অশ্রুবন্দি পর্ব ২৯

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসান ভ্রু কুঁচকায়। খুব এগিয়ে আসে, লিথুর মুখ বরাবর মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। হঠাৎ ভীষণ অস্বাভাবিক দেখায় ওকে। লিথু ঘাবড়ে যায়, ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার। শীতল কন্ঠস্বরে ইহসান ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার প্রাণ।”
ইহসানের ঠান্ডা, শীতল স্বরে বলা কথাটা শুনে আতঙ্কিত আর অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল লিথু। বুক কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো, ঢোক গিলে কয়েকবার। ভীতি স্বরে হাসার প্রচেষ্টা করে,

“এইসব কী বলো তুমি?”
ইহসান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“চাইতে বলেছ, চেয়েছি!”
“আমায় বোকা বানাইতে মিথ্যা বলতেছ!”
ইহসান সরে এলো লিথুর কাছ থেকে। আরাম করে হেলে বসে চেয়ারে। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে এরপর ছোটছোট চোখ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তুমি আমাকে ভালোবাসো, অথচ ভালোবাসার মানুষটাকেই বিশ্বাস করছ না? এমনটা আশা করিনি একদম।”
পরক্ষণেই সূক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,
“দেখো, আমি সত্যিই চাই তোমার প্রাণ, ওটুকু দিলেই আমি প্রমাণ পেয়ে যাব তোমার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু!”
লিথু ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এরজন্য আমায় মরতে হইব? মরে গেলে পাবটা কী?”
ইহসান হাসলো সুন্দর করে,
“আরকিছু পাও আর না পাও, মানুষের ঘৃণা থেকে বেঁচে যাবে। জানোই তো, কত মানুষের ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছ তুমি! ঘৃণা নিয়ে বাঁচা যায় না, এরচেয়ে মরে যাও, ভালো হবে। তোমার জন্যও, বাকিদের জন্যও।”
“কে আমারে ঘৃণা করে? তুমি?”
মাথা নাড়ল ইহসান দু’পাশে। তাচ্ছিল্য সূচক কণ্ঠে বলল,
“উহু! তোমার দুই ডজন প্রাক্তনও তোমাকে ঘৃণা করে। তোমার করা প্রতারণা ঘৃণা করে। তবে আমি যেটা করি সেটা ঠিক ঘৃণা নয়, ঘৃণার চেয়েও বেশিকিছু।”
“সেইটা কী?”

একরাশ গম্ভীরতা ছেয়ে গেল ইহসানের চোখমুখে। বিদ্রুপাত্মক ও তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বরে বলল,
“সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তবে জেনে রাখো,
তোমার উপস্থিতি আমার জন্য অস্বস্তিদায়ক,
তোমার ছোঁয়া কোনোকিছু আমার রাগের কারণ,
তুমি মানেই আস্ত এক নিম্নমানের ডাস্টবিন, যা দেখলেই আমার গা গুলায়। তোমার মেকআপ করা ভারী চেহারাটা দেখলেই আমার সারাদিন খারাপ যায়। তুমি যখন মাঝেমধ্যে হুটহাট এসে আমার উপর ঢলে পড়, আমাকে ছুঁয়ে দাও, সৃজার সামনে আমাকে নিয়ে আহ্লাদ করো; ট্রাস্ট মি, তখন আমার নিজেকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে, জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কতবার জীবাণুনাশক ব্যবহার করি জানো না তুমি। মনে হয়, মনে হয় তোমাকে মেরেই ফেলি!”
শেষ কথাটা বলতে বলতে ক্ষিপ্রতা এসে ভর করে ইহসানের চোখেমুখে। রাশভারী হয় গলার স্বর। লিথুর হিংসায় শরীর জ্বলছিল। বাঁকা স্বরে বলে,

“বউয়ের ছোঁয়া পাইয়া আমারটা ঘেন্না লাগে? ক্যান, তোমার বউ কি আমার থেইক্কা বেশি সুন্দর? ঐ তো ওইটুক চেহারা। নাই কোনো ফ্যাশন সেন্স, নাই স্মার্টনেস, নাই আমার মতো কোটিপতি বাপ। এরপরেও হ্যায় তোমার কাছে সব? কেউ যদি কাউরে বশ না করে তাইলে সেইটা অসম্ভব ব্যাপার। তোমারে ঐ নাগিনী…”
এ পর্যায়ে এসেও সৃজাকে কটুক্তি করায় রাগে শরীর কেঁপে উঠল ইহসানের। কোনোকিছু না ভেবেই সে হিপ হোলস্টারে হাত দিলো। ওখানে থাকা ধাতব বস্তুটাতে আঙুলগুলো ঠেকতেই ঠান্ডা স্টিলের স্পর্শ পেল। গ্লকের গ্রিপটা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বের করে আনতেই লিথুর চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেল। পলক ফেলতে ভুলে গেল সে। চারপাশের শব্দ মিইয়ে গেল, যেন এই অভাবনীয় মুহূর্তের ভারে পুরো দুনিয়া থমকে গেছে। ইহসান এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে হ্যাণ্ডগানের
স্লাইড টেনে নিশ্চিত হয়ে নিল চেম্বারে গুলি আছে কি-না! নিশ্চিত হয়ে সে লিথুর মাথায় গানটা চেপে ধরে ট্রিগারে আঙুল রাখল সে,

“বহুবার তোমার জন্য আমি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি বউটার সামনে। কিন্তু বারবার সুযোগ দিয়ে গিয়েছি, যাতে না শুধরে তুমি নিজের অপরাধের পাল্লা বাড়িয়েছ। সীমা ছাড়িয়েছ ওকে বাজে কথা বলে। আমার জান ও, ওকে তুমি বারবার বাজেভাবে টিজ করবে আর ভাববে আমি চুপই করে থাকব? নট ফেয়্যার, নট ফা*কিং ফেয়ার…”
লিথু ভেবেছিল ইহসান ওকে এতক্ষণ পরীক্ষা
করছিল। প্রাণ চাওয়ার কথা বলে ওকে ভয় দেখাচ্ছিল। ভাবতেই পারেনি ইহসানের কাছে হ্যাণ্ডগান আছে, আর সেটা ওর মাথায়ই ঠেকিয়েছে! কতক্ষণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও এ পর্যায়ে আতংকে কেঁদে ফেলল,
“আ আ আর কমু না, ভভু ভুল হইয়া গেসে। এইডা সরাও, প প্লিজ ইহসান, সরাও এইটা…”
ইহসান সরায় না তার হ্যান্ডগান। সরানোর লক্ষ্মণও নেই। লিথু জোরে কাঁদতেও ভয় পায়, শুধু অনুনয় করতে থাকে। ইহসান বিরক্ত ও শীতল গলায় বলে,

“কুমিরের কান্না কেঁদে লাভ নেই। আজ আমি শোধবোধ করতে এসেছি। এত আদরের বউ আমার, আর ওকেই তুমি আমার থেকে দূরে সরাতে সস্তা পরিকল্পনা করো? শায়েস্তা করতে চাও,বিপদে ফেলতে চাও, জ্বালিয়ে দিতে চাও ওর পবিত্র মুখখানা…কী ভেবেছ? আমি শুধু ওর রুপে মুগ্ধ?
ওর চেহারা ঝলসে দিলে আমি ওকে অবহেলা করে তোমার মতো ভ্রষ্টাচারিণীর প্রতি ঝুঁকে যাব? ঊহু! ওর রুপ থাকুক আর ঝলসে যাক, ওর প্রতিটা কোষে কোষে আমি ইহসান শেখ, মুগ্ধ! যা একবিন্দু পরিমাণেও কমবে না! আজীবন একই থাকবে।”
আগ্রাসী স্বরে হুঁশ জ্ঞান কাজ করে না লিথুর। লাল রঙের পরণের শাড়ি এদিকসেদিক খুলে পড়ে। ইহসান রক্তচক্ষু করে ঘর কাঁপিয়ে ধমকে উঠে ওকে। ট্রিগারে আঙুল বাজায়। ভয়ে, আতঙ্কে লিথু শাড়ি ঠিকঠাক করে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

“তু তুমি আমারে ছাইড়া দাও ইহসান…”
ওর অসহায়ত্ব একটুও টানে না ইহসানকে। বরং বিরক্তিবোধ করে। ফিচেল হেসে বলে,
“ছেড়ে দেব? অনেকবার তো ছেড়ে দিয়েছি, সাবধান করেছি। শুধরাও নি তো! উল্টো আমাকে সিডিউস করতে উন্মাদ হয়ে গেছ! এইযে তুমি রাস্তার মেয়েদের মতো রঙচঙে শাড়ি পরে, সেজেগুজে থাকছ সৃজার যাওয়ার পর থেকে, ভেবেছ আমি তোমার মতলব বুঝি না? আজ আমার সাথে কোন কুমতলব নিয়ে, আমাকে ভুলাতে এসেছ, ভেবেছ আমি জানি না? সব জানি আমি। যাকগে, বাদ দাও। সৃজার উপর এসিড ছুঁড়ার কুবুদ্ধি, পরিকল্পনায় তুমি আর তোমার শয়তান বাপ জড়িত জানি। কিন্তু আরো একজন আছে, যেটা নিয়ে আমি ধোঁয়াশায়। এখন তুমি স্বীকার করো, সেই লোকটা কে, কোনোভাবে আমার বাপ, আজিজ শেখ নয়তো?”

লিথুর ভয়ে অন্তরাত্মা কাঁপছে। বলতে চাইছিল না কিন্তু আপনি বাঁচলে বাপের নাম মনে করে ও মাথা নাড়ল একনাগাড়ে। ইহসান বাঁকা হাসল এবারে।
তার সন্দেহ ঠিক ছিল! এই বুড়ো কিছু করতে না
পেরে এখন মান্ধাতার আমলের ট্রিক্স প্রয়োগ করছে?
কী ভেবেছে? ইহসান জানতে পারবে না? রাগ
শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ল ওর।
“আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমাকে পিস পিস কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াই৷ তবে এসব আমি ভালো পারি না। তাই ভাবছি আজ তোমাকে দিয়েই শুরু করি।”
“কী শুরু করবা?”

“খু-ন। যারা আমার সৃজার ক্ষতি চাইবে তাদেরই খু-ন করব। দরকার হলে আমার বাপকেও। আর বাপকে খু-ন করতে যে ছেলের হাত কাঁপবে না তার নিশ্চয় তোমাকে আর তোমার শয়তান বাপকে মারতেও কোনো অসুবিধা হবে না৷ কী বলো?”
লিথু বাকরুদ্ধ বনে যায়। এই ইহসানকে সে চেনে না, চিনতে পারছে না। তাএ স্বপ্নপুরুষ, তার ভালোবাসা তাকে মারতে নিয়ে এসেছে এখানে? লিথু আতংকিত বোধ করে। ইহসান ওর চোখের ভয় দেখে হাসে। বলে,
“হ্যান্ডগানটাতে পাঁচ রাউন্ড গুলি আছে, সবগুলো তোমার মাথায় ঢুকাব এক এক করে। এরপর তোমাকে পিস পিস করে কাটব, অবশ্য আমি কাটব না। লোক ভাড়া করেছি, তাদের দিয়ে কাটাব। বুঝলে তো, তোমাকে ছুঁলে আমার নিজের হাতটাকেই কেটে ফেলতে ইচ্ছে করবে। তাই সে রিস্ক নিচ্ছি না। তো যা ব বলছিলাম, পিস পিস করার পর কী করব জানো? এইযে কেমিক্যালগুলো দেখেছ, একেকটা এ’সি’ডের বোতল! তোমার হাড্ডি থেকে মাংস সব জ্বালিয়ে দেব। ওয়েট, মরে গেলে তো এ’সি-ডের যন্ত্রণা কেমন হয় তা বুঝবে না তুমি। বেকার কাজ! তারচেয়ে প্রাণ থাকতে থাকতে একটু চেখে নাও….”

বলে ইহসান কোথা থেকে গিয়ে একটা ছোটখাটো বোতল নিয়ে এলো। ভিতরে পানির মতো একটা তরল। লিথু ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করল,
“ওটা কী?”
“যেটা তুমি সৃজার মুখে ছুঁড়তে লোক ভাড়া করেছিলে…”
বলে সময় নেয় না। লিথুর হাতে-পায়ে এবং অনাবৃত থাকা পেটের উপর কিছুটা তরল ছুঁড়ে মারে। তেজালো তরল মাংস গলিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। মরণ যন্ত্রণায় চিৎকার করে ছটফট করে উঠে লিথু। ইহসান শুনে তা, ওর তৃপ্তিবোধ হয়। কোনো মায়ার উদ্রেক হয় না মনের ভেতর। উল্টো রাগ বাড়ে৷ সৃজাকে এই তরলে যন্ত্রণা দিতে চেয়েছিল, এখন দেখ কেমন লাগে। ওর ক্ষতি করতে চাইলে এমনই হবে। লিথুর চিৎকার বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয় ইহসান, পানি এনে ঢালে। ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
“যথেষ্ট চিৎকার করে আমার কানের পোকা মেরেছ। এবার চুপ করো, নয়তো মুখটাই বন্ধ করে দেব।”
লিথু সাথে সাথে থেমে যায়। দয়া-মায়াহীন সাইকো মনে হয় ইহসানকে। কান্না পুরোপুরি বন্ধ হয় না ওর, ফুঁপাতে থাকে শুধু। ইহসান ক্রুর হেসে বলে,

“ভালোবাসো আমায়? আমাকে ভালোবাসলে জ্বলতে হবে, ঠিক এভাবেই! যাইহোক, একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় বলি? তোমাকে শায়েস্তা করার এই ছোট্ট পরিকল্পনাটা
কে সাজিয়েছে জানো?”
যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা লিথু মাথা নাড়ায়, সে জানে না। ইহসান উচ্চস্বরে হেসে উঠে,
“যার সাথে ব্লু-বার্ড হোটেলে যেতে মাঝেমাঝে! যাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফতুর করে ছেড়ে দিয়েছিলে? তোমার সেই হাজব্যান্ড, তপন।”
লিথু বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। তপন! ঐ হাঁদার বাচ্চা? যাকে কোর্ট ম্যারেজ করে, টাকাপয়সা খেয়ে শেষ করে, বুদ্ধু বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল গোপনে ঐ হাঁদা তপন? ওর এত সাহস, প্রতিশোধ নিচ্ছে ওর উপর? তাও ইহসানের সাথে মিলে? লিথু কী করবে? কে বাঁচাবে ওকে এখন? মৃত্যুভয়ে জেঁকে ধরে ওকে। কেঁদে উঠে জোরেশোরে,
“আমি আর এইসব করব না ইহসান। মেরো না আমায়, এবারের মতো ছাইড়া দাও। আর কখনো তোমার জীবনে আসতে চাইব না৷ কাউরে ঠকাব না। ইহসান, আমায় ছাইড়া দাও…”

লিথু কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবে চিৎকার করতে পারে
না ইহসানের ভয়ে। মনে মনে একশো একবার তওবা কাটে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চায়, আজ যদি একবার বাঁচার সুযোগ পায় তাহলে সে আর কখনো কাউকে ঠকাবে না। ভুলভাল কাজ করবে না। কারো ক্ষতি করবে না৷ সৃজার পা ধরে মাফ চাইবে। আর ইহসান, এই সাইকোর থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকবে। দরকার হলে সারাজীবন একলা কাটাবে, তবুও এই ইহসান শেখের সুদর্শন চেহারায় ডুববে না। প্রার্থনা করতে করতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে লিথু,
চোখে সব ঝাপসা দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ইহসান ওর নির্জীব হয়ে পড়ে থাকতে দেখেও বিরক্ত হয়, ভেবেছিল পিস্তলের সব বুলেটের ব্যবহার করে আজই এই চরিত্রহীনার ইতি ঘটাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে এই ভ্রষ্টাচারিণীর শিক্ষা!

ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটা। গাড়িতে শুয়ে অন্ধকার কেটে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল ইহসান। একসময় আঁধার কেটে আলোর দেখা মিলতে লাগল। লিথুর হাজব্যান্ড তপন, ওকে ফোন দিলো ইহসান। লিথুর বাকিসব ব্যবস্থা করতে বলল। লিথুকে শায়েস্তা করায় তপন কৃতজ্ঞ গলায় ওকে ধন্যবাদ দিয়ে জানাল লিথুকে সে নিজের কাছে রাখবে৷ প্রতিশোধ নিলেও এখনো সে লিথুকে খুব ভালোবাসে। ইহসান বিরক্ত হলো কাপুরুষটার এসব কথা শুনে। লিথুকে নিয়ে এসব আহ্লাদি কথা শুনতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। প্রয়োজনীয় কথা সেরে তাই ফোন রাখল। রশিদ ব্যবস্থা করেছিল রাতে গাড়িটার। ইহসান এরপর ওকে ফোন দিয়ে বলল গাড়ি এসে নিয়ে যেতে।

রশিদ জানাল সে আসছে। ফোনে গাড়িটার লোকেশন সেন্ড করল ইহসান ওকে। রশিদ কাছাকাছিই কোথাও ছিল হয়তো, চলে এলো ঘন্টা খানিকের মধ্যে। ইহসান গাড়িতে চড়ল না, হ্যান্ডগা’নটা রশিদকে দিয়ে বিদায় করল ওকে ওই এলাকা থেকে। এরপর নিজেও বিদায় নিলো। অনেকদূর হেঁটে এসে প্রথমে রিকশা নিলো এরপর সিএনজি। সকাল সাতটা। উজ্জ্বল রোদ্দুরে ঝলমল করছে চারপাশ। আকাশ নীল। গাছ-পালা বাতাসে লুকোচুরি খেলছে। ইহসানের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ অবসন্নবোধ করছে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। এই অবসাদটুকু কারো উপর চাপিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। হুট করে কি মনে হলো, ইহসান শ্যাওড়াপাড়ায় সৃজাদের বাড়িতে চলে এলো। সাত-সকালে এলিজা দরজা খুলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। ইহসান ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“ক্লান্ত, একটু ঘুমাতে এসেছি। তোর বোন কই?”

“ঘরে, ঘুমাচ্ছে।”
“ওকে, ডাকার দরকার নেই। আমি যাচ্ছি।”
এলিজা মাথা নাড়ল। কাউকেই ডাকল না। সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে। নীলু বেগম অবশ্য একবার উঠেছিলেন। ফজরের নামায সেরে, রুটি বেলে রেখে এরপর ঘুমিয়েছেন। এলিজা নামাজ সেরে সাড়ে ছয়টায় এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। পড়াশোনার চাপ বাড়ছে, তাই ভোর ভোরই উঠে পড়তে বসে এতক্ষণ পড়ছিল। এত সকালে ইহসানকে আশা করেনি। কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। মেইন ডোর বন্ধ করে আবারো পড়তে বসল। জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় এলিজা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাল। সোনাবরণ রোদের নৃত্য আর সকালের ঘ্রাণে চারপাশ ডুবুডুবু। দূরের বিশাল আকাশে উড়ছে অজানা পাখিরা, পাড়ি দিচ্ছে পথ। আজকের সকালটা অদ্ভুত সুন্দর! মন ভালো করার মতো।

ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ। পর্দা টানা। বাইরে সকাল হলেও ভেতরটা দেখলে যে কেউ ভাববে এখন মাঝরাত। ইহসান অন্ধকারে সৃজাকে মন ভরে দেখল। অনেকক্ষণ দেখার পর তার মন কিছুটা শান্ত হলো। চাদরের তলায় নিজেকে আড়াল করল। ঘুমন্ত সৃজার উদরে আঁকিবুঁকি করতে করতে গলায় মুখ গুঁজল। ছোট ছোট অসংখ্য চুমুতে গাল-গলা ভিজিয়ে দিয়ে ওষ্ঠপুট দখলে নিয়ে নিলো সে। দমবন্ধ ও শিরশির অনুভূতিতে কেঁপে উঠল সৃজা। ঘুম ছুটে গেল সৃজার। শরীরের উপর একটা পুরুষালি অবয়ব দেখে অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে নিলো ওকে। অসাড় হয়ে এলো হাত-পা। তবুও সাহস যুগিয়ে ঠেলে সরাতে চাইল লোকটাকে। তবে সফল হলো না। ব্যর্থ হয়ে চুল খামচে ধরল। আদরের মাঝে ওরকম বাঁধা পেয়ে বিরক্ত হলো ইহসান। পছন্দ হলো না ব্যাপারটা। চুলে টান খেয়ে তাই ক্ষেপে গেল। ওষ্ঠ ছেড়ে সরে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

“একদম শান্তি দিচ্ছিস না…”
হতভম্ব সৃজা লাফিয়ে উঠে বসল সৃজা। ইহসানকে দেখে কতক্ষণ থমকে রইল। এই লোক এখানে? কখন এলো? সৃজার বিশ্বাস হতে চাইল না৷ অবিশ্বাস্য চোখে একবার ঘড়ি একবার ইহসানকে দেখল। এরপর চিমটি কেটে যখন বুঝল লোকটা স্বপ্ন নয়, আসলেই বাস্তব! ঝাঁপিয়ে পড়ল একদম ওর বুকে,
“কখন এসেছ তুমি?”
ইহসানের বুকে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল,
“একটু আগে।”
সৃজা গদগদ কণ্ঠে বলল,
“ডাকোনি কেন?”
“মরার মতো ঘুমাচ্ছিলি, তাই ডাকিনি।”
সৃজার অভিমানী টানলো গলায়,
“তুমি বানিয়ে বানিয়ে এসব বলো, জানি আমি।”
“উহু! কিছুই জানিস না তুই।”
“কী জানি না?”
“আমি কেন এসেছি সেটা।”
সৃজা শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কেন এসেছ?”

“আদর আদর পাচ্ছে তাই। আদর দে!”
সৃজা ওর বুকে নাক ঘঁষে সরে এলো ওর থেকে। বালিশে মাথা রেখে চাদর গায়ে টেনে নিয়ে প্যাকেট হয়ে শুয়ে পড়ল। ইহসান ওর কাণ্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠে বসল। ধমক দিয়ে বলল,
“পাপ হবে সৃজা, স্বামীর কথা মানতে হয়।”
সৃজা শক্ত গলায় বলল,
“হোক পাপ। যে লোক শুধু আদর পেলেই আমার কাছে আসে, তাকে আমি চাই না। কই! এতদিন তো আসোনি। যে, দেখে যাই সৃজাটাকে। কেমন আছে,
কী হালত! আর ফোন! সেটাও দু-একবার দিয়েছ! আমাকেই দিতে হয়েছে বেশিরভাগ সময়।
এখন আদর চাইতে এসেছে।”
ইহসান ওর অভিযোগ শুনে মাথা দু’হাতে চেপে ধরল

ব্যথায় ওর কপালের রগ টনটন করছে। ক্লান্ত লাগছে। কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে সৃজাকে বলল,
“এত রাগছিস কেন? দেখতে আসলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করতো, বেশি বেশি ফোন দিলে তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো। তুই বেড়াতে এসেছিস, আমি যদি ঘন ঘন চলে যাবার কথা বলতাম তখন ভাবতি আমি বেশি বেশি করছি! তোকে শান্তি দিচ্ছি না। বিরক্তি হতি। এখন আসিনি, এটাতেও প্যাঁচ ধরছিস। বোঝ একটু। কাছে আয় না সোনা…”
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ইহসানের শিয়রে পেয়ে সৃজা যে কতটা আনন্দিত হয়েছে সেটা কে বোঝাবে এই লোককে? সৃজা তো রেগে নেই ওর প্রতি। ওকে ঘাঁটাতে এগুলো বলছে। খেলাচ্ছে লোকটাকে।
এদিকে সৃজার নিজেরও প্রেম প্রেম পাচ্ছে। তবে
সেটা প্রকাশ না করে বিরক্ত হবার ভান করে বলল,

“লজ্জা করো একটু!”
“লজ্জা করে কী হবে বল তো? তুই এমনিতেই কাছে চলে আসবি? ওকেহ! লজ্জা করলাম তবে…”
ইহসানের গলা অসহায় শোনাল। সৃজা আড়ালে হাসল। কিন্তু সেটা দেখাল না ওকে। গম্ভীর মুখে তাকাল ওর দিকে। এরপর দু-হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। ইহসান এগিয়ে গেল, সৃজা ওকে চমকে দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

অশ্রুবন্দি পর্ব ২৮

“আমার সকালটা খুশি খুশি রোদে রাঙিয়ে দেওয়ায়
তোমাকে এবারের মতো মাফ করে দিলাম।”
ইহসান ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে ওকে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
“দেখি একটা চুমু খা!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩০