অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪০
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি মন খারাপ করে ঘরে বসে ছিল। এমন সময় হঠাৎ জাঈদ এসে আরুশিকে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলে,”তুমি কি মন খারাপ করে আছ মাম্মা? প্লিজ আমার উপর রেগে থেকো না। আমি কথা দিচ্ছি, আমি আর নিজের পাপার ব্যাপারে কখনো জানতে চাইব না৷ তবুও প্লিজ তুমি এভাবে রেগে থেকো না।”
আরুশি নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”ধুর বোকা! মাম্মা কি তার জাঈদ সোনার উপর রাগ করে থাকতে পারে? তোমাকে দেখলেই যে আমার নিজের পাপার কথা মনে পড়ে যায়। তখন আমি আর রাগ করে থাকতেই পারি না।”
কথাটা বলেই আরুশি জাঈদকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে অতীতে আরিশা ও জাঈদ শেখের সাথে কাটানো সময় মনে করে বলে,”তোমাদের আমি ভীষণ মিস করি আম্মু, পাপা। তোমরা যেখানেই থাকো অনেক ভালো থাকে।”
আমিনা একদম গাল ফুলিয়ে বসে আছে। যবে থেকে সে শুনেছে তার বড় আব্বু খুলনায় যাবে তখন থেকে সে জেদ ধরে বসে আছে যে সেও খুলনায় যাবে। সায়রা তাকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে মানতেই চাচ্ছে না। সায়রা বলে,”আমিনা, এভাবে জেদ করে না৷ তোর বড় আব্বু খুলনায় একটা কাজে যাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করো।”
“না, না, না আমি কিচ্ছু বুজব না। আমিও কুলনায় যাব। ওকানে ছুন্দরবনে হালুম মামা আছে..আমি বইয়ে পড়েছি। আমাকে ওকানে নিয়ে যেতেই হবে৷ আমি হালুম মামা দেখব।”
“হালুম বাবা তো কামড় দেয়!”
“না, হালুম মামা কামড় নেয় না। আমি জানি, আমি যাবো মানে যাবোই..”
এমন সময় আমান সেখানে এসে বলে,”কি হয়েছে? তোমাদের মা-মেয়ের মধ্যে আবার কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে?”
“আর বলো না তো..তোমার মেয়ের জেদের কাছে এবার বুঝি আমায় হার মানতেই হবে। ভাইয়া তার অফিসের একটা প্রজেক্টের কাজে খুলনায় যাচ্ছে। সেটা শুনেই তোমার মেয়ে জেদ ধরেছে যে ও খুলনায় যাবে।”
আমান হেসে বলে,”ভালোই তো। যাবে অসুবিধা কি!”
“মানে? একেই নাচুনী বুড়ি তার উপর তুমি আবার ঢোলের বাড়ি দিচ্ছ! এই একরত্তি মেয়েকে একা একা তুমি খুলনায় পাঠাবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“একা একা কেন পাঠাতে যাব? চলো, তুমি আর আমিও গিয়ে খুলনা থেকে ঘুরে আসি। এমনিতেও আমিনার জন্মের পর সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় নি।”
“তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ৷ তাহলে সবাই মিলে ঘুরতে যাই, কি বলো?”
“হুম। আমি ভাইয়াকে অলরেডি বলেছি কথাটা। ভাইয়া রাজিও হয়ে গেছেন। এখন সবাই মিলে চালো…চালো।”
আরহাম নিজের ঘরে বসে বসে খুলনায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় আফিফা খান এসে আরহামের কাধে হাত রেখে বলে,”খুলনায় গিয়েও কি ওকে খুঁজে বেড়াবে নাকি?”
আরহাম মলিন হেসে বলে,”এ আর নতুন কি মম? তুমি তো জানোই এই ৫ বছরে আমি যেখানেই যাই না কেন ঐ ১ জনকেই শুধু খুঁজে বেরিয়েছি সব খানে৷ কিন্তু জানি না সস কোথায় আছে, কোথাও তার খোঁজ পাই নি। আজকের এই আধুনিক যুগেও কি কেউ এভাবে হারিয়ে যায়?”
বলেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরহাম। আফিফা খান বলেন,”চিন্তা করিও না। তোমার ভালোবাসা সত্য হলে তুমি তার খোঁজ পাবেই।”
“সেই আশাতেই তো আছি। দেখা যাক, কি হয়।”
“সবসময় আশাবাদী থাকবে৷ আল্লাহ তাহলে তোমায় নিরাশ করবে না।”
“আমিও যে নিরাশ হতে চাই না মম।”
২ দিন পর,
আরুশি নিজের চেম্বারে বসে ছিল৷ আজ রাজীবের ডিউটি আছে সুন্দরবনের কাছে। এজন্য আরুশি বলেছিল সে জাঈদকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে কিন্তু হঠাৎ একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে আর যেতে পারে নি। তাই তো বাধ্য হয়ে রাজীবই জাঈদকে সাথে নিয়ে নিজের ডিউটিতে গেছে। আরুশির তাই সব মিলিয়ে একটু ভয় কাজ করছে। সে রাজীবকে ফোন করে। রাজীব ফোনটা রিসিভ করতেই আরুশি বলে ওঠে,”হ্যালো, রাজীব ভাই। তুমি জাঈদকে নিজের সাথে নিয়ে গেছ? ও কি খুব বেশি দুষ্টুমি করছে? তোমায় অনেক সমস্যায় ফেললাম তাই না?”
“আরে মোটেই তেমন না৷ জাঈদ তো একদম ভদ্র শান্ত বাচ্চার মতো বসে আছে। আমায় মোটেই কোন ডিস্টার্ব করছে না। তুমি একটু বেশিই চিন্তা করো আরু। আমি সব সামলে নেব।”
বলেই রাজীব ফোন রেখে দেয়। মূলত সুন্দরবনের পাশেই একটি নতুন সফটওয়্যার প্রজেক্ট স্থাপন করা হবে। সুন্দরবনে কিছু চোরাকারবারি সুন্দরী গাছ এবং বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে অবৈধভাবে। এসবের উপর নজরদারি করতেই গোটা বনজুড়ে একটা নতুন ধরনের প্রযুক্তি বসানো হবে যা এমন কোন অনৈতিক কাজ ঘটলেই বন কর্মকর্তাদের কাছে সংকেত পাঠাবে।
এই প্রজেক্টের কাজের জন্য দেশের নানা অংশ থেকে নানান গণ্যমান্য ব্যক্তি আসছে। যেহেতু এই প্রজেক্টটি অনেকের স্বার্থে আঘাত আনবে তাই নিরাপত্তার জন্য এখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজীব এই কারণেই মূলত এখানে এসেছে পাহাড়া দিতে। আর জাঈদকেও নিয়ে আসতে হয়েছে। জাঈদকে রাজীব নিয়ে এসেই গাড়িতে একটু বসে থাকতে বলল।
“শোনো, তুমি এখন ভদ্র বাচ্চার মতো এখানে বসে থাকো। আমি একটু পর এসে তোমায় নিয়ে যাব।”
জাঈদ মাথা নাড়িয়ে বলে,”আচ্ছা, ভালো আঙ্কেল। তুমি কোন চিন্তা করো না৷ আমি এখানেই থাকব।”
রাজীব নিশ্চিত হয়ে বিদায় নেন। এদিকে জাঈদ বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিল। তার মতো চঞ্চল ছেলের পক্ষে কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা সম্ভব? জাঈদ খেয়াল করল রাজীব গাড়িটা লক করে নি৷ এটা দেখে সে খুশি হয়ে ভাবল,”ভালো আঙ্কেলের আসতে তো এখনো অনেক দেরি। আমি একটা কাজ করি একটু আশেপাশে ঘুরে আসি। বেশি দূর যাবো না। এভাবে আর কত বসে থাকি।”
বলেই জাঈদ গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে একটু হেটে দেখে। খুশি হয়ে বলে,”বাহ,কত্ত লোক এসেছে।”
জাঈদ খুশি হয় এত মানুষের আগমন দেখে। এমন সময় হঠাৎ করে সে দেখে দূরেই বিভিন্ন বাচ্চাদের খেলাধুলা করার নানান সামগ্রী। এটা দেখে জাঈদ খুব খুশি হয়ে দৌড়ে সেদিকে যেতে নেয়। একটু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ করে জাঈদ পা ফসকে পড়ে যেতে ধরে এমন সময় দুটি বলিষ্ঠ হাত জাঈদকে আগলে নেয়। জাঈদ চোখ বন্ধ করে বলে ওঠে,”মাম্মা..”
“তোমার লাগে নি তো বাচ্চা?”
হঠাৎ করে একটা স্নেহভরা কন্ঠস্বর শুনে জাঈদ চোখ মেলে তাকায়। নিজের সামনে এক অচেনা মানুষকে দেখে সামান্য ভড়কে যায়। এদিকে আরহাম জাঈদকে ধরে আছে পরম আবেশে। যেন ছেলেটা তার খুব কাছের কেউ।
” তুমি এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন? আরেকটু হলে তো পড়ে যেতে।”
জাঈদ উত্তর দেয়,”কিন্তু পড়ে যাই নি তো। তার আগেই তো তুমি স্পাইডারম্যানের মতো উড়ে এসে আমায় বাঁচিয়ে নিলে।”
“বাহ, তুমি তো খুব সুন্দর কথা বলো। এত সুন্দর কথা বলতে তোমায় কে শিখিয়েছে।”
“কেউ শেখায় নি। আমি নিজে নিজে শিখেছি। আফটার অল, আমি হলাম ওয়াল্ডের সবথেকে স্মার্ট মাম্মার সবথেকে স্মার্ট বয়।”
জাঈদের এমন পাকা পাকা কথা শুনে তো আরহাম হাসি আটকে রাখতেই পারে না। তার উপর জাঈদকে দেখে তার কেন জানি ভীষণ আপন আপন বোধ হয়। কিন্তু ছেলেটার সাথে তার এই প্রথম দেখা। আরহাম বুঝতে পারে না কেন তাকে এত আপন লাগছে। তাই তো সে জিজ্ঞেস করে,”তুমি একা এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন? তোমার মাম্মা-পাপা কই?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৯
“মাম্মা তো তার চেম্বারে গেছে আর পাপা..”
জাঈদের মুখটা মলিন হয়ে যায়।
“তোমার পাপা?”
এমন সময় রাজীব সেখানে এসে বলে,”জাঈদ তুমি এখানে। তোমাকে আমি বললাম না কোথাও না যেতে আর তুমি..”
বলতে বলতেই আরহামকে দেখে থেমে যায় রাজীব। আরহামের অবস্থাও ঠিক একই। দুজনেই হতবাক চোখে একে অপরকে দেখছে।