অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৯
ইয়াসমিন খন্দকার
আরিশা দীর্ঘ সময় যাবৎ নিশ্চুপ ছিল। আফিফা সকাল সকাল মেডিকেল কলেজের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে গেছে। তার নাকি আজ ভীষণ জরুরি কাজ আছে। আনিকা খানও হাসপাতালে চলে গেছেন। আরিশাকে একা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ঈশিতা আরিশাকে বলে,”আরিশা, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে,এভাবে বসে থাকতে থাকতে তুমি ভীষণ বোর হয়ে যাচ্ছ। আচ্ছা, চলো আমরা বাইরে কোথাও একটা থেকে ঘুরে আসি।”
আরিশা প্রথমে আপত্তি প্রকাশ করে বলে,”না, আপু। আমি ঠিক আছি। আপনাকে আমায় নিয়ে এত বিচলিত হতে হবে না।”
ঈশিতা বলে,”আরে এত অস্বস্তি বোধ করতে হবে না। তুমি আফিফার বোন মানে, তুমি আমারও বোন। চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
এবার আর আরিশা তেমন আপত্তি জানাতে পারল না। অগত্যা ঈশিতা আরিশাকে সাথে নিয়ে তাদের এলাকা ঘুরে দেখাতে লাগল। আরিশারও এবার কিছুটা ভালো লাগছিল৷ হঠাৎ করে ঈশিতার একটা জরুরি কল আসায় সে আরিশাকে বলে,”বোন, তুমি একটু এখানে থাকো। আমার একটা জরুরি কল এসেছে তো কথা বলে আসি।”
আরিশা মাথা নাড়িয়ে বলল,”আচ্ছা,যান।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঈশিতা একটু দূরে গেল৷ আরিশা সেই সময় একাই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই তার সামনে একটি বাইক এসে দাঁড়ালো। আরিশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো বাইকে বসা থাকা হেলমেট পড়া ব্যক্তিটির দিকে। কিছু সময় পর লোকটা হেলমেট নামাতেই আরিশা হতবাক স্বরে বলল,”আপনি!”
জাঈদ করুণ চোখে আরিশার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ আরিশা রাগী কন্ঠে বলে,”আপনি কেন এসেছেন এখানে? কি চাই আপনার? আমি একটু শান্তিতে থাকি, ভালো থাকি সেটা কি আপনার সহ্য হয়না? আবার এখানে চলে এসেছেন আমার শান্তি নষ্ট করার জন্য?”
জাঈদ অসহায় কন্ঠে বলল,”আমি তোমার ভালো থাকা কিংবা শান্তিতে থাকা নষ্ট করতে আসিনি বরং তোমার ভালো থাকার সাথী হতে এসেছি।”
আরিশা তীব্রে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলল,”আপনার এসব নাটক বন্ধ করুন আর দূর হয়ে যান আমার সামনে থেকে৷ আপনাকে দেখলেও আমার ঘৃণা আসে।”
জাঈদ এবার আরিশার হাতটা আলতো করে ধরে বলে,”বিশ্বাস করো আরিশা, তুমি আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর আমি একটা মিনিটও শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি, তোমায় ঠিক কতটা ভালোবেসে ফেলেছি। তাই তো সব কিছু ছেড়ে ছুটে এসেছি তোমার কাছে। দয়া করে আমায় ফিরিয়ে দিও না।”
“আপনার এসব নাটক দেখে আমি কিছুতেই গলব না। আমি এখনো ভুলিনি ঐ বাড়িতে প্রতিটা দিন আপনি আমায় কিভাবে কষ্ট দিয়েছিলাম৷ আমার আপ্পি তো আপনার বিরুদ্ধে কেইসও করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বেশি ঝামেলা চাই নি জন্য কোন আইনি পদক্ষেপ নেই নি। কিন্তু আপনি যদি এভাবেই আমায় বিরক্ত করতে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে আইনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবো!”
“আরিশা!”
এমন সময় ঈশিতা চলে আসে। আরিশাকে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে সে বলে,”এই ছেলেটা কে আরিশা? তুমি কি চেনো ওনাকে?”
আরিশা জাঈদের থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে,”উনি আমার জীবনের একটা অভিশাপ। যা আমি দূর করতে চাই।”
বলেই সে উল্টোদিকে হাটা শুরু করে। ঈশিতা ভ্রু কুচকে জাঈদের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে অতঃপর সেও আরিশার পেছন পেছন যেতে থাকে৷ এদিকে জাঈদ একটা মলিন হাসি দিয়ে বলে,”আমি হয়তো তোমার জীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছিলাম আরিশা কিন্তু আমি চাই আমাদের শেষটা আশীর্বাদে রূপান্তরিত হোক। এজন্য আমায় যতদিন লড়াই করতে হয় আমি করবো কিন্তু তোমার মন আমি জয় করবোই! তোমাকে আমার জীবনে আমি ফেরাবোই। নিজের সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেই তোমায় নিজের জীবনে জড়াবো আমি। কথা দিলাম।”
আদৃতা যেন আজ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না যে, সে আবরাজ ও নিঝুমের মেয়ে নয়। তাই তো এবার সে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বলে,”এই লোকটার কথা তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না,আমার মনে হচ্ছে এই লোকটা একটা ফ্রড। এনাকে তোমরা পুলিশে দাও। তাহলেই আসল সত্য সামনে আসবে।”
আবরাজ খান বলেন,”আমার সেটা মনে হচ্ছে না।”
নিঝুম খানও বলেন,”হ্যাঁ, ওনার চোখমুখ দেখে আমারও মনে হচ্ছে না উনি মিথ্যা বলছেন।”
নির্ঝরও ততক্ষণে সেখানে চলে এসেছে এবং সমস্ত কিছু শুনেছে।। সে বলে,”আমাদের ওনার কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আদৃতা তোকে আমি ছোট থেকেই নিজের বোন ভেবেছি, মম-ড্যাড তোকে মেয়ে ভেবেছে এই স্থানটা সবসময় থাকবে। কিন্তু যদি সত্যি, আমার আসল বোন অন্য কেউ এবং সে যদি অন্য কোথাও কষ্টে থাকে তাহলে তাকেও সেখান থেকে উদ্ধার করে আনা আমাদের কর্তব্য।”
আবরাজ নির্ঝরকে সমর্থন করে বলে,”ও একদম ঠিক বলছে।”
আদৃতা এবার অনেক আশা নিয়ে ছবি বেগমের কাছে যায়। বলে,”গ্রানি, তুমি অন্তত কিছু বলো।”
কিন্তু আদৃতার সব আশায় পানি ঢেলে ছবি বেগম বলেন,”আমার আসল নাতনী যদি অন্য কেউ হয় তাহলে তাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হোক।”
আদৃতা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,”তুমিও!”
এবার ব্লু হসপিটালের লোকটার ফোনে হঠাৎ একটা কল আসে। তিনি ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বলেন। অতঃপর ফোনটা রেখে ভীষণ খুশি মনে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আপনাদের জন্য একটা ভালো খবর আছে। আমি আমার দুই ছেলেকে আপনাদের মেয়েকে যারা নিজেদের মেয়ে বলে মানুষ করছে তাদের তৎকালীন ঠিকানায় সবার সাথে কথা বলতে পাঠিয়েছিলাম। যদিও আমি একবার সেখানে গিয়ে কোন প্রমাণ না পেয়ে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু ওরা ওখানকার একজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথা বলেছেন যিনি সেই সময় ওনাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি বলেছেন, ওনারা আগে সিলেটে একটা ইটভাটায় কাজ করত। কিন্তু ইটভাটাটা বন্ধ হবার পর তারা নিজেদের গ্রাম সুনামগঞ্জের শিমুলপুরে। ওরা হয়তোবা এখনো সেখানেই আছে। ওখানে গিয়ে খোঁজ করলেই হয়তো ওনাদের পাওয়া যাবে। লোকটার মানে বাচ্চাটার বাবা নাম ছিল আব্দুল রহমান।”
নিঝুম অস্থির কন্ঠে বলে,”আমি এখনই ঐ গ্রামে যেতে চাই। আমার আসল মেয়েকে আমি ফেরত পেতে চাই।”
আদৃতা বলে ওঠে,”আমিই তোমার আসল মেয়ে। আর কেউ নয়।”
ছবি বেগম রাগী কন্ঠে বলেন,”এই মেয়ে চুপ করো তো। তোমাকে এতদিন নিজের নাতনি জেনে অনেক খাতির করেছি। কিন্তু এখন যখন জানলাম, তুমি আমার নাতনি নও তখন আর তোমার এত তেজ দেখতে পারবো না। আমার আসল নাতনীকে আমি ফেরত চাই। আবরাজ, নিঝুম, নির্ঝর চলো তোমরা সবাই ঐ শিমুলপুর গ্রামে। আমিও যাব তোমাদেরও সাথে।”
আদৃতা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। নির্ঝর তাকে সামলাতে গেলে ছবি বেগম বলেন,”ওর এসব নাটক দেখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তোমরা এখন তাড়াতাড়ি চলো তো। আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না। এমনিতেই এই মেয়ের জন্য আমার সাজানো সংসার ভেঙে গেছে।”
অতঃপর সকলে মিলে রওনা দেয় শিমুলপুরের উদ্দ্যেশ্যে।
সালমা নিজের গ্রামের এক প্রতিবেশীর বাসায় ছিল। তার এক বান্ধবীকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাই তার বান্ধবীকে সাজানোর জন্য সালমা আজ এখানে এসেছিল। সালমা যখন তার বান্ধবীকে সাজাচ্ছিল। তখন তার বান্ধবী কুলসুম বলে,”তুই সব দিক দিয়া কত সেরা! তোকে দেখইলে মনেই হয় না তুই আমাগো গ্রামের পুরি!”
“ধুর কি যে কস তুই। আমি তো এই গ্রামেরই মেয়ে।”
এমন সময় হঠাৎ করে সালমার ছোট বোন ফাতেমা ছুটে এসে বলে,”আপা, জলদি বাড়িত চলো। সিলেট শহর থাইকা কিছু লোগ আসছে। আব্বা তোমারে জলদি বাড়িতে যাইতে কইসে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৮
সালমা ভ্রু কুচকে বলে,”এই সময় আবার কেডা আসল! আচ্ছা, কুলসুম তুই থাগ। আমি দেইখা আসি।”
বলেই সালমা দেয় একটা দৌড়। কিছু সময়ের মধ্যে সে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সালমা কিছুটা কৌতুহল নিয়েই বাড়িতে ঢুকে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন আর কিছু লোক চেয়ারে বসে আছেন। সালমাকে দেখেই আব্দুল রহমান বলে ওঠেন,”ঐ যে আইসা গেছে, আপনাদের পুরি, সালমা আক্তার “বৃষ্টি”।”
কথাটা শোনামাত্রই নিঝুম দৌড়ে গিয়ে সালমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”আমার মেয়ে বৃষ্টি..”