অশ্রুবন্দি পর্ব ২১

অশ্রুবন্দি পর্ব ২১
ইসরাত জাহান ফারিয়া

সাত বছর আগে সৃজা যখন ইহসানকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল, ওর সেই অশ্রুবিন্দু দেখেই সে প্রেমানুভূতিতে ডুবেছিল। তবে আজকাল মনে হয় সেটা ভুল— বরং সৃজাকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিল ওর মায়ের মৃত্যুর দিন, সে সেদিনই প্রেমে পড়েছিল এই কোমল, সরল মেয়েটির। কিন্তু বয়সের অপরিপক্বতা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির অবনতি আর দ্বিধান্বিত অনুভূতিদের জোয়ারে সে হয়তো ব্যাপারটা টের পায়নি! তবে যেটাই হোক না কেন, ঐ অপরিপক্ব বয়সে ওর কান্না ঐ ইহসানের হৃদয় ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ। তাই ঐ দোষেই ওকে ইহসানের হৃদয়ে আমৃত্যু বন্দি হয়ে থাকতে হবে!

ইহসান অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মনোস্থির করে ফেলল এভাবেই। নিজেকে আলাদা হতে হবে, সৃজার মনে এমনভাবে দখলে নিতে হবে যেন পৃথিবীর কোনো শক্তিই ওকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। এরজন্য মেয়েটাকে পুরোপুরি স্বাধীনতা না দিক, নূন্যতম ছাড় দিতেই হবে। সে বেশ ভালোভাবেই জানে, পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা যায়, কিন্তু তাকে পোষ মানানো যায় না। ফাঁক পেলেই সে উড়ে যায়। অথচ পাখিটাকে স্বাধীনতা দিয়ে, আদর দিয়ে, দানা-পানি খাইয়ে বেড়ে উঠতে দিলে পাখিটা খুব সহজেই পোষ মেনে যায়, ছেড়ে গেলেও ফিরে আসে, বারবার! আর অর্ধাঙ্গিনী যখন নিজ মুখে একবার স্বীকার করেছে, শিশির বিন্দুর ন্যায় টপটপ করে পড়ছে তার প্রেমে, পুরোপুরি ফেলতে তাই ছাড় দেওয়াই যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একচুল ভুলও সে করতে চায় না ইজহানের মতো, বাপ নামক কলঙ্কিত পুরুষটির মতো! ইহসান ঢকঢক করে আরো এক গ্লাস বরফ ঠাণ্ডা পানি গিলে। অর্থব মস্তিষ্কটাকে সান্ত্বনা দিতেই যেন বসে রয় চোখ বুজে। অন্যদের কাছে সৃজা কী জানে না সে— কিন্তু তার কাছে এই মেয়েটা তার একমাত্র গোপন চাওয়া, তার হাহাকার বুকের একবুক প্রশান্তি, তার দুঃখ চাপা মনের বেঁচে থাকার কারণ— তার হৃদয়ের প্রস্ফুটিত ফুল!
ইহসান ফোন করল সৃজাকে। অনুমতি দিয়ে দিলো। শুনে সৃজা প্রচণ্ড খুশি হলো। আদর আদর কথা বলল, ফোনেই চুমু বিনিময় হলো দু’জনের। ইহসান ওকে খুশি দেখে একফাঁকে তিরিক্ষি কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কিন্তু তুই চলে গেলে আমার কী হবে? তোকে ছাড়া আমি রাত কাটাব কীভাবে? ঘুম তো আসবে না…”
সৃজা শুনে চটপটে গলায় বলল,

“তোমাকে রেখে আমি যেতে চাইনি। এলিজা, ফুপি তো সেই কবে থেকে বলে আসছে, তুমিই তো মানা করো। তাই তো বলেছি সঙ্গে চলো। দুটো দিন থেকে আসো…”
ইহসান তীব্র গলায় চেঁচালো,
“ঐ, দুটো দিন আবার কী? আমার তো প্রতিরাতে তোকে চাই। তোদের বাড়িতে যেতে চাই না কারণ আমার অনেক কাজ, তারচেয়ে বড় কথা, নিজের ঘর ছাড়া আমার কোথাও ঘুম আসে না। সত্যি বলতে তোর চেয়েও বড্ড আপন আমার ঘরটা।”
ইহসান রুক্ষ কণ্ঠে বলল কথাগুলো। সৃজা চটে গেল।

উফ! এই মানুষটা কী শুরু করল এক বাড়ি যাওয়া নিয়ে, এইতো অনুমতি দিলো খুশিমনে। প্রেম প্রেম কথা বলল, তুই আমার সব বলল! এখন পল্টি নিয়ে বলছে সৃজার থেকে নিজের শোবার ঘরটাই তার বেশি আপন? এতই যখন আপন তাহলে থাকুক ঘর নিয়ে, ওর না থাকায় এত হাপ্যিতেশ করছে কেন? দু নম্বরি লোক! সৃজা অভিমান ভরা গলায় ঝাঁঝালো স্বরে শুধাল,
“আচ্ছা তাই, আমি তোমার কেউ না? ঘর আপন? ভালো তো, নিজের ঘর নিয়েই থাকো। আমি বাপের বাড়ি চলে যাব, রাতে কীভাবে ঘুমাবে সে তোমার ব্যাপার!”
ইহসান ঠোঁট কামড়ে বলল,
“আরে বউ রাগ করছিস সরি রাগ করছো কেন? কলিজা শুকিয়ে যায় তো…আমি তো কথার কথা উপমা দিলাম। জান, তুই সরি তুমি তো পুরোটাই আমার…”

“অত্যন্ত বিচ্ছিরি আর বোকা বোকা শোনাচ্ছে কথাগুলো ইহসান ভাই।”
মুখ ফসকে ‘ভাই’ ডেকে ফেলায় জিভ কাটলো সৃজা। তখনি ওপাশ থেকে টেবিলে চাপড় দেওয়ার শব্দ ভেসে আসলো, সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর লাগামহীন কথার বাণী,
“কান লাল করে ফেলব বেয়াদ্দব, স্বামীকে ভাই ডাকিস? বুকের নিচে পড়ে রাতে যখন আঁচড়ে-কামড়ে একাকার করিস, সামলায় কে? যখন জান, কুত্তা বলিস তখন মনে থাকে না আমি তোর ভাই নাকি ভা…”
সৃজা ঠোঁটকাঁটা লোকটার কথা শুনে তীব্রভাবে চেঁচালো,
“হে আল্লাহ, রহম করো! এই অভদ্র লোককে কেন আমার কপালে জুড়ে দিয়েছ! ছিঃ ছিঃ কথাবার্তার কি ছিরি, নষ্ট লোক…”
ইহসান আক্রোশ নিয়ে বলল,

“যতবার ভাই ডাকবি…”
কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আগেই সৃজা অসন্তোষ নিয়ে বলে উঠল,
“তোমার বাচ্চাকে মামু ডাকতে শিখাব।”
ইহসান সশব্দ প্রতিবাদ জানাল,
“তোর মতো চুনোপুঁটি নিবি প্রতিশোধ? তাহলেই হয়েছে! তোকে আর বাচ্চাকে মুখ বন্ধ করে, মমি বানিয়ে বসিয়ে রাখব।”
“নিষ্ঠুর একটা!”
“আসছে ভালোর মহারাণী…”
সৃজা মন খারাপ করে ফেলল,
“ভালো না হলে বিয়ে করেছ কেন জোর করে? যাও আমি খারাপ, মেনে নিলাম।”
“আসলেই তুই চূড়ান্ত খারাপ। কিন্তু আমি ভালো লোক, তাই মাফ করে দিলাম বেয়াদবির জন্য!”
সৃজা তেঁতে উঠল,

“ঝগড়া শুরু করেছ তুমি আবার মাফও করবে তুমি? আচ্ছা ভণ্ড আর পাগল!”
ইহসান বিরোধিতা করল না এবার৷ বরং বলল,
“তোর পাল্লায় পড়ে ভণ্ড হতে বাধ্য হয়েছি। তুই
পাগল করেছিস আমায়। তুই ছাড়া আমার জীবনটা ‘ব্যাটারি ছাড়া মোবাইল’-এর মতো হয়ে যাচ্ছে, অথচ
তুই আমার চার্জ না হয়ে আমায় গিলে খাচ্ছিস প্রতিনিয়ত। বউ হোস তাই কিছু বলি না…”
তর্কে না পেরে সৃজা ধৈর্য হারালো,
“ওহে পাগল আর ভণ্ড লোক! তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না। আমি ভালো মানুষের স্ত্রী হতে চাই,
কোনো পাগলের না।”

“কী চাস না চাস দেখার বিষয় না, দিনশেষে তুই আমার, আমার জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি স্বাদের এসপ্রেসো..”
কঠোর ভাবে বলে ফোন কেটে দিলো ইহসান। এরপর বড়বড় শ্বাস ফেলে আবারো গা এলিয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বলল, তোর প্রতিটি কোষসহ তুই পুরোটাই, আপাদমস্তক ইহসানের। চাইলেও, না চাইলেও। ইহসান চোখ বুজে ভাবনার পাতায় এঁকে ফেলল সৃজার রাগান্বিত, অভিমানী মুখটা। টুংটাং
করে ফোন বাজলো, ইহসান হাতে নিয়ে দেখল
সৃজা লিখেছে,
‘তুমি আমার ক্যাচআপ ছাড়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’
— এসপ্রেসো

শব্দ করে হেসে ফেলল ইহসান। বিমোহিত হলো সে। মন শান্ত হলো কিছুটা। অবশেষে অধিকারসূচক কিছু একটা ভেবেছে তাকে। ইহসানের নিরানন্দ মনে পুলক খেলে গেল। এই এক নারী, যাকে মনে জায়গা দিয়েছে সে, বহু বছর আগে। বিয়ে নামক বন্ধনে জড়ানোর পরও নিজের শরীরী তৃষ্ণা সযতনে চেপে গিয়ে ওকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়ে গেছে। কারণ ভালোবাসা এক চিরন্তন বন্দিত্ব, যেখানে দুটো হৃদয় নিঃশব্দে একে অপরকে অধিকার করে নেয়। এটি এমন দামী এক আবেগ, যা স্বৈরাচারী মনোভাব দিয়ে কখনোই দখল করা যায় না। বরং যে ভালোবাসায় মুক্তির অনুভূতি থাকে, সেটাই নিজ গুণে চিরকাল বন্দি হয়ে থেকে যায়। আর সেজন্যই স্বামীর অধিকার আদায়ের জন্য জোরাজোরি না করে সে প্রেমিকরুপে ধরা দিয়েছে সৃজার কাছে, গোপন করেছে নিজের সরুপ। যেন সৃজা নিজেই বাধ্য হয় ওর কাছে হার মানতে! অবশেষে হয়েছেও তাই। ইহসান প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বাঁকা হাসল।

বাইরে বেরুনোর সময় ইহসান সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সৃজার কপালে, গালে চুমু দেয়। গদগদ প্রেম বিনিময় করার পর সৃজা ওকে হাসিমুখে বিদায় দেয়। যেটা ইজহানের চোখে পড়েছে। আর পড়ার পর থেকেই সে অস্থির, রাগান্বিত! ইতোমধ্যে মনে মনে হাজারটা গালি দিয়ে ফেলেছে ইহসানকে। ভেড়াটা কীভাবে এসব নাটকীয় সিন করে বেড়ায়? ওকে দেখানোর জন্যই বোধহয়! ক’দিন আগেও দেখেছে রিকশায় করে দু’জনে নদীরপাড়ের দিকে যাচ্ছে, হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে। আবার একটা বাইকও কিনেছে! বউকে পেছনে বসিয়ে ভার্সিটি নিয়ে যায়, হুহ!
যত্তসব কাপুরুষালি কর্মকাণ্ড! মনকে বোঝালেও ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরছে ইজহান, কারণ ইস্মি কখনোই ওকে হেসে বিদায় দেয় না আর সেও কখনোই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওকে আদর করে না, চুমু দেয় না।

ভেড়াটা বোধহয় রোমান্টিক মুভি দেখে এসব শিখেছে, এটা ইজহানের বদ্ধমূল ধারণা। তবে মনে মনে একটুখানি হলেও লোভ জন্মে তার, অকারণেই। ইচ্ছে করে ইস্মির ঠোঁটে হাসি দেখতে। ইস্মি যে হাসে না তা নয়, কিন্তু সেদিন সৃজার ঐটুকু কথা শোনার পর খেয়াল করে দেখেছে সে, ইস্মি জোর করে হাসে। তার মন রক্ষার্থে! এরপর থেকেই সে ভাবছে, ইস্মিকে কীভাবে একটু খুশি করা যায়! আজ এ নিয়ে পুরোটা দিন ভেবেছে সে। মনমতো কিছু না পেয়ে সে গুগল সার্চ করে দেখল মেয়েরা রেস্টুরেন্টে খেতে, শপিং করতে, আড্ডা দিতে, ঘুরাফেরা করতে, স্বাধীনভাবে থাকতে ভালোবাসে। যেহেতু স্বাধীনতা দেওয়া সম্ভব নয় ইজহানের পক্ষে, তাই সে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়াটাকেই সিলেক্ট করল। ইস্মিকে কথাটা বলতে সে বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল, কারণ ইতোপূর্বে কখনোই ইস্মিকে নিয়ে সময় কাটাতে কোত্থাও সে বেরুয়নি। বাড়িতে একপ্রকার কয়েদির মতোই রেখেছে সে। ইস্মি ঘর গোছাতে থাকাবস্থায় যখন কথাটা শুনল, চোখ
বড়বড় হয়ে গেল ওর। ইজহান অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“বোরকা পরে তৈরি হও।”
ইস্মি হাতের কাজ ফেলে ছুটে এসে ওর কপাল, বুকে হাত দিয়ে চেক করতে করতে বলল,
“আপনার শরীর ভালো তো?”
ইজহান নিজের অপ্রস্তুত ভাব লুকাতে ওর কোমড় জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলল,
“রেডি হও!”
“সত্যি?”
“হুম।”
“বিয়ের এই পাঁচ বছরে?”
“বেশি বাহানা করলে বা কথা বললে আবার দশম বছরে যাওয়া হবে।”

ইস্মি নিজের বিস্ময় ভাব লুকাতে পারছিল না। কিন্তু ইজহানের মুড কখন বদলে যায় তারজন্য ওর কথার পিঠে আর বেশি কথা বাড়াল না। ইজহান ওকে চুজ করে দিলো সবকিছু। কোন বোরকা পরবে, কোন হিজাব, ব্যাগ নেবে, কোন জুতোটা পরবে সবকিছু! ইস্মি সেই মতো সব পরে তৈরি হলো। ইজহান ততক্ষণ বসে বসে ওর রেডি হওয়া দেখছিল, ওর ঠোঁটে হাসি ফুটছে কি-না তার দিকেই নজর ছিল!
ইস্মি তৈরি হওয়া শেষ করে দেখল ইজহান আয়নায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে, নিজে রেডি হয়নি। ও অপ্রস্তুত হয়ে ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি তৈরি হবেন না?”
“কী পরব, বের করো…”
ইস্মি ওকে পাঞ্জাবি-পাজামা বের করে দিলো।

ইজহান বিনাবাক্যে তৈরি হলো। ইস্মি আড়চোখে দেখল ওকে, পাঞ্জাবি গায়ে এত সুন্দর লাগছে মানুষটাকে! ইস্মি হাজারবার মাশাল্লাহ বলল যাতে নজর না লাগে কারোর। এই সুদর্শন পুরুষটার এই নিষ্পাপ, সুন্দর মুখখানি দেখে কে বলবে লোকটা ডমিনেটিং? অহেতুক কারণে ঝামেলা বাঁধায়, সন্দেহ করে, চড় দেয়? ভাইয়ের সাথে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝামেলা করে, মেরে, হেরে ভূত হয়ে আসে? ইস্মি দোয়া করল, যাতে মানুষটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাদের একটা সুন্দর সুখী সংসার হোক। যে সংসারের মূল ভিত্তি হবে ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাস। ইস্মির ঘোর কাটলো ইজহানের কাঁটা কাঁটা কথায়,
“বাইরে নিয়ে যাচ্ছি, ওখানে দুর্গন্ধময় মশা-মাছি চারপাশে সবসময় ঘুরাফেরা করে। ওসবে একদম তাকাবে না, প্রয়োজন নেই। শুধু আমাকে দেখবে, তাকাবে।ম তাই বে্‌শি খুশি হওয়ার দরকার নেই৷ আমাকে পাঞ্জাবিতে কেমন লাগছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে, চুলটা ওকে? দেখে
ঠিক করে বল… ”
ইস্মি বেশ বুঝল ওকে আগে থেকে ওয়ার্নিং দেওয়া হচ্ছে, যাতে পরপুরুষের দিকে না তাকায়। ওর হাসি পেল, অনেক কষ্টে লুকিয়ে বলল,
“সব ঠিকঠাক, মাশাল্লাহ!”

ইজহান মিজুকে গাড়ি বের করতে বলেছিল গ্যারেজ থেকে। কিন্তু গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করে উঠোনে আনার পর সে ভীষণ রেগে গেল। তার মুক্তোর মতো সুন্দর প্রাডোটা গায়ের এখানে-সেখানে লেগে আছে কাদা। কাচের জানালায় ধুলোবালি। হেড লাইটের উপর যেন কেউ ঝাঁমাঘষে দিয়েছে। আবার একটা টায়ারও পাংচার। বাড়ির অন্য গাড়িগুলোও নেই, আজিজ শেখ কোথাও গেছেন। ইজহান মিজুকে ঝড়েবকে জর্জরিত করে ফেলল! ইস্মি তাকে থামানোর জন্য বাহু চেপে ধরে বলল,
“আল্লাহ একটু থামুন আপনি। এত উত্তেজিত হবেন না, এরপর অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ঘরে চলুন, কোথাও যেতে হবে না।”
ইজহান ওর কথা শুনে মিজুর উপর আরো ক্ষ্যাপল,
“তোর জন্য এখন বউকে গাড়িতে নিয়ে বেরুতে পারব না। শালা তুই ইচ্ছে করে এমন করেছিস তাই না? যাতে আমি বউ নিয়ে বেরুতে না পারি! যা তোর চাকরি নট, হ্যাঁ যাওয়ার আগে অবশ্যই গাড়ি পরিষ্কার করে যাবি।”
মিজুর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল এতক্ষণ, তবু সে বাধ্যগত লোকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। মাথা নেড়ে যথা আজ্ঞাপন জানাল। ইজহান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইস্মির হাত ধরে টেনে গেইটের দিকে যেতে যেতে বলল,
“যাব যখন বলেছি তো যাব। দরকার হলে রিকশা
করে যাব, তবুও যাবই…”
ইস্মির মনে হলো সে ভুলভাল কিছু শুনেছে, বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু বললেন?”
ইজহান ভোঁতা মুখে বলল,
“রিকশা করে যাব।”
ইস্মি বিষম খেল, ভান করে বলল,
“ওসবে তো গরিবরা চড়ে, যাদের টাকা নেই তারা…”
ইজহান ভস্মীভূত নজরে তাকাল মিজুর দিকে। সে বেচারা চাহনি দেখেই পগারপার। ইস্মি বেশিকিছু আর বলল না। দারোয়ান একটা রিকশা খুঁজে এনে দিলো। ইজহান নিজের লম্বা-চওড়া শরীরটা নিয়ে বসতে
গিয়ে মেজাজ খারাপ করে ফেলল, জীবনে রিকশায় চড়েনি সে। আর আজ ঐ মিজুর জন্য বেশ ভুগল। ইস্মির এত হাসি পেল যে দম বন্ধ করে বসে রইল গুটিশুটি মেরে। রিকশা চলতে শুরু করলে টাল সামলাতে না পেরে ইজহান সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। শিক ধরে ভীতু ও রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে রিকশা থামাতে বলল চালককে। ইস্মি আঁৎকে উঠে দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওকে সামলালো, এক হাত আড়াআড়ি করে ব্যারিকেডের মতোন করে বলল,

“ভয় নেই, আমি আছি!”
এরপর রিকশাওয়ালাকে বলল,
“আসলে চাচা, আমার স্বামী প্রথম রিকশায় উঠেছে তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে! আপনি সামনে বাড়ান, আস্তেধীরে নিয়ে চলুন আমাদের।”
নিকাবের উপর দিয়ে খেলে যাওয়া ঠোঁট আর চোখের কুঁচকানো চামড়া দেখে ইজহান আন্দাজ ফেলল তার বউটা মিষ্টি করে হেসেছে। সে মুগ্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে ইস্মির দিকে তাকিয়ে রইল। রিকশায় করে কোথাও গেলে যদি বউয়ের সত্যিকারের হাসি দেখা যায়, তাহলে সে অবশ্যই গাড়ি থেকে রিকশাতে যাওয়াটাকেই প্রেফার করবে। সে কোমড় জড়িয়ে
ধরে বসল ইস্মির,
“নিকাব সরাও, চুমু খাব।”
ইস্মি ফট করে তাকাল ওর দিকে,

অশ্রুবন্দি পর্ব ২০

“এটা রাস্তা…”
“আর তুই আমার বউ, সরা…”
জোরালো গলায় বলে নিজেই নিকাব তুলে ফটাফট চুমু খেয়ে বসল ইস্মির গালে। না করার সুযোগ পেল না মেয়েটা। রিকশাওয়ালা এহেম এহেম করে কেশে চেঁচিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,
“আপনে হুজুর হইয়া রাস্তাঘাডে এমুইন করেন
বউয়ের লগে, আস্তাগফিরুল্লাহ!”
লজ্জায় মাথা কাটা গেল ইস্মির, মুখ নামিয়ে বসে রইল। ইজহান বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ঐ মিয়া, রিকশা টানো, এত কথা বলো কেন?”
“মানে হুজুর আপনে যা করলেন…!”
ইজহান এবারে রেগে গেল,
“হুজুর মানে? কে হুজুর? এই তুমি কী এলাকায় নতুন? আমায় চিনো, না চিনলে কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও ইজহান শেখ কে!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ২২