অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি আরহামের দিকে যখন অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল তখন আরহাম খানিক হেসে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থেকো না,প্রেমে পড়ে যাবে!”
আরুশি খানিক বিরক্তির স্বরে বলে,”আপনি একটু বেশিই ভুল ভাবছেন। এমন কিছু সম্ভব না। আমি কখনোই আপনাকে ঐ নজরে দেখিনি।”
“তুমি বোধহয় নিজের মনের কথা কখনো নিজেই বুঝতে পারো নি আরুশি। তাই এসব বলছ। কিন্তু আমি বুঝেছি, তোমার মনে আছে, যখন আমরা স্কুলে পড়তাম স্কুলে একটা মেয়ের সাথে আমার প্রেমের গুজব রটেছিল সেই সময় তুমি গিয়ে মেয়েটিকে আমার নামে কত বাজে কথা বলেছিলে যাতে ও আমার সাথে প্রেম না করে, কলেজ লাইফে তো আমি একটা মেয়ের সাথে ডেটে যাওয়ায় তুমি আমার মমকে পর্যন্ত ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিলে। আর ভার্সিটি লাইফে আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকায়…এসব কিছু তো তোমার জেলাসি ফুটিয়ে তোলে আরুশি। আমি জানি, তুমি বলবে এসব কিছু তুমি আমার সাথে শত্রুতা থেকে করেছ কিন্তু আসল কথাটা এই যে, এই শত্রুতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল ভালোবাসা,অধিকারবোধ যা হয়তো তুমিও উপলব্ধি করতে পারো নি। এজন্য আমি তোমায় দোষও দেব না। আমি শুধু তোমায় পরামর্শ দেব, বাস্তবতাটাকে অস্বীকার না করে বাস্তবকে স্বীকার করে নাও। এতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
আরুশি আরহামের কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মনে একটা অদ্ভুত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আরহামের কথাগুলো যেন তার অতীতের স্মৃতির দরজা খুলে দিয়েছে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি এত বছর ধরে আরহামের প্রতি তার আচরণ, তার রাগ, শত্রুতা, এমনকি ছোট ছোট জেলাসির মুহূর্তগুলো সব যেন একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে কি সত্যিই আরহামের প্রতি কখনো কোনো ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিল? নাকি এটা শুধুই আরহামের কল্পনা? আরুশির মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরহামের দিকে তাকায়। সে বলে,”আপনি যা বলছেন, তা আমার কাছে একদম অবান্তর মনে হচ্ছে। আমি কখনো আপনার প্রতি এমন কিছু ভাবিনি। আমার সব আচরণ ছিল শুধু… শুধু আমার নিজস্ব মতামত আর বিরক্তির কারণে। আপনি এখানে ভালোবাসার গল্প বানিয়ে ফেলছেন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরহাম একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে,”আরুশি, তুমি যতই অস্বীকার করো, আমি তোমার চোখের ভাষা পড়তে পারি। তুমি নিজেকে যতই বোঝাও, তোমার মনের একটা কোণে আমার জন্য একটা জায়গা আছে। হয়তো তুমি সেটা এখনো মানতে চাও না, কিন্তু আমি অপেক্ষা করব। আমি জানি, একদিন তুমি নিজেই সত্যটা বুঝবে।”আরুশি আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তার মনে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। আরহামের এই আত্মবিশ্বাস, তার কথার মধ্যে থাকা দৃঢ়তা এসব যেন তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে দ্রুত বিষয়টা পাল্টাতে চায়।তাই বলে,”দেখুন, আমি এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আপনি এখানে যতদিন থাকবেন, আমি আপনার সঙ্গে শুধুমাত্র সৌজন্যমূলক আচরণ করব। এর বেশি কিছু আশা করবেন না।”
আরহাম হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে হাসিমুখে বলে, “ঠিক আছে, সৌজন্যমূলক আচরণই হোক। তবে আমি তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আরুশি। আমি এখানে এসেছি তোমার মন জয় করতে। আর আমি জানি, আমি সেটা পারব। তুমি যতই দূরে সরে যাও, আমি ততই কাছে আসব।”
আরুশি আর কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। সে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সিলেটের সবুজ পাহাড় আর প্রকৃতির সৌন্দর্য তার মনকে কিছুটা শান্ত করে। কিন্তু আরহামের কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, “আমি কি সত্যিই আরহামের প্রতি কখনো কিছু অনুভব করেছিলাম? নাকি এটা শুধুই আমার শত্রুতা ছিল? আমি কেন এত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি?”
তখন সন্ধ্যা নামে। আরিশা খন্দকার সবাইকে ডাকেন খাবারের জন্য। আরুশি, আরহাম, জাঈদ শেখ, আর আরিশা একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসেন। আরিশা হাসিমুখে বলেন,”আরহাম, তোমার পছন্দের পোলাও আর মুরগির রোস্ট করেছি। খেয়ে দেখো, কেমন হয়েছে।”
আরহাম হেসে বলে,”খালামনি, তোমার হাতের রান্না তো সবসময়ই অসাধারণ। আমি নিশ্চিত, এটাও দারুণ হয়েছে।”
আরুশি চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। তার মনের মধ্যে এখনো আরহামের কথাগুলো ঘুরছে। জাঈদ শেখ হঠাৎ বলে ওঠেন,”আরহাম, তুমি কাল আমার সঙ্গে একটু বাগানে যাবে? আমার বাগানে নতুন কিছু গাছ লাগানোর প্ল্যান আছে। তোমার সাহায্য লাগবে।”
আরহাম অবাক হয়ে বলে,”অবশ্যই, খালু। আমি যাব।”
আরুশি বাবার কথা শুনে একটু অবাক হয়। জাঈদ শেখ সাধারণত আরহামের সঙ্গে এতটা খোলামেলা কথা বলেন না। সে মনে মনে ভাবে,”পাপা কি আরহামের প্রতি নরম হয়ে গেলেন?”
খাওয়া শেষ হলে আরুশি উঠে যায়। আরহাম তার পিছু পিছু বারান্দায় যায়।
“আরুশি, একটা কথা বলি?”
আরুশি থমকে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,”কী কথা?
“আরহাম একটু ইতস্তত করে বলে,”আমি জানি, তুমি আমার উপর রাগ করছ। কিন্তু আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, আমি তোমার জন্য সবসময় ছিলাম, আছি, আর থাকব। তুমি যদি কখনো আমাকে তোমার জীবনে চাও, আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।”
আরুশি কিছু না বলে চুপচাপ চলে যায়। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগছে। সে নিজেকে বোঝায়,”না, আমি আরহামের কথায় ভুলব না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকব।” কিন্তু তার মনের এক কোণে একটা প্রশ্ন জেগে ওঠেসে কি সত্যিই আরহামকে কখনো ভালোবেসেছিল?
পরদিন সকালবেলা জাঈদ শেখ হঠাৎ করে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছিলেন। আরিশা খন্দকার তার এই অবস্থা দেখে কিছুটা অবাক হন। একটু আগেই তো তিনি আরহামের সাথে কত হেসে হেসে গাছ লাগাচ্ছিলেন। হাসতে হাসতে আরহামকে পরামর্শও দিচ্ছিল কিভাবে তার মেয়ের মন জয় করা যায়। এখন তাহলে হঠাৎ করে কি হয়ে গেল? এই ভাবনা থেকেই আরিশা খন্দকার এগিয়ে এসে বলেন,”কি হয়েছে? তোমায় এমন লাগছে কেন?”
জাঈদ শেখ দুশ্চিন্তা নিয়ে বলে ওঠেন,”আর বলো না। ঐ ঈশান কবীরের চক্রান্তে আমার পার্টিতে কিছু ঝামেলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনের টিকিট দেয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছে পার্টি অফিসে।”
এমন সময় হঠাৎ করে জাঈদ শেখের ফোনে কল আসে। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তেজনার সাথে কথা বলেন। আরিশা খন্দকারও চিন্তিত হন। কল কেটেই জাঈদ শেখ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে নেন। এমন সময় আরিশা এখন তাকে থামিয়ে বলেন,”এভাবে কোথায় যাচ্ছ? কিছু খেয়ে তো যাও।”
“পার্টি অফিসে অনেক ঝামেলা হয়েছে। আমায় যেতে হবে।”
“আরে আমার কথা তো শোনো..”
এমন সময় আরুশি এসে বলে,”পাপা, এটা একদম ঠিক হচ্ছে না। তুমি এভাবে না খেয়ে যেও না।”
জাঈদ শেখ বলেন,”আমার প্রিন্সেস তো বুঝদার! পাপার অবস্থাটা একটু বোঝো। আমি ফিরে এসে একসাথে লাঞ্চ করবো।”
“প্রমিস?”
“প্রমিস। আর একটা কথা, আরহামের সাথে একটু সময় কাটাও। আমি যতদূর বুঝেছি ছেলেটা খারাপ না।”
“পাপা, তুমিও এই কথা বলছ!”
“পাপা প্রিন্সেসের ভালো চায় জন্য বলছে৷ কিন্তু পাপা এটা নিয়ে জোর করবে না। প্রিন্সেসের জীবনের সিদ্ধান্ত সে নিজে নিক। টেক কেয়ার।”
বলেই জাঈদ শেখ বেরিয়ে যান। আরিশা খন্দকার থমথমে মুখে চেয়ে থাকেন। আরুশি নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমায় এমন লাগছে কেন আম্মু?”
“জানিনা আরু, আমার মন কেন জানি ভীষণ কু গাইছে। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হবে।”
“আরে পাপা তো বলছে ফিরে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।”
তবুও আরিশা খন্দকার শান্ত হতে পারেন না।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৩
জাঈদ শেখ নিজের পার্টি অফিসে আসতেই দেখতে পান দুই পক্ষ বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মারামারি শুরু করে দিয়েছে। মূলত ইউপি নির্বাচনে দুজন প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীর মধ্যে টিকিট পাওয়া নিয়ে মূলত এই দ্বন্দ। জাঈদ শেখ তাদের থামাতে গেলে হঠাৎ করে একজন তাকে ধাক্কা দেন এবং জাঈদ শেখ ফ্লোরে পড়ে যান। এরমধ্যে সেখানকার দ্বন্দ আরো বেড়ে যায় এবং অনেকে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। জাঈদও হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।