অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৭
ইয়াসমিন খন্দকার
আরিশা জাঈদের বাড়ির সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসে। ঘরটা ধুলায় পরিপূর্ণ। ঘরে প্রবেশ করতেই তার নাকে মুখে ধুলা এসে লাগে। আর সেজন্য সে হালকা কাশতে থাকে। আরিশা উপায়ন্তর না দেখে একটা ঝাড়ু এনে কোনরকমে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে থাকার উপযুক্ত করে তোলে। অতঃপর বিছানায় বসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এই ঘরটা ভীষণই ছোট। তবে এখানেই এখন তাকে মানিয়ে নিতে হবে। নিজের জীবনের এই পরিবর্তন দেখে আরিশার নিজের অদৃষ্টের প্রতি ভীষণ করুণা হয়। কিছুদিন আগেও অব্দি চঞ্চল, হাসিখুশি মেয়েটার জীবন মাত্র ক’টা দিনের মধ্যেই কতোটা মলিন হয়ে গেল। যেই আরিশা একসময় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত আজ সে নিজেই হাসতে ভুলে গেছ। আরিশার চোখের কোণে অশ্রু জ্বলজ্বল করছিল। সে কোনরকমে অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে,”এই জীবন থেকে কি আমার মুক্তি নেই আল্লাহ? মৃত্যুও তো এর থেকে ভালো!”
এমন সময় হঠাৎ করে জামিলা শেখ আরিশার রুমে চলে আসে। তিনি এসেই দরজা লাগিয়ে দেন। আরিশা তাকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। অতঃপর কিছু বলতে যাবে তার আগেই জামিলা শেখ আরিশার সামনে এসে ঠাস করে তার গালে থা*প্পড় বসিয়ে দেন। আরিশা পুরো তাজ্জব বনে যায়। গালে হাত দিয়ে হতবাক স্বরে বলে,”আন্টি…”
“চুপ..একদম চুপ। আপদ একটা, তোকে না আমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম তাহলে কেন আবার ফিরে এলি?”
আরিশা জামিলা শেখকে হঠাৎ এমন তুইতুকারি করতে দেখে বুঝতে পারে তার মধ্যে আরিশাকে নিয়ে কতোটা বিদ্বেষ লুকিয়ে আছে। কিন্তু আরিশাও তো আর চুপ থাকার মেয়ে নয়। তাই সেও প্রতিবাদের সুরে বলে,”আপনার ছেলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি নিজের ইচ্ছায় এখানে আসিনি। আর আমার গায়ে হাত তোলার কোন অধিকার আপনার নেই। নেহাতই আপনি আমার থেকে বয়সে বড় তাই আমি কিছু বললাম। অন্যথায় বুঝিয়ে দিতাম।”
“কি তোর এত বড় সাহস তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? এত সাহস কোথায় পাচ্ছিস তুই? কে দিচ্ছে তোকে এত সাহস?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“সাহস কেউ কাউকে দেয় না। সাহস আদায় করে নিতে হয়৷ আপনারা যদি আমার চুপ থাকাকে আমার দূর্বলতা ভাবেন তো ভুল করবেন। নেহাতই আমি এখন একটু বেকায়দায় পড়েছি তাই চুপ আছি। নাহলে আপনাদের সবাইকে দেখিয়ে দিতাম আরিশা কি জিনিস। বিশেষ করে আপনার ঐ লম্পট ছেলেকে।”
“খবরদার! আমার ছেলেকে নিয়ে কিনা বলবি না। নিজেকে আয়নায় দেখিস ভালো করে। কোথায় তুই আর কোথায় আমার সোনার টুকরো ছেলে জাঈদ। তুই তো ওর পাশে দাঁড়ানোরও যোগ্য না।”
“ঠিকই বলেছেন আপনি। আমি আপনার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য না। কিন্তু দেখুন, আপনার ছেলে আমায় বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি।”
জামিলা শেখ এবার রেগে যান। আরিশাকে চোখ রাঙিয়ে হাতের আঙুল তুলে হুমকি দিয়ে বলেন,”এই শোন! আজ আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যা আসছে এই বাড়িতে৷ ও যেন কিছুতেই জানতে না পারে তোর আর জাঈদের বিয়ের ব্যাপারে। তোকে তো আমি এখান থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু জানি না জাঈদ কেন তোকে ফিরিয়ে আনল..যাইহোক, যদি সন্ধ্যা ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারে তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। কথাটা মাথায় রাখিস।”
আরিশা বলে,”আপনার হুমকিকে আমি ভয় পাই না। কিন্তু আপনার ছেলেকে নিজের স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়ারও কোন অভিরুচি আমার নেই। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন কেউ এই ব্যাপারে কিছু জানবে না।”
“কথাটা মাথায় থাকে যেন।”
বলেই জামিলা শেখ বেরিয়ে যান। তিনি চলে যাওয়ার পরই আরিশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের গালে আলতো করে হাত বুলোয় সে। এখনো তার গালটা বেশ ব্যাথা করছে। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়ে সে বলল,”এসবে অভ্যেস করে নে আরিশা! মানসিকভাবে তো ক্ষতবিক্ষত হয়েইছিস এখন নাহয় শারীরিক ভাবেও হ!”
জামিলা শেখ অধীর আগ্রহে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে উঠতেই তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেন। দরজাটা খুলতেই নিজের বোনঝি সন্ধ্যাকে দেখতে পান। বেশ সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা একটা মেয়ে। পরণে মিনি স্কাট ও টপস। তাকে দেখেই জামিলা শেখ আলিঙ্গন করে বলেন,”আমার সন্ধ্যা! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! বেশ ভালোই বড় হয়েছ।”
“ও মাই সুইট খালা, তোমায় দেখে অনেক ভালো লাগল।”
“এখানে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
“না খালা। সেরকম কোন অসুবিধা হয়নি। তবে আমি আশা করেছিলাম জাঈদ ভাইয়া আমায় পিক করতে যাবে।”
জামিলা শেখ ব্যাপারটা সামাল দেয়ার জন্য বলেন,”আরে! জাঈদের কথা আর কি বলবো। ও তো সারাদিন এত ব্যস্ত থাকে যে ঠিকমতো খাওয়ারই সময় পায় না। জানোই তো সামনে তোমার খালুর ইলেকশনের ডেইট আসছে। তোমার খালু এবার এমপি পদে লড়বে। সেই জন্যই অনেক ব্যস্ততা যাচ্ছে জাঈদের উপর দিয়ে।”
“ওহ আচ্ছা।”
হালকা স্বরে বলে সন্ধ্যা। এমন সময় ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো জাঈদ। জাঈদকে দেখামাত্রই জামিলা শেখ বললেন,”জাঈদ এসো দেখে যাও কে এসেছে!”
জাঈদ এগিয়ে এসে বলে,”কে এসেছে লন্ডনের রাণী ভিক্টোরিয়া?”
সন্ধ্যা বলে,”দেখেছ খালা? জাঈদ ভাইয়া এখনো আমায় এই নামে ডেকে ক্ষেপাচ্ছে!”
“আহা! তোমাদের এই খুনশুটি দেখে খুব ভালো লাগছে।”
সন্ধ্যা তার লাগেজগুলো দেখিয়ে বলে,”এগুলো কোথায় রাখব? এতে অনেক দামী জিনিস আছে। তোমাদের জন্য লন্ডন থেকে অনেক গিফটও এনেছি।”
“ওগুলো..আচ্ছা দাঁড়াও।”
বলেই জামিলা শেখ একজন কাজের লোককে ডেকে বলেন,”যাও তো গিয়ে আরিশাকে ডেকে নিয়ে আসো।”
অতঃপর কাজের লোকটি জামিলা শেখের কথামতো আরিশাকে ডেকে নিয়ে আসে। আরিশা আসতেই সন্ধ্যা তাকে দেখে বলে,”ইনি কে খালা? এনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
জামিলা শেখ বলে ওঠেন,”ও আমাদের বাড়ির আশ্রিতা..কাজের লোকও বলতে পারো। মেয়েটার ভাগ্য খুব খারাপ জানো বিয়ের পর ওর স্বামী ওকে স্বীকৃতি না দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর ওর দুঃখের কথা জেনে আমরা ওকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। জামিলা বলে ওঠে,”এই মেয়ে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? দেখছ না সন্ধ্যা হাতে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাও গিয়ে লাগেজ গুলো ভেতরে রেখে আসো।”
আরিশা অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,”আমি?”
“হ্যাঁ, তুমি। যাও যাও রেখে আসো।”
আরিশা একবার জাঈদের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ গিয়ে লাগেজগুলো নিতে চায়। তখন সন্ধ্যা তাকে বলে,”থাক, থাক তোমায় এগুলো নিতে হবে না। এত টুকুনু পুচকে একটা মেয়েকে এত ভারী লাগেজ বহন করতে দেয়া ঠিক হবে না। আমার তো তোমার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তোমার স্বামী তো ভীষণই খারাপ মানুষ। তোমার মতো এত মিষ্টি একটা মেয়েকে কিভাবে এত কষ্ট দিতে পারল? আল্লাহর লানত পড়ুক এমন মানুষের উপর।”
সন্ধ্যার কথা শুনে জাঈদ ভ্রু কুঁচকে নেয় এদিকে জামিলা শেখ হালকা কেশে বলেন,”আরে ওকে নিতে দাও। ও পারবে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৬
“না, থাক খালা। আমি নিয়ে যাচ্ছি ভেতরে। আর তোমার নাম যেনো কি?”
আরিশা উত্তর দেয়,”আমার নাম আরিশা।”
“ওহ, হ্যাঁ, আরিশা। তুমি শোনো, তোমার সাথে যা হয়েছে তা হয়েছে। এখন তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না। এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। দেখবে একদিন যারা তোমাকে অপমান করেছিল, কষ্ট দিয়েছিল তারা একদিন ঠিকই তাদের অন্যায়ের শাস্তি পাবে।”
বলেই হালকা হাসে সন্ধ্যা। এসব শুনে আরিশা একবার জাঈদ ও জামিলা শেখ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”তাই যেন হয়!”