অশ্রুবন্দি পর্ব ১৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সৃজা হতবাক, স্তব্ধ! বেহেড ইহসান ওর ঠোঁটে লেগে থাকা তিরামিসু চেটে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আই ওয়ান্ট টু বি ইয়োর তিরামিসু।”
ছটফট করতে করতে চোখের মণি লাল হয়ে উঠল ইহসানের। শরীরের উত্তপ্ততা শিরশিরে অনুভূতি কাঁপিয়ে দিলো সৃজাকে। হাতদুটো আঁকড়ে ধরে কোমল আঙ্গুলে সময় নিয়ে চুমু খেল, জড়ানো স্বরে বলে উঠল,
“ইউ’য়্যার সুইটার দ্যান দ্য সুইটেস্ট তিরামিসু, বেইব…”
সৃজা চেষ্টা করল ওকে থামাতে। গাল ধরে মুখ আগলে নিয়ে ইহসানের চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে অসন্তুষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল,
“কখন খেয়েছ এসব, কেন খেলে?”
ইহসান কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল,
“বিদেশি এক ক্লায়েন্ট নিয়ে এসেছিল। খেতে চাইনি, কিন্তু শ’য়’তান ধরেছিল বলে টেস্ট করে ফেলেছি, এখন সব কেমন তুই তুই লাগছে…”
সৃজা রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
“আর কখনো খাবে না, এসব হারাম…”
“শ’য়’তান মাথায় নৃত্য করছে, তোকে একটু আদর করি, কাছে আয়…”
সৃজা মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
“এখান এসব ঠিক হচ্ছে না, ছাড়ো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইহিসানের বোধশক্তি তেমন একটা কাজ করছে না, তাই সৃজার বারণ মানতে চাইল না সে। বরং শার্ট খোলার চেষ্টা করল ব্যস্ত হাতে। উপরের বোতামে হাত দিতেই সৃজা চমকে গেল। মাথার ভেতরটা পাক দিয়ে উঠল। লোকটা সুস্থ মস্তিষ্কে থাকলে সৃজা হয়তো আজ সত্যিই বাঁধা দিতো না, কিন্তু মাতাল অবস্থায় এত কাছে, তাও এইখানে, এই লাউঞ্জে? সৃজা ওকে শান্ত করানোর জন্য রাগ চাপা দিয়ে ইহসানের বোতাম খুলতে থাকা ব্যস্ত হাতটা টেনে, নিজের মুঠোয় নিয়ে ছোট করে চুমু দিলো। নরম হয়ে বলল,
“সেদিনই তো বললে আমাকে সময় দেবে, আমাকে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াবে। তো এখন কি মত পাল্টে ফেলেছ? প্রেমে হাবুডুবু না খাইয়েই আমার কাছে আসতে চাও–তাও এই লাউঞ্জে, এতটা পাগলামি মানায় তোমায়?”
ইহসান ওর কথা শুনে আচমকা ব্যাকুল হয়ে উঠল,
“আমি তো কবেই তোর প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি,
তোর এত সময় লাগছে কেন?”
সৃজা ওর দিকে বড়বড় চোখ করে চাইল। মজার সুরে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি আমার প্রেমে পড়েছ? কই জানি না তো! কখন, কীভাবে?”
ইহসান ছটফটে গলায় বলে উঠল,
“তুই কলেজ ফাংশনে প্রথম যেদিন শাড়ি পরে গেলি, উম… না না…তারও আগে থেকে! ঐ যে একদিন আমার শার্ট ধরে কান্না করছিলি, সেদিন থেকে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল তোর চোখের সব পানি শুষে নেই, কিন্তু তুই ব্যাপারটা ভালোভাবে নিবি না তাই করতে পারিনি…”
সৃজা অবাক ও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাতাল অবস্থায় মনের কথা বলে দেওয়া ইহসানের দিকে। মানসপটে ভেসে উঠল বহুদিন আগের কথা। জানুয়ারি মাসের এক শুক্রবার! সৃজা জমে থাকা আধোয়া জামাকাপড় ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়ে এসেছিল। বিকেলে সেগুলোই আনতে ছাদে গিয়েছিল এলিজা, নামার সময় বেখেয়ালে একটা ওড়নায় পা পড়ায় সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল! বোনের অবস্থা দেখে সৃজা ইহসানের শার্ট খামচে ধরে সেদিন এতটাই কান্নাকাটি করেছিল যে এলিজা পর্যন্ত ভড়কে গেছিল। কারণ সে নিজেও এতটা কাঁদেনি। নীলু বেগম ভালোমন্দ রান্না করেছিলেন বলে ইহসানকে দুপুরে খেতে ডেকেছিলেন, সে গেছিল। কিন্তু বিকেলে পাকোড়া বানানো হবে বলে লাঞ্চের পর আর যেতে দেননি
ওকে নীলু বেগম, জোর করে রেখে দিয়েছিলেন।
তাই এলিজার দুর্ঘটনার সময়টাতে সে ওদের
বাড়িতেই ছিল। ফার্স্ট এইড দিয়ে ইহসানই এলিজাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল সেদিন। প্রায় বছর সাতেক আগের কথা! ইহসান কী সেই দিনটার কথা বলছে? সৃজা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এতগুলো দিন লোকটা ওকে মনে পুষে রেখেছে, অথচ কখনো টেরই পায়নি সে! তার মানে, লিথুটিথুকে বিয়ে করবে না বলে নয়, সৃজার প্রতি প্রেমের অনুভূতি ছিল বলেই কি ওকে জীবনে জড়িয়েছে? সৃজা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ইহসানের প্রতি।
”তুমি কী সেদিনের কথা বলছ, যেদিন এলিজা মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল?”
ইহসান বাধ্য ছেলের ন্যায় মাথা নাড়ল,
“হু, সেদিনই।”
সৃজার বুকের ভেতরটা অদ্ভুত শীতলতায় শিরশির করে উঠল। বিবশ গলায় বলে উঠল,
“কখনো বলোনি তো, বুঝতেও দাওনি।”
“প্রেমে পড়লে সবসময় তা মুখে বলে দিতে হয় না; কখনো কখনো চুপ থাকাটাই সবচেয়ে বড় প্রকাশ।
তখন সময়টা অন্যরকম ছিল, তোর বয়সটা আবেগপূর্ণ ছিল। তাছাড়া প্রেম-ভালোবাসা বুঝতে দিলে তোকে হয়তো আমার আগেই অন্য কেউ নিজের করে নিতো…”
কথাগুলো যদিও বিক্ষিপ্ত, অস্বাভাবিক তবুও সৃজা বুঝে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর দিকে, নিম্ন স্বরে শুধাল,
“প্রেমে পড়েছ, ভালোবাসোনি?”
ইহসান একপলক দেখে নিলো আকুতিভরা চেহারাটা। আঙুল বুলিয়ে দিলো ওষ্ঠ ভাঁজে। মাদকপূর্ণ কণ্ঠে আওড়াল,
“তোকে…কে না ভালোবাসে?”
বলে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। জবাবটা ঠিকঠাক না পেয়ে সৃজা ইহসানের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল, আরো কিছু শোনার আশায়। যে কথাগুলো স্বাভাবিক থাকলে বলে না, হাসিমজার ছলে উড়িয়ে দেয় সেই কথাগুলো মত্ত অবস্থায় বলছে লোকটা। এমন সুযোগ সর্বসাকুল্যে আসে না। ছাইপাঁশ খেয়ে মাতলামো করায় সৃজা যদিও রেগে আছে ইহসানের উপর তবুও ভালোবাসার কথাগুলো শুনতে ওর মনপ্রাণ উচ্ছ্বসিত, তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে। ও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার মাঝেই ইহসান তীব্র গতিতে ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে এসে বলে,
“তোর প্রতি আমার ভালোবাসা বিশাল আকাশে মুক্ত পাখির মতো—সীমাহীন, অসীম আর শাশ্বত। তুই শুধু আমার হৃদয়ের স্পন্দন নোস, আমার আত্মার আরাধনাও। তুই ছাড়া আমি, ইহসান শেখ, এক অদৃশ্য, শূন্য সত্তা—কিছুই নই, একদম কিছুই না! নাথিং টু ডু… ফা*কিং লুজার!”
নিয়ন্ত্রণে নেই ইহসান। কথাবার্তা গভীর ও বেসামাল হচ্ছে। এখনই থামাতে হবে, নয়তো অনর্থ ঘটিয়ে ফেলবে এই অবাঞ্চিত পরিবেশে। সৃজা ঠেলে সরিয়ে দিলো ওকে। ইহসান টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল নিচে। বসে রইল ওই অবস্থায়ই। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বলল,
“ফেলে দিলি…”
সৃজা গায়ের জামাকাপড়, ওড়না ঠিকঠাক করতে করতে উঠে দাঁড়াল। মুখে এখনো অপ্রস্তুত, রাগান্বিত ও ক্ষোভের চিহ্ন লেগে আছে,
“তো কি এখন তোমাকে মাতলামি করতে দেব, এটাই ভাবছ তুমি? রাত কত হয়েছে, খেয়াল আছে? এক্ষণি বাড়ি চলো। তাছাড়া বাইরে প্যাট্রনস, স্টাফরা আছে না? কী ভাববে সবাই?”
ইহসান দু’হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।
সৃজার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে মৃদুস্বরে বলল,
“কেউ কিছু ভাববে না, বকছিস কেন?”
সৃজা ওর অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গিয়ে আগলে ধরল ওকে,
“তাহলে কী করব? উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছা না, বাড়ি ফিরব কীভাবে? কাউকে লাগবে তো তোমাকে সামলানোর জন্য, আমি একা পারব না।”
“রেস্তোরাঁ আজকের মতো ক্লোজড, সবাই চলে গেছে।”
সৃজা এ পর্যায়ে এসে বিস্মিত হলো,
“কেউ নেই?”
“উহু।”
সৃজা ওকে সোফায় বসিয়ে পাশেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। চিন্তিত হয়ে বলল,
“আল্লাহ! তোমার এই অবস্থায় একা আমি বাড়ি নিয়ে যাব কীভাবে, এখন কী হবে?”
“এখানে থাকব আজ রাত।”
বলল ইহসান জেদপূর্ণ স্বরে। সৃজা রেগে উঠে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,
“পাগল হয়েছ? অবশ্য এখন যা অবস্থা পাগলের চেয়ে কম কিছু না। দেখি, উঠে দাঁড়াতে পারবে তুমি? আমাকে ধরো তো…”
সৃজা ওর হাত নিজের কাঁধে রেখে উঠে দাঁড়াতে বলল ওকে। ইহসান রাজি হলো না, জেদী সে। আজ এখানেই থাকবে। সৃজা ওর কথা গুরুত্ব দিলো না। জোর করে টেনে তুলল। ইহসান বিরক্তি নিয়ে বলল,
“যাব না বলছি তো।”
সৃজা কঠোর কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমার কথা শুনব এটা ভাবলে ভুল করবে তুমি। বাড়ি গিয়ে বমির ট্যাবলেট খেয়ে ওসব অপবিত্র লাল পানি বের করে ঝাল তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুম দেবে, আর কোনো কথা নয়।”
অবাস্তব একটা কথা বলেছে সৃজা, অন্য কেউ শুনলে হেসে ফেলত। কিন্তু ইহসান উল্টো জেদের মতো করছিল। এলোমেলো পা জোড়া এদিকসেদিক ফেলছিল বলে সৃজার মেহনত হচ্ছিল ওকে নিয়ে। দরজা অবধি যেতেই দম ফুরিয়ে গেল ওর। ইহসানের হাতও তখন আলগা হয়ে এসেছিল। সৃজা অসহায় গলায় বলল,
“কী অবস্থা করেছ নিজের দেখেছ, প্লিজ জেদ করো না। ধরো আমাকে ঠিক করে …”
ইহসান ধরল ওকে, তবে অন্যভাবে। এক হাতে সৃজার কোমরে ধরে, অন্য হাতে টেনে কফি বারের কাঠের ফোকাল পয়েন্ট টেবিলের উপর বসিয়ে দিলো। সৃজা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। ইহসানের অস্পষ্ট চোখ গেল আধখাওয়া তিরামিসুর দিকে। দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সৃজার অর্ধেক খাওয়া অংশটা একটুখানি মুখে নিয়ে, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে, উন্মাদনা আর উত্তেজনায় ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গভীর এক চুম্বনে মত্ত হলো সে। সৃজা কিছু বলার সুযোগ পেল না, শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ করে ইহসানের উন্মত্ত চুম্বনে ডুবে গেল। সেই চুমুতে কী যে ছিল—একটু ভয়, অনুভূতি আর অনেকটা ভালোবাসার অমোঘ টান! সৃজা ভুলে গেল লাউঞ্জের উজ্জ্বল আলো, মাতাল ইহসান আর বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা! হৃদ মঞ্জিলে তোলপাড় চালানো অনুভূতি আশকারা দিয়ে ফেলল নিত্যদিন ঝগড়া করতে গিয়েও প্রেমে পড়া ঐ বিশেষ পুরুষটাকে! এক হাত দিয়ে ইহসানের আধখোলা শার্টের কলার ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো। তিরামিসুর চেয়েও মিষ্টি স্বাদের ওই মেয়েলি ওষ্ঠাধর আর তার সমর্থন — ইহসানের পৃথিবীটাকে থামিয়ে দিলো। আকাঙ্ক্ষিত
নারীটির সুকোমল ঘাড়, বাহু আর উন্মুক্ত উদরের ঊষ্ণতা তার আত্মাকে স্পর্শ করল, মাদকপূর্ণ কণ্ঠস্বরে উদরে ঠোঁট বসিয়ে বলে উঠল,
অশ্রুবন্দি পর্ব ১৬
“আই ওয়ান্ট অ্যা বেবি…”
সৃজা অবশ্য তা শুনতে পেল না। কফি বারের এক কোণে দু’জনের দেহে তৈরি হওয়া অস্থিরতা আর উন্মাদনা সেই রাতে সময়ের চেনা কাঁটাকেও উল্টে-পাল্টে দিলো