অশ্রুবন্দি পর্ব ২৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া
চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে যেন ইস্মির। বুক হাপড়ের ন্যায় উঠানামা করছে৷ সারা গা কাঁপছে। চোখ জলে চিকচিক করছে, গাল বেয়ে পড়ছে। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! ফর্সা, লালাভ গালে হাত বাড়িয়ে ইজহান ছুঁলো তার বউয়ের অশ্রুবিন্দু। আঙুলে একফোঁটা জল নিয়ে সে বিমূঢ় চোখে দেখে গেল তার ইস্মিতাকে। কোনো কথা বাড়াল না আর। দাঁড়িয়ে রইল। ইস্মি এক ঝটকায় ওর হাত ঝেড়ে ফেলে বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ইজহান আটকাল না, নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। তার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত, বুকে আগ্নেয়গিরি আর দুটো চোখ মরুভূমির চেয়েও শুষ্ক! তবে বাইরে থেকে সে ঠাণ্ডা। কারণ— বিবাহিত জীবনের এই পাঁচটি বছরে ইতোপূর্বে তার ইস্মিতার এমন তেজদীপ্ত রুপ, এমন কণ্ঠস্বর সে শোনেনি৷ তাই সে আশ্চার্যান্বিত! বোধগম্য হচ্ছে না তার এ মুহূর্তে কি করা উচিৎ, তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছে ইস্মিতা
তাকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার জন্য চরম ঘৃণাও মনে পুষে রেখেছে! আর সেই ঘৃণার একমাত্র কারণ— তাদের বাচ্চাটা! মনে মনে সে যা আন্দাজ করতো, তা-ই! এর মানে কী? ইস্মি ইজহানের থেকেও বেশি ভালোবাসে তাদের ঐ ছোট্ট ভ্রুণটিকে? যার শরীরের পূর্ণাঙ্গ গঠনই তখন হয়নি! সেই অগঠিত ভ্রুণ, বাচ্চাটার না থাকা স্বত্তেও ইস্মিতা ওকেই বেশি ভালোবাসে এবং এত বছর পরে এসেও? অথচ
ইস্মি ও-ই ভ্রুণটার ছিন্নভিন্ন অংশটা পর্যন্ত চোখে দেখেনি!
ইজহানের বুকের ভেতর যন্ত্রণার এক মিশ্রণ দোলা দেয়, সেই মৃত ভ্রূণের স্মৃতি ভাসতেই। হাসফাঁস লাগে ঐ মাংসপিণ্ডটার কথা মনে করে। গলা শুকনো লাগে তার। কয়েকবার পানি গিলে সে গ্লাস ভরে, কিন্তু তৃষ্ণা মেটে না। এমন যেন, একটা আস্ত সমুদ্র গিলে ফেললেও তার পিপাসা মিটবে না। ইজহানের ক্লান্ত লাগে, শরীর ভেঙ্গে আসতে চায় হুট করে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে বারান্দার দরজা ঘেঁষে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। কেমন যেন খালি, শূন্য মনে হয় ওর নিজেকে। সে হেসে ফেলে ঘর কাঁপিয়ে আচমকা। হাসতে হাসতে চোখে জল জমে ওর। তাচ্ছিল্য আর উচ্চস্বরে বলে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“বাপ হয়ে সন্তানকে মে’রে ফেলেছি আমি, এরজন্য
এত ঘৃণা পুষিস আমার জন্য? কই, কখনো তো মুখফুটে বলিসনি আমায়! তার মানে কি ধরে নেব, তোর মনে এক, মুখে আরেক?”
অনেকক্ষণ কোনো জবাব আসে না বারান্দার দরজার ওপাশ থেকে। যেন আশেপাশে কেউ নেই। ইজহানের মোটেও এই অবাধ্যতা সহ্য হয় না। সে খ্যাঁকিয়ে উঠে।
ইস্মির জবাব আসে কয়েক মুহূর্ত পরে,
“আপনি কী ভেবে নেবেন, ধরে নেবেন সেটা একান্তই আপনার বিষয়। কারণ, আপনার নিজস্ব স্বাধীনতা আছে আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার, যা খুশি তাই ভাবার। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই৷ কিন্তু আমার যেহেতু স্বাধীনতা নেই,
তাই মনেমুখে কি আছে, তা বলতে পারছি না।”
আজ, একটা দিন শুধুমাত্র সে এই মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। কি কি হলো এরমধ্যে…একটা বাচ্চাকে দেখেছে, কোলে নিয়েছে তারপর থেকেই তার এই শান্তশিষ্ট বউটি এমন রুক্ষমূর্তি হয়ে গেছে, বুক চিঁড়ে ফেলা কথা বলছে। ইজহানের বিশ্বাস হয় না এই মেয়েকে। এ তার ইস্মিতা হতে পারে না! প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচানো হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য সে স্থির হয়ে বসে থাকে, তারপর কঠিন কণ্ঠে বলে,
“এই তোকে আমি ভালোবাসি?”
“আপনার মুখে ভালোবাসার কথা মানায় না।”
ইজহান বড্ড বিস্মিত হয়ে পড়ে। হজম হয় না কথাগুলো৷ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে কী মানায়?”
“জোরজবরদস্তি, সন্দেহ, গালাগালি, স্বাধীনতা হরণ করা, কাঠপুতুল বানিয়ে রাখা। মর্জিমতো না হলে
গায়ে হাত তোলা। নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া।
হু, এসমস্ত কথাকাজেই আপনাকে মানায়…”
উগ্র কথার ভার সইতে বাধ্য হওয়া ইজহান আক্রোশপূর্ণ কণ্ঠে বলে,
“আমি এমনই, জানতিস তুই। সব জেনেও তাহলে ফিরে এসেছিলি কেন? আমি তো যাইনি তোকে আনতে, সুযোগ ছিলো তো; কাজে লাগাসনি কেন?”
“ভালোবাসতাম বলে।”
ঝরঝরে, দৃঢ় গলায় বলে ইস্মি। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে ইজহানের। সে তৎক্ষনাৎ এলোমেলো পায়ে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দার দরজা ঠেলে প্রবেশ করতে চায়। ইস্মি ভেতর থেকে খুলে না সেটা। ইজহান প্রথমে থাবা বসায় এরপর প্রচণ্ড লাথি, একেরপর এক। ইস্মি একসময় বাধ্য হয় দরজা খুলতে। রুক্ষমূর্তি ধারণ করা ইজহান চুলের মুঠি টেনে বিছানায় এনে ফেলে ওকে। গলা চেপে ধরে দু’হাতে৷ শীতল আর হিংসাত্মক স্বরে বলে,
“সেই থেকে বলে যাচ্ছিস— ‘ভালোবাসতাম, ভালোবাসতাম।’ কী হাস্যকর! ভালোবাসা কি কোনোদিন অতীতবাচক
হয়? যে ভালোবাসা সত্যি, তার শব্দ, সংজ্ঞা চিরকাল
একই থাকে, একটুও বদলায় না। ভালোবাসা মানে সজীবতা—যার অনুভূতি কখনো নষ্ট হয় না। অথচ তুই বলছিস ‘ভালোবাসতাম’? মূর্খ মহিলা, শোন, ভালোবাসা
যেমন কখনো নিঃশেষ হয় না, তেমনি এই শব্দটারও
কোনো অতীত – ভবিষ্যৎকাল হয় না। ‘ভালোবাসতাম’
বলার মানেই হলো— তুই কোনোদিনই ভালোবাসিসনি!”
ইস্মি দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করে উঠতে চায় দেহটা। কিন্তু সে নড়েচড়ে না, চিৎকার করে না। শুধু অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হিংস্র সত্তা ধারণ করা স্বামী নামক পুরুষটিকে। মনে মনে প্রার্থনা করে সে এই অবস্থায়— নিঃশ্বাসটুকু নিয়ে নিক লোকটা, মুক্তি দিক ওকে এই নরকযন্ত্রণা থেকে।
ইস্মিকে ওমন ধীরস্থির দেখে ইজহানের হাতজোড়া শিথিল হয়ে আসে। এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে এই মেয়েটির দিকে— আকুতিভরা কণ্ঠস্বর কোথায়, বাঁচার ছটফটানি কোথায়? ছাড়া পাওয়ার জন্য এতটুকু ইচ্ছেও কি নেই ওর? ইজহান চোখ বুজে ফেলে। কি ভেবেছে এই মেয়ে? এত সহজে মরে যাবে, এরপর ইজহানকে একাকিত্ব উপহার দিয়ে শাস্তি দিবে? মুক্তি চায় ও, ইজহানের থেকে মুক্তি? মস্তিষ্কের পোকাটা আবারো কিলবিল করে উঠে ওর। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়। রাগে শরীরের প্রতিটি কোষ ফুঁসে উঠে একসাথে। সামনে থাকা চেয়ারটা লাথি দিয়ে সে উলটে ফেলে। আছড়ে ভাঙে সবকিছু। ভাঙচুরের শব্দ পেয়েও ইস্মি উঠে না, আগের মতোই স্থির পড়ে থাকে বিছানায়, কোনো হেলদোল করে না। শুধু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা! তা দেখে উদ্ভ্রান্ত ইজহানের সবকিছু এলোমেলো লাগে, মাথা চেপে ধরে সে। ইস্মি কেন ওকে থামাচ্ছে না, থামতে বলছে না? রাগে ওর কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইজহানের চোখে ক্ষোভের আগুন, আক্রোশ তার গলার গভীর থেকে বেরিয়ে আসে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে তীব্র ঘুষি বসিয়ে সে গর্জে ওঠে,
“পাঁচটা বছর! পাঁচটা বছর তুই আমার কাছে; অথচ আমি বুঝতেই পারিনি—তুই আর ছলনাময়ীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! তুইও ঠিক সবার মতো, ভালোবাসার নামে, যত্নের নামে আমাকে এতদিন ভুলিয়ে রেখেছিস। নিজে সাবিত্রীর মুখোশ পরে সবাইকে দেখিয়েছিস, তুই দেবী আর আমি এক অত্যাচারী স্বামী! যাতে সবাই ভাবে আমি খারাপ, আমি উগ্র, আমি তোর জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছি, নরকে পরিণত করেছি! প্রতিশোধ নিচ্ছিস তাই না, তোর সন্তানকে মে’রে ফেলেছি তাই?”
“ভুল, আপনি ইস্মিতাকে মেরে ফেলেছেন, আর মৃত মানুষ প্রতিশোধ নিতে পারে না।”
শুয়ে থাকা ইস্মির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে, চোখের কোণ টনটন করে, কিন্তু মুখের বিভীষিকাময় হাসিটা স্থির থাকে। ইজহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর শক্তি তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। সে
দেখে তার ইস্মিতার হাসি, বিধ্বংসী দৃষ্টিতে। তার আদরের ইস্মিতা কি জানে, তার ক্ষতবিক্ষত বুকের ভেতর রক্তবন্যা বয়ে যাচ্ছে?
ইহসান সৃজাদের শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে জামাই আদর খেতে চলে গেল। গেল বললে অবশ্য ভুল হয়। বলা যায়, সৃজার মনের দুঃখ কমাতে সে বাধ্য হয়েছে আসতে। কারণ বাইশ বছরের ধ্যাড়ি মেয়ে গতরাতে ঘুমানোর সময় তার আড়ালে কাঁথায় মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে ভীষণ, ওকে মিস করবে বলে! রাতে হুট করে নাক টানার শব্দ কর্ণপাত হতেই ঘুম থেকে ধরফড়িয়ে উঠে ইহসান, কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিল না সৃজা, চাপাচাপি করাতে স্বীকার করেছে অনেক পরে। তার সৃজা, তার বউ— তাকে মিস করবে বলে এমন বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি করে ফেলছে দেখে ইহসানের মাথায় গণ্ডগোল লেগে গেল।
অশ্রুবন্দি পর্ব ২২
তাই একটা দিন সৃজার সঙ্গে শ্যাওড়াপাড়ায় কাটিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলো! পরের দিন বিকেলের দিকে তাই চলে এলো ওদের বাড়ি। মাসখানেক পর নিজ বাড়িতে, সবাইকে পেয়ে আগের উৎফুল্লতা ফিরে এলো সৃজার মাঝে। বাবা, এলিজা, নীলু ফুপি সবাইকে যে কী মিস করতো এটা শুধু তার মন জানে। ইহসান ওকে হাসিখুশি দেখে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যদিও তার হিংসা লাগছিল। কারণ বাকি ছয়টা দিন সৃজাকে ছাড়া সে একা ঘরে, একা বিছনায় ঘুমাবে। কতটা কষ্ট হবে ওর, ভেবেছে কী এই পাষাণী?