অশ্রুবন্দি পর্ব ২৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সোনালি রঙের কারুকাজ খচিত ব্লাউজের সঙ্গে লাল রঙের হাফ সিল্ক শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে লিথু। সঙ্গে কানে বড়ো ঝুমকো আর গলায় ডায়মন্ড পাথরের হার। বারগেন্ডি চুলগুলো সাইড সিঁথি করে খোঁপায় বাঁধা। ভারী মেকআপ আর লাল লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো শেষ করে নিজেকে আয়নায় দেখে হাসল লিথু। চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে! এমন সাজে যেকোনো পুরুষই ঘায়েল হতে বাধ্য, ইহসানও
নিশ্চয় ব্যতিক্রম হবে না। আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ মন নিয়ে লিথু টিস্যু দ্বারা চোখের কোণের হালকা বেঁকে যাওয়া কাজলটুকু মুছে নেয়। বুকের ভেতর টগবগ করা অনুভূতি আর আনন্দে তার হৃদয় আটখানা হয়ে আছে। লিথু ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা বাজতে পনেরো মিনিটের মতো বাকি। কিন্তু লিথুর ধৈর্য হচ্ছে না এই পনেরো মিনিটের সময়টুকু। কখন সে কাঙ্খিত মানুষটাকে নিজের রুপে ঘায়েল করবে সেই চিন্তায় অস্থির সে। লিথু উচাটন হয়ে শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় সে।
আঁচলটা সরু করে কাঁধের উপর রেখে কুচি ঠিক করে
নেয়। টেনে বাঁধা খোঁপাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে মুচকি
হেসে বলে,
“দারুণ লাগতেছে!”
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ঊনপঞ্চাশে যখন টিকটিক করছে তখন লিথু দরজা খুলে ঘরের বাইরে এলো। আস্তেধীরে দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দেয় ও৷ সারাবাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে। কোনো আওয়াজ নেই কোথাও। সবাই যে যার ঘরে ঘুমুচ্ছে। শুধু জেগে আছে তারা দু’জন। ভেবেই লিথুর মন শীতল হয়ে উঠে। বসার ঘরে অল্প পাওয়ারের টিমটিমে হলদে বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে চোখ সয়ে নিয়ে লিথু দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে একেকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠার চেষ্টা করতে থাকে; তবে গয়নাগাটির রিনঝিন করতে থাকা সূক্ষ্ম শব্দ সেই নিঃশব্দতা ঠিকঠাক আনতে পারে না। লিথু ইহসানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বুক টেনে শ্বাস নেয়। চওড়া হাসি আর উত্তেজনায় বুকের ভেতর জোরালো শব্দ হতে থাকে। লিথুর মনে হয় সে কল্প জগতে আছে, তবে সেই জগতের সব সত্যি। চুড়ি পরা কম্পিত হাতে সে দরজায় টোকা দেয় কয়েকবার। ভেতর থেকে পদশব্দ শোনা যায়, ভেসে আসে পছন্দের পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কে?”
ফিসফিসিয়ে বলে লিথু,
“আমি!”
দরজাটা খুলে সময় নিয়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ট্রাউজার-টিশার্টের আবরণে জড়িয়ে রাখা লম্বা পুরুষালি অবয়ব। যার কপালে ছড়িয়ে আছে চুল, যার চোখজোড়া শাণিত। চোয়াল শক্ত। চোখজোড়া কেমন উদ্ভ্রান্ত। হয়তো ঘুমাচ্ছিল! ইশ, ঘুমালে কোনো মানুষকে এত সুন্দর, এত আবেদনময় লাগে? ইহসানকে কেন লাগছে? উফ! লিথু পাগল হয়ে যাবে। ঐ শাকচুন্নি সৃজা এতদিন ওর রুপ উপভোগ করেছে, লিথুর বুক জ্বলে। ওকেহ! এতদিন দেখেছে দেখুক, আজ থেকে শুধু সে দেখবে। ভেবেই
অতি সুখে লিথুর বুকে প্রজাপতি উড়ে, ছুঁয়ে দিতে
আকুলতা ঘিরে ধরে ওকে। ব্যগ্র হয়ে বলে,
“আসতে বলছিলা তুমি।”
সৃজার সাথে কথা বলে ক্লান্ত থাকায় কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টের পায়নি ইহসান, সত্যিই সে ঘুমাচ্ছিল। নিদ্রাজড়িত চোখে সে তখনো লিথুর সাজগোজ দেখেনি, খেয়াল করেনি ওর ব্যাকুল চেহারা। বরংচ লিথুর কথা শুনে নিজের ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“কখন?”
“বারোটায়।”
“এখন ক’টা?”
“এগারোটা পঞ্চান্ন, আগেই আসলাম আরকি! তুমি
কাগজে লিখছিলা…”
এই তাহলে কাহিনী! ইহসান ভুলেই গেছিল! মনে পড়ায় ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। লিথু ওর উপেক্ষা টের পেয়ে কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়। পরক্ষণেই মাথায় কুবুদ্ধি হানা দেয়, নড়েচড়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। বারবার কানের পাশে চুল গুঁজার ভান করে। ওর এমন অস্বাভাবিক ভনিতা দেখে ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে। এ এমন করছে কেন? আশ্চর্য! তখনি চোখ পড়ে ওর সাজসজ্জার দিকে, পোশাকের দিকে। আপাদমস্তক লিথুকে দেখে এ পর্যায়ে বিস্মিত হয়ে যায়। পা থেকে ব্রহ্মতালু সব জ্বলতে থাকে। লিথু ওর দৃষ্টি খেয়ালে নিয়ে লাজুক হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন লাগতেছে?”
ইহসান কোনো জবাব না দিয়ে ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটা বাঁকা হাসি ফুটাল। দরজার পাল্লায় হাত রেখে তাকিয়ে রইল লিথুর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল জানে না লিথু, কিন্তু ওর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো মুহূর্তে। লিথুর গালে আভা ছড়ায়। ইহসানের হাসিতে ওর তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, বেহায়ার ন্যায় তাকিয়েও থাকে। পলক ফেলে না। ইহসান ওকে এভাবে তাকাতে দেখে রাশভারি কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তোমার চোখ কি আমার মতোই নষ্ট লিথু?”
লিথুর পাগল পাগল লাগে, ইহসান এত নম্রস্বরে ওর সাথে কথা বলছে বিশ্বাসই হতে চায় না ওর। তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“এইখানে দাঁড়ায় কথা বলবা নাকি ভিতরে আসমু?”
“ভিতরে আসবে, কিন্তু কেন?”
লিথু অবাক হয়,
“তুমি যে বলছিলা…মানে প্রুফ নিবা…”
ইহসান মনে পড়ে যায় লেখাটা। সে হেসে বলে,
“স্পেশাল, হুম! প্রুফটা তোমার জন্য খুবই স্পেশাল হতে চলেছে, তাই সেটা তেমনি কোনো স্পেশাল জায়গায় নিতে হবে, এই ঘরটা স্পেশাল না।”
লিথু তাৎক্ষণিক জবাব দেয়,
“কে বলছে, এইডা তোমার ঘর, স্পেশালই।”
ইহসান নাকচ করে,
“উহু! এইখানে প্রুফ নেওয়া যাবে না।”
ইহসানের কথার পৃষ্ঠে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে না লিথু, জিজ্ঞেস করে,
“তাইলে?”
ইহসান নম্র কণ্ঠ টেনে বলে,
“আমার একান্ত, খুব প্রিয় একটা স্পেশাল জায়গা আছে। সেখানে শুধু আমার স্পেশাল মানুষদেরই নিয়ে যাই। ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাজিটেট, তুমি চাইলে
নিয়ে যাব…”
লিথুর বুক ডগমগ করে উঠে। সব স্বপ্ন মনে হয়। ইহসান ওকে স্পেশাল জায়গায় নিয়ে যাবে, ওকে স্পেশাল ভাবছে? আশাই তো করেনি সে এসব।
লিথু একবারো ভাবে না, না ভেবেই যেতে সম্মতি প্রকাশ করে। ইহসান ওর সম্মতি পেয়ে আগের ন্যায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে,
“ওয়েট…”
লিথুকে নিজ ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেয় না ইহসান। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে লাল শাড়ি গায়ে জড়ানো নারী এতে কিছু মনে করে না। সবকিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দ অনুভবে সে বিভোর। এই নিশিরাতে স্বপ্নময় দুনিয়া তাকে তার জীবনের আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিচ্ছে, এরচেয়ে বেশি আর কী চাইবে ইহসানের কাছে?
পরণের কাপড়চোপড় বদলে ইহসান কাঠের আলমারিটা খুলে। চার তাকের সবচেয়ে নিচের অংশের ড্রয়ারটা খুলে ফাইলপত্র সরায় সে। নিচে থাকা আরেকটা গোপন ড্রয়ার খুলে। সেখানে একটা লকার। ভালো করে না দেখলে বা খুঁজলে কেউ কখনো বুঝতে পারবে না এখানে গোপন কিছু আছে! লকারের কপাটে আঙুল ছুঁইয়ে এক মুহূর্ত থামে ইহসান; তারপর চাবি ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে। অন্ধকার ফাঁকা জায়গাটায় হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা খোঁজে… নেই! মুহূর্তেই ইহসানের কপালে ভাঁজ পড়ে। হাতটা আরেকটু ভেতরে নিয়ে যায়, দ্রুত সরায় সারি সারি ফাইলগুলো, কিন্তু পায় না। ইহসান ঠোঁট চেপে শক্ত করে দাঁতে কামড় বসায়, গলার শিরা ফুলে ওঠে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণের শেষ সীমায় পৌঁছাতেই ড্রয়ারটা একটানে খুলে বের করে।
ধুলো জর্জরিত ড্রয়ারে অসংখ্য কাগজপত্র, পেপার কাটিং, অ্যালবাম, ভাঙা কাচের চুড়ি, কাপড়ের ছেঁড়া অংশ, শুকনো ফুল, নীল মলাটের ডায়েরি সরানোর পর ধাতব বস্তুটার স্পর্শ টের পায় সে। খুব ধীরগতিতে আঙুল বুলিয়ে নেয় বস্তুটার ওপর। তারপর… শক্ত করে মুঠো বন্ধ করে তুলে আনে সেটা। চকচক করে ওঠে কালো রঙের ঠান্ডা, ধাতব, মসৃণ বস্তুটা। মুহূর্তেই ওর চোখজোড়া জ্বলে ওঠে, ঠোঁটের কোণে অস্বাভাবিক একটা হাসি খেলে যায়। পরক্ষণেই চট করে সেটা গুঁজে নেয়। এরপর বাকিসব জিনিসগুলো ঝেড়েমুছে, যত্ন করে আগের মতোই গুছিয়ে রেখে দেয় সে। অ্যালবামটা রাখার সময় সেটা একবার খুলে দেখে। বহুদিনের পুরোনো একটি ছবি খুঁজে মনোযোগ দিয়ে। পেয়েও যায় মধ্যিখানের পাতায়। ইহসান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে। তাকিয়ে দেখতে গিয়ে প্রতিবারের মতো রাগ- অভিমানে গিলে নেয় ওকে। ইচ্ছে করে সব শেষ করে দিতে। উত্তপ্ত মেজাজ আর বিতৃষ্ণা নিয়ে শব্দ করে অ্যালবাম বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে লকার আঁটকে দেয়। সব গুছিয়ে আলমারি বন্ধ করে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে নিজেকে স্থির করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখনই বেরিয়ে যায়, খেয়ালই করে না পেছনে কিছু আছে। মেঝেতে অজান্তে উল্টে যাওয়া একটা ডুয়ো ছবি পড়ে, যেটা হাওয়ায় উড়ে ততক্ষণে সোফার নিচে ঘাপটি মেরেছে!
নির্জন নিশীথ। বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমে। ইহসান বেরিয়ে পড়ে লিথুকে সঙ্গী করে। দারোয়ান টুলে বসে ঝিম ধরে ঘুমিয়ে উচ্চস্বরে নাক ডাকছে। ইহসান তাকে ডাকে না, লিথুকেও ইশারায় বোঝায় শব্দ না করতে। উত্তেজিত লিথু ওর কথা মেনে নেয়। ইহসান পুরোনো লেটারবক্স থেকে পকেট গেইটের চাবিটা বের করে আস্তেধীরে গেইট খুলে। যথাসম্ভব শব্দ না করে অতি সাবধানে বেরিয়ে আসে। ইহসান লিথুকে অনুসরণ করতে বলে, সে তা-ই করে। ফুটপাত ধরে হেঁটে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে আসে ওরা। কিছুটা হাঁটতেই আচমকা সামনে একটা গাড়ি এসে থামে। লিথু ভড়কে যেতেই ইহসান ওকে অবাক করে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে বলে। লিথু সারপ্রাইজ ধরে নিয়ে বরফের মতো গলে যায়, কোনো প্রশ্ন না করে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসে। ইহসান চালককে বিদায় করে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। লিথু একটু বিষন্ন হয় ইহসানের পাশে না বসতে পারায়, কিন্তু ততোটা পাত্তা দেয় না।। সবটাতে ওর অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ফিল হয়। গাড়ি স্টার্ট
হয়ে হাইওয়েতে উঠে। ইহসান একমনে ড্রাইভিং করে, লিথুর ইচ্ছে করে ওর সাথে গল্প জমাতে। কিন্তু পাছে রেগে না যায় তাই অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না। নেশাক্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে স্টিয়ারিং ধরে রাখা লম্বা আঙুলগুলো, রগে ভেসে থাকা ফর্সা হাতের পিঠ, পুরুষালি পশমাবৃত হাতটায়।
ভিসর মিররে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে থাকে শাণিত মুখটা৷ এক মোহচ্ছন্ন ঘোরে ডুবে যায় সে। ইহসান যখন বা-হাতে ভিসর মিররটা ঘুরিয়ে দেয় তখনো লিথুর ঘোর কাটে না।
সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিভোর!
ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালানোর পর, ইহসান গন্তব্যে পৌঁছে। গাড়িটি একেবারে নির্জন ফ্যাক্টরি এলাকায় থামায়। পুরোপুরি জনশূন্য পরিবেশ, একেবারে শুনশান। কোথাও কোনো প্রাণী নেই, চারপাশ নিঃস্তব্ধ! ইহসানের চোখজোড়া শীতল—সে লিথুকে নামতে বলে। লিথু গাড়ি থেকে নামতে যায়। কিন্তু মাটিতে পা রাখতেই হিল জুতো বেঁকে গিয়ে সে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ঠিক তখনই ইহসান এসে ওকে হাত ধরে স্থির করে। লিথু গদগদ হয়ে যায়, তার বুকের ভেতর শিহরণ ছোটে। লিথুকে অনুসরণ করতে বলে ইহসান এগিয়ে যায়, আর লিথু বিনা বাক্যে ওর পিছু নেয়। ওর শরীরের প্রতিটি কোষ যেন আনন্দে জেগে ওঠে, খোলামেলা শাড়িটা ধীরে ধীরে কাঁধের আরো উপরের দিকে উঠিয়ে নেয়। পরিত্যক্ত এসিড ফ্যাক্টরিতে তালা খুলে প্রবেশ করে ইহসান৷ ভেতরে প্রবেশ করে লিথু ডগমগ হয়ে একটা চেয়ারে হাফ ছেড়ে বসে। তার ক্লান্ত লাগছে এতটুকু পথ হেঁটেই। একটু রেস্ট নিয়ে সে চারপাশটা দেখে। এখানে ওখানে যন্ত্রপাতি, মরচে ধরা ধাতু, এবং ভাঙা দেয়াল, কাচের বড় বড় বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঝে এবং দেয়ালে এসিডের দাগ আর কেমিক্যাল গ্যাসের তীব্র গন্ধ ভারী করে রেখেছে বাতাস। সব কিছু নোংরা, ক্ষয়প্রাপ্ত, এবং বিপজ্জনক—এখানে কেন নিয়ে এসেছে ইহসান? এটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার মতো জায়গা কোনো? লিথুর বিরক্ত লাগে এ পর্যায়ে! নাকমুখ কুঁচকে বলেই ফেলে,
“এইডা কোনো জায়গা হইলো? আমারে বলতা,
ফাইভ স্টার বুক কইরা নিতাম…”
ইহসান টুলে বসে, তার শরীর একদম সোজা। হাত দুটো পকেটে, মাথা সামান্য নিচে, চোখগুলো একদম স্থির, ঠান্ডা দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। তার সারা শরীর এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে সে একদম শান্ত। মুখের আদল পাথরের মতো শক্ত, চোখে কোনো অনুভূতি নেই। আচমকা এক হাত মাথার পেছনে রেখে, অস্থির দৃষ্টিতে হালকা হাসি দিয়ে, গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে কীভাবে চাও?”
ইহসান সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেছে! ভেবেই মনে
দোলা দেয় লিথুর, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জবাব দেয়,
“সবভাবেই, আমি তোমারে ভালোবাসি।”
তির্যক প্রশ্ন ছুঁড়ে ইহসান,
“কতটুকু ভালোবাসো?”
“অন্নেক!”
“সেতো মুখে বলেই চলেছ, মুখের কথার প্রমাণ দিতেই তো সঙ্গে এসেছ, অ্যাম আই রাইট?”
ইহসানের শীতল গলা। লিথু অজানা অনুভূতিতে হারাতে হারাতে বলে,
“প্রমাণ হিসেবে তুমি কী চাও? যা চাইবে তাই দেব।
ইহসান ক্রুর হাসে,
“দিতে গিয়ে আবার মন পাল্টে ফেলবে না তো? আমি কিন্তু রেগে যাব, তখন কিন্তু জোর করে হলেও প্রমাণটুকু নিয়ে নেব।”
ইহসানের কথা শুনে লিথু দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“তোমারে যখন দিব বলছি, তহন দিবই। নড়চড় হইবে না কথার।”
“ভুলে যাবে না তো?”
“সই-সাবুদ লাগব? নিবা?”
ইহসান ঘাড় বাঁকা করে শাণিত চোখে তাকায়। আচমকা হেসে উঠে উচ্চস্বরে,
“মকবুলের মাকে হাত করে সিঁড়িতে তেল ঢেলে রাখা, ছাদে গেলে দরজা আটকে দেওয়া, খাবারে এটা-ওটা মিশিয়ে সৃজাকে খেতে দেওয়া, ভার্সিটিতে ওর ক্লাসমেটকে হাত করে ওর নামে কুৎসা রটানোর ছোটখাটো, লেইম কাজগুলো তোমার সেসব আমি জানি। কিন্তু এ’সিড দিয়ে চেহারা পুড়িয়ে দেওয়ার কাজটা যে তোমার, কী ভেবেছ, ইহসান শেখ এটা ধরতে পারবে না?
লিথু হতভম্ব হয়ে যায় কারণ এসব কুকর্ম তার গোপন কাজ, যা বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না, মিতুও না। মকবুলের মাকে টাকা খাইয়ে এটা-ওটা করায় কিন্তু এসিডের বিষয়টা! ইহসান কীভাবে এসব জানল, সে বুঝতে পারে না। ওর মস্তিষ্কে একটা আতঙ্ক উঁকি দেয়! ইহসান কীভাবে জানল? কে বলল ওকে এসব? রক্তশূন্য লিথুর মুখপানে তাকিয়ে ইহসানের চোখের কোণে অস্থির হাসি ফুটে ওঠে। ঠান্ডা কণ্ঠে, যেন রাগের কোনো আঁচও নেই, বলে,
“নিশ্চয় ভাবছ, আমি কীভাবে জানি? এইযে, তুমি প্রথম থেকেই সৃজার পেছনে পরে আছ, তোমার বুড়ো, শয়তান বাপটাকে নিয়ে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছ সমানতালে, ভেবেছ আমি কিছুই জানি না?
ভুল, বরং প্রথম থেকেই তুমি আমার নজরে ছিলে, তোমার কোনো কর্মকাণ্ডই গোপন নেই আমার কাছে!”
পরক্ষণেই আগ্রাসী কণ্ঠে বলে ইহসান,
“তোমাকে যতটা বোকা আর নষ্টা মেয়ে ভেবেছি, তুমি তা-ও নও। তারচেয়েও নিম্নস্তরের। আর নিম্নস্তরের তোমাকে ; সৃজার ভালোবাসার মানুষ অ্যাটেনশন দেবে, এই ভাবনাটা মাথায় এলো কীভাবে তোমার?”
হতভম্ব, হতবাক লিথুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় এসব শুনে। মানে কী? ইহসান ওকে নজরে রেখেছিল? এজন্যই কোনো পরিকল্পনায় সফল হতে পারেনি কখনো? লিথুর গলা শুকিয়ে আসে। এখন কী করবে ইহসান ওকে? তবে যাই করুক, মেরে তো ফেলবে না। উত্তেজনা, ভয় আর রাগে ওর হাতের তালু ঘেমে উঠে। মিষ্টি ব্যবহার করে এখানে নিয়ে এসে এখন এসব বলছে ইহসান? দমে যায় না ও, কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“তুমি আমার, আমি তোমায় ভালোবাসি, তোমারে চাই।”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“কিন্তু আমি তো তোমাকে চাই না।”
“ক্যান চাও না?”
“কারণ আমি সৃজার, আর ওর জিনিস আমি অন্য কাউকে— বিশেষ করে কোনো সস্তা, দুশ্চরিত্রাকে দেব না।”
লিথু রাগে ফেটে পড়ে,
“কি বললা তুমি?”
ইহসান চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“দুশ্চরিত্রা— উহু না, প্রস্টিটিউট! না, তার থেকেও লেইম। এতটাই লেইম যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”
লিথুর চোখ থেকে আগুন বেরুতে থাকে,
“আমার আব্বা সব দিয়া দিবে তোমারে, এরপরেও ক্যান চাও না?”
ইহসান উঠে দাঁড়াল। সামনে থাকা একটা কাচের বোতলে লাথি মারে, ভেঙে টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে সেটা। ভেতরের নীল তরলটুকুর ঝাঁঝালো শব্দ তুলে ধোঁয়া ছাড়ে। ক্ষ্যাপাটে স্বরে ইহসান বলে,
“আমি পণ্য— কাপুরুষ নই।”
ভয়ে লিথু একপাশে সরে যায়, আমতাআমতা করে বলে,
“আমারে এইখানে নিয়া আসলা এইগুলা কইতে?”
ইহসান নিজেকে ধীরস্থির শান্ত করে সময় নিয়ে।
ভ্রু উঁচিয়ে শাণিত সুরে বলে,
“উহু! আমি নিয়ে আসিনি, তুমি স্বেচ্ছায় এসেছ, ভুলে গেলে?”
লিথু ভীতি নিয়ে জবাব দেয়,
“না না, ভুলি নাই। কিন্তু আমি তোমারে ভালোবাসি দেইখাই তো আসছি।”
ইহসান দু’হাত পেতে দেওয়ার ভঙ্গি করে বিস্মিত
স্বরে জানতে চায়,
“সেই ভালোবাসাটাই দেখতে চাচ্ছি, কোথায় তোমার ভালোবাসা? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? অনুভবও করতে পারছি না। এটা কেমন ভালোবাসা?”
ইহসানের কথা লিথুর কিছুই বোধগম্য হয় না।
তারপরও বলে,
“তুমি অন্ধ তাই আমার ভালোবাসা দেখো না…”
ইহসানের ঠোঁটে অস্বাভাবিক হাসি খেলে যায়,
“না, সেটা ভুল। আমি দেখি, তুমি কতটা ডেস্পারেট হয়ে আমাকে চাও, আমার কাছে আসতে চাও,
ঘেঁষতে চাও! ভালোবাসার চেয়ে আমার প্রতি শারীরিক আকর্ষণটা বেশি কাজ করে তোমার—তাই না?”
লিথু জবাব খুঁজে পায় না। মাথা নেড়ে ভীতু স্বরে বলে,
“তুমি যদি চাও আমি তাতেও রাজি…”
ইহসান ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করে।
চোখ কুঁচকে, এক পৃথিবী ত্যাক্ততা নিয়ে সে ক্রুর হাসে। কঠিন ও গমগমে গলায় বলে,
“ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে আমি এসব সস্তা জিনিস নেব না, অন্য কোনো দামী বস্তু চাই।”
লিথুর মনে আশার সঞ্চার হয়, একছুটে গিয়ে হাত
ধরে ব্যাকুল চিত্তে জানতে চায়,
অশ্রুবন্দি পর্ব ২৭
“এতদিন যা যা করছি তার জন্য মাফ চাইছি, আর করব না সৃজার সাথে এইসব। তুমি শুধু আমার হইয়া যাও। এরজন্য কী চাও বল, যা চাও তাই দিব।”
ইহসান ভ্রু কুঁচকায়। খুব এগিয়ে আসে, লিথুর মুখ বরাবর মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। হঠাৎ ভীষণ অস্বাভাবিক দেখায় ওকে। লিথু ঘাবড়ে যায়, ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার। ঠাণ্ডা ও শীতল কন্ঠস্বরে ইহসান ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার প্রাণ।”