অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৭

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৭
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশাকে সাথে নিয়ে নিজের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়িতে উঠেছে আফিফা। আবির খান ও আনিকা খানও তাদের সাথে আছেন। আফিফা তার বান্ধবী ঈশিতাকে বলল,”তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি দেখছি যদি আজকের মধ্যে কোন বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে দ্রুতই এখান থেকে চলে যাব।”
ঈশিতা খানিক রাগী কন্ঠে বলে,”এভাবে বলছিস কেন? আমি না তোর বন্ধু, তুই যত দিন ইচ্ছা এখানে থাক আমার পরিবারের কারো কোন সমস্যা নেই। বন্ধুই তো বন্ধুর বিপদে পাশে থাকবে।”

ঈশিতার কথায় আফিফা কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পায়। ঈশিতা রুম থেকে বের হতেই আরিশা আফিফাকে বলে,”আমার জন্য শুধু শুধু তোমরা বাড়ি ছেড়ে চলে এলে। এসব কিছুর কোন দরকার ছিল না। আমি নিজের কোন একটা ব্যবস্থা করে নিতাম। আর আমার জন্যই তো নির্ঝর ভাইয়ের সাথে তোমার দ্বন্দের সৃষ্টি হলো। এসব কিছুর জন্য আমি ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছি আপ্পি৷ এসব মোটেই ঠিক হয়নি। নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে।”
আফিফা কড়া কন্ঠে বলে,”তুই একদম নিজেকে অপরাধী ভাববি না। তুই আমার বোন। হতে পারে আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তার থেকেও বেশি কিছু আছে। আর এখানে ব্যাপারটা শুধু তোর না। এখানে ন্যায়-অন্যায়ের একটা ব্যাপার আছে। নির্ঝর সহ বাকি ওরা সবাই অন্যায় করতে চাইছিল তোর সাথে। যেটাকে আমরা কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। এই লড়াইটা শুধু তোর জন্য না ন্যায়ের জন্যেও। আর নির্ঝর….ও তো আমার কথাটা শোনারই প্রয়োজন মনে করে নি। আর এমনিতেও ও যদি নিজের এই মনোভাব বজায় রাখে তাহলে আজ নাহয় কাল ওর সাথে আমার দ্বন্দ লাগতোই। তাই ভালো হয়েছে এখনই একটা দফারফা হয়ে গেছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবির খানও আফিফার সমর্থন করে বলেন,”একদম ঠিক বলেছিস তুই আফিফা। অন্যায়ের সাথে কোন আপোষ চলবে না। এর আগেও আম্মু আরিশার সাথে অনেক অন্যায় করেছে। তখন আমি কিছু করতে পারিনি। এবারও যদি চুপ থাকতাম তাহলে আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যেতাম।”
আনিকা খান আরিশার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”তোমাকে আমি জন্ম দেইনি কিন্তু বিশ্বাস করো কখনো তোমাকে আফিফার থেকে অন্য নজরে দেখিনি। শুধুমাত্র আম্মার জন্য তোমাকে সেরকম ভালোবাসা দেখাতে পারিনি। তবে আজ আমি নিজের জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সবার থেকে এমন সান্ত্বনা পেয়ে আরিশা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার মনের বোঝা অনেকটাই হালকা হয়।

জাঈদ আরিশার কথা ভেবে বসে বসে চিন্তা করছিল। তার কিছু বন্ধুদের সে আরিশার খোঁজ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আরিশার অবস্থা না জানা পর্যন্ত সে কিছুতেই স্বস্তি পাবেনা। কিছু সময় অস্থির ভাবে পার করে জাঈদ। এরপরেই তার ফোনে একটা কল আসে। জাঈদ দ্রুত ফোনটা রিসিভ করতেই তার এক বন্ধু বলে ওঠে,”জাঈদ! ভাবির খোঁজ পেয়েছি।”
“কোথায় আছে ও?”
“ওনাকে ওনার বড় বোন বাসা থেকে বের করে নিয়ে গেছেন। সাথে ওনার মা-বাবাও গেছেন। এখন ওনারা সিলেটের দক্ষিণ দিকের শহরতলীতে অবস্থান করছেন ওনার বড় বোনের এক বান্ধবীর বাসায়।”
“তুই জলদি আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দে। আমার ওর সাথে কথা বলা অতীব জরুরি।”
অতঃপর সে ঠিকানাটা বলে দেয়।
জাঈদ ফোনটা রেখে দিয়ে বলে,”তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে আরিশা। আমি এতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার অতীতের ভুল গুলো হয়তো শোধরাতে পারব না কিন্তু তোমায় নিয়ে নতুন করে সুন্দর একটা শুরু করতে পারব।”

বলেই জাঈদ তৈরি হয়ে বের হয়। জাঈদকে নিচে নামতে দেখে জামিলা শেখ বলেন,”কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“আমার বউকে ফিরিয়ে আনতে।”
“কি? ঐ মেয়েকে তুমি আবার এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চাও? তোমার মাথাটা খারাপ হলো নাকি? কত অপেক্ষার পর ঐ আপদ বিদায় হলো। ওকে আমি কিছুতেই আর এই বাড়িতে ফিরতে দেবো না। তার থেকে তুমি আমার সাথে চলো, সন্ধ্যা আর আপা দুলাভাইকে বুঝিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনি। ঐ মেয়েটাকে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি সন্ধ্যাকেই এই বাড়ির বউ করে আনব।”

জাঈদ রেগে বলে,”তোমার যদি সন্ধ্যাকে এই বাড়ির বউ করে আনার এতই ইচ্ছা হয় তাহলে একটা কাজ করো। বাবাকে বলে আরেকটা বাচ্চা নেও, যদি তোমার আরেকটা ছেলে হয় তাহলে সন্ধ্যার সাথে তার বিয়ে দিয়ে তাকে বউ করে এই বাড়িতে আনো। কিন্তু আমি তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, আমি আরিশাকে বিয়ে করেছি এবং আমৃত্যু ওকেই আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি৷ অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না।”
বলেই জাঈদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। জাঈদ যেতেই জামিলা শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,”এই আরিশার জন্য আমার সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। ঐ আরিশাকে আমি কিছুতেই এই বাড়িতে ফিরতে দেবো না৷ তার জন্য আমায় যা করতে হয় করব, যত নিচে নামতে হয় নামব। প্রয়োজনে ঐ আরিশাকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেব!”

ছবি বেগম গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছেন। আবরাজ তার পাশেই বসে। নিঝুম সবার জন্য চা বানিয়ে আনলো। এদিকে আফিফারা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই নির্ঝর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আসে। আদৃতা এককোণে দাঁড়িয়ে এসব দেখে বিড়বিড় করে বলে,”যত্তসব ড্রামা! সবার নাটক দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে কারো ফিউনারেল চলছে।”
নিঝুম ছবি বেগমের দিকে চা বাড়িয়ে দিতেই তিনি বলেন,”আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না নিঝুম।”
নিঝুম হতাশ স্বরে বলে,”এখন শোক পালন করে কি হবে চাচি? আপনার উচিৎ ছিল ওদেরকে যেতে না দেওয়া। আমি তো বলেছিলাম ওদের আটকাতে কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন না।”

ছবি বেগম বলেন,”আমি ওদের ব্যবহারে ভীষণ ব্যথিত। আমি ভাবতেও পারিনি, আমার ছেলে আবির, যাকে আমি ছোট থেকে এত কষ্ট করে বড় করেছি সে আমাকে এভাবে ছেড়ে যাবে। এতোটা নির্দয় ও কিভাবে হলো?”
নিঝুম বলে,”নির্দয় আপনিও কম হন নি৷ বরং আমার মনে হয় আপনার দোষই এখানে বেশি।”
আবরাজ রাগী কন্ঠে বলে,”নিঝুম! তুমি কি বলছ এসব? ওনাকে তুমি এভাবে বলতে পারো না।”
আদৃতা বলে,”এটা আর নতুন কি। মম তো সবসময় আমার বিরোধিতা করেই সুখ পায়৷ যেন আমি তার নিজের মেয়েই না।”
নিঝুম আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। আবরাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি দেখছি, কে এসেছে।”

ছবি বেগম খুশি মনে বলেন,”আবিররা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে। আমি জানি, ওরা এই বাড়ি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না সে যতোই রাগ বা অভিমান থাকুক।”
আবরাজ গিয়ে দরজা খুলতেই একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে অবাক হয়। বলে ওঠে,”আপনি কে?”
আগন্তুক ব্যক্তি বলে ওঠে,”এটা কি আবরাজ খান ও নিঝুম খানের বাড়ি?”
“জ্বি, আমি আবরাজ খান। কিন্তু আপনি কে?”
“আমি ব্লু হসপিটাল থেকে আসছি।”
“ব্লু হসপিটাল?”
“আপনাদের সাথে অনেক জরুরি কথা আছে। ভেতরে আসতে পারি?”
“জ্বি, আসুন।”

তিনি ভেতরে আসেন। নিঝুম ও ছবি বেগম আগন্তুক ব্যক্তিকে দেখে অবাক হয়। নিঝুম বলে,”ইনি কে?”
আবরাজ বলে,”ইনি ব্লু হসপিটাল থেকে এসেছে।”
“ব্লু হসপিটাল! এই হসপিটালেই তো আমি আদৃতার জন্ম দিয়েছিলাম এক ঝড়ের রাতে। আজো আমার সেই রাতের কথা মনে পড়ে।”
লোকটি বলে ওঠে,”একটা ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন করতে আজ এখানে আসা।”
আবরাজ বলে,”কি ভুলের কথা বলছেন আপনি?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৬

“আজ থেকে ২০ বছর আগে, যেদিন আপনারা সন্তানের জন্ম দেন সেদিন হাসপাতালে দুটো বাচ্চার অদল বদল হয়। পরবর্তীতে বিষয়টা জানাজানি হলেও হাসপাতালের সম্মানের কথা ভেবে ব্যাপারটা চেপে রাখা হয়! আর সেখানেই একজন দরিদ্র ব্যক্তির সন্তানের সাথে আপনাদের সন্তানের অদল-বদল হয়!”
কথাটা শোনামাত্রই সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। আদৃতা চিতকার করে বলে ওঠে,”এটা হতে পারে না!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৮