অশ্রুবন্দি পর্ব ২২

অশ্রুবন্দি পর্ব ২২
ইসরাত জাহান ফারিয়া

শহরের বিখ্যাত বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই অরবিট টাওয়ারে অবস্থিত। যেখানে ইহসানের নিজস্ব রেস্তোরাঁ! ইজহান কিছুটা নাকউঁচু স্বভাবের লোক, বউকে নিয়ে মাঝারি, সস্তা কোনো রেস্টুরেন্টে কোনোকালেই যাবে না। তাই অরবিট টাওয়ারে অবস্থিত অথেন্টিক ফিউশন রেস্টুরেন্টে ইস্মিকে
নিয়ে যাবে বলে মনোস্থির করল। থাকুক ওখানে ইহসান শেখ! তার কী? সে কী ভয় পাবে নাকি? অরবিট টাওয়ারটা তো তার নিজস্ব সম্পত্তি না। তবে ইজহান অবশ্য ভেবে রেখেছে, কোনোভাবে সামনে পড়া যাবে না ভেড়াটার! কারণ ইতোপূর্বে বউ নিয়ে সে কোথাও বেরুয়নি, আজ বেরিয়েছে!
দেখলে হয়তো ওকে খোঁচা মেরে কথা বলবে, যেমনটা ও করে। তাই সামনে না পড়াটাই শ্রেয়! অরবিট টাওয়ারের সামনে রিকশা পৌঁছানোর পর রিকশাওয়ালাকে ভাড়া হিসেবে ধরিয়ে দিলো সে একটা হাজার টাকার নোট। রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল,

“আমার কাছে ভাঙতি নাই, ভাঙতি দেন।”
ইজহান ভ্রু কুঁচকে ফেলল,
“মানে? ভাঙতি দেব কেন? এটা তোমার ভাড়া।”
রিকশাওয়ালা, ইস্মি দু’জনেই চোখ কপালে তুলে তাকাল। বয়েসী রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল,
“ভাড়া এইডা?”
“হুম, এতে অবাক হবার কী আছে?”
“হায়রে আল্লাহ! আপনে এইগুলা কি কইতাছুইন! ভাড়া হাজার ট্যাহা না, আশি ট্যাহা।”
ইজহান একটা ধাক্কা খেল যেন,
“আশি টাকা? আমাকে বোকা ভাবো মিয়া?”
গদগদ ও অবাক হয়ে বলল রিকশাওয়ালা,
“আরে হুজুর থুক্কু ভাইসাব আপনে জীবনে রিকশায় উডেন নাই মানলাম, তাই বইলা ভাড়ার আন্দাজও নাই? ও আম্মা আপনে কন দেহি!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইস্মি অপ্রস্তুত হয়ে যখন ইজহানকে বলল ভাড়া হাজার না, আশি টাকা৷ সে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। অতটুকু রিকশায়, বয়স্ক রিকশাওয়ালা এতদূর পথ ওদের নিয়ে পাড়ি দিলো অথচ ভাড়া মাত্র আশি টাকা? এত কম? কীভাবে সম্ভব? ব্যাপারটা তার বোধগম্য হলো না। সে অবশ্য টাকা ফিরিয়ে নিলো
না, পুরোটাই দিয়ে দিলো রিকশাওয়ালাকে। সে ইজহান শেখ, দরাদরি শেখেনি। আর বউ নিয়ে বেরিয়েছে, তার সামনে ওসব বার্গেনিং করা কাপুরুষের কাজ! হুহ!
অরবিট টাওয়ারের ছয়তলায় উঠার জন্য এলিভেটরে দুটো ভার্সিটি ছাত্র উঠল বলে ইজহান ইস্মিকে নিয়ে সেটাতে উঠল না, বরং বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। পরবর্তীতে যখন ওটা আবার খালি হয়ে এলো, তখন উঠল। ইস্মি রা করল না কোনো। তবে তিন তলা থেকে মাঝবয়েসী তিনজন লোক যখন উঠল, ইজহানের চোখ দিয়ে রক্ত ঝরল যেন, ইস্মিকে যথাসম্ভব আড়াল হয়ে দাঁড়াল, যাতে লোকগুলো ইস্মির আশেপাশেও দাঁড়াতে না পারে। ইজহান বিড়বিড় করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল। ইস্মি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে গেল লোকটার অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড! কিছুক্ষেত্রে হাসি পেল, তবে সেটা রইল অপ্রকাশিত!

রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আরো একবার মেজাজ খারাপ হলো ইজহানের, অনেক মানুষ দেখে! ইচ্ছে করল সব ক’টাকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে একপ্রকার বিপাকে পড়ে গেল সে। এতগুলো মানুষের মধ্যে বসে ইস্মিকে নিয়ে কোনোক্রমেই বসবে না, কোনোভাবেই না। কী করা যায় ভাবার আগেই একজন স্টাফ এগিয়ে এসে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে প্রাইভেট জোন আছে কি-না জানতে চাইল। স্টাফ ছেলেটা বা-দিকের প্রাইভেট জোনে ওদের নিয়ে গেল। কাচ দিয়ে ঘেরা, বিভিন্ন অর্কিড দিয়ে সাজানো জোনটি হলদে আলোয় চকমক করছে। একপাশে একটা লোক তার বউ, বাচ্চা নিয়ে বসে গল্প করতে করতে খাচ্ছে। বাচ্চাটা অবশ্য খাচ্ছে কম, ছড়াচ্ছে বেশি। কিন্তু সেদিকে তার বাবা-মায়ের খেয়াল নেই। দু’জনে হাত ধরাধরি করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে প্রেমালাপে মগ্ন! বাইরের জন পঞ্চাশেক লোকের চেয়ে এখানে বসে খাওয়াটাই ভালো। ইজহান ভেবেচিন্তে ইস্মিকে নিয়ে এখানেই বসল। তার মুখে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। অন্ধকার নামিয়ে রাখা মুখটা দেখে ইস্মি সাবধানী হাতে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ওর কপাল, মুখ মুছে দিলো৷ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

“জায়গাটা খুব সুন্দর, তাই না?”
ইজহান প্রায় চিড়বিড় করে বলল,
“আর আমি কুৎসিত?”
“আমি তো পরিবেশটার কথা বলছিলাম…”
রুক্ষমূর্তি ধারণ করে ফেলল নিমিষেই,
“কেন? আমাকে চোখে লাগে না? চকমকে আলো দেখেই সব সুন্দর হয়ে গেল, আমার চেয়েও? মেয়ে জাতটাই তোরা এমন, নিজের বর ছাড়া পৃথিবীর সব সুন্দর!”
ইস্মি মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। ইজহান দুইগ্লাস পানি সাবাড় করে বুক জ্বালা অনুভূতি কমালো। ইস্মিকে বিপরীত দিকে সিট থেকে উঠিয়ে নিজের সাথে বসালো। এরপর বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে মেন্যু কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখে ওয়েটার ডাকল—
“মিডিয়াম-রেয়ার গ্রিলড চিকেন স্টেক,
সঙ্গে মাশ পটাটো আর ব্রাউন সস। গ্রেভিটা যেন ঠিকঠাক থাকে। আর হ্যাঁ, গার্লিক বাটার দিয়ে সটেড ব্রকলি আর ক্যারট থাকলে ভালো হয়।”

ওয়েটার লিখে নিল। ইজহান আরো যোগ করল,
“আর দুটো ক্যাপুচিনো। হালকা ফ্রথ রাখবে।”
অর্ডার করা শেষে ইজহান ইস্মির দিকে তাকাল। দেখল মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর দিকে মনোযোগ নেই৷ ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে ইস্মির দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল তার বৌ ওপাশের কাপলদের সঙ্গে আসা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে, বাচ্চাটাও ওকে দেখে আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসছে। ইজহানের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। ইস্মিকে ধমক দিয়ে বলল,
“ওদিকে কী?”
ইস্মি মৃদু কণ্ঠে বলল,

“বাচ্চাটা দেখুন কী সুন্দর করে হাসছে!”
ইজহান দেখল তো না-ই উল্টো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“বাইরে বেরুলেই আসল রুপ বেরিয়ে আসে তোর…”
ইস্মি আঁধার মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল। একটি কথাও বাড়াল না। কি বলবে সে? এই জঘন্য মানসিকতার লোকটা বাচ্চাটাকেও রুক্ষ চোখে, শত্রুর চোখে দেখছে! ওর বুকের ভেতরটা অদ্ভুত শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে, নিত্যদিন লুকিয়ে রাখা চাপা যন্ত্রণাটা চোখ ছাপিয়ে জলধারা হয়ে হঠাৎ নামতে চাইল। দু’হাতের পিঠে চোখ মুছল কয়েকবার। কোণা চোখে তা দেখে ইজহান ফুঁসে উঠল। গলা চড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও পাঞ্জাবিতে টান পড়ায় থেমে গেল। তাকিয়ে দেখল সেই বাচ্চাটা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইজহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে
বিরক্তি প্রকাশ করে,

“কী চাই?”
“আম্মামা আম্মাম…”
বলতে বলতে বাচ্চাটা ইস্মির দিকে হাত বাড়াল। কোলে উঠার পায়তারা আরকি! ইস্মি নরম চোখে তাকাল বাচ্চাটির কাণ্ড দেখে। এদিকে ইজহান
আকাশ থেকে পড়ল,
“ঐ তোর আম্মা কে? আমার বউ তোর আম্মা হতে যাবে কেন? যা ভাগ…”
বাচ্চাটা গেল তো না-ই উল্টো ইজহানের কোমড় জড়িয়ে ওর উপরে উঠার চেষ্টা করতে লাগল। ইস্মি এবার নড়েচড়ে বসল। দেখবে সে, এই পাথর লোকটা কী করে! ইজহান চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু বাচ্চাটি ততক্ষণে ওর গলা অবধি উঠে ওর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে খামচি বসাচ্ছে। ইজহানের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আছাড় মারবে এমন একটা ভাব। ইস্মি আঁৎকে উঠে বাচ্চাটিকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে ওকে বলল,
“ছোট্ট বাচ্চা ও, আমি সরিয়ে দিচ্ছি!”

বলল ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাটিকে কোনোভাবেই কোল থেকে সরাতে পারল না। বাচ্চাটা ইস্মির বুকে ঘাপটি মেরে ওর বোরকা আঁকড়ে ধরে রইল। চোখেমুখে ভীতু আর কান্নার ভান, যেন ইস্মিই ওর মা— আর মাকে ছেড়ে সে যাবে না। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ইস্মি, তবে আগলে রাখে যত্ন করে। ইজহান তখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে! চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবে ভাব, ইস্মি অসহায় নয়নে তাকাল ওর দিকে। ওর হাত টেনে অনুরোধের স্বরে বলল,
“আল্লাহর দোহাই, আপনি সিনক্রিয়েট করবেন না। ও বাচ্চা, একটু আদর করে বুঝিয়ে বললেই চলে যাবে। একটু বুঝেন।”

ইজহান সিনক্রিয়েট করল না তবে গলা উঁচিয়ে বাচ্চাটির বাবা-মাকে ডাকল। ওদের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে বলল৷ লোকটা উঠে এলো বাচ্চা নিতে, তবে ভীষণ বিরক্তি সহিত। কাছে এসে হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,
“ওর মা এমন বোরকা পরতো তো, তাই আপনার স্ত্রীকে মা ভেবে এমন করেছে।”
ইজহানের বিরক্ত গলায় বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাচ্চা এদিকওদিক যায়, খেয়াল রাখুন। আমরা তো এখানে খেতে এসেছি নাকি! অযথাই ঝামেলা।”
বাঁকা গলার ধমক খেয়ে লোকটা নিজে থেকেই বলল,

“আসলে ওর মা মারা গেছে দিন বিশেক আগে। বাচ্চাকে একা সামলাতে পারব না তাই দু’সপ্তাহ হলো বিয়ে করলাম। নতুন বউ, বোঝেনই তো! খেতে এসেছি তো তাই ওর দিকে খেয়াল রাখতে পারিনি।”
লোকটা বাচ্চাটিকে নিজের কাছে ডাকল, কিন্তু ইস্মিকে ছেড়ে যাবে না বলে সে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। ইস্মি পাথরের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ! এরপর ইজহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে নজর সরালো। বাচ্চাটির মাথায় হাত রেখে আদুরে স্বরে বলল,
“বাবা ডাকছে, যাও সোনা।”

অদ্ভুতভাবে বাচ্চাটি কথা শুনল ওর। নিকাবের উপর দিয়ে ইস্মির মুখ ছুঁয়ে এরপর বাবার কোলে চলে গেল। লোকটা বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল টেবিলে। নতুন মা-টাকে ভীষণ বিরক্ত দেখালো। ইস্মি চুপটি করে বসে রইল। ইজহান ওকে আড়চোখে দেখে গম্ভীরমুখে বসে রইল। ওয়েটার ততক্ষণে খাবার নিয়ে পরিবেশন করে গেল। ইজহান ইস্মিকে খাবার বেড়ে দিলো, ওর হাতেই খেলো। পুরোটা সময় রোবটের ন্যায় আচরণ করে গেল মেয়েটা, মুখফুটে একটি শব্দও বিনিময় করল না। অদ্ভুত এক অনুভূতি উসকানি দিলো ইজহানের মস্তিষ্কে, রগে রগে। হাত মুঠোয় নিয়ে চিড়বিড়িয়ে সে বলল,

“মুখে কুলুপ এঁটেছিস কেন?”
“আমি বাড়ি যাব।”
ইজহান আরো জোরে হাত চেপে ধরল ওর। মুহূর্তেই ওর কব্জিতে দাগ বসে গেল৷ ইস্মি হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“দেখুন লোকটা তার নতুন বউয়ের সাথে কী সুখী! অথচ যার জন্য বিয়ে করল সেই বাচ্চাটির চোখভরা কত শূন্যতা, মায়ের অভাব! লোকটা তো বউ পেল, কিন্তু ও কী পেল? পুরুষ মানুষের ভালোবাসা, বিশটা দিনও পেরুয়নি।”
ইজহানের মুখটা দেখার মতো হলো। মাথায় ঠোক্কর খেল কথাগুলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়াল লোকটির উপর। ব্যাটা কাপুরুষের কাজ দেখে তার বউয়ের মন খারাপ হয়েছে, কি ভেবেছে ইস্মির অনুপস্থিতিতে ইজহানও এমন করবে? দম থাকতে না। আচমকাই বউয়ের প্রতি ভালোবাসায় ইজহানের বুকে জোয়ার বইল। ইস্মির গাল ধরে, গম্ভীর গলায় সে বলল,
“কে কেমন জানি না, জানতেও চাই না। শুধু জানি, ইস্মিতা ছাড়া ইজহান শেখ শূন্য, মৃত!”
ইস্মি অশ্রুভেজা চোখে চাইল,
“এই একই কথা যদি আমি বলি, তাহলে বিশ্বাস করবেন?”
ইজহান জবাব দিলো না, চোখের ভাষায়ই বুঝিয়ে দিলো। এরপর ওয়েটার ডাকল বিল পরিশোধের
কথা বলতে!
.
এলিভেটরটা হঠাৎ থেমে গেল চারতলায় আসামাত্রই, দু’পাশের দুটো পাল্লা ধীরেধীরে খুলতেই বাইরে ফোন স্ক্রল করতে থাকা অপেক্ষমাণ ব্যক্তিটি ভেতরে প্রবেশ করবে বলে পা বাড়াল, তবে বাড়িয়েই থমকে গেল। বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,
“তুই? এখানে কী করছিস?”
ইজহান যার সামনে পরতে চাচ্ছিল না, কাকতালীয়ভাবে তার সামনেই পড়ে গেল। সে মোটেও আশা করেনি এই অনাকাঙ্খিত মুহূর্তটির। বিরস ও শক্ত গলায় সে জবাব দিল,

“তোর কেনা নাকি এটা, যে কৈফিয়ত দেব?”
খুব সাধারণ একটা প্রশ্নের এমন ত্যাড়াব্যাকা জবাব শুনে ইহসান বিরক্ত হলো। তবে ইজহানের হাতের দিকে চোখ পড়তেই এবারে তার নজরে এলো ভাইয়ের পাশে বোরকায় আবৃত নারীটির দিকে৷ মেজাজটা বিগড়ে গেল ওর, কে এই মেয়ে? যাকে নিয়ে ইজহান এখানে এসেছে আবার হাত ধরে রেখেছে? ঘরে বউ রেখে তাহলে বাইরে বিরিয়ানি খাওয়া হচ্ছে? বাবার মতো চরিত্রহীন রুপটা ধারণ করেই ফেলল অবশেষে? ইহসান মুখ বিকৃত করে
প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“কে এটা?”
বোরকা পরিহিত মানবী বলতেই যাচ্ছিল ‘আমি ইস্মিতা’ ; কিন্তু ইজহান সেই সুযোগটুকু দিলো না। ওকে থামিয়ে গা জ্বালানো স্বরে বলল,
“তোকে বলব কেন?”
“ঘরে বউ রেখে হোটেল ঘুরছ তাহলে? বাস্টার্ড…”
গালি বেরিয়ে এলো ইহসানের। রাগটা আর চাপা দিতেই পারল না। পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে দু’ঘা বসিয়ে দিলো নাকেমুখে। ইজহান কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। বোরকা পরিহিত মানবী এবার চিৎকার করে নিজের পরিচয় দিলো,
“ভাইয়া এটা আমি…”
ইহসান দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়ে তাকাল। ইজহানের কলার ছেড়ে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ইস্মিতা! ওহ গড! এই শুয়োর দেখেন কতটা ত্যাদড়,
বউ নিয়ে বেরিয়েছে বলতেও তা মুখে বাঁধে,
কুত্তার ছাও একেই বলে… ”

ততক্ষণে গ্রাউন্ডে নেমে এসেছে তারা। এলিভেটর থেমে গেছে, ইহসান বেরিয়ে পড়ল। ইজহান ব্যথাটুকু সহ্য করে নিয়ে ভাইকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার সময়ই পেল না। রেস্টুরেন্টে ছোট্ট বাচ্চাটার পরিণতি ভেবে ও ইজহানের সাথে হওয়া কথোপকথনের পর থেকেই ইস্মির এমনিতেই সবকিছু অর্থহীন লাগছিল। ওর যে কী হলো, রাগ দেখিয়ে ইজহানকে ধরল না, একাই বেরিয়ে গেল৷ বিস্মিত ইজহান একহাতে নাক চেপে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এসে ইস্মিকে বলল,
“আমাকে রেখে বেরিয়ে এলি কেন…”
“যে লোক ভাইকে বলতে পারে না আমি বউ নিয়ে বেরিয়েছি; তার এত অহংকার মানায় না।”
বলামাত্রই ঠাস করে একটা চড় পড়ল ইস্মির গালে। শক্ত হাতের চড় খেয়ে ইস্মি অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে একপলক দেখল ইজহানকে। পরক্ষণেই ঘৃণা আর ক্ষোভ ভরা চোখ সরিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইজহানের সহ্য হলো না ওই দৃষ্টি, ভস্মীভূত নজরে
দেখল ইস্মিকে।
.
ইহসানের বড্ড মাথা ধরেছে। মাথা ধরায় সে সৃজার কোলে শুয়ে আছে। সৃজা ওর কপালে মালিশ করে দিলো, চুল টেনে দিলো। জিজ্ঞেস করল চা খাবে কি-না! ইহসান নিমরাজি হলো, কিন্তু সৃজা ওর কথা শুনল না। আদা দেওয়া চা বানাতে চলে এলো রান্নাঘরে। চা বানাতে এসে ইস্মিকে আনমনা হয়ে চুলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল৷ চুলায় তারকারি গরম হচ্ছে, আগুনের খুব কাছেই ইস্মি দাঁড়িয়ে অথচ মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই। সৃজা তড়িঘড়ি করে চুলাটা কমিয়ে দিয়ে ইস্মিকে ডাকল ধীর গলায়,
“তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
ইস্মি চমকে উঠল সৃজার গলা শুনে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। চুলার দিকে ধ্যান দিতে
দিতে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,
“কই না তো!”

সৃজা ওর মুখের মিথ্যে হাসি দেখল তীক্ষ্ণ চোখে। বুঝতে না দিয়ে বলল,
“বলতে না চাইলে জানতে চাইব না, কিন্তু ছোট বোন ভেবে বলতেই পারো।”
“আরে তেমন কিছু না, তুমি তো কাল বাড়িতে যাচ্ছ, নিশ্চয় আনন্দ হচ্ছে?”
ইস্মি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করল। সৃজা বুঝে আর জোরাজুরি করল না। যে না বলতে চায়, তাকে জোর করে বলানো উচিৎ নয়। প্রথম থেকেই সৃজা অনেককিছু দেখে আসছে এ বাড়িতে, তাই বোঝে!
সবাই সবকিছু বলতে চায় না। সৃজা নিজের
জবাবে বলল,

“আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু কান্নাও পাচ্ছে…”
ইস্মি হেসে বলল,
“কেন? ভাইয়াকে ছেড়ে থাকবে বলে?”
সৃজা গরম পানি বসাতে বসাতে কিঞ্চিৎ লাজুক
গলায় বলল,
“ধুর, তা না! সবাইকে অনেকদিন পর দেখব বলে৷ আসলে আগে কখনো পরিবারের থেকে এতদিন দূরে থাকিনি তো তাই খুশি যেমন লাগছে, তেমনি অদ্ভুত ভাবে কান্নাও পাচ্ছে…”
ইস্মির মনে পড়ল কতদিন সে বাবার বাড়ি যায় না, তিন…তিনটা বছর! ওর মুখটা মলিন হয়ে গেল তবে সেটা লুকানোর তীব্র প্রচেষ্টা করে বলল,
“বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা, একদম অন্যরকম। তাই না?”
“অন্যরকম…”

সৃজা ওর সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়লো, টুকটাক আরো কিছু কথাবার্তা হলো। ইস্মি ডিমের খোসা ছাড়াতে লাগল, আর সৃজা ফুটন্ত পানিতে চায়ের লিকার ছাড়ল। তখনি মিতু এলো, সৃজাকে দেখে
মুখ ভেঙচালো আড়ালে, কিন্তু কিছু বলল
না। ইস্মিকে ঠেস মেরে বলল,
“ইজহান ভাই নাকি তোমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছিল, তা কেমন সময় কাটালে? কই কই ঘুরে এলে? বলোনি তো আমাদের, নিয়েও যাওনি। আমরা কি এতই পর হয়ে
গেলাম ইস্মি?”
মিতু সবসময়ই ইস্মিকে ওর নাম ধরে ডাকে, সম্মান করে না। বেয়াদব মেয়েটার এসব আচরণ গা সওয়া হয়ে গেছে ইস্মির। ও হেসে বলল,
“সময় তো ভালোই কাটালাম। তোমরা তো কয়দিন পরপরই যাও, তাই আর বলিনি আরকি! জানোই
তো, স্বামী-স্ত্রীর একসাথে ঘুরতে বেরুলে তৃতীয়
কেউ যেতে নেই!”

“বাহ! বোবার মুখে কথা ফুটেছে, বড্ড ভালোই
কথা শিখছ তুমি।”
“ঐ আরকি, শিখলাম এক-আধটু।”
“শিক্ষাটা কে দিচ্ছে? উড়ে এসে জুড়ে বসা বউ?”
সৃজাকে ইঙ্গিত করায় ও বিরক্তি আর চরম রাগ নিয়ে তাকাল। ইস্মি ওকে ইশারায় কিছু বলতে বারণ করে মিতুকে প্রতুত্তরে বলল,
“না তো, ও কেন দেবে! দিলো তোমার ভাসুর,
এটাও বলল কেউ আমার সাথে বেয়াদবি করতে আসলে যেন তাকে বলি, সে তার ক্লাস নেবে। জানোই তো ওনাকে, মাথাগরম লোক!”
মিতু ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থমথমে হয়ে গেছে। বলল,
“ইজহান ভাইকে তো দেখি সারাক্ষণই তোমার সাথে সার্ভেন্টের মতো আচরণ করে, বকা বাজি করে। দশপদ রান্না করে খাওয়াতে বলে…”
ইস্মি ওকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে, হেসে বলে,

“দশপদ রান্না করে স্বামীকে খাওয়াতে আমার তো সমস্যা হয় না, তোমার হয় তাই হয়তো ইমরান ভাই আজ অবধি বউয়ের রান্না খাওয়ার সুযোগ পেল না…”
মিতুর গা জ্বলে উঠল। ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল কিছু না বলেই। সৃজা ঠোঁট টিপে হাসল। ইস্মিকে বলল,
“সবসময় চুপ থেকো না, কেউ টিজ করলে এভাবেই জবাব দিও। মাঝেমধ্যে ভাইয়াকেও তো দিতে পারো…”
ইস্মি শ্বাস ফেলে বলল,
“তাকে কিছু বলা আমার সাধ্য ভেবেছ? প্রথমে আমাকে মারবে এরপর নিজেকে।”
“সাধ্যমতো তাকে বোঝাও, এত এত রেস্ট্রিকশন একসময় তাকেই বিপদে ফেলবে।”
সৃজার কথা শুনে ইস্মি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল! এ কথাটা ইজহান বুঝলে তো হয়েই যেত! ও দুটো ডিমসেদ্ধ আর দুধের গ্লাস নিয়ে ঘরে চলে এলো সৃজাকে বিদায় জানিয়ে। ঘরে এসে দেখল ইজহান ফাইল ঘাঁটছে, সে ইজহানের সামনে ডিমের বাটিটা রেখে বিছানা ঝেড়েঝুড়ে নিলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা ওর, তাই শুয়ে পড়ল। ওকে শুয়ে পড়তে দেখেই ফাইল রেখে ইজহান ওকে ডাকল, ইস্মি
উঠে পড়ল সঙ্গে-সঙ্গেই। পা-জোড়া মেঝেতে নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু লাগবে?”
“না।”
ইস্মি রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
“তাহলে অহেতুক ডাকলেন কেন?”
“বিরক্তি দেখাচ্ছিস আমায়?”
“এখন কী বিরক্তও হতে পারব না?”
ইজহান দুধের গ্লাসটা সজোরে মেঝেতে ফেলে দিলো। কাচের গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
“পরপুরুষ দেখেছিস আজ, তাই ত্যাড়েক দেখাচ্ছিস আমায়? মাথা ঘুরে গেছে, না? নষ…”
পুরোপুরি শেষ না করেই থেমে গেল এ পর্যায়ে। তবে বাকিটুকু বুঝে নিলো ইস্মি। বহুদিন পর একবার রক্তাভ চোখে একপলক চাইল, এরপর চুপচাপ বসে পড়ল কাচ পরিষ্কার করতে। ইজহান আবারো
কটমট স্বরে বলে উঠল,
“তোকে নিয়ে বেরুনোটাই আমার ভুল হয়েছে!”
ইস্মি রোবটের ন্যায় কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“আপনার জীবনটাই ভুল ইজহান শেখ, একদিন বুঝবেন। আর যেদিন বুঝবেন সেদিন এই ইস্মিতা আপনার পাশে থাকবে না। আগেরবারের মতো
স্ট্রোক করেও ফিরে পাবেন না আমায়…”

ইজহান চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল ইস্মির গলার দৃঢ়তা বুঝে, ওর কথা শুনে। বুকের ভেতরটা বিষাদে ছেয়ে গেল৷ অশান্তিতে জ্বলে গেল শরীরের প্রতিটি শিরা। সে থমকিত চোখ জোড়া মেলে ইস্মির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোমল মুখখানা অচেনা ঠেকল ওর! একসময় মেঘস্বরে বলল,
“আমাকে ভালোবাসো না?”
“ছেড়ে গিয়েও বেহায়ার মতো ফিরে এসেছিলাম, ভালোবাসতাম বলেই।”
ইজহান চোখের পাতায় একটুখানি ঝাঁকুনি খেল। মুখটা আগের চেয়ে বেশি কঠিন দেখাল। তেড়ে এসে গাল চেপে ধরল ইস্মির,
“তো এখন কী বাসিস না?”
রুদ্ধ স্বরে বলা কথাটা শুনে ইস্মি উত্তর দিলো না, রুষ্ট চোখে তাকিয়েই রইল। ইজহানের সহ্য হলো না সেই দৃষ্টি, সে গাল ছেড়ে দিলো ওর। দু’হাতে কপাল থেকে চুল সরানোর ভঙ্গিতে মাথা চেপে ধরল। বেশ বুঝতে পারছে, রেস্টুরেন্টের বাচ্চাটিকে দেখার পর থেকেই তার বৌ এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে, পাল্টে গেছে, এসবের মানে কী? ইজহান বুঝে পেল না কী বলবে, অস্থির ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলল কয়েকবার এদিকওদিক তাকিয়ে। ইস্মির হাত টেনে ধরে বলল,

“বাচ্চা লাগবে তোর? চল দিব…”
ইস্মির ঘৃণা হলো প্রচণ্ড কথাটা শুনে। হাত ছাড়িয়ে নিলো এক ঝটকায়, কাষ্ঠ হাসলো৷ তিন বছর আগের করুণ স্মৃতিটুকু ভেসে উঠল। দুই মাসের একটা
ছোট্ট ভ্রুণ তার পেটে বড় হচ্ছে, এক সকালে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করে জানতে পেরে সে কতটাই না খুশি হয়েছিল! ভেবেছিল, নিজের সন্তান আসার খবরে লোকটা খুশি হবে, তার সব পাগলামো ছাড়বে।
কিন্তু সে ভুল ছিল! নিজের সন্তানকেও শত্রুচোখে দেখেছে এই লোক প্রথম থেকেই। নিত্যদিন ঝগড়া, ঝামেলা এবং রাগের বশত তাকে আঘাত করে তিন মাসের সেই ভ্রুণটাকে নষ্ট করে দেওয়া, পৃথিবীতে আসতে না দেওয়া! সব তো এই লোকটারই কাজ! এতদিন পর কোনমুখে আবার বাচ্চার কথা মুখে আনে? ইস্মির ধৈর্য চ্যুতি হলো। সে জ্বলন্ত শিখার
ন্যায় বলে উঠল,

অশ্রুবন্দি পর্ব ২১

“এই অসুস্থ সম্পর্কে একটা বাচ্চা এসে আপনার রোষানলের শিকার হোক, আমি মরে গেলেও তা চাই না। আপনার তো ইস্মিকে লাগবে, সে তো আছে। তাকে নিয়েই থাকুন না! আর যদি আমার মতামত জানার জন্যই প্রশ্নটা করে থাকেন তাহলে বলব, একটাই বাচ্চা আমার, যাকে তিনটা মাস গর্ভে ধারণ করেছিলাম, যাকে আপনি পৃথিবীর আলো দেখতে দেননি। ও-ই আলো না দেখা ভ্রুণটাই আমার বাচ্চা, যে আমার কোলে নেই ঠিক, কিন্তু আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। আমার আর কোনো বাচ্চা লাগবে না। আর কখনোই আমি মা হতে চাই না, চাইবও না। না, না, না…”

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৩