অশ্রুবন্দি পর্ব ২৬

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া

তিনদিন যাবৎ সৃজা শ্যাওড়াপাড়ায় বাবার বাড়ি এসেছে। তিনটা দিন ওর কাছে তিনযুগের ন্যায় লম্বা লাগছে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে সে একটা পুরুষকে দেখেনি, তার কণ্ঠস্বর শোনেনি, তার বুকে ঘুমোয়নি, তাকে আলিঙ্গন করেনি, তার চুমু কপালে পায়নি। যদিও প্রতিদিনই ইহসানের সাথে ওর ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে, রাতে ঘুমানোর সময় আধঘন্টা প্রেমালাপ, দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া হচ্ছে তবুও সৃজার কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। এ ব্যপারটা কারো কাছে স্বীকার করেনি সৃজা, কিন্তু এলিজার জহুরি চোখ বোনের অস্থিরতা দেখেছে, তার মনের অবস্থা টের পেয়েছে। যেহেতু আপু ওকে কিছু বলেনি, তাই এলিজাও এ বিষয়ে প্রশ্ন করে বোনকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়নি। এসব প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি খুবএকটা সে বোঝে না। কিন্তু বোঝে এই অনুভূতিটা খুব দামী।

এটা খুব গোপন আর একদম নিজস্ব হয়। কখনোসখনো এই অনুভবের যাতনায় নিজেকেই জ্বলতে হয়, পুড়তে হয়। মোটকথা, ভালোবাসা মানে নিজের সীমাহীন যন্ত্রণা মেনে নেওয়া, অন্যের জন্য। এলিজা বারান্দায় তিতকুটে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বাবার সেবাযত্নে ব্যস্ত সৃজাকে দেখছিল। আচমকা সৃজার চোখ পড়তেই সে জিজ্ঞেস করল,
“দেয়নি ফোন?”
এলিজা হাতে থাকা সৃজার ফোনটাতে আরো একবার ঘাড় নাড়িয়ে ‘না বোধক’ উত্তর দিতেই সৃজা অন্ধকার মুখ করে বাবার ঔষধপত্র গুছিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তবে যেতে গিয়েও ফিরে এসে বসল ওর পাশে। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে এলিজাকে কড়া কণ্ঠে আদেশসূচক বলল,
“ফোনটা তোর কাছে রাখবি, যদি রাতে কলটল দেয় ধরবি না। ধরলেও বলে দিবি আমি ঘুমিয়ে গেছি।”
এলিজা সৃজার বাধ্য বোন। কখনোই বোনের কথা অমান্য করে না সে। কিন্তু অবোধ বালিকার মতো বোনের অভিমান দেখে ওর হাসি পেল। সেটা অনেক কষ্টে চেপে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া হয়তো কাজে, কোথাও হয়তো আটকে গেছে। বাড়ি ফিরে হয়তো ফোন দেবে। তুমি বাচ্চাদের মতো রাগ করো না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৃজা ওর কথা শুনে বিব্রত হলো। ইহসান সন্ধ্যা থেকে ওর ফোন ধরছে না। সাতটার দিকে শুধু একটা ম্যাসেজ লিখেছে ‘সুন্দরী বউ দূরে থাকলে আসলেই জ্বালা, দূর থেকে স্বামীর অ্যাটেনশন চাই সারাক্ষণ। কাছে চলে আয়, এত ভুগতে হবে না আমার মতো।’ সেই থেকে সৃজার মন-মেজাজ খারাপ। কল দিলেই বুঝি অ্যাটেনশন সিকার হয়ে যায়? ও তো খোঁজখবর জানতে চাইছিল, লোকটার হ্যাড়ে গলাটা শুনতে চাইছিল। এটা কী দোষের কিছু? না তো। পরক্ষণেই সৃজার বোধোদয় হলো৷ এতটা উতলা হওয়া আসলেই ঠিক হয়নি! সম্প্রতি, ইহসান নিজের আইডিয়া ব্যবহার করে একটি টেক স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি তার আইডিয়া হাতিয়ে নিয়ে বাজার থেকে তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এ নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছে ইহসান, দিনরাত দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে তাকে। ব্যস্ততার এই চক্রে সৃজার জন্য সময় বের করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। গতরাতেই বলে দিয়েছিল ইহসান।

কিন্তু এরপরেও চিন্তা হচ্ছিল বলে ওকে কল দিয়ে জ্বালিয়েছে সৃজা। কাজে মনোনিবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ইহসান কড়া গলায় ওকে ধমকের পাশাপাশি ওর ফোনে কারফিউ জারি করে দিয়েছে সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত। এ সময় নো ফোন, নো কথোপকথন। কিন্তু বউ তো, সৃজা এই কারফিউ থোরাই কেয়ার করে একেরপর এক কল দিয়েই গেল৷ ইহসান যখন একটা কলও রিসিভ করল না তখন থেকেই ওর মনে অভিমানের মেঘ জমতে জমতে আশি কেজি ওজন ধারণ করে ফেলেছে। এলিজার কথাটা শুনে তাই সৃজার মনে হলো আসলেই সে বাচ্চাদের মতো রাগ করছে, যার কোনো মানেই হয় না। উল্টো মানুষটার উপর যা চাপ যাচ্ছে, তাতে নিজে থেকেই ওকে বোঝা উচিৎ ছিল সৃজার। ও নিজের উপর বড্ড বিরক্ত হলো। অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে প্রসঙ্গ বদলে এলিজাকে বলল,
“রুমে চল, ঘুমাবি তো!”

“এখন ঘুমাব? মাথা খারাপ আপু! টেস্ট পেপার অর্ধেকটাও কমপ্লিট হয়নি। অনেক পড়া বাকি, তুমি শুয়ে পড়ো…”
এলিজা পড়াশোনার বিষয়ে কতটা সিরিয়াস তা জানে সৃজা। তার বোনের স্বপ্ন, আইন নিয়ে পড়বে, ব্যারিস্টার হবে। এরজন্য ছোট থেকেই পড়াশোনায় ডুবে থাকা মেয়ে সে। সৃজা ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“খুব চাপ যাচ্ছে, না?”
এলিজা তিতকুটে কফিতে শেষ চুমুকটা বসিয়ে বলে,
“মার্ক আনতে চাপ গিলে খেতেই হবে। টেস্ট পরীক্ষায় টুয়েন্টি মার্কের জন্য ফার্স্ট প্লেইজ হাতছাড়া হয়েছে। ফাইনালে আমি তা চাই না।”

সৃজার খুব মায়া হলো বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছুদিন পর এইচএসসি ফাইনাল। মুখটা শুকিয়ে আছে পড়াশোনার চাপে। সারাদিন তো পড়ছেই, রাতেও পড়ছে। ঘুমায় ফজরের সময়, উঠে পড়ে আটটায়। এরপর এগারোটায় টিউশন পড়তে বেরিয়ে বাসায় ফিরে বিকেলে। ফিরেই আবার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সৃজা হাত বুলিয়ে দিলো এলিজার মাথায়। এলিজা কিছু বলল না, চুপ করে বোনের আদরটুকু উপভোগ করল। তাদের সম্পর্ক একদিকে যেমন ভালোবাসার, তেমনি তীব্র দুঃখ ও বোঝাপড়ার। একে অপরকে ঘিরে হাজারো আশা, দুঃখ, সুখ এবং কষ্টের জগত তাদেরকে একভাবে বেঁধে রাখে। সৃজা এলিজার কাছে মায়ের মতো, আর এলিজা সৃজার কাছে তার ছোট্ট স্নেহময়ী বোন, যাকে সে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে।

দু’জনের জীবনে অনেক কঠিন সময় গেছে, কিন্তু সেই ছোট বয়স থেকেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। সৃজা শক্ত হলেও মাঝে মাঝে নিজের দুঃখবোধ চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশ করে ফেলে, কিন্তু এলিজা তেমন নয়। তার চিন্তাধারা অন্যরকম—বিচক্ষণ এবং পরিপক্ব। সে কখনো নিজের ক্ষত অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চায় না, পারেও না। নিজের অনুভূতিগুলোকে কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে আত্মমর্যাদা বজায় রাখতেই স্বস্তি পায়। সৃজা ছোট বোনটাকে চেয়ে দেখল, একদৃষ্টিতে! কী সুন্দর প্রিন্সেসের মতো চেহারা! রুপে-গুণে একটুও কমতি নেই। কথাবার্তা, পড়াশোনা, চলাফেরা সবকিছুতে মার্জিত ভাব। কিন্তু একটাই মুদ্রাদোষ তার ছোট বোনটির, কখনোই কোনো অন্যায় দেখলে মুখবুজে থাকতে পারে না। নিজের যেটা ঠিক মনে হবে, সেটাই করবে। এরজন্য এলিজাকে নিয়ে গর্ব হলেও মাঝেমধ্যে ওর খুব ভয়ও করে।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। নামাজ শেষ করে এলিজা কুয়েশ্চন পেপার সলভ করছে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু ওর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাল ফোনের ভ্রাইবেশন। এলিজা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল সৃজার ফোনটা টেবিলের একপাশে জ্বলজ্বল করছে। ও বইটা বন্ধ করে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করতেই ইহসানের অস্থির, হেড়ে গলার ধমক শুনতে পেল,
“সৃজা কা বাচ্চি, আমার ফোন ইগনোর করিস তুই? সামনে পেলে মেরে মুখ ভেঙ্গে দেব…”
“ভাইয়া আমি এলিজা, আপু তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”

এলিজার কণ্ঠ শুনে ওপাশ থেকে ইহসান চুপ করে গেল। ফোন ওর কাছে কেন? ওহ! প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে, তখন ফোন ধরেনি বলে? ইহসানের রাগ হতে লাগল। পরক্ষণেই অস্থির হলো। ভার গলায় বলল,
“শোন এলিজ, এক্ষুনি যা বললাম ওসব ফাঁকা বুলি। আমি তোর বোনকে স্বপ্নেও মারতে পারি না। মুখ ভেঙে দেওয়া তো দূর! উল্টো তোর বোন আমায় খুব চাপে রাখে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন যে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায় করে ফেলি! দোয়া করিস আমার জন্য৷ আমি কিন্তু তোর আপুকে আদরে রাখি, এবিউজার না।”
এলিজা সিরিয়াস গলায় বলল,

“জানি, আপু ন্যাগিং ওয়াইফ।”
“এইতো ঠিক ধরেছিস।”
এলিজা হাসি চেপে বলল,
“কথা বলবে আপুর সাথে?”
ইহসান স্বস্তির শ্বাসটুকু ছেড়ে মাথা নাড়লো, যা ওপাশের এলিজা জানল না। এক্ষুনি সৃজার গলা শুনতে হবে তার, নয়তো রাতে ঘুমাতে পারবে না।
তার তৃষ্ণা পাচ্ছে, বউয়ের কণ্ঠস্বর শোনার। পাছে এলিজার কাছে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হয়, তাই
সে দোষটা সৃজার উপর চাপিয়ে দিয়ে বলল,
“না বললে যদি কথা শোনায়? অত্যাচার করে? চিনিস না তুই ওকে, আস্ত প্যাঁচের বস্তা নিয়ে ঘুরে। তুই ডেকে দে নয়তো?”
এলিজা ওর মনোভাব বুঝে গেল৷ একটুক্ষণ চুপ করে বলল,
“কাঁচা ঘুম ভাঙালে যদি মাথাব্যথা করে? ডাকা কি উচিৎ হবে?”
উত্তেজনায় ভাটা পড়ল ইহসানের৷ হতাশ হয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“তাহলে ঘুমাক।”

সৃজার অনুপস্থিতি স্বস্তি আর সুখ দিচ্ছে লিথুকে।
দুটো দিন ধরে তার মনে যারপরনাই আনন্দ। লাল, হলুদ, কমলা রঙের কিছু শিফন শাড়ি অনলাইন থেকে অর্ডার করে আনিয়েছে। ওগুলো পরে সারা বাড়িময় ঘুরঘুর করছে। উদ্দেশ্য— ইহসানকে আর্কষিত করা। শাড়িতে বাকি সুন্দরীদের আরো সুন্দর লাগে। পুরুষেরা প্রেমে পড়ে, তাদের দুর্বলতা নাকি শাড়ি। ইস্মিকে দেখেছে লিথু, বিয়ের পর থেকে শাড়িই পরে, কখনো সালোয়ার-কামিজ পরেনি। বাড়িতে থাকলে সবসময় ইজহান ওকে চোখে হারায়। যেহেতু, ইহসান- ইজহানের পছন্দে মিল আছে, তাই ইহসানেরও শাড়িতে নিশ্চয় দুর্বলতা আছে। লিথু আজ অবধি সৃজাকে শাড়ি পরিধান করতে দেখেনি। তাই ওর অনুপস্থিতিতে ট্রাই করে ইহসানকে নিজের প্রতি
দুর্বল করতে চাইছে! সকালে ইজহান ব্রেকফাস্ট করতে বসে বিরক্ত হলো লিথুকে দেখে। পাতলা, স্বচ্ছ শাড়ির বেশিরভাগটাই খোলামেলা। আঁচল তুলে রাখা কাঁধের উপর। অঙ্গভঙ্গিও সুবিধার নয়। ইস্মিও লিথুর শাড়ি পরার ধরণ দেখে খুব বিব্রত হলো শ্বশুর আর ইজহানের সামনে। ও তাকাল না, চুপচাপ নাস্তা তুলে দিলো পাতে। ইজহান কাটাকাটা স্বরে লিথুকে ‘গভীর রাতের পরী’ বলল। লিথু কম্পলিমেন্ট পেয়ে খুশিতে ইজহানকে ধন্যবাদ জানাতেই ইজহান রগচটা স্বরে বলল,

“ঐ পরীগুলা রাস্তায় পুরুষ দেখলেই ঢলে পড়ে,
বুঝলা লিথুরাণী? তোমার শাড়ি পরার ঢং ভালো, চালিয়ে যাও। তবে আমার বাড়ির বাইরে…”
লিথু প্রথমে বোঝেনি, কিন্তু যখন বুঝল কথাটা ভিন্ন অর্থে বলেছে ইজহান ওর রাগ হলো। ইস্মিকে আড়চোখে দেখে তর্কে গেল,
“আপনার বউও তো শাড়ি পরে, তারেও কি ওমন লাগে?”
মাথায় রক্ত চড়ে গেল ইজহানের, গ্লাসে থাকা জুসটা ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে উঠল,
“ইস্মিতার সাথে নিজের তুলনা? ওর পায়ের নখের যোগ্যতা আছে তোর? আছে? গলাটা চিপে শ্বাসটা নিয়ে নেব একদম…”

তেড়েফুড়ে গেল ইজহান। ইস্মি ব্যস্ত হয়ে ওকে সামলাতে গেল, আজিজ শেখ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে লিথুকে ইশারা করলেন, ভয়ে একছুটে মিতুর ঘরে গিয়ে দোর আটকে দিলো লিথু। ইজহান গর্জন করে আজিজ শেখকে বলল,
“প্রস্টিটিউটদের মতো ব্যবহার, অঙ্গভঙ্গি! আমার ইস্মিতার সাথে তুলনা করে নিজেকে? এত্ত সাহস
পেল কই রমিজ আলীর মেয়ে? ভেড়ার গলায়
ঝুলাতে চাইছ, ঝুলাও নয়তো বাড়ি থেকে বের কর, আমি কিন্তু ছাড়ব না একে!”
আজিজ শেখ ইজহানকে উত্তেজিত হতে দেখে
ভড়কে গিয়ে বললেন,

“এমন করব না ও আর, ভুল করছে। আমি ওরে মাফ চাইতে বলব বড় বউয়ের কাছে।”
“কীসের মাফ? ইস্মিতার আশেপাশে ঘেঁষলে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলব। কোনো মাফ নাই।”
আজিজ শেখ ইশারা করলেন ইস্মিকে। উত্তেজিত আর রাগান্বিত ইহসানকে ইস্মি জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করল। ইজহান ওর পেট জড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ডুবিয়ে রইল। ইস্মি শুধু বলল,
“রাগ কমানোর চেষ্টা করুন।”
“হয় না।”
“আপনি একটা পাগল।”
“শুধু বউপাগল।”

মিতু ইজহানের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ব্যস্ত। এদিকে লিথুর রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। নিজের বউ পুতপবিত্র আর অন্যরা গভীর রাতের পরী? রাগ-জেদ ওর মন এমনভাবে গ্রাস করে নিলো যে লিথু সিদ্ধান্ত নিলো ও এভাবেই শাড়ি পরবে, ইহসানের সামনে যাবে। কে কি বলল সেসব গুণবে না। তবে ইহসানের সামনে যাবে বললেই চলে না, এই লোক কখন বাড়ি থেকে বেরুয়, রাতে কখন ফেরে লিথু বুঝে উঠে না। তাই দু’টো দিন তক্কেতক্কে রইল। তাতে কাজ হলো। সামনে পড়ল কয়েকবার। বউ ছাড়া বিবাহিত পুরুষ আর আগুনের গোলা; দুটোর মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। এরা সবসময় হল্কা ছড়ায়। এসময়টাকে কাজে লাগানো সোজা। লিথুও সুযোগ নিলো। ভদ্রসভ্য হয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল। লিথু হাসতো চোখাচোখি হলে, কিন্তু ইহসান এমন একটা ভাব করতো যেন ওর সামনে কেউই নেই। তবুও লিথু হাল ছাড়ল না। কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। এটা-ওটা করে। রাতে যখন ইহসান বাড়ি ফেরে সেসময়টাতে ইচ্ছে করে সিঁড়ির ওখানে ঘুরঘুর করে। ইহসান কিছু বলে না। লিথুর সাহস বাড়তে লাগল। একদিন তো ছোট্ট করে কাগজে চিরকুটও লিখল,

“তৃষ্ণার্ত হৃদয়টাকে একটু স্বস্তি দিতে পারো কি, শেখসাহেব?”
এরপর সেটা ইহসানের ঘরে গিয়ে বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখে এলো। পরদিন সকালে সামনে পড়তেই লিথু মনে মনে ভয় পেল, কিন্তু ইহসান কিছুই বলল না। বক্র হাসি উপহার দিয়ে চলে গেল। লিথু চমকাল, থমকাল। প্রত্যাশার চেয়েও বেশিকিছু পেয়ে সন্দেহ হলো, লেখাটা কী পড়েছে ইহসান? নাকি না? পড়লে তো কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া করতো। পজেটিভ নয়তো নেগেটিভ! কিন্তু কিছুই বলেনি, এর মানে কী? উত্তেজিত লিথু ইহসানের ঘরে গিয়ে বালিশের তলায় কাগজটা পেল। হাতে তুলে নিয়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ইহসান শুধু পড়েইনি, লিথুর লেখার নিচে নিজেও লিখে গেছে,

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৫

‘স্বস্তিটুকুই চাই?’
অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আনন্দে লিথুর চোখে পানি চলে এলো। পাল্টা উত্তরে লিখল,
‘চাই—পুরোপুরি তোমাকে, তোমার মনোযোগকে। এরজন্য সবকিছু করতে রাজি আমি। একবার ঠাঁই দিয়ে দেখোই না শেখসাহেব!’
পরদিন এর পাল্টা উত্তর এলো,
‘প্রুফ নেব,
—রাত বারোটা।’

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৭