অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৪

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া

– “মায়ের জন্য দরদ নেই, তার আঁকা ছবির জন্য এত দরদ?”
বিভ্রান্তি, আর সন্দেহজনক কণ্ঠস্বর। চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া। ব্যস! এতটুকুই যথেষ্ট ছিল ইহসানকে থামানোর জন্য। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়ে সে। কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে তাকায় সে সৃজার দিকে। বলে, “ ওটা এই ঘরের জিনিস। আমার খুব প্রিয়। যে কেউ এসে নিয়ে চলে গেল, আমি সেটা চাইতে পারব না? এরজন্য মানে বুঝতে হবে?”
-“ যেকেউ তো নিয়ে যায়নি; মায়ের ছবি ছেলে নিয়েছে। এতদিন তোমার কাছে ছিল, এখন ভাইয়ার কাছে কাছে। থাকুক। নষ্ট তো করে ফেলেনি। এটা নিয়ে এমন ঝামেলা করার মানে হয় না।”
একটু থেমে সূক্ষ্ম চোখে তাকায় সৃজা। কেমন অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করে বসে, “ আন্টিকে দেখে তো মনে হয় না, তিনি এমন ভালো পেইন্টিং করতে পারেন। তার নিজের ঘরেও তো কখনো দেখিনি এমন ছবি।”
ইহসান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে, তার কপাল কুঁচকে আছে। সৃজার কণ্ঠস্বরের বিভ্রান্তি সে ঠিক বুঝতে পারে। ভেতরে ভেতরে তার হাহাকার লাগে। পরক্ষণেই সচেতন হয়। নাহ, সৃজার সামনে এত উতলা হওয়াটা ভুল হয়েছে। ও কোমল মনের মেয়ে, এসব ওকে বলা যাবে না। যদি ওকে ভুল বুঝে, ঘৃণা করে দূরে সরে যায়? ইহসান নিজেকে প্রবোধ দেয়। সময় নিয়ে শান্ত করে সৃজাকে কাছে টানে। কোমড় জড়িয়ে পেটে মাথা রেখে নিচু স্বরে বলে, “অস্থির লাগছে, একটু শান্ত করে দে।”

সৃজা বুঝতে পারে ইহসান ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে না ওকে। চুপচাপ মাথায় হাত রাখে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে সব এলোমেলো লাগে। এই প্রথম মনে হয়, ইহসান তার কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে, ইচ্ছে করে। যেগুলোর দুঃখের যাতনায় সে ভোগে, কিন্তু সৃজার কাছে প্রকাশ করতে চায় না। ওর মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন জমে, উত্তর জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠে।
একদিন সালেহা বেগমকে জিজ্ঞেসও করে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের দৈন্যদশা, বাপ-ভাইয়ের সাথে
দ্বন্দ্ব কেন এত? তার সাথেই বা কেন এত স্থির সম্পর্ক? শুধুমাত্র অত্যাচারী স্বামীর সংসার করছে বলেই নাকি অন্যকিছু? কিন্তু সালেহা বেগম ঠিকভাবে কিছুই বলে না। এড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলে। দু-এক কথায় যা বলে তাতে সৃজার কিছুই বোধগম্য হয় না।তবে ইস্মিতার থেকে দু-ভাইয়ের শীতল সম্পর্কের কিছুটা জানতে পারে। সারমর্ম এমন যে—

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া ইস্মিতা এক বিকেলে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরছিল। বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য একটা শর্টকাট ছোটখাটো গলি আছে, অন্ধকার গলি। গলিটা কেউ ব্যবহার করে না। বলা চলে পরিত্যক্ত, জনশূন্য। মাঝেমধ্যে ইস্মি ওখান দিয়ে যাতায়াত করে। সেই গলিতেই প্রথম ইজহানকে দেখেছিল ইস্মি। গাড়ি পার্ক করা নিয়ে সেখানকার তিন-চারজন বখাটে মতো ছেলে ইজহানকে সেই গলিতে নিয়ে এসে বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছিল। সেই বাকবিতন্ডা একসময় রুপ নেয় হাতাহাতিতে। ইজহানের তখন একা ছিল, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে সক্ষম হলেও ছেলেগুলো একসময় ওর মাথায় বাজেভাবে আঘাত করে। গলি পেরুতে গিয়ে আচমকা চোখের সামনে এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হয়ে ইস্মি চিৎকার করে উঠে। পেছনে ফিরে ওকে দেখে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে যায়। একজন এসে ছুরি ধরে ওর গলায়, বাকিরা আহত অবস্থায় কোঁকাতে থাকা ইজহানকে মাটিতে ফেলে ইজহানের পকেট ফাঁকা করে সাথে থাকা সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। ওরা আসলে ছিনতাইকারী ছিল!

ওরা চলে যেতেই ভয়ে জমে যাওয়া ইস্মি প্রাণ ফিরে পায় যেন। সাহস করে গিয়ে ইজহানকে ধরে, ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খাইয়ে দেয়, ওড়না দিয়ে মাথা ব্যান্ডেজের চেষ্টা করে ওকে ভরসা দিতে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার দরুন ইজহান সেখানেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে! ফাঁকা গলিতে ওরকম জ্বলজ্যান্ত লোককে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে ইস্মিতা খুব ঘাবড়ে গেছিল। বুঝতে পারছিল না কী করবে! হাত-পা অসাড় লাগছিল। তবুও মনুষ্যত্ববোধের জোরে রাস্তা থেকে লোকজন জোগাড় করে হাসপাতালে এডমিট করেছিল ইজহানকে৷ সেই বার দিন দশেকের মতো হাসপাতালে ভর্তি ছিল ইজহান। মানবতার খাতিরে ইস্মি নিজেও কয়েকবার গিয়েছিল ওকে হাসপাতালে দেখতে। তবে ওর এই মানবতা যে ওর গলায়ই ফাঁস হয়ে ঝুলবে তা ভাবেনি৷ ইজহানকে রিলিজ করে দেয়ার আগেরদিন কলেজ শেষে হাসপাতালে ওর খোঁজ নিতে গিয়েছিল, সেদিন ইজহান ওর সাথে প্রথম কথা বলেছিল। এর আগ অবধি যতবার দেখতে গিয়েছিল, কিছুই বলেনি, নূন্যতম ধন্যবাদও জানায়নি ওকে। সেই ইজহান ইস্মিকে দেখে আঁধার মুখ বানিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, “বোরকা পরে চলাফেরা করবে, নয়তো চলাফেরা করার দরকার নেই।”

ইস্মি হতবুদ্ধি হয়ে গেছিল ওর কথা শুনে। বিব্রতবোধ করছিল ভীষণ। এমনিতে বোরকা পরা হলেও কলেজ টাইমে ইস্মি ইউনিফর্ম পড়েই কলেজ যেতো। এর আগে বাবা-ভাই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া ওর বাক্যবিনিময় হয়নি। অথচ এই লোক ওর ড্রেসআপ নিয়ে কথা বলছে? অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল ও। মাথা নেড়ে চুপচাপ সায় জানিয়েছিল বেরিয়ে এসেছিল সেদিন! এরপর… প্রায় দু’সপ্তাহ পর বাড়িতে হঠাৎই বিয়ের প্রস্তাব যায় শেখ বাড়ির থেকে। ইস্মি প্রচন্ড অবাক হয়েছিল। মা ছিল না ওর। ঘরে অসুস্থ বাবা সিরাজুল ইসলাম আর চাকুরিপ্রার্থী বড়ভাই আকাশকে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসার। বিয়ের প্রস্তাবে ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এত বড় বাড়ির সম্বন্ধ, ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ হবে কি-না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ছিল! ইস্মিই তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটায়, একবাক্যে জানিয়ে দেয় সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা। এরপর এডমিশন পিরিয়ড, ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব পড়ে আছে ওর। বাবা-ভাইয়ের ছোট্ট অভাবের সংসারে ওরও তো কন্ট্রিবিউট করা বাকি!

সুতরাং, এখনি বিয়ে নয়। ইস্মির কথায় ওর বাবা নাকচ করে দিয়েছিল এত বড় বাড়ির প্রস্তাব। রিজেক্ট হয়ে নাকি দু’দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিল ইজহান, পরে জেনেছিল ইস্মি! দু’দিন পর বের হয়ে সোজা চলে গেছিল ইস্মিদের বাড়িতে। দুপুরের সময়! বাবা ঘুমাচ্ছে, আকাশ টিউশন পড়াতে বের হয়েছে। ইস্মি তাদের ছোট্ট বসার ঘরে বসে উচ্চতর গণিত প্র‍্যাকটিস করছিল। সেই সময় পড়ল দরজায় জোরালো থাবা, বিচলিত ইস্মি ভাই এসেছে ভেবে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু খুলেই চমকে যায়, বাইরে আলুথালু বেশে ইজহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিতে যাবে ইজহান দু’হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একেবারে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে পড়ে বলে, “কী রেঁধেছ, ভাত দাও।”
হতবিহ্বল ইস্মি ঠাঁই দাঁড়িয়েছিল দরজায়। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছিল ওর। বাবা অসুস্থ, ঘুমাচ্ছে। ডাকার সাহস পাচ্ছিল না, আকাশও নেই। এই সুযোগে যদি এই লোক কিছু করে বসে, তাহলে? ও দরজা থেকে সরছিল না দেখে এক ধমকে আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইজহান ওর। ঘাবড়ে গিয়ে ভাত দেয় ওকে কাকরোলের তরকারি আর পটল ভাজা দিয়ে। গপগপিয়ে খেয়ে আরো দু’বার চেয়ে চেয়ে ভাত নেয় ইজহান। ওর খাওয়া দেখে ইস্মির মনে হচ্ছিল বহুদিন এই লোক খায়নি কিছু। এত মায়া লাগছিল তখন! নিজে থেকেই একটা ডিমের অমলেট করে দেয়। ইজহান পুরোটা একবারে মুখে নিয়ে খেতে খেতে ইস্মিকে বলে, “ভালো রান্না! তবে রান্না খেতেই এখানে এসেছি ভেবো না, এসেছি তোমাকে আমার বিয়ের তারিখ জানাতে।”
বিস্মিত হলেও স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল ইস্মি, “আপনার বিয়ে?”

– “হ্যাঁ।”
-“ওহ!”
-“জানতে চাইবে না, কার সাথে বিয়ে?”
-“ আমি জেনে কী করব? আপনি তো পরিচিত কেউ নন আমাদের। তবে অবশ্যই আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল।”
ইজহান বাঁকা হাসে, “তুমিই তো জানবে, তোমাকেই জানতে হবে। কারণ তোমার সাথেই তো আমার বিয়েটা হবে।”
কপট, অবাক গলায় ইস্মি চিৎকার করে উঠে, “পাগল আপনি? আমি তো আপনাকে বিয়ে করব না। বলে দেওয়া হয়েছে আমাদের তরফ থেকে।”
বসা ছিল ইজহান, না শুনে তেড়েমেরে এসে গাল চেপে ধরে ওর, “বিয়ে করবি না তাহলে অত দরদ দেখিয়েছিলি কেন? মরে পড়ে থাকতে দিলি না কেন রাস্তায়? মাথায় হাত রেখে কেন বলেছিলি তুই আমার সাথে আছিস? একবার যখন বলেছিস, তখন আমার সাথেই তোকে থাকতে হবে। আমার পার্মানেন্ট রাঁধুনি হতে হবে। নয়তো, নয়তো তোর বুড়ো বাপটাকে ধাক্কা দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দেব।”

ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে জমে গেছিল ইস্মি। মুখফুটে শব্দ বেরুচ্ছিল না। ইজহানের রক্তজমা চোখ আর রুক্ষ হাতের চাপে ওর মস্তিষ্ক বোধশক্তি হারিয়েছিল। ইস্মি কাঁপছিল, খেয়াল করে ইজহান ছেড়ে দেয় ওকে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজেকে স্থির করে এরপর বলে, “সরি বাট আমার লাগবে তোমাকে, লাগবে মানে লাগবেই।”
ইস্মি কথা হারিয়ে ফেলেছিল। চোখদুটো জলে পূর্ণ। ভেতরের ঘর থেকে বাবার দুর্বল গলার ডাক শুনতে পাচ্ছিল ও। তবে ইজহানের ভয়ে নড়তেও পারছিল না। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইজহান ওর দুই গাল টেনে দিয়ে বলেছিল, “ আমি শুনেছি তুমি মত দিলেই তোমার বাপ-ভাইও রাজি। তাই এবারের মতটা যাতে ‘হ্যাঁ’ হয়। রাতে আমার বাপ এসে কথাবার্তা বলে যাবে, না করো না কিন্তু৷ আজ থেকে ঠিক দু’দিন পর, আগামী শুক্রবার, দুপুর দুই ঘটিকার সময় ইজহান শেখের সাথে তোমার বিয়ে হতে চলেছে। প্রস্তুতি
নিয়ে রেখো। আর পড়াশোনা, যতটুকু পড়েছ ততটুকুই চলবে। আর পড়ার দরকার নেই। আমি চাই না তুমি বাইরে ঢ্যাংঢ্যাং করে পড়ো আর লোকে তাকিয়ে থাকুক।”

হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখিয়ে বেরিয়ে গেছিল ইজহান। ইস্মির মাথা কাজ করছিল না, আকাশ বাড়িতে ফিরতেই ওকে সব খুলে বলল। রেগে গেছিল ও এসব শুনে। নুন খেয়ে থাকবে তবুও এমন গুণ্ডার কাছে বোন দিবে না বলে পণ করে বসল। ইস্মির বাবাও মেয়েকে ভরসা দিলেন। কিন্তু রাতে আজিজ শেখ দুইগাড়ি বোঝাই করে বিয়ের সব তৈজসপত্র নিয়ে এসে আলাপ জুড়ালেন, বলা যায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়েই বললেন, তার ছেলে যখন ইস্মিকে চেয়েছে, তখন ইস্মিই হবে শেখ বাড়ির বউ। আর বিয়েটা হবেও তার ছেলের কথামতো ঠিক দু’দিন পর, শুক্রবার। এ কথার কোনো নড়চড় নয়!

ইস্মির বাবা আর আকাশ কিছু বলার সুযোগই পায়নি। ওরা বুঝে গেছিল এদের হাত কতটা লম্বা, কতটুকু যেতে পারে। তারা ছা-পোষা মানুষ। কিছুই করতে পারবে না। তাই ইস্মিকে এদের নজর থেকে কীভাবে বাঁচানো যায় সে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে ওরা। ঠিক করে খুলনা চলে যাবে। ওখানে ওদের খালার বাড়ি, ওখানেই পরীক্ষার আগ পর্যন্ত থাকুক ইস্মি। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক। রুটিন দিলে তখন না হয় চলে আসবে। ততদিনে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে অন্য এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরীক্ষাটা দিবে ইস্মি। আপাতত এদের কবল থেকে বাঁচুক! সেই মতোই সকালেই ওকে নিয়ে খুলনা রওয়ানা দেয় তারা। এরপর প্রায় আড়াই মাস কেটে যায় খুলনায়ই। কোনো সমস্যাই হয় না। ফাইনাল পরীক্ষার ডেট পড়ায় আকাশ ইস্মিকে নিয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেয়। এলাকায় খবর নিয়ে জানতে পারে আজিজ শেখ ওদের উপর খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, কয়েকবার ছেলে-পুলে পাঠিয়েছিল। খোঁজখবর রাখছে এলাকায়। ওদের পেলেই নাকি এটা-সেটা করে বসবে।

চিন্তিত হয়ে পড়ে আকাশ। তাই দূরের অন্য একটা এলাকায় বাসা ঠিক করে বোনকে নিয়ে উঠে পড়ে। নির্বিঘ্নে ইস্মি পরীক্ষায় বসে। পড়াশোনা, প্রস্তুতি ভালো ছিল তাই পরীক্ষাও ভালো হয় সব। এভাবেই আরো একটা মাস কেটে যায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে শেষ পরীক্ষার দিন। বান্ধবীর সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে কুয়েশ্চন মেলানোরত অবস্থায় হুট করেই সামনে চলে আসে ইজহান। এরপর সেখান থেকেই একপ্রকার জোরপূর্বক ওকে হুমকিধামকি দিয়ে একেবারে নিজেদের বাড়িতে তুলে নিয়ে চলে আসে। সেসময় ভাইয়ের কাণ্ড দেখে ইহসান প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বাঁধা দিয়েছিল বিয়েতে। মেরে মুখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল এভাবে মেয়ে তুলে নিয়ে আসায়। ভরসা জেগেছিল কিঞ্চিৎ ইস্মির মনে। পুরোটা সময় ইস্মি কাঁদছিল। বিস্মিত হলেও ভরসা নিয়ে ইহসানের কাছে অনুনয় করছিল ওকে সাহায্য মরার জন্য। ইহসানও ওকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু আজিজ শেখ কলকাঠি নেড়ে বুদ্ধি করে ওকে ঘরবন্দি করে কাজি ডেকে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা দিয়ে দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইস্মিকে সাহায্য করতে পারেনি ইহসান।

বিয়ের রাতেই ইজহান ইস্মিকে কাছে টেনেছিল, আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল। এতদিন ওকে খুঁজে না পেয়ে কী অবস্থায় দিন কাটিয়েছে সেই অসহায় অবস্থার কথা জানান দিচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই ইস্মি টলছিল না। উল্টো ক্ষোভ আর ঘৃণাভরা চোখে দেখছিল! ইজহানের সহ্য হয়নি, তাই না চাইতেও আঘাত করেছিল ওকে। পরদিন সকালে খাবার টেবিলে আরো একবার ইহসানের হাতে মার খায় ইজহান, বেদম মার! ঘরে এসে ইস্মির দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যথা দেখিয়ে বলেছিল ইজহান, “সেদিনের মতো একটু হাত রাখো না মাথায় করে ইস্মিতা…”
ইস্মি সাহায্য দূর, তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল, “উচিৎ হয়েছে আপনার সাথে। একদম ঠিক হয়েছে। ভাইয়াকে আমি ধন্যবাদ দেব। আপনার মতো দেখতে হয়েও কী সুবিবেচক ওনি; আর আপনি? একটা পশু, নিকৃষ্ট পশু!”
ইজহান চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, “ আমার ভাই ভালো?”

-“ আবার জিজ্ঞেস করছেন?”
-“করছি।”
-“ তাহলে শুনুন, ওনি এতটাই ভালো যে, বিয়ের প্রস্তাবটা যদি ওনি আমাকে দিতেন নিদ্বির্ধায় আমি ওনাকেই বিয়ে করে ফেলতাম।”
যে ভাইকে দু’চক্ষে সে সহ্য করতে পারে না, তাকে নিয়েই কিনা ইস্মি এমন একটা কথা বলল? ব্যস! থাপ্পড় মেরে নতুন বউয়ের গাল লাল করে দিয়েছিল ইজহান। শাসিয়েছিল, ইহসানের কাছ থেকে যেন শত হস্ত দূরে থাকে। ইজহান চাপে রাখতো ওকে, গায়ে হাত তুলতো সময়ে-অসময়ে। ইহসান ভাইয়ের এমন আচরণ সহ্য করতো না, সামনে পেলেই ধোলাই করতো। ইস্মিকে সবসময় বলতো এই পাগলকে ছেড়ে দিন। প্রথম প্রথম ইস্মিও নিদারুণ অবাধ্য ছিল ইজহানের। কিন্তু ওর পাগলামো, এলোমেলো কথাবার্তা, ভাবনার দৌরাত্ম্য দেখে একটা সময় বুঝতে পারে উপরে উপরেই এই লোকের ফুটানি আর বড় বড় কথা। ভেতরে ভেতরে সে ফাঁপা, একটা ভীতু লোক। যে মানুষ হারানোর ভয় পায়!

নিশ্চিত হয়েছিল সে ইহসানের কাছ এটা শুনে যে, কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক মেয়ের সঙ্গে তিন বছরের বন্ধুত্ব ও চার বছরের দীর্ঘ এক প্রেমের সম্পর্কে ছিল ইজহান। কিন্তু ইজহানের পজেসিভনেস ও রেস্ট্রিকশনের কারণে ধীরেধীরে এই সম্পর্কে হাঁপিয়ে উঠে মেয়েটা। আগ্রহ হারায় সে ইজহানের উপর থেকে, ঝুঁকে পড়ে ইহসানের দিকে। যদিও ইহসান ঐ মেয়েকে চরম অপমান করে রিজেক্ট করে দিয়েছিল, তবুও বেশ কিছুদিন ওর পিছু পড়েছিল। ইজহানের সাথে ব্রেকাপ করে ফেলে। হুট করে প্রিয়তমার এই কান্ডে ইজহান ভেঙ্গে পড়ে, ব্রেকাপের কারণ তখন অজানা ওর। নানাভাবে বোঝায় মেয়েটাকে, ফিরে আসতে বলে। কিন্তু চরম অপমান করে মেয়েটা বারবার তাড়িয়ে দেয় ওকে, ইজহান মানতে পারে না সেটা। কীভাবে মন গলবে তার প্রেমিকার, এই ভেবে সু’সাইডের পথ বেছে নেয়। ভাগ্যগুণে ইহসানই সেদিন ওকে বাঁচায়।

হসপিটালে এডমিট করে। খুলে বলে তার প্রেমিকার কদার্যরুপ। শুনে ইজহান অবশ্য ওকেই দোষারোপ করেছিল। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিল, ওর প্রেমিকা ফিরে আসবে। কিন্তু ও ভুল ছিল, মেয়েটা ওকে দেখতে পর্যন্ত আসেনি। চ্যালেঞ্জে হেরে হাসপাতালের বেডে শুয়েই মন শক্ত করে ফেলে ইজহান, ঐ নাগিনীর জন্য সে আর ছোট হবে না। যে নাগিনী ওকে ছোবল না দিয়ে ওর খারাপ সময়ে মাথায় হাত রাখবে, ঐ নাগিনীকেই সে বিয়ে করে নেবে! আর সেই মাথায় হাত রেখে ‘আমি আছি’ বলা নাগিনীটাই ছিল ইস্মিতা! নিজের এত লম্বা প্রেমের কাহিনী অবশ্য ইজহান লুকিয়ে গেছে। কখনোই ইস্মিতাকে বলেনি, আজ অবধি না। ও সব জেনেছে ইহসানের থেকে। এসব শুনেই একটু টলেছিল ইস্মি ইজহানের উপর। ভালোবেসে ফেলেছিল ততদিনে মানুষটাকে। কিন্তু ইজহানের পাগলামো, পজেসিভনেস থামলে তো! অতিষ্ঠ করে দিচ্ছিল ওকে। দু’বছরের মাথায় যখন পেটে বাচ্চাটা আসে, তখন ভেবেছিল লোকটা বাবা হওয়ার খবরে এবার ঠিক হবে। কিন্তু খবরটা শুনেই প্রথম দু’দিন একেবারে তাক লেগেছিল মানুষটা। আঁধার মুখে বলেছিল, “আমাকে ভালোবাসবি না,

তাই ভাগীদার আনছিস তাই না?”
ইস্মির ভালো লাগেনি কথাটা। মনে গেঁথে গেছিল।
তাই প্রেগ্ন্যাসির সময়টাতে ও বেশ রুঢ় আচরণ করতে শুরু করেছিল ইজহানের সাথে। দূরে দূরে থাকতো যা সহ্য হয়নি ওর। এক রাতে ঝগড়ার মাথায় তাই বাচ্চা মিসক্যারেজের মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে৷ বাচ্চা হারিয়ে ইস্মি পুরোপুরি শকে চলে গেছিল। ঘৃণায় বিষিয়ে উঠেছিল মন। তাই সব ছেঁড়ে ছুড়ে চলে গেছিল বাবা-ভাইয়ের কাছে। ইজহান সেবার ওকে আর আটকায়নি। যেতে দিয়েছিল৷
প্রায় দু’ সপ্তাহ পর আকাশ খবর নিয়ে আসে,

ট্র্যানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাকের শিকার হয়ে
হাসপাতালে ভর্তি ইজহান। জ্ঞান ফেরার পর থেকে কারো সাথেই নাকি কথা বলেনি। কী করতো ইস্মি, জানা ছিল না। বাবা আর ভাই বলেছিল ওকে, এই পাগলের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে, ইহসানও বলেছিল দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা কাজ করছিল না ওর।
ঘৃণার তলায় চাপা পড়া ভালোবাসাটা চিড়বিড়িয়ে উঠে তাকে এই ডমিন্যান্স লোকের কাছে নিজে থেকেই ফিরতে বাধ্য করেছিল! হাসপাতালেই রাতে জিজ্ঞেস করেছিল ইজহান, “এখনো সুযোগ আছে, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
রাত পোহালে যেটা আর থাকবে না।”
ইস্মি ভাবলেশহীন ভাবে ওর দিকে তাকিয়েছিল, “কীসের সিদ্ধান্ত?”
– “আমার অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর। ফিরতে
কিন্তু আমি বলিনি।”
– “কিন্তু এমন কাজ করেছেন, যাতে আমি ফিরতে
বাধ্য হই।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৩

কঠোর শোনাচ্ছিল অসুস্থ লোকটার কণ্ঠস্বর, “এরপরেও বলছি, সুযোগ কাজে লাগাও। আমি যেমন আছি, তেমনি থাকব। বদলাব না। পরে কোনো দোষারোপ, অভিযোগ মেনে নেব না। ভাবো, ভাবতে থাকো।”
ইস্মি ভাবেইনি কিছু। শুধু হাত মুঠোয় নিয়ে বসেছিল। ঔষধের প্রভাবে ঘুমে মগ্ন ইজহানের মুখের দিকে
চেয়ে নিজেকে দুর্বল, ব্যর্থ নারী মনে হচ্ছিল!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৪ (২)