অশ্রুবন্দি পর্ব ৩২
ইসরাত জাহান ফারিয়া
প্রকৃতিতে শীতের ডাক এখনো পড়েনি। তবে ইদানীং বিকেল নামতেই ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে রোদকুচি। চারিদিকে মন খারাপ ভাব। নীলু বেগমের শরীর ভালো না, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি ঘুমিয়ে আছেন নিজের ঘরে। এদিকে আগামীকাল চলে যেতে হবে, সব মিলিয়ে সৃজার মন খারাপ, সাথে এলিজারও। একজন বিকলাঙ্গ, বাকশক্তিহীন পুরুষ আর তিনজন অসমবয়সী মেয়েলোকই এতদিন অর্ধমৃত ফ্ল্যাটটির কিঞ্চিৎ প্রাণ ছিল। কিন্তু সৃজার অনুপস্থিতিতে আগের সেটুকু প্রাণোচ্ছলতাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এলিজা সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নাইমুর সাহেব তো বিছানায় পড়া, যার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, বোধগম্যতা নেই। একেবারে শক্তি-সামর্থ্যহীন। নীলু বেগমের দিনকাল পঙ্গু ও বোধশক্তিহীন ভাইয়ের সেবাযত্ন করেই কাটান।
নয়তো নামাজকালাম পড়ে, কখনোসখনো ওল বুনে অবসর সময় কাটাতেন। অথচ সেই মানুষটাও আজ বিছানায় পড়া। একাকিত্বের ভারে আজকাল তিনিও কেমন নরম হয়ে পড়ছেন। বহুবছর আগে মা চলে যাওয়ার পর থেকে একদম একা হয়ে পড়েছিল এই পরিবারটা। তখন এই ফুফুই তো আগলে রেখেছিল ওদেরকে, জীবনে কোনোদিন কিছু না পাওয়া স্বত্তেও কখনো কিছু চাননি, আফসোস করেননি। সৃজার তাই আজকাল মাতৃতুল্য ফুফুটার জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়, ভেতরটা বিষন্ন লাগে। আগামীকাল চলে গেলে আবারো এলিজা, ফুপি একা হয়ে যাবে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অর্ধমৃত ফ্ল্যাটটা আরো শুনশান হয়ে যাবে। ভেবেই সৃজার চোখদুটো ভিজে আসে। কী আশ্চর্য! আগে কখনো কথায় কথায় ওর চোখ ভিজতো না, কিন্তু এখন কিছু হলেই চোখদুটো নোনাজলে ভিজে উঠতে চায়। দুর্বল ঠেকে নিজেকে। নিজের এই দুর্বলতা নিয়ে সৃজার ভয় হয়, বড় বিষন্ন লাগে। এই বিষন্নতায় ঘেরা রাত দশটার দিকে হঠাৎই কুরিয়ার থেকে সৃজা রেহমানের নামে একটা পার্সেল আসে। কোনোকিছু অর্ডার না করা স্বত্তেও এত রাতে পার্সেল পেয়ে সৃজা যখন বিচলিত তখন এলিজা বলল, পার্সেল খুলে দেখলেই হয়। বোনের কথামতো পার্সেল খোলার পর একটা ল্যাভেন্ডার ফুলের বুকে আর একটা চিরকুট পাওয়া গেল৷ চিরকুটে
শুধু দুটো শব্দ লিখা,
‘ল্যাভেন্ডারের জন্য।’
চিরকুট পড়ে সৃজার ভ্রু কুঁচকে আসে। দ্বিধায় পড়ে যায়।
কে পাঠিয়েছে পার্সেলটা? তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনও তো নেই সৃজার যে এসব পাঠাবে! তাহলে কে পাঠাল? ইহসান? ও কেন এসব পাঠাবে? তাও এ ধরনের লেখা? কাল তো সৃজা বাড়িতে যাচ্ছেই। কিন্তু ইহসান যদি না পাঠিয়ে থাকে তাহলে? এলাকার কোনো বখাটে আবার এমন মজা করেনি তো? সৃজা চিন্তায় পড়ে গেল। এলিজা বোনের চিন্তা দেখে ফোন করে ইহসানকে একবার জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করল। কিন্তু সৃজা মানা করল।
যদিও সে নিজেও দ্বিধাদ্বন্দে ছিল, তবুও বোনকে বোঝাল, ইহসান হয়তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। তাই পাঠিয়েছে। এখন যদি সারপ্রাইজড না হয়ে উল্টো ওকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তাহলে ব্যাপারটা বিশ্রি দেখাবে। তাছাড়া ইহসান যদি না পাঠিয়ে থাকে তাহলে ওকে এসব বললে এত রাতে লোকটা চিন্তায় তো পড়বেই, ঝামেলাও করতে পারে। তাই পরে জানাবে বলে মনোস্থির করল। বোনের অমত দেখে এলিজা আর ইহসানকে ফোন করল না। চেপে গেল। তবে নীলু বেগমের সেদিন রাতে আগের চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তার সেবা করতে গিয়ে দু’বোনের মাথা থেকে এ বিষয়টা উবে গেল। যদিও পরদিনই নীলু বেগম অনেকটা সুস্থ হয়ে যান, কিন্তু তাও সৃজা আরো ক’দিন থেকে যাওয়ার বায়না ধরল ইহসানের কাছে। ইহসান অবস্থা বিবেচনা করে তিনদিন থাকার অনুমতি দিলেও আরো চারদিন বাড়িয়ে দু-সপ্তাহ পর শেখ বাড়িতে ফিরে এলো সৃজা।
এদিকে কথা অমান্য করায় ইহসান রাগ করে ওকে আনতেও যায়নি, বিকেলের দিকে রশিদকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রাতে রেস্তোরাঁ থেকে বাড়িতে ফিরেও সৃজার সাথে কোনো বাক্যবিনিময় করল না। হ্যাঁ, না কোনোকিছু না। সারাক্ষণ এ কাজ, সেকাজের বাহানা দেখিয়ে ফোন আর ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে রইল। রাগ বুঝে সৃজা ওর আশেপাশে ভীতি নিয়ে ঘুরঘুর করল। নিজে থেকে প্রশ্ন করল। ইহসান হু, হা উত্তরে সীমাবদ্ধ থাকল। এমনকি ঘুমানোর সময়ও ইহসান ওর বুকে মাথা রাখতে দিলো না। কাঁদোকাঁদো মুখ করেও লাভ হয়নি সৃজার, ইহসান শক্তপোক্ত গলায় অন্যদিকে ফিরে শুয়ে কাছে না ঘেঁষার রেস্ট্রিকশন দিয়ে দিলো। সৃজা এসব মানলে তো! জোরাজুরি করে নিজে থেকে কাছাকাছি গেল, গিয়ে অবশ্য ফেঁসে গেল। ইহসানও সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিলো। রাতভরে রাগ মিশিয়ে আদর করল তো ঠিকই, তবে একশর্তে ওকে মাফ করবে বলে জানাল। সৃজা শর্ত জানতে চাইলে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, অতি শ্রীঘ্রই বাবা হতে চায়, প্রিন্সেস লাগবে ওর। সৃজার প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতোন, স্তব্ধতায় মুড়ানো চমকিত মুখখানা,
পরবর্তীতে যা ইহসানের নগ্ন বুকের নিচে চাপা পড়েছিল!
দু’সপ্তাহ পর শেখ বাড়িতে ফিরে লিথুকে না দেখে
বেশ অবাক হলো সৃজা। যে মেয়ে সারাদিন রঙঢঙ করে ইহসানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে এবং বিয়ের এ দু-আড়াই মাসে একদিনের জন্যও বাপের বাড়ি যাওয়ার নামগন্ধ নেয়নি, সে শেখ বাড়িতে নেই? ইস্মির কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে সৃজা মনে মনে স্বস্তি পেল বেশ। যাক, এতদিন তাহলে ডাইনিটা ছিল না। ভালোই হয়েছে। যখন তখন ইহসানের গায়ে ঢলে পড়া এ মেয়েকে একদম সহ্য হতো না ওর, পছন্দ করতে পারে না সৃজা। গিয়ে ভালোই হয়েছে ওর কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে গেছে ইহসানটা। তবে একটা জিনিস সৃজা খেয়াল করল, যে ইস্মির ঠোঁটে হাসি খুঁজে পাওয়া দুর্বোধ্য ছিল, তার ঠোঁটের কোণে এখন এক-আধটু হাসিত হাসির ছিঁটেফোঁটা পাওয়া যায়; যেটা আগের মতো নকল নয়। সৃজার বেশ ভালো লাগল এবারের ইস্মিকে দেখে।
নতুন ডিলের চুক্তি সেরে ইজহান ফুরফুরে মেজাজে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল। হাতে তার শপিং ব্যাগ আর পিজ্জার পার্সেল। ডিলের চুক্তি হয়ে যাওয়ার খুশিতে ইস্মির জন্য সে গোলাপি রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি এনেছে, নিজে পছন্দ করে। এই রঙে তার বউকে রাণীর মতো লাগে। প্রতিবারের মতো বাড়ি ফিরে হাঁকডাক না ছুঁড়ে সে নিঃশব্দে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল ইস্মি নেই, ঘর খালি। ইজহানের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। এই বিকেলে তার বউ আবার কোথায় গেল? এ সময় তো এই মেয়ের ঘরে থাকার কথা! আবার ভেড়ার বউটার সাথে গল্পে মজেছে না তো? দেখল তো সে, গতদিন বাড়ি ফিরেছে৷ ইজহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। নিশ্চয় তার ইস্মিতার মাথায় উল্টাপাল্টা কুবুদ্ধি ঢোকাচ্ছে ভেড়ার বউটা, হয়তো বলছে তারা কী রোমান্টিক সময় কাটায়, রিকশা করে ঘুরে, বাইকে করে নদীর পাড় যায়, ফুচকা খায় ইত্যাদি!
ইজহান তিরিক্ষি মেজাজে শপিং ব্যাগ আর পিজ্জার প্যাকেট রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এ ঘর, ও ঘর খুঁজতে লাগল। পেল না কোথাও। শেফালি বুয়াকে জিজ্ঞেস করল৷ সেও নাকি দেখেনি। বসার ঘরে, রান্নাঘরেও নেই৷ চিন্তিত হলো ইজহান। কোথাও না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ইহসানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এখন তার বদ্ধ বিশ্বাস ইস্মিতা এ ঘরেই সৃজার সাথে আড্ডা জমিয়েছে। বউটা তার এই মেয়ের কাছ থেকে কুবুদ্ধি নিয়ে গাল ফুলিয়ে থাকবে তার সাথে—নাহ! এ হতে দেওয়া যায় না। একবুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইজহান বহুদিন… উহু! বহুবছর পর ইহসানের ঘরের দরজায় টোকা দিলো, আস্তে করে দুটো টোকা দিয়েই সে অবশ্য থেমে গেল। বুকটা আচমকা ভার লাগল! এ ঘরটা…এ ঘরটা তার মায়ের! তার কত প্রিয়, অথচ দেয়নি! ভেড়াটা দেয়নি এ ঘরটা, নিজে দখলে নিয়ে বউটাকে নিয়ে সংসার পেতে বসেছে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলতে এত সময় লাগে নাকি? অসহ্য হয়ে সে থাবা বসায় আবারো, ভেতর থেকে মেয়েলি গলা ভেসে আসে,
“আসছি…”
দরজা খুলে ইজহানকে দেখে সৃজা অবাকই হয়। তবে সেটা বুঝতে দেয় না৷ মাথায় ওড়নাটা টেনে বিহ্বল কণ্ঠে বলে,
“ভাইয়া আপনি, কিছু দরকার?”
আদিক্ষেতা! ভাই ডাকা হচ্ছে! সে আবার কখন থেকে এই মেয়ের ভাই বনে গেল? হুহ! ইজহান শক্ত মুখ বানিয়ে গমগমে স্বরে বলে,
“ইস্মিতাকে আসতে বলো।”
সৃজা অবাক হয়ে বলল,
“ইস্মিতা… মানে ভাবি, ভাবি তো এখানে নেই।”
ইজহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে,
“নেই মানে?”
“নেই মানে এখানে আসেনি।”
“মিথ্যা বলছ, ডাকো ওকে।”
সৃজা বোকা হয়ে যায়, সরু গলায় বলে,
“আশ্চর্য! মিথ্যে বলব কেন আমি আপনাকে?”
ইজহান কটমট করে বলে,
“আমার বউকে কানপড়া দিতে, আর কেন! শুনে রাখো মেয়ে, আমি কিন্তু একদম এলাউ করব না আমার বউকে কু-বুদ্ধি দিয়ে নষ্ট করলে।”
সৃজা হতভম্ব হয়ে ইজহানের দিকে তাকিয়ে রইল। এ লোকটা কীভাবে এমন সন্দেহপ্রবণ হতে পারে? এতদিন হলো বিয়ে হয়েছে, তবুও নিজের বউকে সামান্য বিশ্বাস করতে পারে না? আর তার কী দোষ? সে কখন ইস্মিতাকে কুবুদ্ধি দিল? এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগে রাগের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি লাগছে ওর!
“ভাইয়া, আপনি যা বলছেন, সেটা ঠিক না। ভাবি এখানে আসেননি। আমি জানিও না উনি কোথায় আছে। আর আমি কেন ওনাকে কুবুদ্ধি দিতে যাব?”
“কৈফিয়ত চাও? বেয়াদব! ডাকো ইস্মিতাকে, আমি জানি ও এখানেই আছে। ইচ্ছে করে মজা করছ, আমায় বোকা ভেবো না।”
গমগমে স্বরে চেঁচিয়ে উঠে ইহসান। সৃজা প্রথমে হকচকিয়ে উঠে। ভীত গলায় বিস্ময় নিয়ে বলে,
“ভাবি নেই, আসেনি এখানে। বিশ্বাস করছেন না তো, এসে চেক করে যান।”
ইজহান ভ্রু কুঁচকে থাকে। এ মেয়েকে বিশ্বাস করতে তার বয়েই গেছে। আস্ত নাটকবাজ এরা ভেড়া-ভেড়ী! নিশ্চয় ইস্মিকে এটাসেটা বুঝিয়ে এখানে চুপ করে বসিয়ে রেখেছে। তার বউটা তো সরল, নিশ্চয় এদের কথা মেনে বসে আছে। কিন্তু আছে কী? নাকি নেই? ঘর ঢুকে একবার চেক দেবে কী? নাকি না? দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই একসময় সে ঘরের ভেতর পা বাড়ায়, বহুবছর পর! সৃজা একপাশে সরে দাঁড়ায়। ইজহান ঘরে ঢুকে এদিকওদিক দেখে, ইস্মিতা নেই কোথাও। বারান্দায় খুঁজে, সেখানেও পায় না। না পেয়ে সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। নিচে বা ছাদেও তো নেই ইস্মি, এখানেও আসেনি। তাহলে গেল কোথায়? ওকে এভাবে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সৃজার হাসি পায়, ঠিক ইহসানের চেহারা বেরিয়ে এসেছে। এই দু-ভাইয়ের এত মিল কেন, কীভাবে হয়! এইযে, ইজহান ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে আছে, কাছের মানুষ না হলে কেউই
ধরতে পারবে না যে, তারা দু’জন ভিন্ন পুরুষ! সৃজা ধরতে পারে, বেশ ভালোভাবেই। ইহসানের গায়ের ঘ্রাণ শুনলেই বুঝে, দূর থেকে একবার দেখলেও বুঝে। এটা কী—ভালোবাসা, টান? হয়তো তা-ই! সে ডাকলো ইজহানকে।
নম্র স্বরে বলল,
“পেলেন ভাবিকে?”
ইজহান বিরক্ত চোখে তাকাল,
“কোথায় ও?”
সৃজা হতাশ গলায় বলল,
“এখানে আসেনি। দুপুরে রান্নাঘরে দেখেছিলাম,
কিন্তু এরপর আর দেখিনি।”
ইজহান ঠিক বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু সৃজার ভদ্রসভ্য মুখ দেখে মনেও হলো না এই মেয়ে মিথ্যে বলছে। তার চিন্তা শুরু হলো ইস্মির জন্য, বুক ব্যথা অনুভূত হলো, হাত দিয়ে চেপে ধরল। সৃজা সেটা বুঝে সাবধানী কণ্ঠে ওকে বলল,
“ফোন দিয়ে দেখুন নয়তো….”
“ওর ফোন নেই।”
শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো ইজহান। সৃজার বুক কেঁপে উঠল ওর ধমক শুনে। আমতাআমতা করে বলল,
“তাহলে ছাদে গিয়ে খুঁজে দেখি, দাঁড়ান আমি দেখে আসছি….”
“নেই কোথাও, খুঁজে এসেছি।”
অসহায় শোনাল যেন গলাটা। ইজহান কী প্যানিক করছে নাকি? সৃজারও এবার চিন্তা লাগল। গেল কোথায় ইস্মি?
ও ঘর থেকে বেরিয়ে আবারো খুঁজল ছাদে, সব ঘরে। পেল গিয়ে সালেহা বেগমের ঘরে। সালেহা বেগমের পায়ে সরষের তেল মালিশ করে দিচ্ছে ইস্মি। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকায় ইজহ৷ হয়তো ভেবেছে এ ঘরে নেই ইস্মি। সৃজা
দেরি করল না ইজহানের ফেরার খবরটা ইস্মিকে দিতে।
শুনে ইস্মি হন্তদন্ত হয়ে কাজ সেরে ছুটে গেল উপরে, সৃজাদের ঘরে। গিয়ে দেখল ইজহান ঐ ঘরের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বুকে হাত চেপে বসে আছে। ইস্মি চিৎকার দিতে গিয়েও দিলো না৷ ছুটে গিয়ে ধরল ওকে। বুকে হাত বুলাতে বুলাতে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“কী হলো আপনার?”
ইজহানের জানে যেন পানি ফিরে এলো বউয়ের গলা শুনে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। এরপর হুট করে একহাতে গাল চেপে ধরে বলল,
“কই ছিলি তুই? কোন প্রেমিকের সাথে বিকেলের
প্রেম জমাতে গেছিস? এদিকে সারা বাড়ি খুঁজে আমি হয়রান!”
ইস্মি জানতো না ইজহান আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরবে, কখনো ফেরেও না এমন সময়ে। আজ এমনিতেই ক্ষেপে আছে, এখন যদি শুনে ইস্মি
সালেহা বেগমের পা মালিশ করে দিচ্ছিল, অন্যের কাজ করছিল তাহলে এই লোক আরো হাজারটা প্রশ্ন করে ওকে আধমরা করে ফেলবে। ইস্মি তাই আমতাআমতা করে বলল,
“মাথাব্যথা করছিল, আম্মার ঘরে ঔষধ খেয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
বউকে খুঁজে না পেয়ে কী অবস্থাই না হয়েছে লোকটার! এত এত টক্সিসিটির মাঝেও ইজহানের এই বউ পাগলামো মনোভাব দেখে সৃজার একসাথে মিশ্র অনুভূতি হলো। এদিকে ইজহান বউয়ের অসুস্থতার খবর শুনে শান্ত হলো। রাগ-ক্ষোভ উবে গেল। উল্টো ওকে কাছে টেনে নিয়ে বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
“মাথাব্যথা কমেছে?”
“কমে গেছে।”
“সত্যি?”
“মিথ্যা বলি আমি?”
অভিমানী গলা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ইজহান মাথা নাড়ল দু’পাশে। ইস্মিতা মিথ্যা বলে না, সে জানে। ইজহান
স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে, তখনি ওর চোখ যায় দরজায়। বাইরে দাঁড়ানো সৃজা। যদিও এদিকে তাকাচ্ছে না, তবুও ওকে দেখে মুখটা কালো করে ফেলে ইজহান।
ইস্মিকে বলে,
“এই বউটা কুনজর দিবে, চল ঘরে যাই!”
ইস্মি ধমক দিতে গিয়েও দেয় না, হতাশ গলায় বলে,
“চলুন।”
দু’জনেই উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবে বলে ইজহান একবার ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়, বারান্দায় উঁকিঝুঁকি মেরে আসে। ইস্মি বোকার মতো ওর কান্ড দেখে। ডাক দেয় ওকে। ইজহান অপ্রস্তুত হয়ে যায়, ইস্মির হাত ধরে বেরিয়ে আসে৷ বেরিয়ে এসে সৃজাকে ইজহান রাগী গলায় বলে,
“তুমি আমার বউ থেকে দূরে থাকবে। আমার সংসারে অশান্তি চাই না আমি।”
ইস্মি হতবিহ্বল। পাগল নাকি এই লোক? কাকে কী বলছে? ইস্মি কিছু বলতে যাবে তার আগেই সৃজা ওকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ইজহানকে বলল,
“আপনার সংসার! আপনার সংসারে অশান্তি থাকুক বা না থাকুক, এতে আমার কিছু যায় আসবে না। কিন্তু আপনার বউয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিল, সেটা একবার ভেবে দেখবেন ভাইয়া। আর আমি সত্যিই চাই, আপনারা সুখী থাকুন, সুখী হোন। আপনি একটু পাগল আছেন বটে, কিন্তু নাইস গাই। আপনি নিজের মনটাকে কন্ট্রোল করলে সত্যিই আপনারা পারফেক্ট কাপল হবেন।”
কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল ইজহান, কোনো উত্তর দিলো না। এই নারীবাদি মেয়ে কী ওর প্রশংসা করল নাকি নিন্দা? কনফিউশনে পড়ে গেল সে। ইস্মি বহুকষ্টে হাসি আটকাল। ইজহান বোকা বোকা হয়ে গেল। সৃজাকে ধমক দিলো,
“বেশি কথা বলো তুমি।”
“কম বলার চেষ্টা করব।”
“তাহলেই ভালো।”
এটুকু বলে হঠাৎ করেই আবার ইহসানের ঘরটাতে প্রবেশ করে ইজহান। ইস্মি হতভম্ব, সাথে সৃজাও। এমন করছে কেন এই লোক? দু’জনেই কিছু বোঝে উঠল না। ইজহান গিয়ে দেয়ালে টাঙানো একটা ভ্যান গগের একটা পেইন্টিং খুলে নিয়ে সঙ্গে নিয়ে নেয়। সৃজাকে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করে না, তবে ঘর থেকে বেরিয়ে ফিসফিস করে ইস্মিকে বলে,
“এটা আমাদের ঘরে টাঙাব।”
ইস্মি বুঝতে পারে না ভাইয়ের ঘরের পেইন্টিং এই লোক না বলে নিয়ে এলো কেন! ও বিস্মিত হয়ে বলে,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩১
“কিন্তু এটা তো ওদের।”
“চুপ, এটা ওদের না।”
ইস্মি শুধোয়,
“কার তাহলে? আপনার?”
ইজহান নম্র স্বরে বলে,
“উহু! আমার মায়ের।”