অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৬

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৬
ইয়াসমিন খন্দকার

খান ভিলায় চলছে দারুণ প্রস্তুতি। আজ দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবরাজ ও নিঝুম ফিরতে চলেছে খান ভিলায়৷ সকাল থেকে আনিকা খান কিচেনে একের পর এক পদ রান্না করে চলেছেন। আফিফা আজ মেডিকেলে যায়নি৷ সেও মাকে সাহায্য করছে। ছবি বেগম সব কিছু তদারকি করছেন। আবরাজ ও নিঝুমের সাথে দেখা করার জন্য তিনি যতটা না উদগ্রীব তার থেকেও বেশি উদগ্রীব আদৃতার সাথে দেখা করার জন্য। এজন্য তো তিনি আনিকা খানকে বলছেন,”আদৃতা দিদিভাইকে সেই কোন ছোটবেলায় সামনাসামনি দেখেছি। না জানি এতদিনে কত বড় হয়ে গেছে।”
আনিকা খানও বলেন,”ঠিক বলেছেন। ভিডিও কলেও তো সেরকম একটা কথা বলে না ও। আমিও ওকে সামনাসামনি দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে আছি।”

নির্ঝর কিচেনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ আফিফা সেদিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়৷ নির্ঝর আফিফাকে দেখেই চোখ টিপে। তার পরণে একটা শুভ্র পাঞ্জাবি। এ অবস্থায় তার দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। কিন্তু আফিফা লজ্জায় পড়ে চোখ ফিরিয়ো নিলো। এদিকে আরিশা সিঁড়ি বেয়ে নামতেই তার নজর পড়লো নির্ঝর এর দিকে৷ সে কিছু সময় অনিমেষ তাকিয়ে অতঃপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে স্বগতোক্তি করে বলল,”নিজেকে সামলা আরিশা। যে কখনোই তোর হবে না তার উপর এভাবে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।”
আরিশার ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। ছবি বেগম সজাগ হয়ে বলেন,”নিশ্চয়ই আবরাজরা চলে এসেছে।”
বলেই তিনি লাঠিতে ভড় দিয়ে একপ্রকার ছুটে যান।নির্ঝরও যায় তার পিছন পিছন। দরজাটা খুলতেই আবরাজ ও নিঝুমের হাসিমুখ দেখতে পান ছবি বেগম। এতদিন পর তাদের দেখে ছবি বেগমের চোখে জল চলে আসে। নিঝুম খান ছবি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”কেমন আছেন চাচি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ তুমি কেমন আছ?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“এতদিন পর এই বুড়ির সাথে দেখা করার কথা মনে পড়লো।”
আবরাজ খান বললেন,”আমরা তো আপনাদের সাথে দেখা করতে চাই। কিন্তু সময়ই যে হয়ে ওঠেনা।”
ছবি বেগম কিছুটা অভিমানী স্বরে বলেন,”থাক, আর অজুহাত দিতে হবে না। তা আমার আদৃতা দিদিভাই কোথায়? ওকে দেখার জন্য যে আমার দুই চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। ও আসেনি তোমাদের সাথে?”
আবরাজ খান বলে ওঠেন,”এসেছে তো। এই আদৃতা সামনে এসো। গ্র‍্যানির সাথে দেখা করো।”
আবরাজ খানের কন্ঠস্বর শুনে হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসে এক অতীব সুন্দর তরুণী। পরনে তার মিনি স্কাট ও জিন্স, পায়ে হাই হিল। একদম পাশ্চাত্যের তরুণীদের মতোই লাগছে তাকে দেখে। সে এগিয়ে এসেই ছবি বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”হ্যালো, গ্র‍্যানি, হাউ আর ইউ?”

ছবি বেগম হালকা হেসে বলেন,”আমি তো এত ইংরেজি বুঝি না, দিদিভাই। তবে তোমায় দেখে অনেক ভালো লাগছে। কেমন আছ তুমি?”
“আ’ম ফাইন। ভালো আছি। কিন্তু তোমাদের সিলেটে এত ডাস্ট কেন? উফ..রাস্তাঘাট কি নোংরা আর ডাস্টে ভর্তি। আমার স্কিনের প্রবলেম হবে তো।”
নিঝুম রেগে বলেন,”আহ, আদৃতা। এসব কেমন কথা?”
ছবি বেগম বলেন,”ওকে বকো না নিঝুম। ও তো ছেলেমানুষ। এসো দিদিভাই ভেতরে এসো।”
সবাই মিলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। কিছু সময় পর আবির ও আনিকা এসে তাদের সাথে দেখা করে এবং কথা বলে৷

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই মিলে বসে পড়েছে ড্রয়িংরুমে। ছবি বেগম সকলের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন। আবরাজ খান দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে বলেন,”আপনি কি আমাদের কিছু বলবেন?”
ছবি বেগম হালকা হেসে বলেন,”হ্যাঁ, যেই জন্য তোমাদের সবাইকে এত তড়িঘড়ি করে দেশে ডাকা। তোমরা তো জানোই, আমার বয়স হয়েছে৷ তোমাদের বাবা তো অনেক আগেই গত হয়েছেন। আমিও আজ আছি কাল নেই। তবে আমার ইচ্ছা, নিজের মৃত্যুর আগে যদি নিজের নাতি-নাতনির বিয়ে দেখে যেতে পারি। ”
নিঝুম বলে ওঠেন,”এমন কথা বলবেন না চাচি। আল্লাহ করুক, আপনি আরো অনেক দিন আমাদের মাঝে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।”
‘কারো হায়াত-মউত এর কথা তো বলা যায়না নিঝুম। এজন্যই আমি তোমাদের সবার সামনে একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।’
আবরাজ জানতে চান,”কি প্রস্তাব?”

ছবি বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আমি অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম, নির্ঝর দাদুভাইয়ের সাথে আফিফা দিদিমনির বিয়ে দেব। আমার এই ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নির্ঝর ও আফিফাও জানিয়েছে তারা একে অপরকে পছন্দ করে। এটা জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। এবাড়ির কারো এই বিয়ে নিয়ে কোন আপত্তি নেই। এখন মূলত তোমাদের মতামত নিতেই এখানে ডাকা। চাইলে এসব কথা আমি ফোনেও বলতে পারতাম কিন্তু বিয়ের মতো এত জরুরি একটা কথা সামনাসামনি বসে বলাটাই ভালো৷ তাই তোমাদের ডেকে পাঠানো। এখন তোমাদের যদি এই সম্পর্কে কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা কথা সামনে আগাবো।”
আবরাজ ও নিঝুম কিছু সময় একে অপরের দিকে তাকান। অতঃপর দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে। আবরাজ বলেন,”আপত্তি থাকবে কেন? আমরা তো অনেক খুশি এই প্রস্তাবে।”

নিঝুমও বলেন,”আফিফার মতো এত ভালো একটা মেয়েকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। তার উপর ওরা যখন একে অপরকে পছন্দও করে তখন তো আমাদের আপত্তি করার কোন উপায় নেই।”
ছবি বেগম নিশ্চিন্ত স্বরে বলেন,”আমি জানতাম তোমরা রাজি হবে। এখন আমি নিশ্চিন্তে বিয়ের কথাবার্তা সামনে এগোতে পারব। আমি একটা ব্যাপার ভেবে দেখলাম, এই সময় তোমরা সবাই ছুটিতে আছ নাহলে এমনিতে তো তোমাদের পাওয়াই যায় না। তাই বলি কি, আর ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যাক।”
আবরাজ এবার একটু চিন্তিত স্বরে বলেন,”এত তাড়াহুড়ো করে কি বিয়েটা দেয়া ঠিক হবে?”
নিঝুম বলেন,”আমি চাচির সাথে একমত। এই সময় যেহেতু সবাই ফ্রি আছি তাই এখনই বিয়েটা হয়ে যাক। আর খুব বেশি জমজমাট করে বিয়ে দেয়ার তো দরকার নেই। কাছের কিছু আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জানালেই তো হয়।”

আবরাজ বলে ওঠেন,”কিন্তু আমার লন্ডনের ফ্রেন্ডসরা!”
নিঝুম বলেন,”এত চিন্তা করো না। এরপর নাহয় লন্ডনে ফিরে আবার একটা অনুষ্ঠান করলাম।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
ছবি বেগম খুশি হয়ে বলেন,”বাহ, তাহলে তো সব সমস্যা মিটেই গেল। এবার তাহলে বিয়ের আয়োজন শুরু হোক। হাতে তো আর বেশি সময় নেই।”
আফিফা ও নির্ঝর এই কথাগুলো শুনে ভীষণ খুশি হয়। দুজন পাশাপাশি বসে ছিল৷ নির্ঝর আফিফার হাতটা শক্ত করে ধরে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আরিশার চোখে জল চলে আসে। সে সন্তপর্ণে এই জল মুছে বলে,”না আমি কাঁদবো না, নিজের আপ্পির খুশিতে আমি নজর দেব না।”
সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে যাবার পর আফিফা ও নির্ঝর একত্রে কথা বলছিল। এমন সময় আদৃতা এসে নির্ঝরকে বলে,”সিরিয়াসলি ব্রো! তুমি বিডিতে বিয়ে করবে!”

নির্ঝর সামান্য হেসে বলে,”হ্যাঁ, কেন?”
আদৃতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ইউকেতে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ের প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি। আমি তো ভাবতেই পারছি না যে বিডিতে বিয়ে করবে তুমি তাও আবার নিজের কাজিনকে।”
নির্ঝর এবার রাগী স্বরে বলে,”এতে খারাপ কি আছে?”
আদৃতা বলে,”উফ! তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তুমি তো স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতেই জানো না৷ ইভেন তোমরা কেউ না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৫

এমন সময় আরিশা সেখানে এসে বলে,”আমার আপ্পির স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাবে না আদৃতা আপ্পি। সে নিজের যোগ্যতায় একজন ডক্টর হতে চলেছে। আপনার মতো বাবার টাকার ফুটানি করছে না।”
“হাউ ডেয়ার ইউ!”
বলে আদৃতা আরিশার দিতে এগোতে নেবে এমন সময় নির্ঝর তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে,”এনাফ ইজ এনাফ! আর কোন বেয়াদবি করলে আমি মম ড্যাডকে জানাতে বাধ্য হবো!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৭