অশ্রুবন্দি পর্ব ২৭

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া

সৃজার বেশ লজ্জা লাগছে। রাতে ঘুমিয়ে পড়ায় ফোনে লোকটার কণ্ঠস্বর শোনেনি, কিন্তু এলিজার কাছে মানুষটার উদ্বিগ্নতার খবরটুকু ওর মনটাতে আলতো করে দোলা দিয়ে গেল। অনুভবে, অনুরণে অবাধ্য মানবকে মনে করে চিত্ত শিহরিত হয়, রাগ গলে পানি হয়। গায়ে সাতশো টাকার সুতির জামা, সস্তার স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে রাখা সৃজাকে যেদিন ইহসান ওর হাত ধরে বিয়ে করতে বেরিয়ে গেছিল, সেদিন সৃজা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দ্বিধান্বিত ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে, ইহসানের পাশে যে নিরাপত্তা আর শীতল শান্তি অনুভব হয়েছিল, তা অস্বীকার করতে পারে না ও।বরং আশেপাশের মানুষজনের অপবাদকে বুড়ো আঙুল দেখানোয় ইহসানের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। বেশিকিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি, শুধু বিয়ে কেন করেছে, এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু লোকটা কোনো সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়নি— রহস্য করে হেসে, একেকবার একেক বুঝ দিয়েছিল। কিন্তু সেদিনের স্বীকারোক্তির পর সৃজা বুঝে, ইহসান তাকে কতটা অনুভব করে, কতটা গুরুত্ব দেয়!

আর সেই অনুভূতির গভীরতায় মধুর এক আলোড়নে ভরে ওঠে ওর হৃদপিণ্ডটি। হিমেল বাতাসে রক্তের ভেতর জ্বলে ওঠে দুর্বার উত্তাপ। মৃদু শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে রক্তকণিকায়। রক্তিম মুখখানির দুর্বলতা যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য মুখ ফিরিয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের এক গোপন কোণে সে স্পষ্ট টের পায়, ইহসান তার ভাবনায় রঙ ছড়াচ্ছে, নিঃশব্দে, নিবিড়ভাবে।
“আই গেস, তুমি লজ্জা পাচ্ছ আপু!”
এলিজার কথায় ঘোর থেকে সৃজা অপ্রস্তুত হয়। বারান্দার ফুল গাছগুলোর মরা পাতা বেছে ফেলতে ফেলতে চকচকে মুখখানি স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা করে বলে,
“মোটেও না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুমি আসলে ভাইয়ার প্রতি উইক হয়ে পড়েছ!
যারজন্য মিথ্যে বললে সেটা তোমার চোখেমুখে ফুটে উঠে, তাই ভুল করেও মিথ্যে বলো না।”
“ইঁচড়েপাকা হচ্ছিস দিনদিন— তুই উইকের কী বুঝিস?”
এলিজা হেসে বলে,
“তুমি কি সত্যি ভাবো আমি কিছু বুঝি না? আহ, সিস্টার মাইন, ভাইয়া যদি তোমার জন্য এভাবে পাগলপারা হয়ে ঘুরে, তাহলে একটু তো বুঝবই!”
সৃজা এবার গাছের শুকনো পাতাগুলো একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“তুই যা, নিজের পড়াশোনা কর। এত জ্ঞান দিতে হবে না আমাকে।”
এলিজা ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্টু হাসে। ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করে কল লিস্টের প্রথম নাম্বারটিতে। এরপর সেটা সৃজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। সৃজা ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে ইহসানের গলা শোনা যায়, খানিক কর্কশ, খানিক উত্তেজিত। যেন অপেক্ষাতেই ছিল,

“সৃজু বলছিস?”
সৃজা চোখ বন্ধ করে হালকা শ্বাস নেয়। শব্দহীন, কিন্তু গভীর অনুভূতিতে ধীর স্বরে বলে,
“হুম।”
ইহসান একটু হাসে, সেই হাসির মধ্যে একটা
চাপা অভিমান মিশে থাকে।
“তোর একটা ‘হুম’ শুনতে সারা রাত অপেক্ষা
করেছি, জানিস?”
“উহু।”
ব্যাকুল চিত্তে বলে ইহসান,
“উফ! তোর কণ্ঠের পাণিপ্রার্থী আমি জান, কিন্তু
এখন ভীষণ ব্যস্ত। কিছু একটা বল। হাতে সময় নেই। রাতে কথা হবে। রাগ করে থাকিস না, কিছু বল…”
উচাটন কণ্ঠস্বরকে থামাল সৃজা,
“রেগে নেই আমি, কাজে মন দাও। ফোনের
অপেক্ষায় থাকব।”

বাড়িতে সৃজা নেই, তাই ইহসান ইদানীং রাত করেই ফেরে। আজ ফিরল সাড়ে দশটায়। শেফালি বুয়া ওর অপেক্ষায় ঝিমুচ্ছিল, ফিরতেই খাবার গরম করে ঘরে দিয়ে গেল। ইহসান বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, বলতে গিয়েও বলল না সে। একজন তারজন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করেছে, তার দামটুকু সে দিলো। শেফালি বুয়া চলে গেলে ও দু-লোকমা খেয়ে নিলো। বাকিটা ঢাকা দিয়ে রাখল। একটা মেইল আসার কথা, ইহসান ল্যাপটপ খুঁজল তার। পেল টেবিলের ড্রয়ারে। চার্জ নেই, তাই চার্জে বসিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার আশায় বিছানায় পিঠ ঠেকাল সে। এরমধ্যেই ফোন বেজে উঠল৷ সৃজার ফোন। রিসিভ হতেই
দু-একটা কথার পর জিজ্ঞেস করল,

“খেয়েছ?”
“দু’বার ডিনার সারলাম!”
সৃজা বিস্মিত হবার ভান করে বলল,
“বাবাহ! আমি নেই দু’বার করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে? এমনিতে তো বলে-কয়েও এক প্লেট ভাত বেশি খাওয়াতে পারি না।”
ইহসান নাটুকে স্বরে বলল,
“কী আর বলব বল! তুই যাওয়ার পর থেকে, শরীরে জোর পাই না, উঠে দাঁড়াতে গেলে মাথাটা ঘুরে। বমি বমি পায়। চোখে অন্ধকার দেখি! আসল খাওয়াদাওয়া হচ্ছে না, পুষ্টি পাচ্ছি না তো। তাই নকলটা দিয়ে কভার করা চেষ্টা মাত্র, এই যা!”
সৃজা বেলাজ কথাগুলো শুনে রেগে যেতে গিয়েও গেল না। তীক্ষ্ণ স্বরে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“বাবু আসবে মনে হচ্ছে।”

“কার?”
“লক্ষ্মণ যেহেতু তোমার দেখা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে তোমারই।”
বাকরুদ্ধ বনে গেল ইহসান। হজম হলো না কথাটা। চেঁচিয়ে ধমকে উঠল সে,
“এসব কী কথাবার্তা রে সৃজা? কোথা থেকে শিখলি? তুই তো এমন নোস! মুখেও আনবি না ওসব অযাচার। ভুলে যাস না আমি ভদ্রলোক, ওসব কর্মকাণ্ড আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
“কে যেন লাল পানি খেয়ে লাউঞ্জে মাতলামি করেছিল?”
“শাট আপ।”
সৃজা ধমক খেয়ে মনে মনে প্রমাদ গুণল। অভিমান টানল গলায়। অস্ফুটস্বরে বলল,

“তুমি একটা খারাপ লোক। আমাকে শুধু ধমকাও, নিজে যখন উল্টাপাল্টা বলে মজা নাও তখন আমি এভাবে তোমাকে ধমকাই? নিজের ষোলো আনা চাই, আর মানুষের বেলায় এক আনা-ও নিতে পারবে না।”
“তুই আমার কত আদরের! তুইবিহীন ওসব ষোলো আনা টোলো আনা ভিত্তিহীন…”
“হুহ! আমাকে ভুলানোর ধান্ধা! মুখে মধু অন্তরে বিষ, মাথাভর্তি স্বৈরাচারী আর শয়তানি বুদ্ধি তোমার।”
ইহসান এ কথা শুনে হেসে ফেলল। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আচমকা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এত তাড়াতাড়ি চিনে ফেললি আমায়?”
সৃজা কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা বুঝে উচাটন হলো। হৃদমঞ্জিলে ব্যাকুল হাওয়া টের পেল। ফিসফিস করে বলল,

“ফেললাম যে!”
“তাই?”
“হুম।”
ইহসান উৎকণ্ঠিত অস্থিরতা নিয়ে এবার শুধায়,
“প্রেমে পড়েছিস?”
“সেতো কবেই।”
“ভালোবাসিস?”
জবাবে লজ্জা কাতুরে সৃজা নিরুত্তর রইল। ইহসান মিনিটখানেক অপেক্ষা করে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই সৃজা আবারো ফিসফিস করে সাড়া দিলো,
“বাসি তো, ভালোবাসি।”
ইহসান তীব্র গলায় বলল,
“তাহলে বলব ভালোবেসে অন্ধ হয়েছিস তুই,

চিনতে পারিসনি আমায়।”
“কেন?”
“চিনলে ভালো দূর, প্রেমেও পড়তি না।”
“আচ্ছা, এত খারাপ তুমি?”
ইহসান শ্লেষাত্মক হেসে বলল,
“খারাপ, উহু! অতিরিক্ত ভালো—তবে জানিসই তো অতিরিক্ত ভালোও ভালো নয়।”
সৃজা আগামাথা বুঝল না কথার। জিজ্ঞেস করতে যাবে এসব কথার মানে কী, তখনই প্রসঙ্গ বদলে ফেলল ইহসান,
“পড়াশোনার কি অবস্থা, ভার্সিটি যাচ্ছিস?
তোর না এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেইট পরশু!”
সৃজা ভাবলেশহীন স্বরে বলল,
“তোমার ঘাড়ে যখন চাপিয়েছ, আমার সব দায়িত্ব তোমারই। অহেতুক পড়াশোনার এত চাপ নিয়ে মস্তিষ্কের বারোটা বাজাতে চাই না, এবার একটু
পানাহ চাই। লেখাপড়া আর করব না ঠিক করেছি।”

ইহসানের দৃঢ় ও বিস্মিত কণ্ঠস্বর,
“সিরিয়াস তুই?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে?”
“কিছুই মনে হচ্ছে না, আবার হচ্ছেও!”
“মানে?”
“দেখ, তোর ভাবনায় একচোখামি পাওয়া গেছে। তুই শুধু মস্তিষ্কের কথা ভাবছিস, শরীরের কথা ভাবছিস না। আমি বলি কী! তোকে যদি একেবারে পঙ্গু বানিয়ে রেখে দিই তাহলে সাময়িক কষ্ট হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তোর কষ্ট কমবে। পড়াশোনার জন্য তোর মস্তিষ্ক আর শরীর কোনোটাকেই চাপ নিতে হবে না। উল্টো আমার ঘাড়ে যখন চাপিয়েছি, তখন ঘাড়ে বসে বসেই না-হয় আরাম-আয়েশ করবি, বাচ্চা-কাচ্চা পালবি, সংসার সামলাবি। আইডিয়াটা ভালো না?”

আহাম্মক বনে গেল সৃজা। সে তো এমনি এমনিই কথাটা বলেছে। এসাইনমেন্ট জমা করার লাস্ট ডেইট পরশু, অবশ্যই যেতে হবে ভার্সিটিতে। কিন্তু যাবে বললে ইহসান বাইক নিয়ে চলে আসবে ড্রপ করতে। যেটা ও চায় না। তাছাড়া সৃজা চেয়েছিল ভার্সিটি শেষে একবার রেস্তোরাঁয় ঢু মেরে ইহসানকে চমকে দিয়ে আসবে। অথচ এই লোক দেখ কেমন করে ওর সাথে কথা বলছে, ঠাণ্ডা স্বরে হুমকি দিচ্ছে! সৃজা কটমট করে বলল,
“আমাকে পঙ্গু বানিয়ে লিথুরাণীকে নিয়ে বাইকে
চড়ানোর মতলব কষছো বুঝি? শত হলেও এক্স হবু স্ত্রী তোমার…”
সৃজা ভেবেছিল ইহসান এ কথা শুনে ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তা হলো না। ওকে অবাক করে দিয়ে ইহসান
নিচু স্বরে বলল,
“মন্দ বলিসনি।”
সৃজা বিস্মিত হলো প্রথমে এরপরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। রাগারাগি করে একাকার হয়ে গেল। ইহসান এসব কিছু পাত্তা না দিয়ে শুধু বলল,
“রাগের বারুদ আমার উপর না ঝেড়ে বরং আমার আইডিয়াটা ভেবে দেখিস, শুভরাত্রি!”

লিথু নিজের উত্তেজনা সামলাতে পারছে না। সে খুশিতে ডগমগ। সবচেয়ে বড় কথা ওর এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না ইহসান তাকে সিগন্যাল এএক্সেপ্ট করেছে। এর মানেটা খুব ভালোভাবেই জানা আছে লিথুর। আবারো প্রমাণিত হলো, পুরুষমানুষ নারীসঙ্গ পাবার জন্য বহুদিন অপছন্দের তালিকায় ফেলে রাখা কারো প্রতিও দুর্বল হয়। লিথুর অবশ্য ধারণা, ইহসান তার নতুন রুপ মানে শাড়ি পরা রুপ দেখেই গলেছে। অবশ্য গলবে না-ই বা কেন? শাড়িতে
তাকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চেয়ে কম কিছু লাগে নাকি? সাথে যদি বারগেণ্ডি খোলা চুল আর ঝকঝকে, তকতকে, কোমল লতানো দেহখানা দ্যুতি ছড়ায় তাহলে তো চোখ ফেরানোই দায়! সারাটা দিন লিথুর কাটল উত্তেজনায়। বিকেলের দিকে স্যালুন থেকে একপাক ঘুরেও এসেছে। মিতু বোনকে ওমন হাসিখুশি দেখে কাহিনী কী জিজ্ঞেস করলে লিথু এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে , এড়িয়ে গেছে। বোনকে এটা-সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। ইহসানকে সে পটিয়ে ফেলেছে এটা সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক, আগে সব সেটিং করে নিক। এরপর বলবে। তার আগে অনেক কাছাকাছি যেতে হবে ইহসানের, যাতে চিরজীবনের জন্য বাঁধা পড়তে বাধ্য হয়।

যদিও লিথুর বাবা রমিজ আলী আজিজ শেখকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন, শেখ বাড়িতে তার ছোট মেয়ে বউ হয়ে না গেলে কোটি টাকার ব্যবসা ভাঙবেন তিনি। তবুও মেয়ের পছন্দের হেলাফেলা করবেন না। কিন্তু কাজ হচ্ছেটা কই? বুড়ো ভাম আজিজ শেখ আছে শুধু তার ব্যবসা বাড়ানোর ধান্ধা নিয়ে, এদিকের কোনো খেয়ালই নেই! তার নজর শুধু রমিজ আলীর সম্পত্তির দিকে। রমিজ আলী যুবক বয়স থেকেই ধান্ধা করে বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। মানুষকে টাকা ধার দিয়ে, অসহায়কে জিম্মি করে, সু’দের ব্যবসা করে আজ প্রচুর টাকার মালিক তিনি। গাড়ি-বাড়ি কিছুর অভাব নেই তার। অভাব শুধু একটা জিনিসেরই, পুত্রসন্তান! কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স ব্যবসা ভোগ করার মানুষ থাকলেও দেখাশোনা করার মতো উত্তরাধীকার নেই তার।

দুটো মেয়ের পিতা হবার পর তৃতীয়বার স্ত্রীর গর্ভে ছেলেসন্তানই এসেছিল, কিন্তু সে সন্তান টেকেনি।ডেলিভারির সময় মারা যায়, সেইসাথে ভুল চিকিৎসার দরুণ তার স্ত্রীও মা হবার ক্ষমতা হারায়। যদিও রমিজ আলী অর্থলোভী মানুষ কিন্তু নারীবাজ নন। পুত্রসন্তান নেই বলে বহু জনই তাকে অতীতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। মেয়েদেরকেই অতিরিক্ত আদরে বাঁদড় বানিয়েছেন। কিন্তু কোনোটাই দায়িত্ব নিতে শিখেনি, শিখেছে সাজগোজ আর পয়সা উড়ানো! রমিজ আলী অবশ্য বাঁধা দেননি বরং শিখিয়েছেন ভোগ-বিলাসিতা। তবে বয়স হবার সাথে সাথে তার মাথায় সম্পত্তি কে সামলাবে, এ নিয়ে চিন্তা এসেছে৷ তার অবর্তমানে মেয়েদুটো এসব সামলাতে পারবে না। যে-কেউ ঠকিয়ে সব হাতিয়ে নেবে!

এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই তিনি মেয়েদের পাশে চেয়েছিলেন এমন কাউকে, যে সবকিছুর দায়িত্ব নিবে কিন্তু তার মেয়েদের ঠকাবে না। দুই কন্যার মাঝে আর ছোট কন্যা লিথু তার বড়ই আদরের। সেজন্যই তার ইচ্ছে ছোটকন্যা লিথুকে সারাজীবন নিজের কাছেই রাখবেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন ঘর জামাই রাখবেন। ব্যবসায় সূত্রে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজিজ শেখের সাথে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং আত্মীয়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ আজিজ শেখ নিজেই ধনী, আবার তার ছেলেগুলোকেও বেশ পছন্দ রমিজ আলীর! বিশেষ করে বড় দু’জন, টাকাপয়সার প্রতি তেমন লোভ নেই তাদের। তাছাড়া তাদেরও কম সম্পদ নেই, বরং অনেক আছে। তাই নিজের কোটি টাকার সম্পত্তির রক্ষার আশায়, ব্যবসার খাতিরে আজিজ শেখকে প্রস্তাব দিলে তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়তে সম্মত হয়েছিলেন।

প্রথমে মিতুর সাথে ইহসানের বিয়ের আলাপ তোলা হয়েছিল, কিন্তু নিজের মন-মর্জির মালিক ইহসান তখন কঠোর ও স্পষ্ট স্বরে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেয়, এদিকে ইজহানও ততদিনে ইস্মিকে বিয়ে করে নিয়েছিল। তাই পরবর্তীতে মিতুর বিয়ে হয় ইমরানের সাথে। বড়বোন মিতুর বিয়েতে লিথু ইহসানকে দেখেনি, দেখেছিল বৌভাতে এসে। সাদা পাঞ্জাবি পরা ইহসানকে দেখেই প্রেমে পড়ে যায় লিথু। এই মানুষটার হাঁটাচলা, কথা বলা, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই তার মন কাড়ে। কথিত আছে, নিষিদ্ধ জিনিসে মানুষের আগ্রহ বেশি। ঠিক তেমনি লিথুও আরো বেশি আগ্রহী হয়, যখন জানতে পারে ইহসানকেই তার বাবা পছন্দ করেছিল মিতুর জন্য, দিয়েছিল বিশাল সম্পত্তি সামলানোর প্রস্তাব। কিন্তু মোটেও তাতে আগ্রহ দেখায়নি বরং বিরক্ত হয়েছিল ঘর জামাই হবার প্রস্তাব পেয়ে। শুনে লিথু আগ্রহী হয় ইহসানের প্রতি।

কৌতূহলী হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক নেই ইহসানের, তেমনি সে কোনো বেহুদা মেয়ের প্রতি আগ্রহও দেখায় না। সব মিলিয়ে লিথু দুর্বল হয়ে পড়েছিল আচমকাই ইহসানের উপর। তখন অবশ্য লিথুর নিজেরও রানিং চারটে বয়ফ্রেন্ড ছিল, মাস ছয়েকের মধ্যেই তাদের সাথে সম্পর্কের ইতি টানে লিথু। এরপরে যদিও কয়েকবার স্বভাবের দোষে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে, কিন্তু মনেপ্রাণে জীবনসঙ্গী হিসেবে ইহসানকেই চেয়েছে সে। সবসময় ওর সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে রেখেছে! বাবাকে বুঝিয়েছে ঘর জামাই আনতে হবে না, সে স্বামীর ঘরই করবে। তবে স্বামীটা হতে হবে ইহসানকেই। রমিজ আলী অসন্তুষ্ট হলেও মেয়ের জেদ মেনে নেন! লিথুর এ বাড়িতে আসার মূল কারণই ছিল ইহসান। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ইহসানকে গোলাপ আর ব্র‍্যান্ডেড ঘড়ি দিয়ে প্রপোজ করেছিল, কিন্তু সেগুলোর জায়গা হয়েছিল ডাস্টবিনে। তা দেখে ক্রন্দনরত সুরে লিথু জিজ্ঞেস করেছিল ইহসানকে, সে কেন এমন করল; জবাবই দেয়নি ইহসান।

কতবার, কত রকমভাবে ইহসানকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করেছে, হিসেব নেই। কিন্তু কাজে দেয়নি কিছুই। এক বছর আগে, ব্লু বার্ড আবাসিক হোটেল থেকে বয়ফ্রেন্ড তপনকে নিয়ে বেরিয়ে যখন গাড়ির অপেক্ষা করছিল, ইহসান তখন রিকশা করে ওদিকেই কোথাও একটা যাচ্ছিল! সে—কথা মনে পড়লে আফসোস হয় লিথুর, সেদিন নিশ্চয় ইহসান ওকে দেখে ফেলেছিল তপন উল্লুকটার সাথে; যারজন্য ওর এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। লিথু সব ভেবে হতাশ হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরে! পরক্ষণেই নিজের ভেতর ক্রোধের আগুনে জ্বলতে থাকা লিথুর মাথায় নানাবিধ পরিকল্পনা ঘুরপাক খেতে শুরু করল! আজ একবার যদি ইহসানকে সে বশ করতে পারে তাহলে দু’জনের মাঝে আর দূরত্ব তৈরি করার সুযোগ দেবে না।

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৬

এমনভাবে আঁকড়ে ধরবে যেন সৃজাটার থেকে মনমুখ ফিরিয়ে নেয়। এতদিনে কম তো চেষ্টা করেনি সৃজাটাকে রাস্তা থেকে সরাতে, উচিৎ শিক্ষা দিতে। কিন্তু কী যেন, বারবার বিফল হয়েছে ওর সব চেষ্টা। এ নিয়ে লিথুর অবশ্য দুঃখ আছে। সৃজাটাকে মেরে ফেলতে পারলে ও বেশি শান্তি পাবে! তবে এরচেয়ে বেশি প্রশান্তি পাবে যখন ইহসান পুরোপুরি ওর হয়ে যাবে, ওকে ছাড়া কিছুই বুঝবে না৷ আর নাগিনী সৃজা সেটা দেখবে, জ্বলবে, কিন্তু ও কিছুই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না! এই সৃজাকে সে বেশ দুর্বল প্রবৃত্তির মনে করে এ বাড়িতে ওকে জ্বালাতে এসেছিল, কিন্তু দিনশেষে নিজেই জ্বলেছে, অপমানিত হয়েছে। নিজের রুপ-গুণ কিছুই কাজে লাগাতে পারেনি। অবশেষে পেরেছে, এই সময়-সুযোগের অপেক্ষায়ই তো ছিল!

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৮