অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসান বাকরুদ্ধ বনে গেল। সৃজা হন্যে হয়ে ওর খোঁজ করছে, এটা সে জানে। কিন্তু মেয়েটা এতই অভিমানী আর খেয়ালি… যদি সত্যিই ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করে বসে? ইহসান তড়িঘড়ি করে নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল। দু-একটা জামা-প্যান্ট ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই ইনজান আর আজিজ শেখের উপস্থিতি মনে পড়ায় থমকে গেল। উহু! এই দুই কুটিল আর বিপদজনক লোককে একা এভাবে এখানে ছেড়ে রেখে গেলে আবারও কোনো ঘট পাকিয়ে বসবে। একটা ব্যবস্থা করে এরপর এখান থেকে বেরুতে হবে। ইহসান ব্যাগ ছুঁড়ে হতাশ হয়ে বসে পড়ল। মাথা চেপে ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। ভেবেচিন্তে পেল না কী করা উচিত তার!
সৃজাকে কী সে বলে দেবে সত্যিটা, নাকি এড়িয়ে যাবে? তাতে যদি মেয়েটা ওকে ভুল বুঝে? এমনিতেই তো ভুল বুঝে আছে! কিন্তু তাতে আর কী? সত্যিটা জানার জন্য এই মেয়ে নিশ্চয় উদগ্রীব হয়ে আছে। সে কী নিজে থেকে বলে দেবে? এটা কি উচিত হবে? কিন্তু নিজের মুখে এই অপ্রিয় সত্যিগুলো সে বলবে কী করে? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল, একটা চিঠি লিখবে সে সৃজাকে। কারণ— যে কথাগুলো মুখে বলা যায় না, সেগুলো কাগজে লিখে সহজেই প্রকাশ করা যায়! এই কাজটা তথাকথিত সহজ। কণ্ঠের আকুলতা, দুর্বলতা অন্যরা বুঝতে পারে না। ইহসানের চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস নেই। তাই দোনামনা করে কলমে খসখস শব্দ তুলে কাগজে লিখতে বসল।
সৃজা,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তোর উপর এমনি এমনি রাগ করিনি। কারণ আছে বলেই রাগ করেছি। তবে রাগ হলেও তোকে আঘাত করতে বা তোর থেকে দূরে থাকতে চাইনি। তবুও থেকেছি, কারণ তুই এমন একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিস, যা আমি সব সময় লুকিয়ে রেখেছি। অতীতের সেই ঘটনা আমি ঘৃণা করি, কখনো কারো সামনে আনিনি, আনতেও চাই না। কিন্তু যেহেতু তুই সন্দেহ করেছিস, তাই মনে হচ্ছে তোকে সত্যিটা না বললে আমার শান্তি মিলবে না। যদিও সত্যি বলেও
যে শান্তি পাব, তেমনও নয়। কারণ এমন অনেক সত্যি আছে, যা আমি তোর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি। জানলে তুই ভয়ানক কষ্ট পাবি, আর আমি তোকে কষ্টে দেখতে চাই না। তুই আমার কাছে একটু খুশি—আর নিজের খুশিকে কেউ কষ্টে দেখতে চায় না। ঠিক এই কারণেই তোকে ভালোবাসা সত্ত্বেও কখনো তোকে বুঝতে দিইনি, মুখ ফুটে বলিনি। তোকে ভালোবাসলেও কখনো আমার জীবনে পেতে চাইনি, আশা করিনি, বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিনি। সব মিলিয়ে, আমার জীবনে তোর পদার্পণ আকাঙ্ক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিত।
এবার শোন, তোর সন্দেহটা সত্যি। ছবিতে আমি, আমার ভাই ইজহানের সাথে যিনি ছিলেন, তিনি আমার মা। জন্মদাত্রী মা। এমিলি ইয়াসমিন। আমার জীবনে দেখা অতীব সুন্দরী, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো এক নারী। শান্ত, ভদ্র, পড়াশোনায় ভালো। ক্যানভাস আর রং-তুলিতেই তার ভালোবাসা খুঁজে পেত। ফরাসি মা আর বাংলাদেশি বাবার সন্তান। জন্মের সময় মা মারা যায়। স্ত্রী বিয়োগের কষ্ট আর মাতৃহীন মেয়েকে বাবা একাই বড় করেন। মেয়ে কখনো বাংলাদেশ দেখেনি, তাই নিজ দেশ দেখাতে সতেরো বছরের কিশোরী মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। গ্রামে আসার পর গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমিলি রং-তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতো। নিরবে-নিভৃতে বসে ছবি আঁকতো। কিন্তু এটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। তার ঝঞ্ঝাটহীন রূপ চোখ ধাঁধিয়ে দেয় গ্রামের চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া, নষ্ট চরিত্রের ছেলেটার। সে এমিলির পিছু পড়ে যায়। প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব যায় বাড়িতে। কিন্তু মেয়েটা, তার বাবা এবং পরিবারের সবাই বারবার তা ফিরিয়ে দেয়। এদিকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে চেয়ারম্যানের ছেলের ইগোতে আঘাত লাগে। শোধ নিতে একরাতে সে এমিলিকে অপহরণ করে। টানা চার মাস তাকে পরিত্যক্ত বাংলোতে আটকে রাখে। নিজের মতো করে ভোগ করে মেয়েটাকে। চার মাস পর পুলিশের সাহায্যে এমিলিকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু চেয়ারম্যানের ক্ষমতার জোরে তার ছেলে জেল থেকে পালিয়ে ফেরারি হয়ে যায়।
ততদিনে এমিলি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বাড়ি ফিরে এলেও তার চারপাশে ছি ছি, ধিক্কার পড়ে যায়। তাকে পাপিষ্ঠা, চরিত্রহীন নারী বলে অপমান করা হয়। তার পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়। তার বাবাকে অপমান, অপদস্ত করা হয়। তিনি মেয়েকে নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইলে সেটাও হতে দেয়নি কিছু লোক। এর মধ্যে ঘটে যায় আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা। এমিলি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেই রেপি’স্টের সন্তান। একমাত্র ও আদরের মেয়ের হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি, উন্নত চিকিৎসার অভাব এবং মৃত্যুর শঙ্কা, মেয়ের দুর্বিষহ ভবিষ্যতের শঙ্কা—এসব সহ্য করতে না পেরে এমিলির বাবা শোকাগ্রস্ত হয়ে মারা যান। এতিম হয়ে যাওয়ার সেই শোক সামলানো সহজ ছিল না এমিলির পক্ষে। তবুও নয় মাস পর এক ঝড়ের রাতে এমিলি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।
এরপরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। চেয়ারম্যান বাড়ির বংশপ্রদীপ দুটি এমিলির গর্ভ থেকে এসেছে। হাতছাড়া করা যায় নাকি? চেয়ারম্যান ও তার ছেলে আনন্দে আটখানা হয়ে গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে। এদিকে এমিলির দাদার পরিবার মানসম্মান আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে ছেড়ে দেয়। এমিলিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার সৌন্দর্যের লোভে তাকে ধ্বংস করা হয়। চেয়ারম্যান তার ছেলেকে সংসারী করার উদ্দেশ্যে ছেলে আর নাতিদের জন্য বাড়িসহ কোটি টাকার সম্পদ লিখে দেন। বাচ্চা ছেলে দুটো অবশ্য তখন রেপি’স্টের অন্তঃপ্রাণ। সব পেয়ে সে বিশ্বজয়ী। কিন্তু কিন্তু কিন্তু… এমিলি ইয়াসমিন তো তাকে বিশ্বজয়ী হিসেবে দেখতে চায়নি! না হতে চেয়েছে তার সন্তানদের মা, না তার স্ত্রী! কোনোদিনই সে ভালোবাসেনি ঐ কুলা’ঙ্গার লোককে, না কাছে টেনেছে, ভালোবেসেছে ঐ দু’টো সন্তানকে।
অথচ তার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তার নির্দোষ সন্তানেরা ভিখিরির ন্যায় হাত পেতে থাকতো, আর সে মা হয়ে দূরছাই করে তাড়িয়ে দিতো। দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যেত, উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করতো। পালাতে চাইতো, মারতে চাইতো স্বামী আর সন্তানদের। কিন্তু স্বামী নামক কুলা’ঙ্গার তাকে আটকে রাখতো, আটকে রাখতো ঘরে। গায়ের জোরে তাকে থামাতো। তেজ কমাতো। অবশ্য সে যে কম বিকারগ্রস্ত ছিল, তা নয়। আগেরবার তো অবৈ’ধ ট্যাগে বাচ্চা এনেছিল, এবার তার কাছে বৈধ ট্যাগ আছে। লালসা সামলাতে পারেনি কখনো মেয়েটার উপর থেকে। যার ফলে আরো দু, দু’বার গর্ভবতী হয়। এমিলি ইয়াসমিন বুঝে যায় তার জীবনটা এমনিতেই চলতে থাকবে, কেউ নরক থেকে তাকে রক্ষা করতে আসবে না। ছোটপুত্রের জন্মের বছর পাঁচেক পর একদিন তাদের মায়ের স্নেহ থেকে চিরজীবনের মতো বঞ্চিতের ট্যাগ দিয়ে ছাদ থেকে পড়ে নিজের কলঙ্কিত জীবনের ইতি টেনেছিল…সাতাশ বছরের এমিলি ইয়াসমিন।
যার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল আজিজ শেখ নামক কুলাঙ্গারের ছত্রছায়ায়। কিন্তু তার সন্তানরা আজও সেই ন’ষ্ট, লালসাবাজ অমানুষের রক্ত বহন করছে। তাদের জন্যই তাদের মায়ের জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল। বল, এগুলো শুনলে লোকে ঘৃণা করবে না? হাসবে না?
সৃজা, এই সত্যি আমি, আমরা কখনো কাউকে বলিনি। তোকেও বলতে পারব না। তাই এই চিঠি লিখলাম। তুই কি আমাদেরও হেলা করবি? ভালোবাসা বন্ধ করে দিবি? অবশ্য নষ্টদের কি কেউ ভালোবাসে?
এটুকু কাগজে লিখে থামল ইহসান। এরপর একবার নয়, বারবার পড়ল চিঠিটা। কিন্তু সবকিছু তার কাছে অগোছালো মনে হলো। কাটাকুটি করে আবারো সাজিয়ে লিখল। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না। ভেতরটা হাঁসফাঁস লাগল, হতাশায় নিমজ্জিত হলো। এসব জানলে সৃজা ঘৃণা করবে সত্যিই ওকে। নাহ! এসব সে সৃজাকে বলতে যেমন পারবে না, তেমনি লিখেও জানাতে পারবে না। বিশ্বাস হয় না, তবুও মনে উঁকি দেয়… সৃজা ঘৃণা করবে ওকে। ওর থেকে দূরে চলে যাবে! ইহসান ঘড়ির দিকে তাকালো। কাঁটা ঘুরছে এগারোটার আশেপাশে। সৃজার খবর নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় স্থির বসে থেকে এরপর নিজের অন্য একটা সচল নাম্বার থেকে ইজহানের বেডরুমের ল্যান্ডলাইনে ফোন দিলে ধরল ইজহান। ধরেই হেঁড়ে গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ইহসান আশা করেছিল ফোনটা ইস্মি ধরবে। কিন্তু তা হয়নি দেখে সে নিরাশ হলো। কাঠ গলায় জবাব দিলো, “আমি!”
ইহসানের গলা শুনে বেজায় চমকাল ইজহান। কিছুটা সময় পর ধাতস্থ হওয়ার পর অবাক হওয়া ভুলে সে নড়েচড়ে বসল। খোঁচা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তা হাতছাড়া করল না। গা জ্বালানো হাসি হেসে বলল, “তা রেস্টুরেন্ট ওউনারের ফোনটা কি ভুল রাস্তায় ব্রেক কষে এখানে চলে এসেছে? হুম?”
আজেবাজে কথা শুনে ইহসান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোকে ফোন করিনি, ফোনটা… ইস্মিকে দে।”
ইজহানের মুখ শক্ত হয়ে গেল। কেন? এই ভেড়া কেন কথা বলতে চায় ইস্মিতার সাথে? ওর সন্দেহ হলো। ঘুমন্ত ইস্মির দিকে দৃষ্টি তাক করে সে কাঠখোট্টা গলায় বলল, “আমার বউকে কী বলতে চাস তুই? গোপন কথা নাকি কোনো কুবুদ্ধি? শোন, ইস্মি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমাদের বাবু আসছে। আমরা এখন ভালোয় ভালোয় সংসার করছি। ঝামেলা লাগানো অত সহজ না। তাই যা বলার আমাকেই বল, ওকে নয়! দেখি কী বলবি…”
ইজহানের উল্টোপাল্টা কথায় মহা বিরক্ত হলো ইহসান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর পাছায় লাথি মেরে যেন চলে যায়, এটাই বলব!”
“মুখ সামলে কথা বল!”
গর্জে উঠল ইহসান, “ইস্মিকে ফোনটা দে!”
“ও ঘুমাচ্ছে, আমি ওকে ডেকে ঘুম নষ্ট করতে পারব না। তোর কি দরকার বললে বল, নয়তো ভাগ!”
ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সৃজার খোঁজ এনে দে, কী করছে ও?”
ইজহান বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
“আমি কোথা থেকে খোঁজ এনে দেব? অবশ্য খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই। তোর বউ বাড়িতেই আছে, ঘরে আছে! তোর জন্য অযথা দুশ্চিন্তা করে ভেবে মরছে—এমন ভাবার দরকার নেই, এখনো এতটা হনুও হয়ে যাসনি। আমি তো এতদিন মেয়েটাকে উল্লুক ভেবে এসেছিলাম, এখন দেখছি অতো খারাপও নয়।
ঠিকই আছে। কিন্তু তোর মতো শয়তানের গলায় ঝুলে বেচারির এই দশা হয়েছে।”
“বেচারি কাকে বলছিস? আমি এখনো বেঁচে আছি।”
ইহসানের কর্কশ কণ্ঠ শুনে ইজহান ফোনের ওপাশে মুখ বাঁকালো। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই গলার স্বর নামিয়ে বলল, “এই! তোর বউ মায়ের ছবিতে হাত দিয়েছে বলে তুই নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিস? কেন বল তো? বউয়ের ভয়ে, নাকি তার চোপা নিতে না পেরে? ভালোই নাটক জানিস তো!”
ইহসানের মেজাজ মুহূর্তেই চড়ে গেল। “মজা নিচ্ছিস? নিজের দশা কী হবে, সেটা ভুলে গেছিস? মায়ের ব্যাপারটা জানাজানি হলে ইস্মি তখনো তোর পাশে থাকবে তো? ওকে বলে দিয়েছিস নাকি, তোর বাপ একজন রে’পি’স্ট, তোর মা ভিকটিম, আর আমরা সেই রে’পি’স্টের অবৈধ ডিএনএ! আর যাকে সবাই আমাদের মা ভাবে, সে আসলে আমাদের মা-ই নয়, আজিজ শেখের দ্বিতীয় স্ত্রী! বলেছিস এসব? নাকি এখনো মুখ বন্ধ রেখেছিস? অ্যাসহোল!”
একগাদা কথা শুনিয়ে ইহসান ফোন রেখে রাগে, বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বসে রইল। এই ইজহানটাকে চড়িয়ে গাল লাল করতে পারলে তার শান্তি লাগত! ওকে এসেছে ভড়কাতে, নিজেও যে একই পথের সঙ্গী ভুলে গেছে! ইহসান বিরক্তির শ্বাস ফেলে মাথা চেপে ধরল। লুজারটা দিলো না তো ফোনটা ইস্মিকে, এখন কোথায়, কার কাছ থেকে সে সৃজার খোঁজ জানবে? বাড়ি ফিরতে তো আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন! ইহসান যখন এসব ভাবনার দোলাচালে জর্জরিত, তখনই আবার ফোনটা বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে ইহসান ফোনটা কানে তুলল। রাগ মিশ্রিত স্বরে বলল, “বিরক্ত করছিস কেন? তোর…”
ওপাশ থেকে নম্র ও উত্তেজিত নারী কণ্ঠ ভেসে এল, “ভাইয়া, আমি ইস্মিতা। আপনি কোথায়? জানি ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো উচিত না, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি… এভাবে হুট করে কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়ে বসে আছেন? সৃজা কতটা চিন্তায় আছে, কত জায়গায় খোঁজ করছে জানেন আপনি? ফোনটাও বন্ধ রেখে কষ্ট দিচ্ছেন মেয়েটাকে, এসব কী মানায় আপনাকে? আপনি তো দেখছি আপনার ভাইয়ের মতোই যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করেছেন!”
ইহসান ইস্মির সব কথা শুনল চুপ করে। জবাব কী দেবে এত প্রশ্নের তা ভেবে পেল না। আসলেই সে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করছে। কেন করছে, সে জানে না! রাগ জড়িয়ে রেখেছে ওটাই শুধু জানে। সৃজা না বলে কেন ধরল সেদিন ছবিটায়? এরপরে এত এত প্রশ্ন জুড়ল! এতেই তো সবকিছু হয়েছে, নয়তো কী ইহসান এমন করত? গায়ে হাত তুলত? যন্ত্রণা সৃজা একা পাচ্ছে? নিজেও সে যন্ত্রণা ভোগ করছে। কীভাবে সৃজার মুখোমুখি হবে তা নিয়েও দোটানায় ভুগছে! নিজের বাচ্চামি আচরণে সে নিজেই বিরক্ত, অথচ ইহসান এসব কিছু ইস্মিকে বলল না। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সৃজাকে একটু দেখে আসুন তো, ঠিক আছে কি না!”
ইস্মি এ কথায় বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “ওর কী হবে?”
“রাগ করে নাকি রশিদকে কীসব উল্টাপাল্টা বলেছে। তাই…”
ইস্মি চিন্তিত হয়ে গেল, “ফোনটা আপনি সৃজাকে করলেই পারতেন। রাগ-অভিমান মিটে যেত! যাইহোক, আমি দেখে আসছি!’’
“ওকে।”
এদিকে বারান্দায় গিয়ে ইজহান বিড়বিড় করে গালাগাল করছিল ইহসানকে, যা কানে আসছিল ইস্মির। ইস্মি কিছুই বুঝতে না পেরে ফোন রাখার আগে ইহসানকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনার ভাইকে কী বলেছেন যে সে এত গজগজ করছে অহেতুক?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “অনেক কিছুই বলেছি, আপনার সেসব জানা উচিত হবে না। অবশ্য না জানলেও চলবে। আপাতত সৃজার খোঁজটা এনে দিন আমাকে।”
ইস্মি কথার আগা-গোড়া কিছুই বুঝতে পারল না। তবে সৃজার ঘরে যেতে যেতে আন্দাজ করল কিছুটা! দু’ভাইয়ের কেউই এ ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। অথচ সৃজার সাথে সাথে ইস্মিও জেনে গেছে ওদের মায়ের ব্যাপারটা! ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সৃজার ঘরে গিয়ে ওকে ইহসানের ফোন করার ব্যাপারটা জানাতেই সৃজা কষ্ট নিয়েই হেসে ফেলল। ইস্মি ওকে হাসতে দেখে ভড়কে গেল, “হাসছ যে?”
“তোমার ভাইয়ার নাটক দেখে।”
“নাটক?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৬
ইস্মির ভড়কানো কণ্ঠস্বর শুনে সৃজা গম্ভীর গলায় বলল, “নাটক নয়তো কী? ফোনটা আমাকে না করে তোমাকে করেছে! কত বড় খারাপ লোক দেখেছ? এতদিন ধরে তার খোঁজ পেতে মরিয়া আমি, অথচ ফোন করল কাকে? তোমাকে! শোনো ভাবি, তোমাকে যদি এই লোক আবার ফোন করে, তাহলে তুমি ফোন ধরবে না। আর যদিও ধরো, তাহলে বলে দিও তুমি কোনো খবর দিতে পারবে না।”
ঘরে ফিরে ইস্মি ঠিক সৃজার কথামতোই কাজ করল। ওদিকে ইহসান ইস্মির এমন কড়া কথা শুনে কিছুক্ষণ থমকে গেল। হজম করতে কষ্ট হলো ওর ব্যপারটা!