অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩১
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি ও আরহাম দুজনেই আজ খুব সুন্দর ভাবে সেজে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আজ তাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। যার কারণে আজকের দিনটা তাদের দুজনের কাছেই খুব স্পেশাল৷ আমানও আজ খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে৷ কারণ আজ দীর্ঘ ১ বছর পর সে সায়রার মুখোমুখি হবে তাই সে অনেক এক্সাইটেড।
আফিফা খানের আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত সময় কাটছে এসব নিয়েই। আরুশিও হাতে হাতে তার কাজে সাহায্য করে দিচ্ছে। বাড়িতে আসা সকল অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সকাল থেকেই তারা আজ রান্নাঘরেই ব্যস্ত সময় পারছে। আফিফা খান আজ হাসপাতালেও যান নি।
কাজের ফাঁকে আরহাম বেশ কয়েকবার আরুশির সাথে দেখা করে যাচ্ছে। আফিফা খান যেটা দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন। তিনি একসময় আরুশিকে বলেন,”তোকে এত খুশি দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে আরু। বোনু যেখানেই থাকুক, তোকে এত খুশি দেখে ও নিশ্চয়ই অনেক আনন্দ পাচ্ছে।”
আরুশির মনটা এবার একটু খারাপ হয়ে যায় মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়ে। তবুও সে আলতো হেসে বলে,”বাকি জীবনটাও আমি তোমাদের সবাইকে এভাবে সুখে কাটাতে চাই খালামনি। আর আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া, আমার আম্মু-পাপা যেখানেই থাকুক খুব ভালো থাকুক। তাদের সকল গোনাহ যেন আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দেন।”
এভাবে গল্পগুজব করতে করতেই তাদের সব রান্নাবান্না হয়ে যায়৷ তত্মধ্যে সায়ন চৌধুরী ও সায়রার চলে আসে খান বাড়িতে। সায়রাকে দীর্ঘ ১ বছর পর দেখে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে আমান। এই এক বছরে সায়রার সৌন্দর্য যেন আগের থেকে প্রায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্ঝর খান এগিয়ে এসে সায়ন চৌধুরীকে অর্ভথনা জানিয়ে বলেন,”অনেক ধন্যবাদ তোমাকে সায়ন, সব ভুলে আবার এখানে আসার জন্য।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সায়ন চৌধুরী হেসে বলেন,”আপনারা তো আমাদের আপনজন৷ আপনাদের সাথে কিভাবে রাগ করে থাকি? বৃষ্টি যদি আজ বেঁচে থাকত তাহলে আরো অনেক আগেই আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সব ঠিক করে দিত। আসলে..আপনারা তো জানেন, আমার মেয়েই এখন আমার কাছে সব। তাই ওর অপমান মেনে নিতে পারিনি।”
নিঝুম খান নিজের নাতনী সায়রাকে বুকে টেনে নেন। বলেন,”এসব অতীতের কথা বাদ দাও। এখন আমাদের সামনের কথা ভাবতে হবে।”
সায়রাও বলে,”তুমি একদম ঠিক বলেছ নানু..অতীত ভুলে এবার আমরা নতুন করে সবটা শুরু করব।”
আরহামও সেখানে উপস্থিত হয়। সায়ন চৌধুরী ও সায়রাকে দেখেই সে মাথা নিচু করে নেয়। অতঃপর হাতজোড় করে বলে,”আমি আন্তরিকভাবে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। যা হয়েছে তার জন্য হয়তো আমিই দায়ী। আমার জন্য আপনাদের অনেক কষ্ট আর অপমান সহ্য করতে হয়েছে। আমি সত্যিই নিজের কাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত।”
সায়ন চৌধুরী বলে ওঠেন,”আরে কি বলছ তুমি? এমন ভেবো না। সবকিছু ঠিক আছে। আমরা অতীতের কোন কিছু আর মনে রাখিনি। যা হয়েছে তাতে তোমাকেও খুব একটা দোষ দেয়া যায়না৷ আসলে তোমাদের জেনারেশনটাই এমন। তবে হ্যাঁ, এখন একটা পরামর্শ দেই তোমায় জীবনে আর কখনো নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিও না যার কারণে তোমায় আবারো পস্তাতে হয়।”
আরহাম মাথা নাড়ায়। সায়ন চৌধুরী আরহামের পিঠে হাত রেখে বলেন,”তোমাদের এই জেনারেশনটার কিন্তু অনেক দোষ আছে। তোমরা খুব সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ো এবং আবেগের বশে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো। তাই আবারো বলছি, পরবর্তী জীবনে আর এমন কিছু করো না।”
“আচ্ছা,আঙ্কেল। আমি কথাটা মাথায় রাখবো।”
সায়রা বলে ওঠে,”আপনার স্ত্রী কোথায় আরহাম ভাইয়া?”
আরহাম বলে,”ও তো কিচেনে..”
“আচ্ছা, আমি গিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আসি।”
বলেই সায়রা ধীর পায়ে হেটে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। সহসাই আমানের মুখোমুখি হয়ে সে থেমে যায়। সহাস্যে বলে,”কেমন আছ আমান?”
আমান তো সায়রাকে দেখে একদম থ বনে যায়। আগের সেই শান্তশিষ্ট মেয়েটা এক বছরেই কতটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে বলে,”ভালো আছি সায়রা। আর তুমি?”
সায়রা বলে ওঠে,”সায়রা কি হ্যাঁ? তোমার থেকে গুণে গুণে ২ বছরের বড় আমি। ভুলে গেছ? সায়রা আপাই বলো আমায়।”
আমান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তুমি তো দেখছি অনেকটা চঞ্চল হয়ে গেছ।”
“হুম,কারণ আমার ড্যাড আমায় বলেছে চুপ থাকলে মনের ব্যথা আরো তীব্র হয়৷ তাই এই এক বছরে আমি যতোটা পেরেছি নিজের মনকে ফ্রেশ করার চেষ্টা করেছি। নিজে একা একা গুমড়ে মরার থেকে এমন হওয়াই ভালো।”
বলেই সে কিচেনের দিকে এগোয়। কিচেনে নিয়ে আফিফা খান ও আরুশির সাথে কুশল বিনিময় করে নেয়। আরুশি অতীতের ঘটনাগুলোর জন্য কিছুটা অপরাধবোধ থেকে সায়রার সাথে ঠিকভাবে কথাই বলতে পারছিল না। সায়রা এগিয়ে এসে আরুশির সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি কি কোন কারণে আমার উপর রাগ করে আছেন ভাবি? আমার সাথে কেন জানি ঠিক করে কথাই বলছেন না!”
আরুশি বলে,”না, তেমন না মোটেও। আমি কেন আপনার উপর রাগ করব? উলটে আপনারই তো রাগ করার কথা..”
সায়রা আরুশির কথার প্রতিত্তোরে হালকা হেসে বলে,”আমি আপনার উপর মোটেও রেগে নেই। আমি তো সব শুনেছি যে আপনার ঐ বান্ধবী মারিয়া কিভাবে চক্রান্ত করে সবটা করেছিল। পরে তো আমার আপনার জন্যই খারাপ লেগেছিল। আপনাকে সবার কত কটু কথা শুনতে হয়েছে। পরবর্তীতে যখন আপনার মা-বাবার ব্যাপারে শুনলাম…আমি নিজেও নিজের মাকে হারিয়েছি। তাই আপনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি৷ তবে এখন যে আপনি নিজের পরিবারের সাথে ভালো আছেন এটা দেখে ভালো লাগছে।”
আরুশি সামান্য হাসে। অতঃপর আরো কিছু টুকটাক কথা বলে তারা।
আরহাম ও আরুশির Marriage anniversary উদযাপন করার জন্য অনেক বড় একটা কেক আনা হয়েছে। আমানই কেকটা আনিয়েছে। আরুশি কেকটা দেখেই আমানকে বলে,”এসবের কি দরকার ছিল ভাই?”
আমান বলে,”দরকার ছিল আপাই। এবার তুমি এসো তো আর ভাইয়া তুমিও এসো। একসাথে কেক কাটবে।”
নির্ঝর খান, নিঝুম খান, আফিফা খান, আনিকা খান, এমনকি আবরাজ খানও হুইলচেয়ারে করে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সায়ন চৌধুরী আর সায়রা তো ছিলই। সবাই ভীষণ আনন্দিত। সবার মুখেই হাসি। সায়রা আরহামকে বলে,”হ্যাঁ, ভাইয়া যান। গিয়ে কেকটা কাটুন।”
আরহাম এবার এগিয়ে যায়। আরুশির হাতটা আলতো করে ধরে। দুজনে একসাথে একটা চাকু হাতে নেয় কেকটা কাটার জন্য। সবাই হাততালি দিতে থাকে। তারা দুজনে মিলে কেকটা কাটতে যাবে এমন সময় হঠাৎ একজন মহিলা সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে ওঠেন,”আরে দাঁড়াও..দাঁড়াও আমাকে ছাড়াই কিসের সেলিব্রেশন?”
আরুশি ও আরহাম থেমে গিয়ে অবাক চোখে সামনে থাকায়। তাদের সামনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলা। কিন্তু বাড়ির বড় সবার মুখে বিস্ময়। নিঝুম খান বলে ওঠেন,”আদৃতা!”
আদৃতা এগিয়ে এসে নির্ঝরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”হতে পারি আমি তোমার নিজের বোন নই কিন্তু ২০ টা বছর তো আমাকে নিজের বোনের মতোই দেখেছ। আর আজ এত স্পেশাল একটা দিনে আমায় ডাকলে না যখন পারিবারিক পুনঃমিলন হচ্ছে। আর নিজের ছেলের বিয়েতেও তো আমায় ডাকোনি। যাইহোক,আমি নিজের ভাতিজার জন্য গিফট এনেছি।”
বলেই তিনি আরহাম ও আরুশির দিকে গিয়ে তাদের হাতে একটি গিফট তুলে দিতে বলেন,”এটা তোমাদের জন্য।”
আফিফা খান বলে ওঠেন,”তুমি কেন এসেছ এখানে?”
আদৃতা বলেন,”আমি জানি,আমার এখানে আসায় আপনারা অনেকেই খুশি নন। কিন্তু আমাকে যে আজ আসতে হতোই। একটা অনেক বড় সত্য আপনাদের জানানোর জন্য।”
নির্ঝর খান বলেন,”কি সত্য?”
“তোমার বোন বৃষ্টির খু*নের সত্য।”
সায়ন চৌধুরী ও সায়রা সহ সবাই হতবাক হয়ে যায়। সায়ন চৌধুরী বলে ওঠে,”মানে? কি বলছেন কি আপনি?”
আদৃতা বলে,
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩০
“আপনারা সবাই তো জানেন, ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে আদৃতা একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সবাই ভেবেছিলেন সেটা স্বাভাবিক দূর্ঘটনা কিন্তু তা নয়। এই দূর্ঘটনার পেছনে কার হাত ছিল জানেন?!”
“কার?”
“জাঈদ শেখের!সেই খুন করেছিল বৃষ্টিকে।”
আরুশি বলে ওঠে,”নাহ,এটা হতে পারে না। পাপা খুনি নয়।”