অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি তার বান্ধবী মারিয়ার সাথে একটি ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়া একটার পর একটা ফুচকা খেয়ে চলেছে কিন্তু আরুশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ মারিয়া ফুচকা খেতে খেতেই আরুশিকে বলে,”কিরে? তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন আরু? নে একটা ফুচকা খেয়ে দেখ।”
আরুশি বলে,”তুই তো জানিস মারিয়া আমি এসব আইহাইজেনিক খাবার খাই না।”
মারিয়া মুখ বাকিয়ে বলে,”জানিস তোর কথা শুনে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোর সাইকোলজি নিয়ে না ডাক্তারি লাইনে পড়া উচিৎ ছিল।”

“ছোটবেলায় তো আমারও ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার কিন্তু তারপর যখন দেখলাম আমাদের ফ্যামিলিতে ডাক্তারের অভাব নেই, তখন ভাবলাম আমার নতুন কিছু ট্রাই করা দরকার।”
মারিয়া টিটকারি করে বলল,”এই কারণে নাকি বড় খালার ছেলের…”
আরুশি রেগে বলল,”ধুর! তোকে না বলেছি এসব ফালতু কথা না বলতে।”
“সত্য কথা তেতো তো লাগবেই। আমি কিন্তু সেই ক্লাস ওয়ান থেকে তোর সাথে পড়ি আরু। তাই তোর গতিবিধি ঠিকই খেয়াল করি। ছোট থেকেই তুই এমন ভাবে সবকিছু দেখাস যে, তুই আরহাম ভাইকে একদম সহ্যই করতে পারিস না। অথচ ছোট থেকেই তুই ওনার সাথে একই স্কুল, একই কলেজ এমনকি একই ভার্সিটিতেই পড়েছিস।”
“এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার। আমার ঐ আরহামের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। বুঝলি?”
মারিয়া আর কিছু বলবে তার আগেই সেখানে চলে এলো রাজীব। রাজীব এসেই আরুশির দিকে তাকিয়ে বলল,”কি নিয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মারিয়া তো রাজীবকে দেখেই খুশি হয়ে গেল। অতঃপর বলল,”আরে দেখুন না ভাইয়া, এই আরু এতো স্বাস্থ্য সচেতন যে কি আর বলবো সামান্য একটা ফুচকাও খেতে চায়না।”
রাজীব মুগ্ধ হয়ে আরুশির দিকে তাকিয়ে বলে,”এমনটাই তো হওয়া উচিত।”
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আরুশির দিকেই তাকিয়ে ছিল আরহাম। তার পাশে ছিল তার বন্ধু সাগর তার পাশেই ছিল৷ সাগর বলে ওঠে,”আমি বুঝি না, এই মেয়েটাকে তুই নিজের শত্রু মনে করেও সবসময় এমন ভাবে ওর উপর নজরদারি করিস কেন? এসব দেখে তো মনে হয় তুই ওকে শত্রু না গার্লফ্রেন্ড ভাবিস!”
আরহাম রেগে বলে,”ভুল ভাবছিস তুই। মোটেই এই কারণে আমি ওর উপর নজর রাখি না। আসলে কি বলতো, নিজের শত্রুর উপর, তার গতিবিধির দিকে সবসময় নজর রাখতে হয়। এসব তুই বুঝবি না।”
সাগর মাথা চুলকে বলে,”আমি তো কিছুই বুঝি না। যা বোঝার তুই একাই বুঝিস। তবে যাই বলিস, তোদের একসাথে ঝগড়া কর‍তে দেখলে না আমার সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের করা ঝগড়া মনে পড়ে যায়।”
আরহাম আরো একবার রাগী চোখে তাকাতেই সাগর চুপ হয়ে যায়। এদিকে আরহাম বলে,”অনেক হয়েছে নজরদারি৷ এখন আমায় বাসায় যেতে হবে।”
বলেই সে একটু দূরে গিয়ে নিজের বাইকে উঠে রওনা দেয়।

ঢাকার মিরপুরে একটি বিরাট আলিশান বাড়িতে বসবাস করে খান পরিবার। বর্তমানে এই পরিবারের মধ্যমনি আবরাজ খান ও নিঝুম খান। নিজেদের জীবনে বেশিরভাগ সময় লন্ডনে কাটিয়ে অবশেষে শেষ বয়সে তারা ঢাকায় এসে স্থায়ী হয়েছেন। এখানে তারা তাদের ছেলে নির্ঝর খান,বৌমা আফিফা খান ও আবরাজ খানের ছোট ভাইয়ের বউ আনিকা খানের সাথে থাকেন। ছবি বেগম ও আবির খান অনেক আগেই মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবাই সিলেটেই থাকত। তবে তাদের মৃত্যুর পর নির্ঝরকে নিজের ব্যবসার কাজে ঢাকায় আসতে হয়, আফিফাও ঢাকা মেডিকেলে নিউরোলজিস্ট হিসেবে যোগদান করে। প্রবীণ সদস্যরাও নিজেদের অবসরের পর এখানে এসেই রয়েছেন।

আফিফা খান রাগী ভাব নিয়ে সোফায় বসে আছেন। আনিকা খান এসে নিজের মেয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”একটু শান্ত হও। এত রাগ করে কোন লাভ নেই। আরহাম ছেলেমানুষ আর এই বয়সে একটু আধটু..”
আফিফা খান যেন কথাটা শোনামাত্রই ফুসে উঠে বললেন,”এসব কি বলছ তুমি আম্মু? তোমার নাতি এখনো ছোট আছে? ও এখন ভার্সিটিতে পড়ে, ২৪ বছরের যুবক ও। আজকে বিয়ে দিলে কালকে বাচ্চার বাপ হয়ে যাবে আর তুমি ওকে ছেলেমানুষ বলছ! আজ আসুক শুধু ও একবার বাড়িতে। ভার্সিটি গিয়ে নোংরামো করা বের করে দেবো। কই, ওর ছোট ভাই তো লন্ডনে পড়াশোনা করছে। সেখানকার পরিবেশ তো আরো খোলামেলা কই আমার ছোট ছেলের নামে তো কোন অভিযোগ আসে না। তাহলে ওর নামে এত অভিযোগ কেন? তুমি আর ওর বাবা লাই দিয়ে ওকে অনেক মাথায় তুলেছ কিন্তু আর নয়।”

এমন সময় আরহাম নিজস্ব একটা এটিটিউড নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। এসেই নিজের মায়ের এমন অগ্নিমূর্তি দেখল। আনিকা খান ইশারা করে আরহামকে নিজের রুমে যেতে বললো। কিন্তু আরহাম ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে আফিফা খানের চোখ আরহামের দিকে যেতেই তিনি বললেন,”এই তো এসে গেছেন মহারাজা। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন ভেতরে আসুন।”
আরহাম নিজের মায়ের দিকে এগোতে এগোতে বলে,”কি হয়েছে মম? ইজ এভরিথিং অলরাইট?”
আফিফা খান নিজের রাগকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ করে বলেন,”ঠিক থাকবে না আবার? যার কাছে তোমার মতো গুণধর ছেলে আছে তার জীবন আর কিভাবে বেঠিক হবে!”
আনিকা খান বলেন,”দাদুভাই, তুমি ভেতরে যাও। তোমার মা অনেক রেগে আছে।”
“মম রেগে আছে! কিন্তু কেন?”

আফিফা খান বলেন,”তোমাকে কি আমরা অসভ্যতামি করার জন্য ভার্সিটিতে পাঠাই? ভার্সিটিতে গিয়ে মেয়েদের দেখে তাদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার জন্য পাঠাই?”
আরহাম কিছু বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই আফিফা খান ঠাস করে নিজের ছেলের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। আরহাম গালে হাত দিয়ে অবাক কন্ঠে বলেন,”তুমি আমায় মারলে মম!”
“হ্যাঁ, বেশ করেছি মেরেছি। প্রয়োজনে আবারো মারব। বেয়াদব ছেলে। আদর দিয়ে তোমাকে বাঁদর তৈরি করেছি তাইনা? এবার বাদর থেকে আবার মানুষ মানাবো।”
বলেই আরহামের গালে আরো একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে যাবেন তার আগেই আনিকা খান তাকে আটকে দিয়ে আরহামের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”দাদুভাই, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, নিজের রুমে যাও। আমি তোমার মমকে সামলাচ্ছি।”
আরহাম আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের রুমের দিকে যায়।
আনিকা খান নিজের মেয়েকে বলেন,”শান্ত হও এবার একটু।”
“তুমি ওকে যেতে দিলে কেন আম্মু? ওকে শাসনও করতে দাও না একটু। এর জন্য দেখবে,একদিন তোমরা সবাই পস্তাবে।”

এমন সময় নিঝুম খান সেখানে চলে আসেন৷ বয়সের ভাড়ে আজ তিনি নুইয়ে পড়েছেন। যেই ২২ বছর বয়সী নিঝুম খানের গল্প শুরু হয়েছিল আজ তার বয়স ৮২। জীবনে অনেক বসন্ত পেরিয়ে আজ তিনি শেষ দিনগুলো গুনছেন। নিঝুম খান এসেই বলে ওঠেন,”পস্তানোর কিছু নেই বৌমা। আরহাম হয়তো এখন পথভ্রষ্ট হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ওর দাদা, বাবার রক্ত বইছে তো শরীরে। তবে আমার বিশ্বাস, ওর জীবনে যখন তোমার আর আমার মতো কেউ আসবে তখন ও একদম বদলে যাবে।”
আফিফা খান বলেন,”কিন্তু এমন কেউ কখন আসবে?”

“হয়তো খুব শীঘ্রই। যাইহোক, তোমাকে একটা কথা বলব বলে ভাবছি। দেখো, অনেকদিন থেকে তো আমরা এখানে আছি। সিলেটে যাওয়াই হয় না, তাই এবার আমি ভাবছি এই ঈদে আমরা সপরিবারে সিলেটে যাব। তাছাড়া সায়ন, সায়রা দিদিভাই, আমান দাদুভাই(আফিফা-নির্ঝরের ছোট ছেলে) ওরাই এই ঈদে বাংলাদেশে আসবে বলেছে।”
আফিফা খান আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন,”আমার ছোট ছেলেটা সেই কতগুলো বছর থেকে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে আছে। কতদিন ওকে নিজের চোখে দেখি না। সেই গতবছর লন্ডনে গেছিলাম তখন শেষ দেখেছিলাম। ওসব ভিডিও কলে কি মায়ের মন ভড়ে? এবার ওকে দেখতে পাবো তাহলে। ভেবেই ভালো লাগছে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ১

নিঝুম খান চোখের জল ফেলে বলেন,”তুমি তো তবুও চাইলে নিজের ছেলেকে দেখতে পাবে বৌমা। কিন্তু আমার মেয়ে..আমার বৃষ্টি ওকে যে আমি আর চাইলেও দেখতে পাব না। ১৫ বছর আগে এক সড়ক দূর্ঘটনায় ও আমাদের সবাইকে একা ফেলে চলে গেল! এতবছর পর মেয়েটাকে ফিরে পেয়েও আমি তাকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন আনিকা খান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,”অতীতের কথা ভুলে যান। এখন আমরা পরিবারে যারা আছি সবাই মিলে আনন্দে বাঁচব। বৃষ্টি সবসময় আমাদের মনের মধ্যেই থাকবে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩