অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৪ (২)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইস্মির মুখে ইজহানের তুলে এনে বিয়ে করার
ঘটনা শোনার পর সৃজা আরো একবার ইজহানের পাগলামোর সাক্ষী হলো এর ঠিক দু-মাস পর। যেদিন
ইস্মি ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ঠিক সেদিন! ইজহান অফিসে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ওকে খবর দেওয়া হয়নি। দু-ঘন্টা পর খবর যায়। খবর শুনে ও আর দেরি করেনি। মিজুকে ছাড়া একাই ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরেছিল বিশ মিনিটের মধ্যে। এরপর বিধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যখন দেখল ইস্মি চোখ বন্ধ করে নিথর হয়ে বিছানায় শোয়া, আর ডাক্তার ওকে চেকআপ করছে ; বেচারা সেখানেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল! দারোয়ান আর মকবুল মিলে ধরাধরি করে পানিটানি ঢেলে ওর হুঁশ আনতেই ভয়ে চুপসে গিয়ে ইস্মির পাশে গিয়ে বসলো সে। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল না কী হয়েছে, কেন হয়েছে—জিজ্ঞেস
করল, “আমার বউটা বেঁচে আছে তো?”
ইহসানের ইচ্ছে করল ওর মুখে একটা ঘুষি মারতে। বদমাইশটার আক্কেল দেখ! ও নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো। আর এমন কথা শুনে ঘরভর্তি মানুষ সঙ্গে সঙ্গে চমকে ইজহানের দিকে তাকালেও ডাক্তার সাহেব ইজহানের স্বভাব জানা স্বত্তেও সেদিন ওর দিকে বিরক্ত চোখে চাইলেন, “এসব কী কথা? বৌমা মরে যাবে কেন?”
“ও তাহলে এমন করে পড়ে আছে কেন?”
ডাক্তার যেন মজা পেলেন, “তুমি যদি অহেতুক বেহুঁশ হতে পারো তাহলে এসময় বৌমার হুঁশ হারানো তো একদম ফরজ!”
“এসময় মানে? এটা আবার কেমন সময় আংকেল?”
ডাক্তার সাহেব ভনিতা করছিলেন, “কঠিন সময়! উল্টাপাল্টা কিছু হলে বা মানসিক চাপ দিলে এ সময়ে মানুষ মরেও যেতে পারে।”
ইজহানের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। সৃজা তা দেখে মকবুলকে ইশারা করতেই ও পানি নিয়ে আসে। বলে, “স্যার মাথাডাত পানি ঢালুম? আপনে তো আবার অজ্ঞ্যান হইয়া যাইতেছেন।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বউ মরে যাচ্ছে আর এই হারামি আছে পানি নিয়ে? ইজহান মুখ খারাপ করে ফেলে, “কু’ত্তার বাচ্চা সর তুই!”
ডাক্তার ওর স্বভাব জানেন। তাই আটকান না, বরং বলেন, “উহু! এ সময়ে বৌমার সামনে এমন আচরণ করা যাবে না। তোমার উগ্র আচরণের এফেক্ট ওর মানসিক অস্থিরতার কারণ হবে। সেই থেকে ভেতরের কলকব্জায় পচন ধরবে। ভেতরের পচন বাইরের থেকেও দ্রুত হয়, তাই… সাবধান!”
এসব কী বলছে এই ডাক্তার? পচন৷ ভেতরে-বাইরে? কী এসব? ইস্মিতার কী বড়সর রোগ হয়েছে? ও যেভাবে চড়-থাপ্পড় দিতো, ধাক্কাও দিয়েছে অনেকবার! এসবের কারণে কিছু হয়নি তো? উফ আল্লাহ! কী করবে ও? ইস্মিতাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না ও? ইস্মিতার কিছু হলে ও তো মরে যাবে! ইজহানের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম গড়য়ে পড়ে। সে ঢোক গিলে কয়েকবার ধরা গলায় বলে, “কী হয়েছে ওর? ক্যান্সার?”
“তার থেকেও মারাত্মক কিছু!”
“কী?”
ডাক্তার একটি রিপোর্ট এগিয়ে দেয়, যেটা হাতে নিয়ে ইজহান পড়ে এরপর বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
১২ সপ্তাহের গর্ভাবস্থা! ইস্মির চাওয়া, তারও কী? ইজহান বুঝে উঠতে পারে না। ডাক্তার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “টেস্ট করানো হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সব স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু আগের ঐ ইন্সিডেন্টটা কিন্তু মারাত্মক ছিল, তাই এবারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এবারের প্রেগ্ন্যাসিটা ওর জন্য হাই রিস্ক হতে পারে। যদিও আমরা মনিটরিং করব তবুও সর্বক্ষণ মনিটরিং করার দায়িত্বটা এবার তোমাকে দিলাম। আর কোনো ভুল নয়, আগের বারের মতো পাগলামি নয়।”
ইজহান বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনে। কিন্তু বোধগম্য হয় না কিছুই। শুধু মাথায় ঘুরে এটা ‘হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি।’
সে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। চোখে আঁধার দেখে। ঝাপসা ঝাপসা ঠেকে ইস্মিকেও। মকবুল ওর পিছেই ছিল, ও এসে ধরে। ইজহান ঢলে পড়ে ওর উপর। ডাক্তার সাহেব হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, “এ তো নিজেই দুর্বল হার্টের রোগী। বৌমাকে সামলাবে কি! ওকেই তো সামলাতে হবে মনে হচ্ছে!”
ইহসান সৃজার ফোন পাওয়ামাত্রই বাড়িতে এসেছিল। এতক্ষণ চুপ করে ভাইয়ের বেঁহুশ হওয়ার নাটক দেখছিল। ডাক্তারের কথা শুনে ল এবার তাচ্ছিল্য করে বলল, “কাপুরুষ কী আর এমনি এমনি বলি? তুই বাপ হবি, কোথায় বুক ফুলিয়ে বউয়ের সেবাশুশ্রূষা করবি না উল্টো তারই চারটা নার্স লাগবে। আংকেল একে এক বছরের জন্য রিহ্যাবে রাখার ব্যবস্থা করুন তো! নয়তো হাড়-মাংস জ্বালিয়ে খাবে।”
সবাই হেসে উঠলেও সৃজা একমাত্র, যে ইহসানকে চোখ গরম করে থামতে বলল! সৃজার ইশারা পেয়ে ইহসান একটু থতমত খেল, ভাবলো—সৃজার এরকম অবস্থা হলে সে কী করতো! এইরকম করতো কী? উহু…হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি হলে সে নিজেও চায় না সৃজাকে সেদিকে ঠেলে দিতে! এদিকটাতে ভাইয়ের সঙ্গে নিজের চিন্তাধারার মিল পেয়ে, ইহসান শুকনো মুখ করে তাকিয়ে রইল ইস্মির পাশে বসে থাকা সৃজার দিকে। ঢোক গিলে বলল, “বাপ হওয়া লাগবে না আমার।”
এরপর ইস্মি যখন স্বাভাবিক হয়—ইজহান পুরো রাত ওকে আর ঘুমাতে দেয় না! পুরুষ কাঁদে না, কাঁদতে নেই এই থিওরি ভুল প্রমাণ করে হু হু করে কাঁদে সে। তবে শব্দ করে না। ইস্মি শুধু হতবিহ্বল হয়ে দেখে আর অনুভব করে, এই পাগল লোক তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা হারানোর ভয় পায়। ও শুধু কাঁপা গলায় ইজহানকে বলে, “আপনার মা আসছে তো, আপনার মায়ের আদরে ভাগ না বসিয়ে আমি কোথাও যাব না।”
গোসল সেরে বেরুতেই ইহসান দেখল খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে সৃজা৷ মেয়েটাকে এত মনোযোগী হতে দেখে ইহসান যখন ও কথা বলে, তখন! এখন তো ও কথা বলছে না, তাহলে কীসের প্রতি এত মনোযোগ সৃজারন? ইহসান পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘায়ারে নাক ঘঁষে জিজ্ঞেস করে, “আমার মনোযোগ কাকে বিলি করছিস?”
শীতল স্পর্শে চমকে উঠে সৃজা। ঢোক গিলে কয়েকটা পরপর। মৃদু কণ্ঠে বলে, “উমম..একটা ছবি।”
“কী এমন ছাতার ছবি দেখা তো…”
“এইযে….”
ছবি দেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না ইহসানের। কিন্তু চোখের সামনে অতি পরিচিত কোলাজটা দেখে নিজেও চোখ সরাতে পারল না বেশ কিছুক্ষণ। এরপর যখন সম্বিৎ ফিরল তখন আপনাআপনি সৃজার কোমড় ছেড়ে গেল তার হাতদুটো। কপালে ভাঁজ ফেলে একপ্রকার ছোঁ মেরেই ছবিটা নিয়ে নিলো সে। পকেটে পুরলো দুমড়েমুচড়ে। গম্ভীর হয়ে এলো কণ্ঠ, “ধরেছিস কেন না বলে…”
“আমি তোমার বউ তো! ধরে ফেলেছিই না হয়! এবার বলো তো, কে ইনি?”
ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েই যে সৃজা ছবিটা পেয়েছে সেটা ওকে বলল না। ইহসানও অবশ্য জিজ্ঞেস করল না ওকে ছবিটা কোথায় পেয়েছে। উল্টো চোয়াল শক্ত করে বলল, “জানি আমার সবকিছুতে তোর অধিকার আছে, কিন্তু তারপরেও আমি চাই না তুই আমার অজান্তে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে ঘাঁটাঘাঁটি করবি। এটা ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে না৷”
সৃজা হতবিহ্বল মুখে চেয়ে রয়, “আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি ইনি কে?”
ইহসানের গলা গমগমে হয়ে এলো, “তোকে আমি এসব জানার জন্য বিয়ে করিনি।”
“মানুষের কৌতূহল থাকতে পারে না?”
ইহসান ত্যক্ত কণ্ঠে বলল, “অনর্থক কৌতূহল থাকতে পারে না। ছবিতে কে আছে, কী আছে, কে এরা জেনে তুই কী করবি? তোর কী কাজ? আমি তোর বর, তোর ধ্যানজ্ঞান থাকবে আমাকে নিয়ে। এর বাইরে অন্যকিছুতে না। কিন্তু ইদানীং তুই বড্ড বেশি অনর্থক কৌতূহল দেখাচ্ছিস যেটা আমার ভালো লাগছে না।”
“আসলে বাচ্চাদুটো তো… ”
“তর্ক করিস না সৃজা।”
সৃজা অতি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়ে। সেই গলায়ই বলে, “এভাবে বলছ কেন? আমি শুধু জানতে চেয়েছি৷ এটাতে এতো রিয়েক্ট করার কী আছে? বললে কী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব…”
ইহসানের মাথায় দপ করেই আগুন জ্বলে উঠে। মেজাজ হারিয়ে ফেলে সে। আচমকা সৃজার গাল চেপে ধরে বলে উঠে, “ছেড়ে যাবি এ কথা মুখে আসে কেন? ভাবিস নিশ্চয়? উহু! না ভাবলে তো মুখে আসতো না! মাথার ভাবনা মাথায়ই রাখ, পুঁতে ফেলব। সব রেখে কার জন্য এত করি আমি? তোর জন্য। আর সেই তুই আমাকে বলিস ছেড়ে চলে যাবি? ডাফার!”
কথাটা তো শেষও করতে পারেনি! সৃজা বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাকিয়ে থাকে ইহসানের রক্তজমা চোখে। কাঁপছে কেন লোকটা? ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ডানহাত বাড়িয়ে ইহসানের কপালে পড়ে থাকা ঘর্মাক্ত চুল সরিয়ে গালে হাত দিয়ে কম্পিত স্বরে বলে, “অ্যাই!! কী হয়েছে তোমার?”
উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “আমি তোকে যেমন রেখেছি, তেমনি থাক। যতটুকু জানাই, ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাক। কেন খামোখা এটা-ওটা বলে আমার মাথা খারাপ করিস? জানিস না অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়? জানিস তো!”
সৃজা হঠাৎ বলে উঠে, “কোনো সত্যি জেনে যাব কী?”
ইহসানের হাতের চাপ বাড়ে সৃজার নরম, মসৃণ গালে। দাগ বসে যায়। সৃজা তবুও চুপ থাকে না। ব্যথায় অস্ফুটস্বরে শব্দ করে উঠে। বিভ্রান্তি নিয়েই বলে, “ছবিটা তোমার—তোমাদের মায়ের, তাই না?”
ইহসান রুক্ষ চোখে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই প্রশ্ন করে, “তোকে কে বলল?”
“কেউ বলেনি, তুমি এবার বলো।”
ইহসানের বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। কপালের শিরা ভেসে উঠে। গলা হয়ে উঠে তীক্ষ্ণ, রুক্ষ। হিসহিসিয়ে বলে সে, “ওটা একটা ছবি। বুঝেছিস? স্রেফ একটা ছবি। তুই..তুই আর কখনো না বলে আমার গুছিয়ে রাখা জিনিসে হাত দিবি না। প্রথমবার বলে বেশিকিছু বললাম না।”
ইহসান ওর গাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। দু’হাতে চুল খামচে ধরে হাসফাঁস করে এযা সৃজার নজর এড়ায় না। ও তবুও বলে, “আমি জানি এটা তোমার মা।”
ইহসান চিৎকার করে উঠে, “বল…কোন হারামি এটা তোকে বলেছে? কে? কেন একটা ছবির জন্য আমার মাথা খাচ্ছিস সৃজা? আমার হাত উঠে যাবে।”
“তোমার চোখ বলেছে!”
দৃঢ় স্বরে বলে সৃজা। না পেরে সত্যি সত্যিই হাত উঠিয়ে ফেলে ইহসান। দ্বিতীয়বারের মতো গালে হাত রেখে অবিশ্বাস্য নজরে তাকায় সৃজা। গাল ভেসে যায় নোনাজলে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তবে ও শব্দ করে না। উল্টো শক্ত গলায় ইহসানের চোখে চোখে রেখে বলে, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না।”
অস্থির ও থমকানো ইহসান ছবিটা পকেটে পুরে চেয়ারে লাথি মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সৃজা
শূন্য চোখে ওর প্রস্থান দেখে।
দরজা খোলাই ছিল, ইস্মি পানির জগ হাতে নিয়ে করিডোর পেরুতে গিয়ে না চাইতেও দেখে ফেলে দৃশ্যটা। ইহসান সৃজার গায়ে হাত তুলেছে, এ জিনিসটাই ওকে বাকরুদ্ধ করে দেয়!
পুকুরে কয়েকটা হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। সাদাকালো, সবুজ-বাদামির মিশেলে রাঙানো হাঁসগুলো একটু পরপরই ঠোঁট ডুবিয়ে পানি থেকে শ্যাওলা খাচ্ছে। তাদের বয়ে চলাতে, ডানা ঝাপটানোতে মৃদু তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে পানিতে টইটম্বুর পুকুরটাতে। সৃজা ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে, একমনে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে, গায়ের ওড়না উড়ছে। সৃজার সেদিকে খেয়াল নেই। গাল ভেজানো নোনাজলে ওর চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে। রুদ্ধ হয়ে থাকা মনটা বারবার শুধু বলছে, দ্বিধান্বিত মনের মেয়ে হওয়াটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ওর উচিৎ ছিল যা হচ্ছে তা হতে দেওয়ার আগে প্রশ্ন তোলা, জিজ্ঞেস করা যে, এ কাজটা কেন হচ্ছে, কেন করছে! কিন্তু না, সবকিছুই ও এতদিন বিশ্বাস আর ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়ে অদৃষ্টের দেখানো পথ ধরে হেঁটে গেছে! তাই আজ ওর এ দশা। দূরের রেললাইনে সশব্দে ট্রেন ছুটছে। সৃজা সেদিক পানে তাকায় না, তাকাতে ইচ্ছেও হয় না। অথচ যতবার এপথে ট্রেন ছুটে যায়, ততবার বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে ও দীর্ঘ যানটাকে মুগ্ধ চোখে দেখে। অথচ আজ ওর কিছুতেই মনোযোগ নেই, কিছু দেখার ইচ্ছেও নেই। আচমকা কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করে সৃজা। শুনতে পায় ইস্মির গলা, “কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো! রোদ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে, ঘরে চলো।”
সৃজার চোখদুটো বুজে আসে। নড়ে না জায়গা থেকে। বলে, “শরীর তো সেরে যাবে, মনের কী হবে?”
“সেটাও সেরে যাবে। ভাইয়া সারিয়ে দেবে। সে তো ভালোবাসে তোমাকে।”
“ভালোবাসলে গায়ে হাত তুলতো না।”
“রাগের মাথায় তুলেছে।”
সৃজা অভিমান ভরা গলায় বলে, “সেই রাগ আমারও আছে।”
“তাহলে ছেড়ে দাও, চলে যাও ভাইয়ার জীবন থেকে।”
সৃজা এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকাল, “অসম্ভব!”
“অসম্ভব কেন?”
সৃজা মুখ গোঁজ করে ফেলে, “কারণ ভালোবাসি তাকে।”
ইস্মি হাসে, “এতদিন বলতে না কেন আমি তোমার ভাইয়াকে ছেড়ে যাই না? কেন তার সব অপমান, গালিগালাজ, অবুঝপনা মেনে নিয়ে পড়ে আছি!
এই ভালোবাসাটা হয়ে গেছিল বলে!”
ইস্মির কথার পিঠে সৃজা নিজেও কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর নিজেও হেসে ফেলে। ঝাপসা হয়ে আসা চোখজোড়া মুছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়ায়। পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধ গাছগাছালির উপর দৃষ্টি রেখে বলে, “তারা ভাইয়েরা যতই নিজেকে আলাদা বলে দাবি করুক, দু’জনেই এক তাই না? হোক ভালো, হোক খারাপ! যেকোনো একটা রুপ দেখিয়ে বিপরীত মানুষটাকে দুর্বল করে দিয়ে এ দুর্বলতার নাম দেয় ভালোবাসা। আটকে ফেলে এই জালে। এরপর তাদের কদর্যরুপ দেখিয়ে ফেললেও আর এই জাল থেকে বেরুনো সম্ভব হয় না। ইচ্ছেই জাগে না। কী অদ্ভুত!”
ইস্মি খানিকটা কেঁপে উঠে৷ তার প্রেগ্ন্যাসির চার মাসে পড়তে চলল! অথচ এ উপলব্ধিটা সে করতে পারেনি আজও। অথচ সৃজা করেছে এবং খুব দ্রুতই। ও ছোট শ্বাস ফেলে, “ভাইয়া তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন করেছে আমাকে কী বলা যায়? বড়বোন হিসেবে!”
সৃজা চুপ করে থাকে। এরপর মাথা নাড়ে। হাতের ফোনটা নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে একটা ছবি বের করে ইস্মির দিকে এগিয়ে দেয়৷ ইস্মি কিছুই বুঝে উঠে না। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয়। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে একটা ছবি, যার মধ্যে কোলাজ করা অনেকগুলো ছবি একসাথে। অনেক পুরোনো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে—বিশ-বাইশ বছরের ম্লানমুখের এক তরুণীকে। যার বাদামি চোখ। সরু নাক। পাতলা ঠোঁট। চুলগুলো কালচে-লাল। অথচ খুব সুন্দরী। চোখ ধাঁধানো। পরণে ঢোলাঢালা শার্ট আর স্কার্ট৷ বিরক্তি আর রাগের চিহ্ন ফুটে আছে তার চোখেমুখে। দেখতে বিদেশি মনে হলেও বাঙালি এটা অবশ্য বোঝা যায়। এমন সুন্দরী তরুণী ইস্মি এর আগে খুব কমই দেখেছে। তবে চমকের বিষয়টা হলো তরুণীর দু’পাশে বসে থাকা দু’টো বাচ্চা। একজন কাঁদছে, অন্যজন ভীতু মুখে তরুণীটির দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ তরুণীর তাতে কিছু যায় আসছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এরা যে এই তরুণীটির সন্তান তা বোঝাই যাচ্ছে। নিবিড় চোখে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে ইস্মি তেমন কিছুই খুঁজে পায় না। তবে একটা সময় বাচ্চাদুটোর ঠোঁট আর ভ্রু দেখে একটু ধাক্কা খায়। চমকিত ও কাঁপা ঠোঁটে বলে সৃজাকে, “এটা তো ও-নি; ম মানে তোমার ভাইয়া। আর..কাঁদছে যে এটা ইহসান ভাই…”
সৃজা ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। বলে, “স্ক্রল করো, পরের ছবিটা দেখো…”
ইস্মি পরের ছবিটা দেখে। আগের ছবিটারই উল্টোপিঠ! সাদাটে ফাঁকা জায়গা। সেখানে কালো কলমে ইংরেজি অক্ষরে কিছু লিখা। প্রথমে নীল কালিতে লিখা, Vous êtes innocents, mais je vous déteste. Tant que je vivrai, je détesterai. এরপরেই তার নিচে কালো কালিতে লিখা,
Même si tu nous détestes, tu es notre seul amour. Parce que tu es notre mère.
ইংরেজি হলেও ভাষাটা অন্য। পড়ে মোটেও কিছু বোধগম্য হয় না ইস্মিতার। অবুঝ চোখে তাকায় ও সৃজার পানে। জিজ্ঞেস করে, “কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“প্রথমে লিখা, ‘তোমরা নিষ্পাপ, কিন্তু আমি তোমাদের ঘৃণা করি। যতদিন বাঁচব, ততদিন করব।’
পরেরটাতে লিখা, তুমি ঘৃণা করলেও তুমিই আমাদের একমাত্র ভালোবাসা। কারণ তুমি আমাদের মা।”
সৃজা নিঃশব্দে হাসে। ইস্মি প্রচন্ড অবাক গলায় বলে, “কীভাবে বুঝলে?”
”ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখা, স্ক্যান করে অর্থ বুঝেছি।”
বিস্ময় কাটে না ইস্মির, উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কই পেলে ছবিটা?”
“সোফার নিচে পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছি। ধুলো জমে গেছিল৷ বাতিল কাগজ ভেবে ফেলে দিতেই যাচ্ছিলাম, পরে দেখি এটা ছবি।”
ইস্মি আগের মতোই বিস্ময় নিয়ে বলে, “মূল ছবিটা কোথায়?”
“কী ভেবেছ, তোমার ভাই ওটা দিয়ে যাবে? ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি অবশ্য ওকে দেখানোর আগেই ফোনে ছবি তুলে রেখে দিয়েছিলাম।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৪
ইস্মি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “আম্মা তাহলে ওদের মা নয়!”
সৃজা মলিন অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “যদিও আমি এই ছবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারিনি তবে এটা নিরানব্বই শতাংশ শিওর যে ছবির এই মেয়েটিই ওদের মা। আন্টি না। আর নিজের মা নয় বলেই আন্টির প্রতি ওদের এমন ব্যবহার! নিজের মাকে বোধহয় খুব ভালোবাসে, অন্য কাউকে সেই জায়গাটা দিতে পারেনি।”
ইস্মি বলার মতো অবশিষ্ট কিছু খুঁজে পায় না। ও বাকরুদ্ধ বনে গেছে।শব্দ ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে৷ মাঝেমধ্যে ভাইদের আচরণ দেখে যে ওর সন্দেহ হতো না, তেমনটা নয়৷ কিন্তু আসলেই ও ভাবতে পারেনি সালেহা বেগম ওদের মা নয়!