অশ্রুবন্দি পর্ব ২০
ইসরাত জাহান ফারিয়া
মাঝরাতে যে মানুষটাকে সে জ্বরাগ্রস্ত ও দুর্বল অবস্থায় বমি করে বুক ভিজিয়ে দেওয়ার পরেও লোকটা টু শব্দ না করে সবার আগে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘জান, তুমি ঠিক আছ?’
প্রতুত্তর কী হতে পারে, এক পৃথিবী মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া? আকৃষ্ট হয়ে পড়ে সৃজা। ‘তুই’ থেকে ডিরেক্ট ‘তুমি’, চোখেমুখে ফুটে উঠা আর্তনাদ চোখ এড়ায় না ওর। চেপে রাখা ব্যাকুলতা বুঝে সে টের পায় তরঙ্গ বইছে হৃদয়ে, ডুবে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে! ওই কণ্ঠস্বরের ব্যাকুলতা তখন মেরে ফেলে সৃজাকে। বিস্মিত হয় সে প্রচণ্ডভাবে,
আফসোস হয় ভীষণ! সৃজা দুর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার গায়ে বমি করে দিয়েছি, ঘৃণা হচ্ছে না?”
ইহসান অবাক ও কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে,
“আজেবাজে কথা ছাড়া আর কোনো কথা নেই তোর?
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস, পেটের খাবার সব বের করে দিচ্ছিস টেনশনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আর তুই জিজ্ঞেস করছিস আমার ঘৃণা হচ্ছে কিনা?”
সৃজা তাকিয়ে রয় দুর্বল চোখে। ইহসানের গালে হাত রাখে। ঊষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে চামড়ায়। ইহসান ওর হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে চুমু খায়,
“এভাবে তাকালে আমি পুড়ে যাই, তাকাবি না এভাবে।”
সৃজা হেসে নাক কুঁচলায়,
“গেঞ্জিটা চেঞ্জ করে ফেলো, গন্ধ লাগছে…”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইহসান চেঞ্জ করে কাপড়টা বিনে রেখে, ফ্রেশ হয়ে আবার ওর কাছে ফিরে আসে। হাতমুখ মুছিয়ে, ঔষধ খাইয়ে চাদর টেনে শুইয়ে দিয়ে ওর শিয়রে বসে জলপট্টি দিতে থাকে। ঔষধের প্রভাবে সৃজা চোখ খুলে রাখতে পারে না, তবুও সে টেনে চেয়ে থাকে। এই জীবনে যত্ন-আত্তি সে খুব কমই পেয়েছে। খুব ছোটবেলায় হঠাৎ একদিন এগুলো থেমে গেছে। দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যু, আই.সি.ইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা এলিজা, আর স্ত্রী-সন্তানের নির্মম দশায় ভেঙ্গে পড়া নাইমুর সাহেব সঠিক বিচার না পেয়ে যখন ব্রেন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন সেদিনই সৃজা বুঝে গেছিল, সবকিছুর মেয়াদ এবার ফুরোলো। আদর-যত্ন নামক স্নেহগুলো সেই ছোট্ট বয়সেই জীবন থেকে হারানোর পর ফিরে পাবার আশা করেনি কখনো, বরং দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে বাবাকে, সৃজাকে। নীলু ফুপি প্রচণ্ড ভালোবাসে ওদের,
কিন্তু সত্য তো এটাই যে, কোথাও না কোথাও কিছু ফাঁকা থেকেই যায়! তাই ইহসানের থেকে পাওয়া এসকল যত্নানুভূতি সৃজাকে টেনে নেয় অদ্ভুত মায়ায়!
পাঁচদিনের অসুস্থতার সময়টাতে সে অনুভব করেছে ইহসান শেখকে! চেয়ে চেয়ে দেখেছে লোকটার অস্থিরতা, পাগলামো আর দুশ্চিন্তা। আদর, যত্নের সাথে ভালোবাসা নামক দামী জিনিসটাও খুঁজে পেয়েছে স্বামীর দৃষ্টিতে। দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলে তাদের মধ্যে মায়া, মোহ, অনুভূতি তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না। আর সেখানে যদি একবার প্রেম ছুঁয়ে যায় তাহলে ভালোবাসা এমনিতেই হৃদকুঠুরিতে কড়া নাড়ে। সৃজার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।
সে বুঝে পায় না, মাস কয়েক আগেও যে লোকটাকে স্বপ্নেও জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারেনি, এখন সেই লোকটাকে ছাড়া নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগে, একাকিনী মনে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠার পর এই শূন্যতাটা যেন আরো বেড়েছে। সারাক্ষণ মনে হয় ইহসান তার চোখের সামনে থাকুক, তার কোলে মাথা রাখুক, দুষ্টু মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখুক পুরোটা সময়। কিন্তু দিনদিন চাওয়া-পাওয়া বাড়লেও মুখফুটে সেগুলো বলতে এখনো বড্ড সংকোচ ওর। মনের কথা বলার চেয়ে ঝগড়া করাটা ওর কাছে বেশ সহজ মনে হয়। ইহসানের অনুপস্থিতির সময়টুকুতে তার শার্টে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে নিজেকে বোঝায় সৃজা, বদ লোকটা তার মনেই আছে! মিশে গেছে তার অস্তিত্বে, ক’দিনেই। অবশ্য মিশবে না-ই বা কেন? সৃজার ইদানীং আফসোস হয় ভীষণ! গত সাতটি বছরে সে কেন টের পায়নি এই মানুষটার মনের খবর? তাহলে হয়তো শাসন-বারণের পাশাপাশি কিছু-মিছু ভালোবাসাও আদায় করে নিতে পারতো।
জ্বর থেকে সেরে উঠার পর পাঁচদিন পেরিয়েছে।
কথা সরুপ ইহসানের কাছ থেকে সৃজা বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরেছে সৃজা। ইহসান অনুমতি দেবে কি সে একদম চুপ মেরে গেল! দিনদিন সৃজার প্রতি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে সে, তাই চাইছিল না সৃজা তার কাছে থেকে দূরে থাকুক, একটা দিনের জন্যও। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলে স্বৈরাচারী আচরণ হয়ে যাবে ভেবে মুখফুটে বারণ করল না। তবে সৃজা বুঝে গেল! ইহসানের অসন্তোষ চেহারাটার দিকে তাকিয়ে ওর বুক ভার হয়ে এসেছিল!
ইহসান কোনোকিছু না বলেই শুকনো মুখে রেস্তোরাঁয় চলে এসেছে সকালে। তার মেজাজ খারাপ, বাড়িতে থাকলে প্রকাশ করে ফেলবে তাই বেরিয়ে এসেছে।
রোদ্দুরে ছেয়ে আছে চারিপাশ। বাতাস খেলা করছে গাছগাছালিতে। পুকুরে ডোবা মাছেরা খেলা করছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। স্নিগ্ধময় এক সময়। আদর আদর দুপুর! রোদে বসে ভেজা চুল শুকাতে থাকা সৃজার মন ভালো নেই। ওর বাড়ি যাওয়া নিয়ে ঘট পেকে আছে, ইহসান চাইছে আবার চাইছেও না ওকে ঐ বাড়ি যেতে দিতে। অনুমতি দিচ্ছে আবার দিচ্ছেও না। সৃজা ওর মনের ভেতর কি চলছে বুঝতে পারছে না। সকালে বাড়ি যাওয়ার কথাটা জিজ্ঞেস করতেই কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করল, সেই থেকে সৃজা অস্থির হয়ে আছে। ও কল করল ইহসানকে,
“আমি বাড়ি যাব না।”
ওপাশ থেকে ইহসানের কর্কশ সুর ভেসে আসে,
“তোর বাড়ি, তোর পরিবার। যাবি না কেন ওদের কাছে? অবশ্যই যাবি। আমি তো না করিনি, অবশ্য না করারই বা কে? তুই যাবি, আগামীকালই। দ্যাটস ফাইনাল।”
সৃজার অভিমানী কণ্ঠস্বর,
“কথার মাঝে এরকম খোঁচা মিশিয়ে অনুমতি দিচ্ছ, লাগবে না অনুমতি। আমি যাব না তোমাকে ছাড়া।”
“ঐ? আমি তোকে বেশি বেশি আদর দেই বলে আমাকে কুকুর ভাবিস? আমায় ছাড়া কেন যাবি না? শোন, আমি ইহসান শেখ ভালো মানুষ নই। তুই চিনিস না আমায়, ভালো রুপে আছি তাই থাকতে দে। খারাপটা সামনে আনলে ঘৃণা করতে বাধ্য হবি, যেটা আমি মরণেও চাই না।”
ইহসান ফোন কেটে ছুঁড়ে মারলো সোফায়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? ওহ গড! সে কেন এত উদ্ভট আচরণ করছে?ইহসান পরণের শার্টের বোতাম খুলে এসির টেম্পারেচারটা নামিয়ে দিলো আরো। মাথা এলিয়ে বসল সোফায়। ইন্টারকমে রশিদকে ডেকে পাঠাল। তক্ষনি হাজির হলো সে। ইহসান তাকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ড্রিংক্স আছে স্টকে? বিয়ার, শ্যাম্পেইন এনিথিং..”
রশিদ মাথা নেড়ে বলল,
“বিয়ার!”
ইহসান তুড়ি বাজানোর মতো করে বলল,
“সব নিয়ে আসো, ট্রাই করব…”
“আপনি তো খান না এসব..”
ইহসান চোখ লাল করে তাকাল,
“এখন থেকে খাব, রোজ! ব্যবস্থা করবে তুমি। গট ইট?”
রশিদ হা হয়ে গেল। ইহসানকে কখনোই সে এসব খেতে দেখেনি। আজ কেন? সে ভয় মনে নিয়েই কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নটা করে ফেলল,
“কিছু নিয়ে চিন্তিত স্যার?”
“হু চিন্তিত, এখন কি করবে তুমি? আমার চিন্তা দূর করে দেবে? তাহলে আসো, এসে আমার কোলে বসো। মাথায় উঠে নৃত্য করো…”
রশিদ তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমি যাই স্যার।”
একপ্রকার পগার পার হলো রশিদ। কিছুক্ষণ পর এলো বিয়ারের দুটো ক্যান নিয়ে। পিন্ট গ্লাস সাজিয়ে দিয়ে ইহসানের সামনে রাখল। এরপর একপাশে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইহসান পানি খেতে খেতে ওকে এভাবে ওয়েটারের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বিয়ার ট্রাই করবে? ট্রাই করে লাভ নেই, যখন বউয়ের বিরহে ভুগবে তখন ট্রাই করো। এখন যাও…”
রশিদ আমতাআমতা করে বলল,
“একটা খবর দেওয়ার ছিল!”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইহসান,
“কী?”
“অনিকের অবস্থা ভালো না।”
ইহসানের সাথে সাথে মনে পড়ল না,
“অনিক কে?”
“আপনার ফুপুর ছেলে, যাকে মেরে তক্তা বানিয়েছিলেন। পাজরের হাড়ে ক্ষয় ধরেছে।”
মনে পড়ল এবার। ইহসান বিস্মিত স্বরে বলল,
“ওই বাস্টার্ড, ভোগে যায়নি এখনো? আমি তো ভেবেছি তিন হাত মাটির নিচে কবেই পৌঁছে গেছে!”
ইহসানের একমাত্র, কুটনী ফুপু অনিতা বেগমের মাতাল, নেশাখোর, ইভটিজার, চাঁদাবাজ, গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে অনিক। তার ফুপাতো ভাই। খুব কম বয়সেই নষ্টামির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও কেউ তাকে আটকায়নি, বারণ করেনি কখনো কোনো অপরাধ করতে৷ আজিজ শেখ তো আরো খুশিই ছিল, এরকম সন্ত্রাসী ভাগ্নে থাকলে লোকে তাকে ভয় পাবে, সমীহ করে চলবে ভেবে। ডানহাত বানাতে চেয়েছিলেন। রাস্তাঘাটে নোংরামো করতে করতে এই শেখ বাড়িতেও আধিপত্য করার সুযোগ পেয়েছিল অনিক এই আজিজ শেখের কারণেই। আর এরই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে ক্লাস টেনে পড়া পুনমের দিকে কুনজর দিয়েছিল। পুনমের ওয়াশরুমে গোপন ক্যামেরা ফিট করে ওর গোসলের ভিডিয়ো ধারণ করেছিল।
ইহসান জানতে পেরে বেধড়ক মেরেছিল সেদিন অনিককে, কিন্তু আজিজ শেখ এসবে গা করেননি। ভাগ্নেকে অবিশ্বাস না করে পুনমকেই অবিশ্বাস করেছিলেন এবং ঝামেলা এড়াতে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শেখ বাড়িতে অনিকের আনাগোনা ছিলোই। শুধু তাই নয়, সবসময় সব ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করতো। ইহসান তাকে কস্মিনকালেও পছন্দ করতো না, সহ্য করতো না। যেমন তাদের বিয়ের দিন সন্ধ্যায় আজিজ শেখের সাথে কথা কাটাকাটির সময় বাপ-ছেলের মধ্যে নাক গলাতে এসেছিল অনিক, সৃজাকে ‘ফকিন্নির ঝি’, ‘বাজারি লোভী মেয়েছেলে’ বলেছিল। গায়ে পড়ে ওর সাথে লাগতে এসেছিল, সহ্য করতে পারেনি ইহসান। পুরোনো ক্ষোভ, ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল! অনিককে মেরে আধমরা করে হাসপাতালে পাঠিয়ে, সৃজাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে সে শপিং করতে বেরিয়েছিল। আজ প্রায় দেড় মাস অনিক হাসপাতালে ভর্তি। সেই থেকে ভয়ে ফুফু এ বাড়ি আর আসে না। কথাগুলো মনে পড়ায় ইহসান একদলা থুতু ফেলে ক্ষোভিত গলায় বলে,
“জা’নোয়ারগুলো সহজে মরে না, এটাই চিরন্তন সত্য রশিদ।”
“ঠিক বলছেন স্যার।”
“এখন যাও।”
রশিদ চলে যাওয়ার পর ইহসান বাঁকা হাসলো অনিকের নিয়তির কথা ভেবে। পরক্ষণেই চিন্তা ঢুকল মনে। অনিককে সৃজা চেনে না, নামও জানে না। এই ঘটনাও জানে না। বাড়ির প্রত্যেককে হুমকি দিয়ে রেখেছে সে, কেউ যদি এসব সৃজার কানে তুলে তাহলে তার জিভ ছিঁড়ে নেবে। সেটা তার বাবা হলেও!ভয়ে তাই কেউ সৃজাকে বলেনি এই ঘটনা। এমনকি মিতু-লিথু বা ইজহানও সাহস করেনি, ব্যাড রেকর্ড ইহসানের বেশ ভালোই আছে। তাই সে কোনোক্রমেই চায় না সৃজা এসব জানুক। মেয়েটা ওকে নিয়ে অন্যরকম ধারণা পুষে রাখে মনে। এসব শুনলে যদি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায়? উহু! ঠিক হবে না। উত্তপ্ত মেজাজের ইহসানের নজর পড়ল বিয়ারের ক্যান গুলোর উপর। মাথায় ঘুরপাক খেল সৃজার বিনীত কণ্ঠস্বর,
অশ্রুবন্দি পর্ব ১৯
“তুমি আর কখনো ওসব গিলবে না।”
মনে পড়তেই উঠে গিয়ে ক্যান দুটো বিনে ফেলে দিলো ইহসান। একবোতল ঠাণ্ডা পানি শেষ করল। যদিও সে ভীষণ ঈর্ষান্বিত হচ্ছে, তবুও মন ঠিক করল সে। বিরহ, কষ্ট অনুভব হলেও সৃজাকে ঐ বাড়িতে যেতে নিষেধ করবে না, এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ! এরকম করলে ইজহানের সাথে তার পার্থক্য কই? সে তো আলাদাই হতে চায় শেখদের থেকে! পারলে সবার থেকে, শুধুমাত্র সৃজার থেকে না।