অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া
অফিস থেকে দেরি করে ফেরায় দেরিতেই ইজহান ভাত খেতে বসেছে, নিজের হাতে যদিও খাচ্ছে। সাথে ইস্মিকেও মুখে তুলে দিচ্ছে। পাতে রুই মাছের তরকারি, কিন্তু কাঁটা নিজে বাছতে পারছে না। ইস্মিকে বেছে দিতে হচ্ছে। একজন লোকমা মাখবে, একজন মাছ বাছবে। মহা যন্ত্রণা! খাবার মুখে নিতে নিতে ইস্মি ওকে বলল,
“আমাকেই দিন না, আমি কাঁটা বেছে মেখে দিই। এভাবে সব ঘেঁটেঘুঁটে যাচ্ছে।”
ইজহান প্লেট সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“না, তুমি শুধু মাছটাই বাছো। আমি তো খাইয়ে দিচ্ছিই, ভালো লাগছে না?”
ইস্মি শুকনো গলায় বলল,
“সেটা আমি কখন বললাম?”
ইজহান বিরক্ত হলো নিজের উপর। আশ্চর্য, সে বউকে ধমকি দিচ্ছে কেন? এখনি না আবার মন খারাপ করে ফেলে। এই মহিলা ইদানীং কথায় কথায় গাল ফুলাচ্ছে।
পাঁচ বছরে এমন রুপ সে হাতেগোনা দু-বার দেখেছিল। আর ইদানীং বেশিই দেখছে। আজকাল তাই সতর্ক থাকে সে কথা বলার সময়। গুগপ করে জেনেছে সে, অহেতুক কথা বলে কষ্ট দিয়ে কোনোভাবেই বউকে মন খারাপ করিয়ে দেওয়া চলবে না। তাতে ভালোবাসা কমে যাবে। এটা তো
সে হতে দেবে না, নো নেভার। ইজহান ঠোঁটে হাসি আনার প্রচেষ্টা করে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“বলোনি? ওহ! আচ্ছা এখন চুপ করো। খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই, গলায় আটকে যাবে।”
এ কথা শুনে বিস্মিত ইস্মি আড়ালে মুখ ভেঙালো। নিজে যখন খেতে বসে হাজার কথা বলে ওর কান ঝালাপালা করে দেয়, তখন উপদেশবাণী কই থাকে? নিজের বেলায় সব ঠিক, অন্যের বেলায় বেঠিক। ইস্মি বিড়বিড় করল। ইজহান নিজের লোকমা মুখে পুরে ইস্মির মুখে যখন খাবার দিতে গেল তখন গোলাপি ঠোঁটজোড়ার নড়নচড়ন দেখে সে ভ্রু
কুঁচকে রুক্ষ গলায় বলে উঠল,
“কী বিড়বিড় করছ? আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন?”
ইস্মির হুঁশ ফেরে। থতমত খেয়ে বলে,
“কারণ আমি কিছু বলিইনি।”
“আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি বিড়বিড় করছ।”
“করিনি।”
ইজহান সূক্ষ্ম চোখে তাকায়, দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“করেছ।”
ইস্মির রাগ লাগে খানিকটা। প্রকাশও করে ফেলে,
“আপনি সবসময় অহেতুক বিষয় নিয়ে পড়ে থাকেন কেন বলুন তো? আমি কেন বিড়বিড় করছিলাম সেটা জেনে আপনার কী কাজ? খেতে বসেছেন খাবারটার দিকেই মনোযোগ রাখুন না। এতদিকে নজর দিলে খাওয়া
ঠিকঠাক হবে? গলায় আটকে মরে যাব তো!”
বিরক্তি প্রকাশ পায় ইস্মির কণ্ঠে। কুঞ্চিত হয়ে উঠে ভ্রু জোড়া৷ ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুকজ মুছে নেয়। ইজহান লাল চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর হাতে তোলা খাবারটা প্লেটে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“আমার প্রতি খুব বিরক্তি কাজ করে তোমার?”
ইস্মি কিছু না ভেবেই জবাব দেয়,
“সারাক্ষণ এভাবে যন্ত্রণা দিলে বিরক্ত তো লাগবেই। আর ছোটখাটো বিষয়ে আপনি যেভাবে হাইপার হয়ে যান, মাঝেমাঝে দমবন্ধ লাগে আমার। জেলখানায় বন্দি মনে হয়। আচ্ছা, আপনাকে যদি কেউ এভাবে সারাক্ষণ প্রশ্ন আর সন্দেহ করে কথাবার্তা বলে আপনি বিরক্ত হবেন না? ইচ্ছে করবে না দুটো চড় বসিয়ে দিই?”
ইজহানের চোখ জ্বলে উঠে। এলোমেলো লাগে মাথার ভেতরটা। হঠাৎ প্লেট রেখে ঠাস করে উঠে দাঁড়ায় সে। কোনো বাক্য বিনিময় না করে হাত ধুতে চলে যায় বেসিনে। ইস্মি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। মস্তিষ্ক কাজ করে ততক্ষণে। জিভ কাটে পরপর। কপাল চাপড়ায়। কাকে এতক্ষণ ভাষণ দিলো সে? ইজহান শেখকে? নিজের অবুঝ স্বামীকে? যে এসব কথার মর্ম বোঝে না? যে এখন ফিরে এসে রাগারাগি করে আরেক প্রস্ত যন্ত্রণা দিবে? ইস্মি হতাশ হয়ে ঘাড় বাঁকায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে বিছানার সাইডে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মুখ তুলে চায়। ইজহানের থমথমে মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। কৈফিয়ত দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ওকে একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ইজহান গিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে গা, হাত-পা ছড়িয়ে। ইস্মি ভড়কে গিয়ে থম মেরে থাকে। এত শীতল কেন মানুষটা? রাগারাগি করল না যে? ঝড়ের পূর্বাভাস নয়তো? মাথায় হয়তো ছক কষছে কীভাবে ওকে যন্ত্রণা দিবে একটু একটু করে। ইস্মি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ঢোক গিলে ভীত কণ্ঠে শুধোয়,
“খাবার পড়ে আছে যে…”
ইজহান ধমকি দেয়,
“তুই খা।”
“আপনি তো কিছুই খেলেন না…”
“খাবার হজম হবে না। বমি হয়ে যাবে।”
“কেন? শরীর খারাপ আপনার?”
উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে ইস্মি। ইজহান শক্ত মুখে বলে,
“আমি ভালো আছি।”
ইস্মি হাত পরিষ্কার করে এসে বসে শিয়রে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ভার গলায় বলে,
“তাহলে খাবার হজম হবে না কেন? রান্না ভালো হয়নি? লবণ কম হয়েছে? কী হয়েছে বলুন না…”
ইস্মি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ওকে। জানতে চায় কেন, কী কারণে এমন করছে ইজহান। কিন্তু ইজহান বলে না, সরু চোখে চেয়ে থাকে। একসময় না পেরে ঠাস করে এসে ওর কোলে মুখ গুঁজে রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দেয়,
“ওসময় কী বিড়বিড় করছিলি বল…”
ইস্মি হাফ ছাড়ে,
“ওহ চড়ের কথা? ওটা তো কথার কথা বলেছিলাম, আপনাকে না। আমি কী আপনার গায়ে হাত দেব নাকি? এর আগে খসে যাক আমার হাত।”
ইজহান বলতে চাচ্ছিল না কথাটা। তবুও কৌতূহল খোঁচাচ্ছে ওকে। নিজের কাছেই হার মেনে নিয়ে সে জানতে চায়,
“উহু, ওসব না। বিড়বিড় করে কি বলেছিলে সেটা জানতে চাইছি।”
ইস্মি হতভম্ব। ও তো ভেবেছিল দুটো চড়ের কথা বলায় এই লোক ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, কিন্তু তা নয়। ও কি বিড়বিড় করছিল তা জানতে এমন অদ্ভুত ব্যবহার? সামান্য কারণে এমন আচরণ? ওর মাথা চক্কর দিলো।
বলল,
“তখন কি বলছিলাম? গুরুত্বপূর্ণ কিছু না তো, মাছের কাঁটার কথাই বলছিলাম।”
“কী বলছিলে?”
ইস্মির গলায় কাঁদোকাঁদো ভাব এসে জমা হতে চায়, তখন ও আসলে কী বলছিল? মনে নেই। কিন্তু এখন এই লোককে কিছু না বললে এভাবেই ওকে নাজেহাল করে ছাড়বে। ইস্মি বহুকষ্টে আবেগ লুকিয়ে বলল,
“বলছিলাম আপনার গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে গেলে কীভাবে ছুটাব! কোন সূরাটা যেন পড়তে হয়, সেটাই বিড়বিড় করছিলাম।”
ইজহান ওর স্বীকারোক্তি শুনে শান্তি পেল। তার বউ মনে মনে, উপরে উপরে কি ভাবে সব তার জানা চাই, জানতে ইচ্ছে করে। নয়তো হাসফাঁস লাগে। খালি খালি লাগে। সন্দেহ সন্দেহ লাগে। ও ইস্মির অনাবৃত উদরে ঠোঁট বসিয়ে চুমু খেয়ে এরপর স্বস্তি নিয়ে
বলল,
“এটা তখনি বলে দিলেই হতো। তুমি ইদানীং বড্ড
কথা প্যাঁচাও ইস্মিতা, আমার রাগ লাগে।”
ইস্মি হতাশ শ্বাস ফেলে ওর চুল টেনে দিতে দিতে বলে,
“রাগ কমান। এত রাগ ভালো না।”
ইজহান মৃদু কণ্ঠে বলল,
“চেষ্টা করি তো।”
ইস্মি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“চেষ্টা করলে চলবে না। পারতে হবে।”
ইজহান ধীর গলায় বলে,
“কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো? আমি রাগ কমাতে পারব না। রাগ আমার রক্তে মিশে গেছে। না চাইতেও তোমার সাথে দেখিয়ে ফেলি।”
ইস্মি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“রাগ যাতে আমাদের মাঝে এসে তিক্ততা না বাড়ায় এরজন্যই তো রাগকে আয়ত্বে নিতে হবে। আচ্ছা ভেবে দেখুন, আমি যখন আপনার উপর সেদিন রাগ করেছিলাম তখন কী আপনার ভালো লাগছিল? সত্যি বলুন তো।”
“না লাগেনি। তোমাকে মেরে নিজেকেও মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।”
“তাহলে ভাবুন, আমার কী অবস্থা হয়! আমারও তো ভালো লাগে না আপনি এভাবে কথায় কথায় রাগ করলে। তাছাড়া আমিও তো আপনার মতোই মানুষ। রাগ তো আমারও আছে। তবুও তো আমি কথায় কথায় আপনার মতো রাগারাগি করি না। করি কি?”
“না।”
ইস্মি নিজের কোমল হাতে ওর কপাল টিপে দিতে দিতে সাবধানী গলায় বলল,
“রাগ ভালো কিছু বয়ে আনে না। আপনার রাগগুলো কষ্ট দেয় আমাকে। সত্যি বলতে তখন আমি অসহ্য হয়ে পড়ি আপনার উপর। আপনি কী চান সেটা? না তো! তাহলে কষ্ট করে হলেও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।”
“তুমি আমার পাশে থেকে যেও ইস্মিতা, কখনো দূরে যেও না, যাবার চিন্তাও করো না। আমার আপন বলতে কেউ নেই। বাবা আছে অবশ্য। আর ভাইগুলো তো মীরজাফর। ওদের আমি সহ্য করতে পারি না। আমার তো এই তুমি ছাড়া এত কাছের আর কেউ নেই, তাই না? ভয় লাগে যদি তুমি চলে যাও আমায় কে এভাবে সামলাবে! থেকেও যেও এভাবেই, হু?”
ইজহান ইস্মির কোমড় জড়িয়ে বলে উঠে। ইস্মি খেয়াল করল ওর ভ্রু কুঁচকে আছে। মুখ আরক্ত। জানালা খোলা, সেখান দিয়ে ফরফর করে শীতল হাওয়া আসছে। চাঁদের একফালি আলো মেঝেতে আদর ছড়াচ্ছে, ইজহানের মুখে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। লোকটা এত আবদার করে বাচ্চাদের মতোন! কবে একটু ঠিক হবে? অবশ্য ঠিক হয়ে গেলে ইস্মি আবার এই পাগলাটে ইজহানকে মিস করবে। কী যেন চায় মনটা, ইস্মি আনমনে শ্বাস ছাড়ে। ঘাড় নেড়ে সায় জানায় ইজহানের প্রশ্নের প্রতুত্তরে। মুখ আগলে ধরে নাকের ডগায় নাক ঠেকিয়ে বলে,
“থেকে যাব, রাখতে শিখুন।”
“শিখব।”
বাতের ব্যথা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে সালেহা বেগম। কোমরে আঘাত লেগেছে তার। চিৎকার শুনে ছুটে আসে সৃজা-ইস্মি। এসে দেখে বাথরুমে পড়ে আছে সালেহা বেগম। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ওরা তুলে ঘরে নিয়ে আসে তাকে। বুঝে উঠে না কী করবে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই, সবাই যে যার কাজে। বাধ্য হয়ে সৃজা ইহসানকে ফোন দিয়ে জানায় ব্যাপারটা। ও সব শুনে বাড়িতে ডাক্তার পাঠিয়ে দেয়। ডাক্তার এসে দেখে গেছে সালেহা বেগমকে। এক্স-রে আর বেডরেস্ট দিয়েছে। ঔষধপথ্য সব বুঝে নিয়েছে সৃজা আর ইস্মি। পুরোটা বিকেল, সন্ধ্যা কেটে গেছে সালেহা বেগমের যত্নেই। ইস্মিও যথেষ্ট দেখাশোনা করছে। একমাত্র মিতুই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। বড় দু’জন ছেলে বৌয়ের যত্ন পেয়ে সালেহা বেগম ছলছলে চোখে তাকান ওদের দিকে, মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা বলেন। প্রশ্ন করেন, জবাব দেন। সৃজা খেয়াল করে সালেহা বেগম ইহসান-ইজহানদের কথাই বেশি জিজ্ঞেস করছে, ওদের সম্বন্ধে জানতে চাইছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করে কি-না, স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখে কি-না এসব!
সৃজা সব কথারই জবাব দেয়, ওর বেশ খারাপ লাগে। এ বাড়ির দৈন্যদশা সে দেখে। আজিজ শেখের জন্য সালেহা বেগম সবসময় ভীত হয়ে থাকেন। কারণ রগচটা এই লোকটা ভীষণ বদমেজাজি। সারাদিন ব্যবসাপাতি সামলে এসে যদি দেখেন বা বুঝতে পারেন যে সালেহা বেগম তার কথার অবাধ্য হয়ে সৃজার বা ইহসানের বিষয়ে নূন্যতম শ্বাস ফেলেছেন তাহলেই হলো! এই বয়সে এসেও সালেহা বেগমকে মার খেতে হয় স্বামীর হাতে। এজন্য ভয়ে তিনি
কুঁকড়ে থাকেন। আগ্রহী হন না ওদের সাথে কথা বলতে। মাঝেমধ্যে দিনের বেলা টুকটাক কথা হয়, কিন্তু তাতে কোনো ছন্দ থাকে না। আবার ইহসানও খুব একটা পছন্দ করে না সৃজাকে সালেহা বেগমের সঙ্গে মিশতে দিতে। কেমন যেন একটা সম্পর্ক, সালেহা বেগমের সাথে ছেলেদের! ইহসান-ইজহান, ইমরান কাউকেই মাকে নিয়ে এতটা কনসার্ন হতে দেখে না সৃজা। বিষয়টা বেশ কিছুদিন ধরেই ওকে ভাবাচ্ছে। পারিবারিক ঝামেলা যতই থাকুক, নিজের মায়ের সঙ্গে ছেলেরা কেন এত দূরত্বে থাকবে? সৃজা তাই ভেবেছে আজ এলে ইহসানকে বলবে মা’কে কিছুটা সময় দিতে।
ইহসান ফিরলো সাড়ে আটটায়। সৃজা তখন সালেহা বেগমের ঘর থেকে এসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে ডোপামিন ডিটক্সে চোখ বুলাচ্ছে শুয়ে শুয়ে। তেমন সময় ইহসানকে ফিরতে দেখেই একলাফে উঠে গেল। কোণে রাখা ছোট্ট ফ্রিজ থেকে লেবুর শরবত নিয়ে দ্রুতপায়ে ছুটে এলো। ইহসান বাঁ দিকের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জানতে চাইল,
“ডাক্তার এসেছিল? কেমন আছেন এখন?”
সালেহা বেগমের কথা জানতে চাইছে ইহসান, বুঝে সৃজা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিচে মায়ের ঘর পেরিয়ে এসেছে তো, দেখে আসেনি? আশ্চর্য! মা হয় তো! সৃজা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“কেন তুমি দেখে আসোনি?”
ইহসান চটপট জবাব দিলো,
“ঘর বন্ধ তাই বিরক্ত করিনি। কেমন আছে সেটা বল!”
“ঔষধ খাওয়ার পর ব্যথা কমেছে। এক্স-রে করাতে হবে।”
“ওহ!
বলে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল ইহসান। সৃজাকে কাছে টেনে উরুতে বসাল। ঘাড়ের চুল সরিয়ে ফুঁ দিয়ে বলল,
“কেমন কাটালি সারাদিন?”
সৃজা শিরশিরে অনুভূতিতে কেঁপে উঠে ওর শার্ট আঁকড়ে ধরে। পরক্ষণেই বলে,
“খুব বোরিং, একা একা কি সারাক্ষণ বসে থাকা
যায় নাকি? একটু আন্টি মানে শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে গিয়ে বসলে কি এমন সমস্যা হয়? তিনিও তো একাই থাকেন সারাদিন, অনুমতি দাও না…”
সালেহা বেগমের কথা বলছে সৃজা। বুঝতে পেরে ইহসান রুক্ষ স্বরে বলল,
“দেওয়া যাবে না!”
“কেন?”
“আমি বলেছি তাই।”
সৃজার অবাকের সঙ্গে সঙ্গে এবার একটু রাগও হয়।
বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
“এটা কোনো কথা হলো? এইযে, আজ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেল তোমার তো উচিৎ ছিল খোঁজ নেওয়া, মা হয় তো তোমার—নাকি? আন্টি সারাক্ষণ একা একা থাকে। আংকেলের জন্য ভয়ে কারো সাথে কথাও বলতে যান না। একা একা বসে মেয়ের জন্য কাঁদে, তোমাদের জন্য কাঁদে। তোমাদের ভাইদের কি মায়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই? দরদ নেই?”
সৃজা এতকিছু কখন লক্ষ্য করল? কেন এত কথা বলছে? ওর কেন এত মাথাব্যথা সালেহা বেগমকে নিয়ে? ইহসানের মোটেও ভালো লাগল না৷ মা নিয়ে এত এত কথা কেন বলবে সৃজা? ও কী জানে—কিছুই না। না জেনে অহেতুক কথা কেন বলবে? ইহসান রক্তাভ মুখ করে চাইল,
“কতটুকু দরদ আছে, সেটা একজীবনেও পরিমাপ করতে পারবি না।”
সৃজা বিস্ময়ে ফেটে পড়ল ইহসানের কথা শুনে। দরদ আছে মায়ের প্রতি? কই, এ বাড়িতে আসার পর আজ পর্যন্ত দেখেনি তো দেখেনি তাদের কোনো ভাইকে সালেহা বেগমের সাথে বসে গল্প করতে, তার আদেশনিষেধ শুনতে! বরং, অপ্রয়োজনীয় একজন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে যেরকম আচরণ করতে হয় সালেহা বেগমের সাথেও ঠিক একই আচরণ করে তারা ভাইয়েরা। একদিকে আজিজ শেখ এক অদ্ভুত লোক, সালেহা বেগমকে মারধর করে একাকিত্ব দিয়ে রেখেছেন। ইজহান ইস্মিকে নাজেহাল করতে ব্যস্ত।
ইমরান মিতুর কথায় উঠবস করে, বউয়ের একচুল অবাধ্য হয় না সে। অন্যদিকে ইহসান, সে সবার থেকে আলাদা হয়েও কোথাও যেন এক, বুঝদার হয়ে অবুঝ! সৃজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“দরদটা কী আসল?”
ইহসান তেঁতে উঠে,
“কী বলতে চাইছিস?”
সৃজা অনুযোগের স্বরে বলল,
“তোমার চোখে আমি আন্টির জন্য সহানুভূতি দেখি না, দেখতে পাচ্ছি না। কোনো সন্তান তার মায়ের শরীর খারাপ শুনে এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে না৷ তোমার উচিৎ ছিল বিকেলেই ফোন পেয়ে ছুটে আসা, নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অথচ কী করলে, ডাক্তার পাঠিয়ে দিলে। এরপর একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করলে না কী অবস্থা, কেমন আছে মা! বলো, মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক এমন নির্লিপ্ত হয়?”
ইহসান বিরক্ত চোখে তাকায়,
“আমার সাথে তার সম্পর্ক এমনই চলে আসছে চিরকাল।”
“কিন্তু কেন?”
ঝোঁকের মাথায় বলে বসে ইহসান,
“কারণ—সে এ সংসার ছেড়ে যায়নি। আমার জালিম জন্মদাতাটার অত্যাচার সহ্য করে এখনো রয়ে গেছে। কোনো মানে হয়, বল? ঘৃণা করি আমি এই বোকা মহিলাকে।”
এটুকু বলে থেমে যায় ইহসান। সৃজা কিছুই বুঝতে পারে না। ইহসানের চোখ কথা বলছে, সেই চোখে সালেহা বেগমের জন্য একটুও ভালোবাসা দূর দরদও নেই। সৃজা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে বলে,
“তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না।”
ব্যগ্র স্বরে বলে ইহসান,
“যতটুকু বুঝিস তাতেই চলবে, বেশি বুঝতে যাস না। বেশ আছি তো আমরা নিজেদের মতো, অহেতুক
কেন অন্যের বিষয়ে নাক গলিয়ে শান্তি নষ্ট করব?
বাদ দে এইসব। তুই…”
এটুকু বলে আচমকা আলমারির পেছনের দেওয়ালটায় চোখ পড়ে ওর। ভ্রু কুঁচকে ফেলে ও সঙ্গে সঙ্গে, জায়গাটা খালি, কী ছিল এখানে? কী নেই? উহ, কী যেন একটা নেই! ইহসান মনে করার চেষ্টা করে, সৃজা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকটাতে তাকায়। কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,
“ওদিকে কী দেখছ?”
ইহসানের কপালে ভাঁজ। প্রশ্ন শুনে ভাবুক চিত্তে বলে,
“ওখানে কি একটা ছিল, এখন নেই…কী ছিল বল তো…”
সৃজা মনে করার চেষ্টা করে দেয়ালটাতে কী ছিল, মনে পড়ছে না। ও মাথা নাড়ে। ইহসান ওভাবেই তাকিয়ে থাকে দেয়ালটাতে ঠোঁট কামড়ে। আচমকা বলে উঠে,
“ওখানে পেইন্টিং ছিল একটা, কোথায় ওটা? আশ্চর্য, ওটা তো ওখানেই থাকে। নেই কেন? এই সৃজা…”
ইহসানের মুখ থেকে শুনে সৃজার মনে পড়ে যায় ভ্যান গগের চিত্রকর্মটি। আলমারির পেছনের দেয়ালে সাঁটা ছিল, যেটা সচরাচর চোখে পড়ে না। বাঁ দিকের সোফাটায় বসলেই যেটা চোখে পড়ে। আর এই পেইন্টিংটাই দু’সপ্তাহ আগে ইজহান খুলে নিয়ে গেছিল। সৃজা এবার একটু বিচলিত হয়, ইহসানকে বলবে কথাটা? ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করবে কি? সামান্য একটা পেইন্টিংই তো!
ততক্ষণে ইহসান উঠে দাঁড়িয়েছে রাগান্বিত ভঙ্গিতে। উচাটন ও উদ্ভ্রান্ত দেখায় ওকে। সৃজা শুকনো মুখে
ওর বিচলিত রুপ দেখে। একসময় না পেরে ইহসানের হাত ধরে বলে করুণ গলায় বলে,
“পেইন্টিংটা ভাইয়া নিয়ে গেছিল সেদিন। বাদ দাও না, একটা পেইন্টিংইতো! এতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে? হয়তো পছন্দ হয়েছিল খুব, তাই নিয়েছে। ভাইয়ের জিনিস ভাই নিলে কোনো ক্ষতি তো না, তাই না?”
“ওটা আমার মায়ের সৃজা। আমার ঘরের জিনিস, অথচ তুই ওকে নিয়ে যেতে দিলি? কীভাবে? আশ্চর্য!”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩২
ইহসান রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মুহূর্তেই। কপালের শিরা ফুলে উঠে ওর। ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে যায় রাগে। এত রাগার কী আছে বুঝে উঠে না সৃজা। অবাক হয়ে যায় ও, ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় ওর। মায়ের জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি, অথচ সেই মাকে একবার জিজ্ঞেসও করে না ভালো আছে কি-না? সৃজার খটকা লাগে।