অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি জাঈদকে ঘুম পাড়িয়ে সবেমাত্র খেতে বসেছে এমন সময় তার ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। আরুশি ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে একজন বলে উঠল,”নিজের মা-বাবার আসল খুনি পর্যন্ত পৌঁছাতে চান?”
কথাটা শুনেই আরুশি আতকে উঠল। হতবাক স্বরে বলল,”কে আপনি?”
“সেটা আপনার না জানলেও হবে। আপাতত আপনার ফোনে একটা ভিডিও পাঠিয়ে দিচ্ছি, এই ভিডিওটা কিছু সময়ের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়ে যাবে..এছাড়াও কিছু ডকুমেন্টসও পাঠিয়ে দিচ্ছি। আশা করি, এসব ঠিকভাবে কাজে লাগাবে।”

কথাটুকু বলে আরুশিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দেন আব্দুল মান্না৷ অতঃপর হেসে বলেন,”এই ঈশান কবীর আর আদৃতার জন্য এতদিন আমি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কোন উন্নতি করতে পারি নি। এবার এদের অপকর্ম সামনে এলে দল থেকে এরা বিতাড়িত হবে আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি হয়ে উঠব দলের সর্বসর্বা।”
আরুশি অপেক্ষা করতে থাকে। লোকটার বলা কথা এখনো তার কানে ভাসছে। আরুশি বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“লোকটা কি সত্যিই বলছিল নাকি এটা কোন ট্রাপ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এরমাঝেই তার হোয়াটসঅ্যাপে হঠাৎ একটি ম্যাসেজ আসে। আরুশি ম্যাসেজটা সিন করেই অবাক হয়ে যায়। সেখানে প্রথম একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, এটা অনেক আগের একটি সিসিটিভি ফুটেজ। যা হয়তো এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর এমন সময় একটা গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিল। বৃষ্টির ছবি দেখেছে আরুশি তাই সহজেই চিনে ফেলল। গাড়িতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন মহিলা বসে আছে৷ আরুশি ছবিটা জুম করতেই দেখতে পেল মহিলাটা আসলে আদৃতাই!
আরুশি অবাক হলো না। কারণ সে জানত আসল সত্য এটাই। তবে সে অবাক হলো এটা ভেবে যে, এতদিন এই প্রমাণ কিভাবে লুকিয়ে রাখা হলো। এরপর আরুশি পরবর্তী ভিডিও দেখল, যেখানে আদৃতা বলছে,”আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাঈদ শেখের এবার ভোটে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু সেটা হতে দেয়া যাবে না। ঈশানকে আবারো এমপি নির্বাচিত হতে হলে জাঈদ শেখকে আমাদের পথ থেকে সরাতে হবে।”
তখন তার একজন অনুগত কর্মচারী বলে ওঠে,”কিন্তু সেটা কিভাবে?”

“জাঈদ শেখের দলের মধ্যে তো আমাদেরও কিছু লোক লুকিয়ে আছে৷ তাদের বলো, কোনভাবে ঝামেলা তৈরি করতে। শুনলাম, কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে বেশ একটা দ্বন্দ দেখা দিয়েছে। এই বিষয়টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করো। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করো যাতে সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমাদের দলের লোক ঢুকে গিয়ে গোপনে ঐ জাঈদ শেখকে শেষ করে দিতে পারে। আর কোন সন্দেহও আমাদের উপর এসে না পড়ে।”
ভিডিওটা দেখার পরই আরুশি ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,”আমাদের পাপা আর আম্মুর মৃত্যুর পেছনেও তাহল এই মহিলার হাত আছে! ওনাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।”
এরমধ্যে সেখানে কিছু ফাইল ও ছবি দেখে আরুশি যেখানে দেখা যাচ্ছে, আদৃতার ঠিক করে রাখা লোকেরাই জাঈদ শেখের পার্টি অফিসে বোমা রেখে এসেছিল, যা বিস্ফোরিত হয়ে জাঈদ শেখ-আরিশা খন্দকার সহ আরো অনেকের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে পুলিশদের ঘুষ খাইয়ে এটাকে বৈদ্যুতিক শর্ট শার্কিট ও ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেইসের মোড় ঘোড়ানো হয়।

সবকিছু দেখে আরুশির চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। এমন সময় আরহাম এসে বলে,”আরুশি কি হয়েছে তোমার? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন?”
আরুশি এই সমস্ত কিছু আরহামকেও দেখায়, আরহামও হতবাক হয়ে যায়। হতাশ স্বরে বলে,”এসবের মানে কি? এত নিখুঁত পরিকল্পনা! এই মহিলা এভাবে সবকিছু শেষ করে দিল।”
আরুশি বলে,”মানুষের পরিকল্পনা যতোটাই ভয়ানক হোক তাতে কিছু না কিছু খুঁত থাকেই। আল্লাহর পরিকল্পনাই আসল। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আজ সব সত্য সবার সামনে এসেছে। আর কেউ আমার আম্মু-পাপাকে খুনি বলতে পারবে না। গোটা দেশের মানুষ আজ সত্যটা জানবে। আর ঐ আদৃতা নামক পাপীষ্ঠা মহিলা নিজের অপকর্মের শাস্তি পাবে।”

আদৃতার সব অপকর্মের ভিডিও রাতারাতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। চারিদিকে শোরগোল পড়ে যায়। আদৃতা যে সিলেটে নিজের বাসায় ছিল এসব দেখে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তার স্বামী ঈশান কবীর বলেন,”এখন তুমি কি করবে আদৃতা?”
“আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমি হারতে পারি না। তুমি একটা কাজ করো, গোপনে আমাকে সিলেটের সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমাকে ভারতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে হবে।”
“আচ্ছা, আমি দেখছি।”

বলেই ঈশান কবীর কারো একটা সাথে কথা বলে আদৃতাকে বলে,”বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমার লোক একটু দূরেই আছে। ওরা তোমায় সেফট এক্সিটের ব্যবস্থা করে দেবে।”
আদৃতা হাফ ছেড়ে বাঁচে। অতঃপর দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে বের হবার চেষ্টা করে। কিন্তু দরজা খোলামাত্রই অবাক হয়ে যায়। কারণ পুলিশ যেন সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে। আদৃতাকে দেখামাত্রই একজন পুলিশ অফিসার বাকা হেসে বলেন,”আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। কি ভেবেছিলেন এত জঘন্য জঘন্য অপরাধ করে এত সহজে পালিয়ে যাবেন? তা হবার নয় মিসেস কবীর। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।”
আদৃতার কাছে আজ আর পালানোর পথ ছিল না। তার সব অপকর্ম আজ সবার সামনে। পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। অবশেষে আদৃতাকে টানতে টানতে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। অপরাধীকে যে ত্র অপরাধের শাস্তি একদিন না একদিন পেতেই হয় তা আজ আবার প্রমাণিত হলো।

অন্য আর বাকি সবার মতো নির্ঝর খানও সমস্ত সত্যটা জানলেন। তার বুকে এতদিন যে চাপা কষ্ট ছিল তা যেন আজ আরো বেশি প্রকট হলো। অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। বিনা দোষে তিনি এতদিন আরুশি, আরহামের জীবনটা এলোমেলো করে রেখেছিলেন। তার মস্তিষ্ক আর এই চাপ নিতে পারল না। বুকে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লেন তিনি। নিজের অপকর্মের জন্য এই মানসিক যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। কিছু সময়ের মধ্যে তিনি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জীবনের শেষ মুহুর্তগুলো গুণতে থাকেন। অথচ নিয়তির নির্মম পরিহাসে জীবনের শেষ মুহুর্তেই তার স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনী কেউ তার পাশে নেই। সবই যেন তার কর্মফল। সারাজীবন যে ইগো তিনি বয়ে বেরিয়েছেন সেই ইগোই যেন তাকে আজ শেষ সময়ে তার আপনজনের থেকে বিছিন্ন করে দিল। ধীরে ধীরে নির্ঝর খানের শ্বাস কমে এলো। জীবনের সুন্দর স্মৃতি বলতে মায়ের সাথে সুন্দর শৈশব, আফিফার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো, নিজের দুই ছেলের জন্ম, নাতনী আমিনার সঙ্গ এসবই বারবার ভেসে উঠছিল সামনে। তারপর এক নিমেষে চারিপাশটা থেমে গেল, অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। ঘোর একাকীত্ব নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নির্ঝর খান!

আরহামের ছোট্ট ফ্লাটে তখন চলছিল উৎসবের আমেজ। আমান, সায়রা, আমিনা, রাজীব সবাই আজ এসেছিল এখানে। রাজীব বলে,”এতদিনে তাহলে সব সত্য সামনে এলো। যদিও আমাদের তদন্তের জন্য নয় তবে যেভাবেই হোক সব সত্য সামনে এসেছে৷ আসল অপরাধী শাস্তি পেয়েছে এতেই আমি খুশি।”
সায়রা ও আমান হেসে একে অপরের দিকে তাকায়। আমান বলে,”একইদিনে দু দুটি খুশির খবর পেলাম আমরা।”
আফিফা খান জিজ্ঞেস করেন,”দুটি খুশির খবর মানে?”
সায়রা হাস্যজ্বল ভাবে বলে,”আমাদের মায়ের খু-নি আজ তার অপরাধের শাস্তি পেয়েছ..অন্যদিকে আমার ও আমানের সংসারে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।”
বলেই সে নিজের পেটে হাত বুলায়। আফিফা খান খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলেন,”আমি জানতাম, আল্লাহ আবার আমার পরিবারকে সুখে মুড়িয়ে দেবেন। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া, এখন চলো সবাই মিলে আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে যাই। সেখানে গিয়ে আনন্দ করি।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৭

আরহাম ও আরুশি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। আফিফা খান তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন,”নির্ঝর হয়তো এবার নিজের ভুল বুঝতে পারবে। আমি তোমাদের ওকে ক্ষমা করতে বলবো না তবে..আমরা তো একই পরিবার। তাই কতদিন আর আলাদা থাকব? তোমাদের দাদীর কথাও ভাবো।”
আরুশি বলে,”বেশ চলুন, আজ জাঈদেরও ওর বাড়িতে গৃহপ্রবেশ ঘটবে। আমিও পুরাতন কোন রাগ, ক্ষোভ জমিয়ে রাখতে চাই না।”
এরপর সবাই মিলে রওনা হয়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৯