের মানুষগুলোকেও অকারণে অনেক কষ্ট দিয়েছে। জাঈদ নিজের চোখের জল মোছে। আরহাম এবার দরজায় দাঁড়ানো আরুশির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি কি এখনো আমায় ক্ষমা করতে পারো নি আরুশি? তাই কি এতোটা দূরে সরে আসো?”
আরুশি ধীর পায়ে এগিয়ে আসলেন। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টা করেও পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন,”আমার কি অধিকার আছে নাকি কারো উপর রাগ করার? শুধু অন্যের রাগ সহ্য করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। তুমি একবার রাগ করে আমাকে আর আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে দূরে পাঠিয়ে দেবে,তোমার ছেলে একবার রাগ করে আমাদের সবাইকে ছেড়ে কানাডায় চলে যাবে.আর আমি চুপচাপ এসব দেখবো।”
জাঈদ আরুশির সামনে এসে বলে,”মম আমি..”
আরুশি জাঈদকে কড়া স্বরে বলে,”আমায় মম বলবে না৷ মারা গেছেন তোমার মম৷ তুমি কি ভেবেছ টা কি? এই ৬ বছর তো একবারো খোঁজ নাওনি মম বেচে আছে নাকি মারা গেছে..এতো স্বার্থপর ছেলের জন্ম দিয়েছি আমি। জীবনে না স্বামীকে দিয়ে সুখ পেলাম না ছেলেকে দিয়ে। সবাই শুধু আমায় কষ্টই দিল। আমার কষ্টের কথা নাহয় বাদ দিলাম কিন্তু আমিনাকে তুমি এই ৬ বছর যে কষ্ট দিয়েছ তার কি হবে?”
“আমিনা? কোথাও ও?”
একটু পরই আমিনা এলো। দীর্ঘ ৬ বছর পর দুজনের চোখাচোখি হলো। আমিনার চোখ আবেগে টলমল করছিল। এতদিন পর সে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে দেখল। আমিনা দূর থেকেই এতক্ষণ সব দেখছিল। জাঈদ আমিনার মলিন মুখশ্রী দেখে থমকে গেল। সে তো ভেবেছিল আমিনা অনেক সুখে আছে কিন্তু…এরমধ্যেই আরুশি বললেন,”যাক! এত বছর পরও নিজের স্ত্রীর খবর জানতে চাইলে সেজন্য ধন্যবাদ।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৮
বলেই আরুশি আমিনার কাছে এসে তার কাধে হাত রেখে বলেন,”কেমন থাকবে সেই মেয়েটা..যার সন্তান হারিয়ে গেছে..যার স্বামী দীর্ঘ ৬ বছর তার থেকে দূরে ছিল..মেয়েটাকে একা এই নরককুণ্ডে রেখে গেছে..”
জাঈদ আমিনার দিকেই তাকিয়ে থাকল অপলক।