অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৫
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি নিজের সামান্য উঁচু পেটটায় হাত বুলিয়ে মৃদু হাসল। যত সময় এগোচ্ছে সে নিজের ভেতরে বড় হওয়া এই প্রাণটির অস্তিত্ব ঠিক ততোটাই উপলব্ধি করতে পারছে। তার ঢাকা থেকে খুলনায় আসার পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৪ মাস। এখন খুলনার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছে সে। এখানে তার যত্ন আত্তিরও কোন অভাব নেই।
“দুপুরের খাবারটা খেয়েছ আরু মা? এই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কিন্তু খাবার ক্ষেত্রে কোন কার্পন্য করতে নেই।”
এক মধ্যবয়সী নারী কন্ঠে কথাটা শোনামাত্রই আরুশি হাস্যজ্বল কন্ঠে সামনের দিকে তাকালো। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন আতিকা বেগম। যিনি সম্পর্কে রাজীবের ফুফু হন। তবে খুলনায় আসার পর এই মহিলা আরুশিকে একদম নিজের আপন করে নিয়েছে। তার কারণেই আরুশির আর নিজেকে একা মনে হয়নি।

তার মায়ের অভাবও পূরণ করেছে এই মহিলা। ভীষণ সরল মনের এই নারীর জীবনে একটা দুঃখের কাহিনিও আছে যা রাজীবের কাছে শুনেছে আরুশি। ভালোবেসে নাকি পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন আতিকা বেগম। শুরুর দিকে সুখে থাকলেও ধীরে ধীরে নিজের ভালোবাসার মানুষটার পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তিনি। পরিস্থিতি আরো খারাপ রূপ নেয়, যখন আতিকা বেগমের কাছ থেকে যৌতুকের দাবিতে তার গায়ে হাত তোলা হয়। এরকমই সময় নাকি আতিকা বেগম প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েন৷ তখন তিনি ভেবেছিলেন এবার হয়তো সুখের দেখা পাবেন৷ কিন্তু বিধি-বাম। সন্তান জন্মের পরই তার জীবনে সবথেকে বড় আঘাতটা নেমে আসে। যৌতুক না পাওয়ায় আতিকা বেগমের শ্বশুর বাড়ির লোক এমনকি তার স্বামী এতোটাই লোভী হয়ে পড়েছিল যে জন্মের পরপরই নাকি তারা আতিকা বেগমের সদ্যজাত সন্তানকে বিক্রি করে দেন! আতিকা বেগম এই খবরটা জেনে পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। তারপর থেকে নাকি নিজের সন্তানকে অনেক খুঁজেছেন কিন্তু তার কোন সন্ধান পান নি। তার স্বামীর সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। জীবনে আর কখনো বিয়ের বন্ধনেও জড়ান নি। তার স্বামী ও তার পরিবারের পরবর্তীতে জেলও হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কখনো মাতৃত্বের সুখ অনুভব করতে না পারা এই নারীটি আরুশিকে প্র‍থম দেখাতেই তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল৷ আরুশিরও তখন মনে হয়েছিল ইনি তার কত জন্মের আপনজন। তাই তো তাকে আম্মা বলে ডাকে।
এসব চিন্তা থেকে বের হয়ে আরুশি অমলিন হেসে বলে,”হ্যাঁ, আম্মা। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি খেয়ে নিয়েছি।”
“বাহ, ভালো। এখন তুমি কেমন বোধ করছ? শোন, এই প্রেগ্যান্সির সময়টা কিন্তু খুব জটিল হয়। এই সময় আমাদের শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন আসে। এই সময়ই তো আমাদের আপনজনের সবথেকে বেশি প্রয়োজন। অথচ তোমায় দেখ..এই কঠিন সময়ে তোমার কোন আপনজন তোমার পাশে নেই।”

আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কোন ব্যাপার না, আম্মা। আমি নিজেকে এভাবেই মানিয়ে নিয়েছি। আমার আর কারো প্রয়োজন নেই৷ আপনি আছেন, রাজীব ভাইয়া আছেন আপনারাই তো এখন আমার পরিবার। আর বাকি রইলো আমার সন্তান, ওর জন্য আমি একাই যথেষ্ট। আমিই ওর পরিবার হবো৷ নিজের সন্তানের জন্য হলেও যে আমায় ভালো থাকতে হবে। তবে আমি জানি, আমার বেবি অনেক স্ট্রং হবে। ওকে যে অনেক ম্যাচিউরও হতে হবে।”
“তুমি কি কখনো নিজের পরিবারের কাছে ফিরবে না আরু মা? বিশেষ করে তোমার স্বামীর কাছে৷ সে তো বোধহয় জানেই না যে তার সন্তান পৃথিবীতে আসতে চলেছে। আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝি কিন্তু মাঝে মাঝে যে তার জন্যও বড্ড খারাপ লাগে।”

আরহামের ব্যাপারে শোনামাত্রই আরুশির চোয়াল শক্ত হয়। মনে পড়ে যায় তার বলা কথাগুলো। অতঃপর সে বলে,”আমার স্বামীর কাছে সবকিছু আছে৷ এতদিনে হয়তো সে নিজের বাবার পছন্দমতো নতুন একটা সংসারও শুরু করেছে। কিন্তু আমার কাছে যে, আমার এই সন্তান ছাড়া আর কেউ নেই। যেকোনমূল্যেই আমি ওকে নিজের থেকে দূরে যেতে দেবো না।”
“কিন্তু সেও তো বাবা। নিজের সন্তানের কথা জানার অধিকার তো তারো আছে।”
“কিসের বাবা? যে নিজের স্ত্রীর কঠিন সময়ে তার পাশে থাকে না তার ব্যাপারে আমি মোটেই ভাবব না। সে তো খুব ড্যাড, ড্যাড করছিল৷ এখন নিজের ড্যাডকে নিয়েই থাকুক। আমি ঐ টক্সিক পরিবেশে নিজের সন্তানকে বড় করে ওর শৈশব নষ্ট হতে দেব না। আমি চাই, আমার সন্তান একটা সুস্থ পরিবেশে বড় হোক। তবে হ্যাঁ, আমি তো ঢাকায় আবার ফিরবোই৷ নিজের আম্মু-পাপাকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে। কিন্তু সেটা এখনই না। যখন আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হবে ঠিক তখনই।”

আরহাম নিজের রুমে বসে বসে নিজের আর আরুশির বিয়ের ছবিগুলো দেখছিল। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো আরুশির ফটোফ্রেমের উপর। সে আরুশির ছবির উপর হাত বুলিয়ে বললো,”কেন আরুশি কেন? কেন এভাবে আমায় একা ফেলে চলে গেলে? আমি কি তোমায় খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম? আমায় কি একটা সুযোগ দেওয়া যেত না নিজের ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার?”
এরমধ্যেই নিজের কাধে কারো স্পর্শ থেকে উঠে দাঁড়ায় আরহাম। নিজের মাকে দেখে চোখের জল মুছে বলে,”মম, তুমি?”

আফিফা খান মলিন হেসে বলেন,”এভাবে চোখের জল মুছে কি নিজের দুঃখগুলো তুমি লুকাতে পারবে আরহাম? পারবে না? আমি তো মা, তাই তোমার মনের দুঃখটা বুঝি।”
“কি করবো বলো, তোমাদের সবার প্রিয় আরু তো আমার দুঃখটা বুঝল না। আমায় একা রেখে চলে গেল। কোথায় গেল, সেই সম্পর্কে কোন তথ্যও দিয়ে গেল না। কোথায় খোঁজা বাদ রেখেছি ওকে? ঢাকা, সিলেট সব চুষে বেরিয়েছি। তবুও ওর কোন খোঁজ পাই নি।”
“যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তার যে কোন খোঁজ পাওয়া যায় না বাবা।”

“ও কি আর কখনো আমার জীবনে ফিরবে না মম? আমাকে কি একবারো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেবে না?”
আফিফা খান বুঝতে পারেন না নিজের ছেলের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কি বলবেন। তাই তো তিনি আরহামকে জড়িয়ে ধরেন। আরহাম মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। ২৫ বছর বয়সী যুবক যেন নিমেষেই বাচ্চা হয়ে যায়।
দরজার বাইরে থেকে মা-ছেলের এই কথোপকথনের সাক্ষী হয় আমান। তার চোখেও জল নিজের ভাইয়ের এই দুঃখ দেখে। আমান খুব ভালো করেই জানে তার ভাই কতোটা ভালোবাসে আরুশিকে। তাই তার ভাইয়ের কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পারে। আমান আনমনেই বলে,”যদি তোমার কষ্টটা লাঘব করতে পারতাম তাহলে ভীষণ খুশি হতাম ভাইয়া। কিন্তু আমার হাতে যে কিছুই নেই। তবুও চেষ্টা করব যতটা করা যায়।”

রাতে ডিনার টেবিলে বসে নির্ঝর খান খেতে খেতেই হঠাৎ আরহামের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন,”কতদিন আর এভাবে দেবদাসের মতো জীবন কাটাবে ভাবছ? যে চলে গেছে তার কথা ভাবা বন্ধ করো। ৪ মাস তো অনেক অপেক্ষা করলে। এবার জীবনে এগিয়ে যাবার কথা ভাবো। তাছাড়া তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে আরুশিকে ডিভোর্স দেবে আর মাঝখান থেকে ও নিজেই যখন চলে গেছে ভালোই হয়েছে। আমি তো আগে থেকেই সায়রাকে এই বাড়ির বউ করে আনতে চাই তাই ভাবছি….”

আরহাম হঠাৎ খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”ড্যাড..দুঃখিত। বাট এই বিষয় নিয়ে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। আমার জীবনে শুধু আরুশির অস্তিত্ব আছে। ও আমার থেকে যতোই দূরে থাকুক ও সবসময় আমার মনের কাছে থাকবে। সেই যায়গা আর কাউকে দেওয়া সম্ভব না।”
বলেই আরহাম চলে যায়। এদিকে আরহাম যেতেই আমান বলে ওঠে,”ড্যাড, তোমার যদি সায়রাকে এতোই বাড়ির বউ করে আনার ইচ্ছা হয় তাহলে আমার সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দাও।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৪

“মানে? এটা কিভাবে? সায়রা তোমার থেকে বয়সে বড়..”
“তো কি হয়েছে? বয়সে বড় হলে কি বিয়ে করা যায়না? আমি সায়রাকে পছন্দ করি আর ওকে বিয়ে করে চাই। তাছাড়া, আমার ক্যারিয়ারও সেটেল। আর কিছুদিন পর আমি উকিল হবো। তাই আপত্তির তো কোন কারণ দেখছি না।”
নির্ঝর খান দমে যান।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৬