অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি সবেমাত্র নিজের হোস্টেলে ফিরে এসে গোসল করে নিয়ে খেতে বসেছিল। এমন সময় হঠাৎ করে তার ফোন বেজে ওঠে। আরুশি ফোনটা রিসিভ করা মাত্রই বিপরীত দিক থেকে আরহাম বলে ওঠে,”কাজটা তুমি মোটেই ঠিক করলে না!”
আরুশি ভ্রু কুঁচকে বললো,”কোন কাজ?”
“ন্যাকামি করছ তাইনা? কি ভেবেছ, আমি কিছু জানি না। নিশ্চয়ই তুমি ফোন করে মমকে সবটা বলেছ। যার কারণে মম আজ আমার গায়ে হাত তুলেছে।”
“বেশ হয়েছে। আপনি এটাই ডিজার্ভ করেন৷ আর শুনুন মিস্টার আরহাম খান, এখানে আমার কোন দায় নেই। আপনিই শুরু করেছেন সবটা। আমার আম্মুকে ফোন করে আমার নামে অভিযোগ করার আগে এটা আপনার ভাবা দরকার ছিল। আমাকে তো বিনা দোষে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন কিন্তু এখন নিজেই নিজের করা অপরাধের শাস্তি পাচ্ছেন। বরাবরের মতো এবারও আপনি আমার কাছে হেরে গেলেন। সো ক্রাই মোর!”
আরহাম হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,”কান্নার কিছুই এখনো তুমি দেখো নি অনাথ মেয়ে। সময় আমারও আসবে। আর মনে রেখো, যখন আমি সুযোগ পাবো তখন তোমার তোমায় এত কাঁদাব যে তোমার চোখের সমস্ত অশ্রুও শুকিয়ে যাবে।”
আরুশি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”আপনার এসব হুমকিতে আমি ভয় পাইনা। সারাজীবন তো এসব হুমকিই দিয়ে গেলেন কিছু আর করতে পারলেন না। যাইহোক, বাই। আপনার সাথে এত বকবক করার সময় নেই।”
বলেই আরুশি ফোনটা রেখে দিলো। অতঃপর রান্নায় মনোনিবেশ করতে হলো। ঢাকায় একটা হোস্টেলেই থাকতে হয় তাকে৷ তাই নিজের সব কাজ একাই করতে হয়। আরিশা ও জাঈদ এখন সিলেটেই আছে। তবে নিজের এসএসসি পরীক্ষার পরই আরুশি ঢাকায় চলে আসে। জাঈদ এখন একজন রাজনীতিই করছে। তবে সে এখন আর সংসদ সদস্য নয়, বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আছে৷ আর আরিশা সিলেটেরই একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। যদিওবা আফিফা খান অনেকবার আরুশিকে বলেছিল তাদের বাসায় গিয়ে থাকতে কিন্তু আরুশি রাজি হয়নি৷ কারণটা হলো এই আরহাম খান৷ তাদের একসাথে এক সেকেন্ডও বনিবনা হয় না৷ তাদেরও জন্মই যেন শত্রু লগ্নে। তাছাড়া আরহাম যেভাবে আরুশিকে সবসময় অনাথ মেয়ে বলে অপমান করে তাতে তাদের বাড়িতে থেকে আর অপমানিত হতে চায়নি সে। ছোট থেকেই ভীষণ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ে আরুশি। আর যা-ই করুক, নিজের আত্মসম্মানের সঙ্গে কখনো আপোষ করে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নির্ঝর খান অফিস থেকে ফিরেই যখন জানতে পারেন আফিফা আরহামের গায়ে হাত তুলেছে আর আরহাম সকাল থেকে না খেয়ে আছে তখন তিনি ভীষণ রেগে যান। আফিফা খানের রুমে এসে রাগারাগি করে বলেন,”তোমার কি কোন আক্কেল নেই আফিফা? এত বড় ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে?”
আফিফাও রেগে বলে,”আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি। তোমার এসব অতিরিক্ত আদরের কারণেই আজ আমাদের ছেলের এত অধঃপতন হয়েছে।”
“কি এমন করেছে আমার ছেলে যে তুমি ওর গায়ে হাত তুললে?”
“কি করেছে জানতে চাও? তাহলে শোনো, ভার্সিটিতে গিয়ে মেয়েদের শরীরের দিকে তাকিয়ে সেইসব নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছে নিজের বন্ধুদের সাথে মিলে।”
নির্ঝর খান এবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে যান। তবে পরমুহূর্তেই বলেন,”এসব নিশ্চয়ই ঐ মেয়েটা তোমার কানে তুলেছে?”
“কে কানে তুলেছে সেটা মূখ্য কথা নয়। তোমার ছেলে কি করেছে সেটা নিয়ে ভাবো।”
“শোনো, এই বয়সে সবাই একটু আধটু এমন করে। আর যে তোমার কানে এসব কথা তুলেছে তার পালক বাবার অতীত ভুলে গেলে? কিভাবে ঐ জাঈদ তোমায় রাস্তায় ইভটিজিং করত, সেসব মনে আছে নিশ্চয়ই!”
“তুমি এখানে অতীতকে কেন টেনে আনছ নির্ঝর? নিজের ছেলের দোষ দেখা বাদ দিয়ে কি তুমি এখন অন্যের অতীত নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে!”
“আমার এমন কোন উদ্দ্যেশ্য নেই। আমি শুধু তোমাকে এটাই বোঝাতে চাইছি যে এসব বয়সের দোষ। আর এই অসুখ কিভাবে সাড়াতে হয় সেটাও আমার জানা আছে।”
“মানে?”
“মমের সাথে আমার কথা হলো। এই ঈদে সায়ন সায়রা ও আমানকে নিয়ে দেশে ফিরছে। আমি ঠিক করে নিয়েছি, সায়রাকেই নিজের পুত্রবধূ করব। আমার বোনের শেষ স্মৃতি সায়রা। ওকে তাই আমি নিজের কাছেই রাখতে চাই। তাছাড়া সন্তানদের সঠিক বয়সে বিয়ে দেয়া দরকার যাতে করে তারা কোন পাপাচারে লিপ্ত না হয়।”
আফিফা খান বলেন,”কিন্তু আমাদের বড়দের এভাবে একতরফাভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ঠিক? সায়রা আর আরহামের থেকেও তো শোনা দরকার ওরা কি চায়।”
“সায়রার সাথে সায়ন কথা বলে নেবে আর আরহামের সাথে আমি। তবে আমি যতদূর জানি, আরহামের কোন গার্লফ্রেন্ড বা পছন্দের কেউ নেই, থাকলে ও আমায় নিশ্চয়ই বলতো। আমরা তো বাবা-ছেলে কম বেস্টফ্রেন্ড বেশি। তাই ও নিশ্চয়ই সায়রাকে বিয়ে করতে রাজি হবে।”
আফিফা খান বলেন,”তাহলে তো ভালোই। আমিও চাই, আমার ছেলেটা কোন অন্যায় না করুক। হালাল ভাবে কাউকে বিয়ে করে সুখী হোক।”
আরুশি নিউমার্কেটের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ শ্রমিকদের ধর্মঘট চলায় রাস্তায় কোন ক্যাব বা রিকশা পাওয়াই যাচ্ছে না। এদিকে আরুশিকে এখন একটা জরুরি কাজে পল্টনের দিকে যেতে হবে। তাই সে বিরক্ত হয়ে পায়চারি করছে।
আরহাম আজ রাগ করে বাড়িতে কিছু খায়নি। তাই নিউমার্কেটের দিকে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে বন্ধুদের সাথে লাঞ্চ সেরে নিয়ে ফিরছিল নিজের বাইকে করে। একটু দূর থেকে আরুশিকে দেখে আরহাম ভাবে,”এই মেয়েটা এখানে কি করছে,আজ তো পরিবহন ধর্মঘট চলছে। কোন গাড়িও তো পাবেনা!”
ভেবেই আরহাম একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বলে,”বেশ হয়েছে, ওর জন্য আমি আজ মমের হাতে মার খেয়েছি। এবার ও একটু ভুগুক।”
বলেই বাইক নিয়ে যেতে নেবে এমন সময় খেয়াল করে কিছু ছেলে দূর থেকে আরুশির দিকে শকুনের মতো তাকিয়ে আছে। তাদের উদ্দ্যেশ্য খুব সহজেই অনুমান করতে পারে আরহাম। আর তাতেই কেন জানি আরহামের মাথা গরম হয়ে যাক। যতোই সে আরুশিকে অপছন্দ করুক কিন্তু আরুশির এত বড় ক্ষতি সে হতে দেবে না। এজন্য দ্রুত বাইক চালিয়ে ছেলেগুলোর কাছে গেলো। ছেলেগুলো তখন আরুশির দিকেই যেতে ধরেছিল। তবে আরহাম গিয়ে তাদের পথ আটকে দাঁড়ায়। অতঃপর বাইক থেকে নেমে বলে,”ওয়েট, এত তাড়া কিসের।”
তাদের মধ্যে একটা ছেলে এগিয়ে এসে আরহামের কলার চেপে ধরে। এতে করে আরহামের রাগ আরো বেড়ে যায়। আরহাম সেই ছেলেটাকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মারতে থাকে। এসব সম্পর্কে অজ্ঞাত আরুশি হঠাৎ এভাবে মারামারি দেখে ভয় পেয়ে যায়। তারপর যখন খেয়াল করে আরহাম মারামারি করছে তখন তো সে আরো অবাক হয়। বিড়বিড় করে বলে,”এই ছেলেটা এমন কেন? ছোটবেলা থেকেই এভাবে ঝগড়া-মারামারি করতেই দেখি একে। শান্তিতে থাকতে শেখে নি নাকি?”
এদিকে মারামারির একপর্যায়ে আরহাম একটা রড তুলে নিয়ে একটা ছেলেকে মারতে মারতে প্রায় মেরেই ফেলছিল এমন সময় আরুশি গিয়ে তাকে আটকে বলে,”এসব হচ্ছেটা কি। থামুন এবার,পাগল হলেন নাকি?”
আরহাম আরুশিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে,”সরো আমার সামনে থেকে। একে আজ আমি মেরেই ফেলবো।”
তবে এই সুযোগে ছেলেটা পালিয়ে যায়৷ সাথে বাকি সবাইও। আরহাম রাগী চোখে আরুশির দিকে তাকায়। এদিকে আরুশি পড়ে গিয়ে হাতে ভীষণ আঘাত পায়। আরুশি বলে ওঠে,”আপনি এমন অমানুষ কেন? এতো রাগ, অহংকার কেন আপনার? মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই? এভাবে কেউ মানুষকে মারে, আর আমাকেও আপনি আঘাত করলেন। এসব কারণেই আমি আপনাকে ঘৃণা করি।”
আরহাম কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ রাজীব সেখানে চলে আসে। আরুশিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে সে দৌড়ে এসে আরুশিকে টেনে তুলে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো আরু?”
আরুশি ইশারা করে হ্যাঁ বোঝায়। রাজীব বলে,”ইশ, তোমার হাতে তো অনেকখানি কেটে গেছে। আমার সাথে এসো, আমি তোমায় ফাস্টএইড করে দিচ্ছি।”
আরুশি বলে,”আসলে আমায় কিছু জরুরি কাজে পল্টন যেতে হবে কিন্তু গাড়িই পাচ্ছি না।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২
“আমিও তো পল্টনের ঐদিকেই যাচ্ছি, আমার বাইকে করে চলো তুমি।”
“আচ্ছা, চলুন।”
বলেই আরুশি আরহামের দিকে আরেকবার ঘৃণার সাথে তাকিয়ে রাজীবের সাথে চলে যায়। এদিকে তাদের একসাথে যেতে দেখে আরহাম রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।