অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৪
ইয়াসমিন খন্দকার

পুরো খান ভিলায় আজ যেন উৎসবের আমেজ লেগেছে। আজ এতগুলো দিন পর খান পরিবারের সব সদস্য একসাথে আনন্দে মেতে উঠেছে। খান পরিবারের সদস্য “সালমা আক্তার বৃষ্টি” কে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য একটা বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই নিয়েই পুরো বাড়িতে এত তোড়জোড় চলছে। এদিকে যাকে নিয়ে এত আয়োজন সেই সালমা তথা বৃষ্টি একদিকে গুটিশুটি মেরে বসে আছে৷ যদিও তার নাম সালমা তবে এই বাড়ির সবাই তার জন্য বৃষ্টি নামটাকেই বেশি উপযুক্ত মনে করেছে এবং এই নামেই মূলত তাকে ডাকছে সবাই।
বৃষ্টিকে একা বসে থাকতে দেখে আরিশা এসে তার পাশে বসে। আরিশাকে বৃষ্টিকে উদ্দ্যেশ্য করে হালকা হেসে বলে,”এভাবে চুপচাপ বসে আছ কেন? নার্ভাস ফিল হচ্ছে নাকি?”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-বোধক ইশারা করে। তখন আরিশা বৃষ্টির হাতে হাত রেখে তাকে সাহস দিয়ে বলে,”এতটা নার্ভাস হওয়ার দরকার নেই। এখানে সবাই তোমার আপনজন। এটাই তো তোমার আসল পরিবার৷ তোমার ভাগ্য ভীষণ ভালো জানো, তাই এত বছর পর হলেও নিজের আসল পরিবারকে ফেরত পেয়েছ। সবার তো আর সেই ভাগ্য হয়না।”

বলেই আরিশার মুখটা একটু আধার হয়ে যায়। তবে সে বেশি দুঃখ না পেয়ে পরক্ষণে আবারো বৃষ্টিকে বসা থেকে উঠিয়ে বলে,”ওদিকে নাচগান হচ্ছে। চলো একটু নাচি।”
বৃষ্টি একটু ইতস্তত বোধ করে কিন্তু আরিশার জোরাজুরিতে আর বেশিক্ষণ না করতে পারে না৷ তারা দুজনেই “সোহাগ চাঁদ বদনী” গানে নাচতে থাকে। দূর থেকে তাদের এত আনন্দ করতে দেখে আফিফা খুশি হয়। নির্ঝর ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে। আফিফা বলে ওঠে,”এতদিন পর যেন আবার সেই আগের হাসিখুশি আরিশাকে ফেরত পেলাম আমি। ওকে এভাবে আনন্দ করতে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে জানো। নাহলে একয়দিন ওর উপর দিয়ে যা গেছে তা ভাবতেই আমার গা শিউরে ওঠে।”
নির্ঝর আফিফাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,”এখন কষ্টের দিনগুলো আর মনে রেখো না। এখন শুধু আমাদের একসাথে খুশি থাকার পালা।”
“আর কখনো আমায় দূর করে দেবে না তো?”
“মৃত্যু ছাড়া আর কেউ কখনো আমাদের আলাদা করতে পারবে না আফিফা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নির্ঝরের কথায় আফিফা স্বস্তি খুঁজে পায়৷ এদিকে আরিশা ও বৃষ্টিকে একসাথে নাচতে করতে দেখে নিঝুম, ছবি বেগম, আনিকা খান সবাই আনন্দ পাচ্ছিলেন। একটু পর আরিশা ছুটে এসে ছবি বেগমকেও টেনে নিয়ে এসে তাকে নিয়েও নাচতে থাকে। সবাই যখন এভাবে আনন্দ করছিল তখন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখে আদৃতা যেন হিংসার আগুনে জ্বলছিল। আদৃতার এই হিংসার আগুনে ঘি ঢালার জন্যই যেন কিছু সময়ের মধ্যে সায়নও সেখানে চলে এলো। মূলত এই অনুষ্ঠানে সায়নদেরও সপরিবারে আমন্ত্রণ করেছেন আবরাজ খান। সায়নের মা বাবা আর বোন তো আসেনি তবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে সায়ন এসেছে। এসেই মুগ্ধ হয়ে আরিশাকে দেখছিল সায়ন। সায়নের চোখে আরিশার জন্য মুগ্ধতা খেয়াল করে আদৃতা বলে,”একজন আমার পরিচয় কেড়ে নিলো আর একজন আমার ভালোবাসা! কাউকেই সুখী হতে দেব না আমি৷ এদের সুখ আমি ধ্বংস করে দেব। আই প্রমিস।”

জামিলা শেখ ফোনে তার বড় বোনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন বহুদিন থেকে। অবশেষে আজ অনেক দিন পর ইভা চৌধুরী ফোন রিসিভ করায় জামিলা শেখ অনেক আশা নিয়ে ছিলেন যে এবার বোধহয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে৷ তবে ফোন রিসিভ করতেই তার ভুল ধারণা ভেঙে যায়। ইভা চৌধুরী তাকে একগাদা কথা শোনান৷ অবশেষে জামিলা শেখ কিছুটা বোঝানোয় তিনি বলেন,”ঠিক আছে, সন্ধ্যা আর জাঈদের ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখবো। কিন্তু তার আগে জাঈদকে নিজে এসে বলতে হবে যে ও ওর আগের বিয়েটা মানে না এবং ও আমার সন্ধ্যাকে বিয়ে করতে চায়।”
ইভা চৌধুরী মূলত নিজের ছেলের কথা ভেবেই কথাটা বলেছেন। কেননা, সায়ন যেভাবে কিছুদিন থেকে আরিশা, আরিশা করে পাগলামী করছে তাতে শুরুর দিকে ইভা চৌধুরী ও তার স্বামী মান্যতা না দিলেও নিজেদের ছেলের জেদের সামনে অবশেষে তাদের দমে যেতে হয়েছে। কেননা, সায়ন বলে দিয়েছে, সে আরিশাকেই বিয়ে করবে নাহলে আজীবন বিয়ে করবে না। এখন যদি মাঝখান থেকে জাঈদ আর আরিশার বিচ্ছেদ হয় তবেই তাদের ছেলের মনের আশা পূরণ হবে৷ এসব ভেবেই মূলত ইভা চৌধুরী এমন একটা শর্ত দিলেন।

এদিকে ফোন রেখে জামিলা শেখ গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন যে কিভাবে তিনি এখন নিজের ছেলেকে মানাবেন। কিছু সময় পরই জাঈদ মলিন মুখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। বিগত কিছুদিনেই জাঈদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সেদিনের আরিশার প্রত্যাখ্যানের পর থেকে জাঈদ ঠিকভাবে ঘুমায় না,খায় না একদম বিধ্বস্ত লাগছে তাকে এই অবস্থায়। জামিলা শেখ জাঈদকে দেখেই বললেন,”কি হয়েছে জাঈদ? তোমায় এমন লাগছে কেন?”
জাঈদ বলে,”তেমন কিছু না। কিছু বলবে?”
“শোনো, আমি জানি তুমি ঐ মেয়ের কথা ভেবে এভাবে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে এমন পাগলের মতো ঘুরছ। কি লাভ এসব করে? ঐ মেয়ের যা দেমাগ, ভাব দেখে মনে হয় রাণী ভিক্টোরিয়া কিন্তু .আসলে তো একটা অনাথ ফকিন্নি তার এত দেমাগ কোথা থেকে আসে আমি বুঝিনা।”

আরিশার নামে এমন কথা শুনে জাঈদ রেগে বলে,”খবরদার আম্মু। আমার আরিশাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে কিন্তু আমি ভুলে যাব তুমি আমার জন্মদাত্রী মা হও।”
“জাঈদ! তোমার এত অধঃপতন হয়েছে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি আমাকে, নিজের মাকে এভাবে বলছ?”
জাঈদ এবার পাশে থাকা একটা ফুলদানি ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে বলে,”ও বাইরের মেয়ে নয়, আরিশা আমার স্ত্রী, ও আমার..ও এখানে থাকে(নিজের বুকের দিকে ইশারা করে) আমার মনে..ওকে একদম বাইরের মেয়ে বলবে না। হতে পারে ও আমার উপর রাগ করে আছে, আমায় ঘৃণা করে। করুক, আমার কিছু যায় আসে না৷ একদিন ওর সব রাগ, সব ঘৃণা দূর করে আমি ওর মনে আমার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি করবো। ও ঠিকই একদিন আমায় ভালোবাসবে। বুঝেছ তুমি?”
“আমি এত কিছু বুঝতে চাই না। আমি কিছুতেই ঐ মেয়েকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মানবো না। তোমার বড় খালার সাথে আমার কথা হয়েছে। উনি আমায় বলেছেন, তুমি যদি এখন গিয়ে সন্ধ্যার কাছে ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করে নাও তাহলে..”

জাঈদ মাঝপথেই জামিলা শেখকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”বাজে বকা বন্ধ করো আম্মু। আমি তোমাকে আগেও অনেক বার বলছি আর আজ শেষ বারের মতো বলছি আমি শুধু আর শুধু আরিশাকে ভালোবাসি৷ অন্য কাউকে না। তাই তুমি সন্ধ্যাকে নিয়ে যেই মিথ্যা স্বপ্ন দেখছ তা যত তাড়াতাড়ি বাদ দেবে ততোই তোমার জন্য ভালো। ”
বলেই জাঈদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। জামিলা শেখ রেগেমেগে বলেন,”সন্ধ্যাকে তো আমি এই বাড়ির বউ করবোই। আর সেটা কিভাবে করতে হবে সেটাও আমার জানা আছে। এর জন্য সবার আগে আমার পথের কাঁটা মানে ঐ আরিশাকে দূর করতে হবে। ভেবেছিলাম ওকে এই বাড়ি থেকে দূর করতে পারলেই হবে কিন্তু এখন দেখছি ওকে দুনিয়া থেকে বিদায় না করতে পারলে আমার স্বার্থসিদ্ধি হবে না। বেশ,তাহলে এবার আমি ওকে দুনিয়া থেকে সরানোর ব্যবস্থাই করছি।”
বলেই জামিলা শেখ একটা শয়তানী হাসি দেন।

এদিকে আফিফা নিজের রুমে এসে নিজের আর আরিশার একসাথে বাধানো একটা ছবি দেখছিল হাতে নিয়ে। হঠাৎ করে তার হাত ফসকে ছবিটা পড়ে যায়। আফিফা হচকচিয়ে যায় এবং ছবিটা তুলতে গিয়ে কাচ ফুটে তার হাত থেকে রক্ত বের হতে থাকে। এরমধ্যে হঠাৎ করে ছবি বেগম আফিফাকে খুঁজতে আফিফার রুমে এসে এই অবস্থা দেখে বলেন,”কি হয়েছে দিদিভাই?”
“দেখো না দাদি..আমি ছবিটা দেখছিলাম আর হঠাৎ করে..”
“তোমার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে। দেখি দেখি..আর এভাবে ছবি ভেঙে যাওয়া তো ভালো লক্ষণ নয়। তাহলে কি কোন অমঙ্গল হতে চলেছে?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৩

“এসব কি বলছ তুমি দাদি? এমন কিছু হবে না৷ এসব কুসংস্কার।”
ছবি বেগমকে এসব বললেও আফিফার নিজের মনেও কেমন একটা খুতখুতানি থেকেই যায়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৫