অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৬
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি রুমে বসে গভীর ভাবে অতীতের ভাবনায় ডুবে ছিল। দীর্ঘ কত গুলো দিন সে নিজের আপন জনদের থেকে বিছিন্ন। আসার সময় কারো সাথে দেখাও করতে পারে নি৷ আপনজনের চিহ্ন বলতে তার কাছে শুধু তার পার্সে থাকা নিজের মা-বাবার ছোট্ট একটা ছবিই ছিল৷ আরুশি সেই ছবির উপর হাত বুলিয়েই বলে ওঠে,”তোমরা নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করে আছ তাই না আম্মু পাপা? আমি তোমাদের কথা দিয়েছিলাম, তোমাদের খু**নিদের উচিৎ শাস্তি দেব, তোমাদের উপর আসা মিথ্যা অভিযোগকে ভুল প্রমাণিত করব। কিন্তু আমি সেসব না করে ভীতুর মতো এখানে দূরে বসে আছি। আমার উপর তোমাদের রাগ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কি করবো বলো? আমি যে এখন মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভীষণ দূর্বল৷ এখন এই প্রেগ্যান্সির অবস্থা যেন আমাকে আরো দূর্বল করে দিয়েছে। তবে তোমরা ভেবো না, আজ হোক বা কাল সব সত্য আমি সামনে আনবোই৷ তোমাদেরকে দেয়া কথা আমি রাখবোই।”
আরুশি এসবই ভাবছিল এমন সময় আতিকা বেগম তার রুমে এসে উত্তেজিত স্বরে বলে,”আরু মা..অবশেষে আমার ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। আমি নিজের সন্তানের খোঁজ পেয়ে গেছি..”
“আরুশি তো আতিকা বেগমের মুখে এই কথা টা শুনে পুরোই অবাক হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে ওঠে,” কি? আপনি নিজের সন্তানের খোঁজ পেয়ে গেছেন? কোথায় সে?”
আতিকা বেগম আজ অনেক খুশি৷ জন্মের পর থেকে নিজের সন্তানের কোন দেখা তিনি পান নি। কারণ তার স্বামী ও নির্দয় শ্বশুর বাড়ির লোকজনও টাকার লোভে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তবে আজ তার স্বামী মৃত্যুর আগ মুহুর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে জানিয়েছেন আতিকা বেগমের সন্তানকে কোথায় বিক্রি করেছিলেন। আতিক বেগম বলেন,”আমার প্রাক্তন স্বামী আমায় জানিয়েছেন যে, উনি আমার মেয়েকে একটা শিশু পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তবে ওকে পাচার করার আগেই নাকি শিশু পাচারকারী চক্রটা ধরা পড়ে যায়৷ এরপর ঐ শিশুদের সিলেটের কোন এক অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সিলেটের নামটা শুনতেই আরুশি স্তব্ধ হয়ে যায়। চেনাজানা সেই শহর যেখানে সে বেড়ে উঠেছে। মনে পড়ে যায় নিজের আম্মু পাপার কথাও৷ তার চোখের কোণে জল আসে। আতিকা বেগম আরুশিকে কাঁদতে দেখে বলেন,”ওহ, বুঝেছি। সিলেটের কথা শুনে তোমার নিজের মা-বাবার কথা মনে পড়ে গিয়েছে তাই না? ব্যাপার না, আমিও তো তোমার মায়ের মতোই। জানো, রাজীব বলেছে ও ঐ অনাথ আশ্রমের লোকদের সাথে যোগাযোগ করবে। যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করবে যে, আমার বাচ্চাটা এখন কোথায় এবং কিভাবে আছে।”
এমন সময় রাজীব সেখানে চলে আসে। তার দৃষ্টিতে চমকের ছাপ। এসেই সে আরুশির দিকে তাকায় অন্যরকম ভাবে। যেন ঐ দৃষ্টিতে অন্যরকম এক অনুভূতি ছিল। রাজীবকে দেখামাত্রই আতিকা বেগম তার দিকে ছুটে গিয়ে বলেন,”কি হলো রাজীব? তুমি খোঁজ নিলে অনাথ আশ্রমে? কি বলল ওনারা? আমার সন্তান এখন কোথায় আছে?”
রাজীব আরুশির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার খুব কাছেই..”
আরুশি ও আতিকা বেগম দুজনেই ভীষণ অবাক হয়। আতিকা বেগম বলে ওঠেন,”মানে?”
“আমি ঐ অনাথ আশ্রমে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, আজ থেকে ২২ বছর আগে তোমার মেয়ে যখন ২ বছরের শিশু ছিল তখনই তাকে দত্তক নেয় এক দম্পত্তি। আর সেই দম্পত্তির নাম জাঈদ শেখ ও আরিশা খন্দকার..ওনারাই লিগ্যালি ওর মা-বাবা হয়ে যান। ”
কথাটা শোনামাত্রই আরুশি যেন বড় একটা ঝটকা খায়। আতিকা বেগমও আরুশির মুখে তার মা-বাবার নাম ও গল্প শুনেছেন। তাই তার কাছেও সবটা পরিস্কার হয়ে যায়। প্রবল আবেগ নিয়ে তিনি তাকান আরুশির দিকে৷ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন,”তার মানে আরু মা…”
“হ্যাঁ, ফুফু। আরুই তোমার মেয়ে..আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ফুফাতো বোন..”
আতিকা বেগম ছুটে গিয়ে আরুশিকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেন আহাজারি করে। এদিকে আরুশি একদম জমে বরফ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই তার নিজের আসল মা-বাবার প্রতি একটা ক্ষোভ ছিল যে তারা কেন আরুশিকে এভাবে একা ফেলে গেছিল অনাথ আশ্রমে। এই নিয়ে স্রষ্টার কাছে কম অভিযোগও করে নি। আরুশি ভেবেছিল যেদিন তার জন্মদাতা মা-বাবার মুখোমুখি হবে সেদিন তাদের কাছে জানতে চাইবে, “কি দোষ ছিল আমার? কেন আমায় নিজেদের থেকে আলাদা করলে।”
সে আরো ভেবেছিল নিজের আসল মাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে না তার শৈশবকে নষ্ট করার জন্য। কিন্তু আজ যখন সে নিজের আসল মাকে কাছে পেল তখন তার মনে আর কোন অভিযোগই রইল না। কি অভিযোগ দেবে সে এই জনম দুঃখিনী মহিলাকে? যিনি আজীবন নিজের সন্তানকে কাছে না পাওয়ার দুঃখে তড়পে গেছেন!
আরুশির আবেগের বাধ ভাঙল। সেও পরম মমতায় নিজের জন্মদাত্রী মাকে কাছে টেনে নিলো।
খান বাড়ি আজ আবারো উৎসবের রঙে ছেয়ে গেছে। বিয়ের সানাই বাজছে। আজ আমান ও সায়রার বিয়ে। আমানের আবদার অবশেষে মেনে নিয়েছেন তার বাবা নির্ঝর খান। সায়ন চৌধুরীও এই বিয়েতে মত দিয়েছিলেন৷ তাই বাবার বাধ্য মেয়ে সায়রাও কোন আপত্তি করে নি।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আমান ও সায়রাকে মুখোমুখি বসানো হয়৷ অতঃপর কাজি সাহেব বিয়ের দোয়া পড়তে শুরু করেন। কিছু সময়ের মধ্যেই “কবুল” নামক পবিত্র শব্দ উচ্চারণ করে তারা দুজনেই বাধা পড়ে এক পবিত্র বন্ধনে! সায়রার আজ বড্ড খুশি খুশি লাগছে তেমনটা নয়। তবে আমানের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে তার ভালো লাগছে। কোথাও না কোথাও আমানের প্রতি তার একটা ভালো লাগা ছিল। তবে বয়সে ছোট বলে সবসময় তাকে ছোট ভাইয়ের মতোই ট্রিট করে গেছে সায়রা। এজন্য কখনো অন্যভাবে ভেবে দেখে নি। তবে আজ বিয়েটা সম্পন্ন হবার পর তার কেমন জানি অন্য রকম এক অনুভূতি হচ্ছে আমানকে নিয়ে।
আফিফা খান নিজের ছেলেকে খুশি দেখে কিছুটা স্বস্তি পান৷ কিন্তু তার পাশেই দাঁড়ানো বড় ছেলে আরহামের চোখে দুঃখের চিহ্ন যেন তার স্বস্তি মলিন করে দেয়। আফিফা খান আরহামের কাধে হাত রাখেন। আরহাম নিজের চোখের জল মুছে বলে,”এভাবেই একদিন আমি ও আরুশিও বিয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিলাম। শুরুতে কত সমস্যা তারপর একদিন আমাদের মাঝে সব ঠিক হলো। এক বছর কত আনন্দে সংসার করলাম। একসাথে কত স্বপ্ন সাজালাম। জানো মম, আমরা প্ল্যান করছিলাম খুব শীঘ্রই একটা বেবি নেয়ার..কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল..আরুশি আজ কোথায় আছে কেমন আছে কিছুই আমি জানি না।”
“এতটা চিন্তা করিও না আরহাম। ভরসা রাখো, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় একদিন সব ব্যথা সারিয়ে দেবে।”
“কিন্তু আমি যে আর পারছি না মম। আরুশি কি আর সত্যিই কখনো আমার জীবনে ফিরবে না?”
এমন সময় নিঝুম খান সেখানে এসে বলেন,”অবশ্যই ফিরবে দাদুভাই। তোমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তাহলে আরুশিকে একদিন না একদিন তোমার কাছে ফিরতেই হবে। নিজের ভালোবাসা উপর ভরসা রাখো। আমার এবং তোমার দাদার জীবনেও অনেক দীর্ঘ বিচ্ছেদ ছিল তবুও শেষ অব্দি আমরা এক হয়েছিলাম। তোমাদের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই তেমনি হবে। এখনই এতোটা ভেঙে পড়ো না।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৫
সবার কথা শুনে আরহাম একটু আশায় বুক বাধে। যে সময় হয়তো সত্যিই সব ঠিক করে দেবে। আরুশিকে হয়তোবা আবারো সে ফিরে পাবে। কিন্তু এই অপেক্ষার পালা আর কত দীর্ঘ হবে?