অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৭

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৭
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি ভাবলেশহীন ভাবে তার বাবা-মায়ের সাথে একই ফ্রেমে তোলা একটা ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে। তার মুখে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে না। সে শুধু একদৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় আরহাম আসলো আরুশির কাছে৷ আরুশির একদম পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”আরুশি, তুমি তো সকাল থেকে কিছু খাও নি৷ চলো কিছু খেয়ে নেবে।”

আরুশি কোন প্রতিত্তোর দেয় না৷ নিশ্চুপ থাকে। আরহাম বুঝতে পারে এভাবে কাজ হবে না। তাই সে নিজেই গিয়ে আরুশির জন্য খাবার নিয়ে এসে তার মুখের সামনে ধরে বলে,”খাবারটা খেয়ে নাও।”
আরুশি বলে ওঠে,”প্লিজ আমায় জোর করবেন না। আমার একদম খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি আরুশি কিন্তু এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। এই টুকুনি খেয়ে নাও। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো খালামনি, খালু আর ফিরে আসবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। নিজের জন্য না হলেও খালামনি-খালুর জন্য। একবার ভেবে দেখো তো,ওনারা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে কি তোমায় এভাবে দেখে খুশি হতেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি এবার নড়েচড়ে বসে। আরহাম খাইয়ে দিতে গেলে এবার আর জেদ করে না। চুপচাপ খেতে থাকে। তবে একটু খেয়েই বলে,”আমি আর খেতে পারবো না।”
আরহাম আরুশির দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আরুশি পানিটুকু খেয়ে নেয়। অতঃপর আরহাম ভাতের থালাটা নিয়ে যেতে নিতেই আরুশি আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। আরুশিকে এভাবে কাঁদতে দেখে আরহামেরও বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে। সে আরুশিকে জড়িয়ে ধরে বলে,”এই পাগলী কাঁদছ কেন?”
আরুশি কাঁদতে কাঁদতেই বলে,”আম্মু-পাপা আর কখনো ফিরে আসবে না তাইনা? আর কখনো পাপা আমায় প্রিন্সেস বলে কোলে টেনে নিবে না..আম্মু আর কখনো আমায় বকবে না…”
আরহাম বুঝতে পারছিল না আরুশিকে কিভাবে সমবেদনা জানাবে। তবুও সে চেষ্টা করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আরুশিকে আগলে রাখতে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,এই কান্নাই শেষ কান্না হবে৷ এরপর আর সে কখনো আরুশির চোখে জল আসতে দেবে না।

আফিফা খান কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। এখনো তিনি মেনে নিতে পারছেন না যে তার বোন আরিশা খন্দকার আর এই পৃথিবীতে নেই। এমন সময় নির্ঝর খান এসে তার পিঠে হাত রাখতেই তিনি আরো দূর্বল হয়ে পড়েন। নির্ঝর খানকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,”বোনু আর কখনো ফিরবে না তাইনা? ও সারাজীবনের জন্য আমায় ছেড়ে চলে গেছে। ও তো আমার ছোট বোন ছিল ওকে তো আমার থেকেও বেশি বাঁচতে হতো। তাহলে কেন ও আমায় এভাবে ছেড়ে চলে গেল?”
“আফিফা..এভাবে কেঁদো না। তোমার শরীর খারাপ করবে।”
“আমি যে এটা মেনে নিতে পারছি না যে আমার বোনুটা আর নেই! ও আর কখনো আমায় আপ্পি বলে ডাকবে না…”
এমন সময় নিঝুম খান এসে বলেন,”এভাবে ভেঙে পড়ো না আফিফা৷ আমাদের বড়দের তো নিজেকে সামলাতে হবে। নাহলে বাচ্চাগুলো নিজেদের কিভাবে সামলাবে? তুমি একবার আরুশির কথা ভাবো৷ কিছুক্ষণ আগেই মেয়েটা নিজের মা-বাবা দুজনকেই হারিয়ে ফেলেছে। ও তো এখন একদম নিঃস্ব হয়ে গেছে৷ আমাদেরকে তো এখন ওর দিকটা ভাবতে হবে।”

আরুশির কথা ভেবে আফিফা খান এবার নিজেকে একটু সামলালেন। চোখের জল মুছে বললেন,”আরু.. ও কোথায়? আমার তো ওর কথা মনেই ছিল না৷ বোনু এখন আর নেই৷ তাই আরুকে আমাকেই সামলাতে হবে।”
বলে তিনি সামনের দিকে এগোতে নেবেন এমন সময় নিঝুম খান বলে ওঠেন,”আরহাম আছে আরুশির কাছে৷ তোমায় এত চিন্তা করতে হবে না। ওই আরুশিকে সামলে নেবে।”
আফিফা খান বলেন,”আরুর এখন যা মানসিক অবস্থা ওকে এখানে একা রেখে যেয়ে আমি শান্তি পাবো না। ওকে আমি আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই। এখানে একা থাকলে ডিপ্রেশনে ও না ভুল কিছু..”

বলেই তিনি নির্ঝর খানের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলেন,”আমি জানি, তুমি আরহাম আরুর বিয়েটা মেনে নাও নি। কিন্তু আমি তোমার কাছে অনুরোধ করব, দয়া করে আরুকে আমাদের সাথে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দাও। এখানে থাকলে মেয়েটা একদম শেষ হয়ে যাবে। ঐ এখন আমার বোনুর শেষ চিহ্ন..ওর কিছু হয়ে গেলে আমি..”
নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”আমাকে কি তোমার এতটাই অমানুষ মনে হয় আফিফা? আরুশির এই অবস্থা দেখেও আমি কিভাবে না করতে পারি? বরং আমি নিজেই তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবার কথা। আমি দেখেছি, আরহাম কিভাবে আরুশির খেয়াল রাখছে। আরহাম হয়তো সত্যিই মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসে..আমি আর ওদের জীবনে কোন বাধা দিতে চাই না৷ ওরা যদি একসাথে থাকতে চায় আমি সেটা মঞ্জুর করব।”
“ধন্যবাদ। অবশেষে তুমি নিজের ভুলটা বুঝতে পারলে। আজ যদি বোনু বেঁচে থাকত তাহলে..”
বলেই আফিফা খান আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নির্ঝর খান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কেউই আজীবন থাকে না আফিফা। তবে আবার আমাদের অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যাতে করে আমরা একটা সুখী পরিবার হতে পারি।”

১ সপ্তাহ পর,
আরুশি এখন আরহামদের পরিবারের সাথে ঢাকায় থাকে। যদিও সে সিলেটে নিজের বাড়ি ছেড়ে আসতে চায়নি কারণ সেখানে তার মা-বাবার স্মৃতি মিশে ছিল কিন্তু ওখানে থাকলে আরুশি কখনোই অতীত ভুলে সামনে মুভ অন করতে পারত না তাই আফিফা খান ও আরহাম তাকে এখানে নিয়ে এসেছে৷ এই এক সপ্তাহ সবার জীবন মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছে। তবে আরুশি এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রায়শই নিজের ভাবনায় হারিয়ে যায়।
আরহাম এই ব্যাপারটা ঠিকই খেয়াল করেছে। তাই সে আরুশিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছে। আরুশি যখন রুমে একা বসেছিল তখন তার সামনে একটা সাইকোলজির বই নিয়ে যায় আরহাম৷ আরুশির মুখোমুখি হয়ে বইটা তার হাতে তুলে দেয়। আরুশি হঠাৎ করে অবাক হয়ে যায় এবং আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম হালকা হেসে বলে ওঠে,”এভাবে তাকিয়ে কি দেখছ? মনে নেই, সামনের সপ্তাহ থেকে তোমার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম? এভাবে বসে বসে শোক পালন করলেই তো শুধু হবে না। মনে নেই, খালামনি তোমার পড়াশোনা নিয়ে কতটা সিরিয়াস ছিলেন? তোমাকে পড়াশোনা করার জন্য নিজের থেকে এত দূরে সিলেট থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন উনি৷ যাতে তুমি পড়াশোনা করে ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়তে পারো। আর এখন যদি তুমি এভাবে না পড়ে ফেইল করো তাহলে তো উনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন না।”

আরুশি বলে ওঠে,”কি বলছেন আপনি? ফেইল আর আমি কখনো না। আমি কখনো ফেইল করি না।”
“কিন্তু এবার করবে। পড়াশোনা না করে কি কেউ পাস করে কখনো? নাকি তুমি নকল করার চিন্তাভাবনা করছ। আমার তো তাই মনে হচ্ছে, আগেও বোধহয় নকল করে পাস করেছ তাই না?”
আরুশি বলে,”এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আরু কখনো নকল করে না। দিন তো বইটা, আপনাকে দেখিয়ে দেব আরু কতটা মেধাবী স্টুডেন্ট।”
বলেই আরুশি বই নিয়ে পড়তে শুরু করে। আরহাম স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,”যাক, এতদিনে আরুশি একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলল ঠিক আগের মতো। ”
এদিকে পড়তে পড়তে হঠাৎ আরুশির আবার নিজের মা-বাবার কথা মনে পড়ে যায়। তাই সে বইটা রেখে দিয়ে নিজের মা-বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকে। আরহাম তার কাধে হাত দিতেই সে বলে ওঠে,”জানেন, পাপা বলেছিল যেদিন আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হবে সেদিন উনি ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবেন..গোটা সিলেট শহরে মিষ্টি বিলাবেন..কিন্তু..”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৬

“কোন ব্যাপার না আরুশি। আমি খালুর সেই ইচ্ছা পূরণ করব। নেক্সট ইয়ার তো তুমি গ্রাজুয়েট হয়ে যাবে তারপর দেখবে আমি কত বড় করে সেলিব্রেশন করি। এখন পড়ায় মন দাও নাহলে আর গ্রাজুয়েশন করতে হবে না রিটেক দিতে হবে।”
আরুশি এবার একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৮