অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশিকে সাথে নিয়ে খান বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন আরিশা ও জাঈদ। আরিশাকে দেখেই আফিফা আবেগপ্রবণ হয়ে নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”এতদিনে তোর আপ্পির কথা মনে পড়লো বোনু!”
আরিশাও নিজের বোনের অভিমান বুঝতে পেরে রাগ ভাঙাতে বলল,”কি করবো আপ্পি বলো? কাজের এত চাপ যে..”
“থাক, আর অজুহাত দিতে হবে না৷ তুই নাহয় নিজের কাজের জন্য সিলেটে থাকিস সেটা মানা যায়। কিন্তু তোর মেয়ে তো ঢাকায় থাকে নাকি। আরুকে আমি কতবার বললাম যে, ঢাকায় আমাদের নিজস্ব বাড়ি আছে ওকে হোস্টেলে থাকতে হবে না৷ কিন্তু ও আমার কোন কথাই শুনল না।”
আরিশা খন্দকার আরুশির দিকে তাকিয়ে বলেন,”ওর যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছে আপ্পি। ও তো এখন বড় হয়েছে, সব ব্যাপারে তো আর জোর করতে পারি না।”
এমন সময় আনিকা খান এগিয়ে এসে বলেন,”তোমরাও না! এতদিন পর দেখা হলো আর তোমাদের অভিযোগের পালা শেষই হচ্ছে না।”
আরিশা আনিকা খানের সাথে সালাম বিনিময় করে তার খোঁজ খবর নেন। আনিকা খান আরিশাকে বুকে আগলে নেন। জীবনের মাঝপর্যায়ে এসে নিজের আসল মা-বাবাকে ফিরে পেলেও আরিশা তাদের সঙ্গ বেশিদিন পাননি। ১৫ বছর আগে আরিশার বাবা আর ১০ বছর আগে আরিশার মা রাহেলা খন্দকার ইন্তেকাল করেন। তাই এখন আনিকা খানই আরিশার মায়ের জায়গা জুড়ে আছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিশা হঠাৎ বলে ওঠেন,”তো যার জন্য এখানে আসা সে কোথায়? আমার আমান বাবু কোথায়?”
এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ২০ বছর বয়সী এক চঞ্চল ছেলে। সে এসেই আরিশা খন্দকারকে জড়িয়ে ধরে বলে,”মাই ডিয়ার খালামনি তুমি কেমন আছ?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?এখন তো আর তোমাকে বাবু বলা যাবে না দেখছি, লন্ডনে থেকে যা সুদর্শন হয়েছ। তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।”
আমান নিজের স্প্রাইক করা চুলে হাত বুলিয়ে বলে,”দেখতে হবে না, আমি কার বোনপো। আমার খালামনি এত স্টাইলিশ ৪৫ বছরে এসেও নিজের সৌন্দর্য এমনভাবে ধরে রেখেছে..আর আমি একটু হ্যান্ডসাম হবো না?”
সবাই হেসে ওঠে আমানের কথা শুনে। আরহাম এরইমধ্যে এসে বলে,”বাড়ির ছোট ছেলেকে ফিরে পেয়ে তো তোমরা সবাই দেখছি আমায় ভুলেই গেছ।”
আরিশা খন্দকার এগিয়ে গিয়ে আরহামের সামনে গিয়ে বলে,”আরে..বললেই হলো। আমার প্রিয় বোনপোকে আমি ভুলে যাব? আর কেউ মনে রাখুক না রাখুক আমি তোমায় সবসময় মনে রাখব।”
আরহাম আরিশা খন্দকারকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”থ্যাংকিউ খালামনি৷ একমাত্র তুমি আমায় বোঝো। মমের পর তুমিই আমায় সবথেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছ। ছোটবেলায় তো আমি মমের থেকে তোমার কাছেই বেশি ছিলাম। আমি জানি, এই পৃথিবীর সবাই আমায় ভুলে গেলেও তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে।”
এদিকে আরুশি এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,”কি হিংসুটে ছেলে রে বাবা! নিজের ছোট ভাইকেও হিংসা করে।”
ততক্ষণে সায়ন চৌধুরী ও তার মেয়ে সায়রাও নিচে নেমে আসে। তারা আসতেই সবার সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন। অনেকদিন পর যেন আজ এক পারিবারিক মিলনমেলা বসে।
আরুশি চুপচাপ সোফায় বসে ছিল৷ এমন সময় হঠাৎ আমান এসে আরুশির পাশে বসে। অতঃপর বলে,”আরুশি আপাই..কি অবস্থা তোমার?”
“এই তো, তোমার?”
“আমি তো সবসময় চিল মুডে থাকি।”
“শুনলাম তুমি নাকি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়ছ! ইশ, আমাদের ফ্যামিলির ডাক্তারি ঐতিহ্যটা কিভাবে নষ্ট হয়ে গেল। তোমার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার হবে আর তুমি হবে উকিল!”
“তা যা বলেছ আপাই..তবে চিন্তার ব্যাপার নেই। আমার বাচ্চাকাচ্চা হলে আমি তাদের আবার ডাক্তার বানিয়ে পরিবারের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনব।”
“বাবাহ! এখনই বাচ্চাকাচ্চার পরিকল্পনাও করে নিয়েছ! তা পছন্দের কেউ আছে নাকি তোমার?”
আরুশির কথা শুনে আমান আরচোখে কিছুটা দূরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সায়রার দিকে তাকায়৷ এই হাসিখুশি চেহারা যেন তার হৃদয়ে আলোড়ন তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। আমান সায়রার দিকে তাকিয়েই বলে,”সে তো আছে একজন! কিন্তু তার কাছে তো আমি বাচ্চা!”
আরুশি ভ্রু কুচকে বলে,”মানে?”
আমান এবার আরুশির দিকে তাকিয়ে বলে,”কি বলবো বলো? সে আমার থেকে সিনিয়র আর আমাকে একদম নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই ট্রিট করে সবসময়। মানুষ তো ফ্রেন্ডজোনে আটকে যায় কিন্তু আমি তো একদম ব্রাদারজোনে আটকে গেছি। কিভাবে যে তাকে নিজের মনের কথাটা বলি।”
আরুশি আমানের কাধে হাত রেখে বলে,”শোনো, মনে একটু সাহস আনো। সময় থাকতে যাকে ভালোবাসো তাকে নিজের মনের কথা জানিয়ে দাও। পরে যাতে আর আফসোস করতে না হয়।”
“ঠিক বলেছ তুমি আপাই। আমি ভাবছি খুব শীঘ্রই তাকে নিজের মনের কথা জানিয়ে দেব।”
বলেই সে আবারো সায়রার দিকে তাকায়।
এদিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমান ও আরুশিকে একসাথে কথা বলতে দেখে আরহাম রাগী চোখে তাকিয়ে ছিল৷ রাগে ফুঁসতে ফু্ঁসতে বলে,”এই মেয়ের সমস্যাটা কি? আমি বাদে আর সবার সাথেই হেসে হেসে কথা বলে। অথচ যখন আমার সাথে কথা বলে তখন যেন মনে হয় ওর মুখ দিয়ে আগ্নেয়গিরির লাভা বের হয়।”
আরহাম এসবই ভাবছিল এমন সময় আরহামের বাবা নির্ঝর খান এসে আরহামকে বলেন,”আরহাম, একটু এদিকে এসো তো। তোমার সাথে একটু জরুরি কথা আছে।”
আরহাম মাথা নাড়িয়ে বলে,”আচ্ছা, ড্যাড।”
অতঃপর নির্ঝর খানের সাথে একটু দূরে যান৷ নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”আসলে তোমার থেকে একটা বিষয়ের অনুমতি চাইতেই তোমাকে এখানে ডাকা।”
“মানে?”
“তুমি তো জানো আরহাম, তোমার দাদা কতদিন থেকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।”
“হুম, গ্যান্ডপা তো এখন অনেক অসুস্থ।”
“এই অসুখের সময়েও তিনি সবসময় আমার বোন বৃষ্টির নাম নেন। আজও তিনি বৃষ্টিকে ভুলতে পারেন নি। কি করবো বলো, আমার বোনটা এতটা অভাগী ছিল..জন্মের পর থেকে আমাদের থেকে বিছিন্ন ছিল। তারপর যখনই বা ওকে ফেরত পেলাম কিছু বছর আনন্দে কাটালাম তারপর আবার একটা এক্সিডেন্টে সব শেষ হয়ে গেল।”
“হুম, ড্যাড। আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কত কষ্টের।”
“তোমার দাদা কি বলেন জানো? সায়রার মধ্যে উনি বৃষ্টির প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। সায়রা যেন সবদিক দিয়েই বৃষ্টির মতোই৷ চেহারা হোক বা আচার-আচরণ। তাই আমি একটা ব্যাপার ভাবছিলাম, সায়রাকে এ বাড়ির বউ করে আনব। তোমার সাথে ওর বিয়ে দেব। কিন্তু এর জন্য আমার তোমার মতামতও জানা দরকার। একপাক্ষিক কিছু তো আমি করতে পারি না। আমি যতদূর জানি তোমার কারো সাথে কোন রিলেশন নেই। এখন তুমি বলো তোমার কি মতামত।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫
আরহাম কিছুটা দূরে তাকিয়ে আমান ও আরুশিকে একসাথে হাসাহাসি করে কথা বলতে দেখে৷ তার মাথায় যেন জেদ চেপে বসে এক মুহুর্তে আর সে বলে,”ঠিক আছে। আমার কোন আপত্তি নেই।”
“বাহ, ভালোই তো সায়রাও বলল ও রাজি আর তুমিও রাজি। তাহলে আজকেই এনগেজমেন্টটা হয়ে যাক!”
“আজকেই!”
আরহাম অবাক হয়। কারণ সে তো জেদের মাথায় বলেছে কিন্তু তাই বলে যে নির্ঝর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগবে তা তার ভাবনার বাইরে।