অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৮

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া

মায়ের মৃত্যুর সময় ইনজানের বয়স ছিল পাঁচ। ছোট, অবোধ শিশু। মায়ের মৃত্যুতে তারই বেশি কাঁদার কথা থাকলেও সে কাঁদেনি। বরংচ খুশি হয়েছিল। সবাইকে বলছিলও তা, তাকে না ভালোবাসা, আদর না করা, তাকে চড় মারা মহিলাটা মরে গেছে এতে সে খুশি। এই খুশিতেই সে দিন সাতেক নাচানাচি, দাপাদাপি থামাতে পারেনি। ছোট ভাইয়ের ঔদ্ধত্যপনা নয় বছরের ইহসানের সেবার পছন্দ হয়নি, ইজহানেরও নয়। কারণ মা তাদের ভালো না বাসলেও তারা মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাই মায়ের মৃত্যুতে ইনজানের উৎফুল্লতা প্রকাশ করাটা ওরা ভালোভাবে নেয়নি। দু’জনেই ইনজানের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে বেশ মেরেছিল সেদিন ওকে। মেরে ঠোঁট কেটে দিয়েছিল। আজিজ শেখ আটকেছিল ওদের। ইহসান তাকেও ধাক্কা দিয়েছিল! তবে এরপর হঠাৎই একদিন বিকেলে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ইনজানকে খুঁজে পায় ছাদের চিলেকোঠায়, যেখানে মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছিল। ডাকতেই ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “মরে যাওয়া মানে কী লুকিয়ে থাকা? মা এতদিন ধরে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে? মায়ের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”

ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে তার প্রতি একটু রাগ কমিয়েছিল ইহসান। তবে আজিজ শেখ ছেলেকে বুঝিয়েছিল, মায়েরা মরে যায় না, দূর আকাশের তারা হয়ে যায়। তার মাও তারা হয়ে গেছে। আকাশ থেকে তাদের দেখছে। এখন থেকে সেখানেই থাকবে। ইনজান খুশি হয়েছিল। সত্যিই বিশ্বাস করেছিল মা তারা হয়ে ওদের দেখছে! সে এরপর থেকে তারাদের সাথেই কথা বলতো, জিজ্ঞেস করতো মায়ের কথা। কিন্তু কোনো উত্তর পেতো না। তখন তার আবার রাগ হতো। চিৎকার, কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় করতো, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতো। আজিজ শেখ কিছুই বলতেন না। ছেলেকে ছেলের কাজ করতে দিতেন, এভাবেই যদি শান্তি পায় তো পাক!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার কী টাকার অভাব? ছেলেরা নিজের দুঃখ পূরণে যদি সবকিছু ভেঙে ফেলে তাহলে তিনি আবার নতুন করে সব কিনবেন। এভাবে শাসন, বারণহীন বড় হতে গিয়ে দেখা গেল তার ছেলেগুলো বড়োই বেপরোয়া হয়ে গেছে। যাক তবে, বেপরোয়াই ভালো। হাঁদারাম তিনি নিজেও নন, ছেলেগুলোকেও বানাতে চান না। সেই…পনেরো পেরোতেই ইনজান যতটুকু বিপথে পা বাড়ানো যায়, বাড়িয়েছিল! ম-দ, গাঁ-জা, সিগারেট….এমন করতে করতে ড্রা’গে আসক্ত! অপরিণত বয়সেই রাস্তায় বাপের গাড়ি নিয়ে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে বেপরোয়া গতিতে রাস্তায় ছুটানো, ইভটিজিং থেকে শুরু করে এহেন কোনো অপকর্ম নেই যাতে সে নিজেকে জড়ায়নি। দু’দিন পরপর নতুন নতুন গার্লফ্রেন্ড বানানো, এরপর তাদের ব্যবহার করে, মেরেধরে একাকার করে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলা! সব ঝামেলা সামলাতেন আজিজ শেখই, তবে পুত্রকে মানা করতেন না।

বয়সটাই তো এমন, এ বয়সে একটু-আধটু এরকম হয়ই! তবে সেইবার একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট আর এক নেতার ছেলেকে মেরে, ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার পর যখন বড়সড় ঝামেলায় পড়েছিল…তখন একটু টনক নড়েছিল আজিজ শেখের। বড় পদের লোকজন ধরে, টাকাপয়সা দিয়ে ঝামেলা
মিটিয়ে ছেলের নামটা সবার সামনে প্রকাশ্যে আনা থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এরপরই পড়াশোনার অজুহাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশের বাইরে, লণ্ডনে! তবে সেখান থেকে ইনজান আবার শিফট করেছিল প্যারিস শহরে। এতটা বছর সে ওখানেই ছিল। বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল, শুধু ইহসানকেই ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতো মাঝেমধ্যে। আর আজিজ শেখকে তার কোনো বিশেষ
দিনে ফোন দিয়ে কংগ্রেচুয়েট করতো!

ইজহান এসবে গা করতো না, মাথাব্যথাও বেশি ছিল না ছোট ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে। তবে ইহসান খানিক মাথা ঘামাতো, ঘামাতেই হতো! কারণ মায়ের প্রতি মাঝেমাঝে অভিযোগের পসরা সাজিয়ে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো ইনজান। আর মাকে নিয়ে একটা বাজে অক্ষরও ইহসান নিতে পারতো না। তাই ইনজানের প্রতি বিক্ষিপ্ত আচরণ করতো। মারও দিতো। এটাকে মজা ভেবে নিয়ে ভাইয়ের পেছনে লাগতো ইনজান সবসময়। সেই থেকে ইনজান ইহসানের বই, খাতা, কলম থেকে শুরু করে পছন্দের খাবার এমনকি জামাকাপড়ে পর্যন্ত ভাগ বসাতো। বিরক্ত হলেও স্বাভাবিকভাবে নিতো ইহসান। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল সবকিছুতেই ইনজান বেশি বেশি! তার যে জিনিস পছন্দ, সেটাতে ইনজানেরও একটা সূক্ষ্ম নজর সবসময় বিদ্যমান। ছোটভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র জানা আছে বলেই সে কিছুতেই চায় না সৃজার আশেপাশে থাকুক ইনজান। একেই তো চরিত্রহীন, তার উপর ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলছে। সৃজাকে ওমন নজরে দেখবে ভাবলেই ওর রাগে ভাইয়ের চোখ গেলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভ্রাতৃত্বের টানেই ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও সে গুরুতর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ইহসান চোখমুখ শক্ত করে গিয়ে আজিজ শেখকে বলল, “ওকে যদি বাড়িতে দেখি তাহলে হাতদুটোও ভেঙ্গে দেব।”

নিজের এতবড় বাড়ি থাকতেও ছোট ছেলে
এই ফ্ল্যাটে থাকবে এই বিষয়টা একদমই মানতে পারলেন না আজিজ শেখ। তিনি ঠিক করলেন ইনজানকে এখান থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সেখানে সালেহা বেগম ওর সেবাযত্ন করবে, মকবুল করবে। দরকার হলে আরো কাজের লোক রাখবে ছেলের দেখাশোনা করার জন্য। ইহসানের আপত্তিতে তাই খ্যাঁকিয়ে উঠেন আজিজ শেখ, “বাড়াবাড়ি কইরো না ইহসান, ও তোমার ভাই লাগে।”
“তাই তো কিছু করছি না। কিন্তু সৃজা…”
আজিজ শেখ বাঁকা গলায় চেঁচিয়ে উঠেন, “ওইডা তোমার দেখার বিষয়। ও ঐ মেয়েরে পছন্দ করে এইডা নিশ্চয় তুমি জানতা, তো ভাইয়ের জন্য স্যাক্রিফাইস করতা, জানোই তো ও একটু অবুঝ, পাগলপনা বেশি…”
“কোথায় ওকে বোঝাবেন, তা না করে আরো আস্কারা দিচ্ছেন? ছেলেদের এমন কুশাসনে বড় করে অবুঝের ট্যাগ দিতে লজ্জা করে না?”

“বাপ হইলে বুঝবা।”
“ওমন কু-বাপ হতেও চাই না।”
“ইহসান, মুখ সামলাও।”
আজিজ শেখের রাগান্বিত কণ্ঠে কপালের শিরা ফুলে উঠে ইহসানের। গলার স্বরে নেমে আসে নিদারুণ ক্রোধ, “স্যাক্রিফাইসের কথাটা কেন এলো তাহলে? হুম? আমি আপনার মতো একজন কুলাঙ্গারের অবাধ্য তাই? আপনার মতো তথাকথিত কলুষিত এখনো হতে পারিনি সেজন্য আমাকে খুব সাধু ভাবছেন? ভাবছেন আপনি বললেই আপনার কথামতো চলব? লিথুকে লোভে পড়ে বিয়ে করে ফেলব? সৃজাকে ছেড়ে দেব? আবার আপনার ছোট ছেলের জন্য ওকে স্যাক্রিফাইসও করব? জি না, এত সাধু হতে পারিনি।”

আজিজ শেখ কিছু না বলে বিক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান। আসলেও তাই! ইহসান তার কথা অনুসারে জীবনে কোনোদিন চলেনি। চলেছে নিজের মর্জি মতো। চলাফেরা করেছে ভালো-খারাপ সব ধরনের মানুষের সাথেও। তাতে যদিও বিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু যায়নি। সেজন্যই আজিজ শেখ কিঞ্চিৎ ভেবে এসেছেন, তার অন্য ছেলেদের চেয়ে ইহসান একটু বুঝদার, অন্য সময় অবাধ্য হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে সে নিশ্চয় বাপের কথা শুনবে। কিন্তু না, বরাবরের মতোই তিনি ভুল ছিলেন!
নিজের ভাবনা পরাজয়ের পর থেকেই তিনি তাই বিপর্যস্ত! এ পর্যায়ে এসে শক্ত গলায় বলেন, “কাজ, কথা কোনোটাই ভালো না তোমার।”
“আমি এমনই।”
“ইনজান ছোট, বোঝা উচিৎ তোমার।”

“আমি বড়, আমার স্ত্রী ওর বড় ভাবি, মায়ের চোখে দেখা উচিত। এটা ওরও বোঝা উচিৎ। অবশ্য জীবনে শিক্ষা দিলে তো বুঝবে, যার বাপ একজন রে’পিস্ট তার ছেলের থেকে এরচেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়?”
আজিজ শেখ ক্রোধ সামলাতে না পেরে উঠে এসে চড় বসিয়ে দেন ওর গালে। ইহসানও কম যায় না। সে হাত মুচড়ে ফেলল আজিজ শেখের। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল, “এই থাপ্পড়টা নিজের গালে বসান। আমি দেখি, তিরিশ বছরে একটুখানি অনুতাপ ছুঁতে পেরেছে কি-না আপনাকে!”
“অনুতাপ, অনুশোচনা তোমার আব্বার আসে না।”
“আমারও দয়া আসে না আপনার প্রতি!”
কথাটা হসান ঘৃণা ভরে তাচ্ছিল্যপূর্ণ গলায় বলল।এরপর ইনজানকে যেন বাড়িতে না দেখে এটা নিয়ে আবারও সাবধান করল আজিজ শেখকে। ফলে দু’জনের মধ্যে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। ইহসান শেষ পর্যন্ত রেগে বের করে দিলো ফ্ল্যাট থেকে আজিজ শেখকে। এরপর তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে গেল ইনজানের রুমে। দেখল বিছানার হেডবোর্ডে হেলে বসে ল্যাপটপে গেইম খেলছে সে। তবে ইহসান নিশ্চিত এতক্ষণ ধরে তার আর আজিজ শেখের চলা বাকবিতন্ডতা সবই এই শয়’তানের কানে এসেছে। কিন্তু এখন ভাব ধরেছে সে দুনিয়ায় নেই! ইহসান বাঁকা হেসে, চোয়াল শক্ত করে গিয়ে ওর ভাঙ্গা পা চেপে ধরতেই ইনজান ল্যাপটপে নজর রেখেই ভারী স্বরে বলল, “পায়ের থেকে বুকে বেশি ব্যথা দিচ্ছ!”

“কেটে দেখব?”
“খু-নের পরিকল্পনা করছ নাকি?”
“চুনোপুঁটি মেরে হাত নষ্ট করি না।”
ইনজান বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলে উঠে, “হেই ব্রো! তুমি ভুলে গেছ, আমি রাঘববোয়াল, চুনোপুঁটি না! আমার চুনোপুঁটিদের আমারই মতো পঙ্গু করে দিয়েছ তুমি! তবে আমি কিন্তু বেশ কষ্ট পেয়েছি তুমি আমার বিশ্বস্ত গুপ্তচরটাকে লুলা করে দিয়েছ, তাই। ”
ইহসান ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, “পাঠা দিয়ে চরগিরি করবি, ঝোপে লুকিয়ে আমার বউয়ের উপর নজর রাখবি, ভয় দেখাবি, গিফট পাঠাবি, ফুল, চিঠি পাঠাবি আর আমি টের পাব না? তোকে আর তোর ডাকু চরকে যদি কেটে পিসপিস করতাম তাহলে শান্তি পেতাম।”
ইনজান হেসে উঠল উচ্চস্বরে, “শান্তির জন্য সব জায়েজ, করে ফেলো।”

ইহসান ওর কপাল থেকে গাল অবধি আঙুল টেনে ভারী স্বরে বলল, “যদি তোর মুখটা মায়ের মতো না হতো…”
ইনজান কুটিল হেসে বলল, “ধুর, ঐ মহিলার মতো হয়ে দেখি বিরাট সমস্যায় পড়ে গেলাম! ভালোবাসার জন্য খু-ন হতে গিয়েও হচ্ছি না। আমার কী নিজেই আত্ম’হুতি দেওয়া উচিৎ?”
ইহসান চোখেমুখে কঠোরতার বীজ বপন একহাতে ওর চুল টেনে মুখটা নিচু করে চেপে ধরল। অন্যহাতে পেটে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলল, “ভালোবাসা মানে তোর কাছে কী, বল তো হা’রা’মজাদা।”
ইনজান ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠল ঠিকই, তবে আর্তনাদের স্বর লুকিয়ে বলল, “যাকে একবার চোখে লাগে, তাকে পাওয়া।”
“ধর, সৃজা বাদে অন্য কেউ তোর চোখে লেগে গেল, তাহলে?”
“তাহলে তাকেও চাইব।”
“মর তুই!”

ম্যাট্রেসে শুয়ে গা ব্যথা হয়ে গেছে ইহসানের। মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে তার মেজাজও খারাপ। একেই তো একশো বিপদ, তার উপর ইনজানের যন্ত্রণা, ইস্মির কড়া কথা বলে ফোন রাখা, রশিদের কাছেও নিশ্চয় সৃজা আর ফোন দেবে না। তাহলে মেয়েটার খবর পাবে সে কোথায়? আচ্ছা, আর কতদিন সে এমন অবুঝপনা করবে? একটা সময় তো ফিরতেই হবে। তাহলে অহেতুক কেন কষ্ট বাড়াচ্ছে? ধুর! চুলোয় যাক এসব রাগাভিমানের খেলা। সে বাড়ি ফিরবে এক্ষণি! এমন অস্বস্তি আর শূন্যতায় আর একটা দিন কাটলে সে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে! চারটা বাজার একটু আগেই ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে রশিদের উপর ইনজানের দায়িত্ব দিয়ে ইহসান বেরিয়ে পড়ল অশান্ত মনে শান্তির ছিঁটেফোঁটা পাওয়ার জন্য!

কুয়াশাজড়ানো নরম হাওয়ায় দুলছে প্রকৃতি। নিঃস্তব্ধতার ভিড় ঠেলে আঁধার সরেনি চারপাশ থেকে এখনো। মন কেমন করা বিবর্ণ ভোর। ঠকঠক শব্দ তুলে দরজায় টোকা পড়ল ঠিক এ অসময়টাতেই। চোখ লেগে আসা কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল নিমিষেই সৃজার। হকচকিয়ে উঠল ও। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল আসলেই দরজায় শব্দ হচ্ছে না-কি ভুল শুনছে! সে একা—এইঘরে! ইহসান নেই। বাড়িতে তো সবাই ঘুমাচ্ছে। এই অসময়ে কে আসবে? কিছুটা ভয় হলো সৃজার। দরজা না খুলেই বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে উঠে বসল। ফোনটা হাতের কাছে রাখতেই তখনি আবার টোকা পড়ল। সৃজা ঢোক গিলল দু’বার। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না৷ এদিকে দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ ব্যক্তি ধৈর্যহারা হয়ে আস্তে কিন্তু একনাগাড়ে শব্দ করেই যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলানোর নিমিত্তে সাহস সঞ্চয় করে সৃজা বলে উঠল কাঁপা গলায়, “কে?”

“খুল।”
অস্বস্তি আর ভীতি নিয়ে বসে থাকা সৃজা চমকে গেল। এটা তো ইহসানের গলা। এই লোক এখানে কী করছে? কখন ফিরেছে? আদৌ ফিরেছে? কেন যেন ওর বিশ্বাস হলো না৷ তাই আবারও সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আমি।”

কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল সৃজা। বিশ্বাস হচ্ছে না ইহসান ফিরেছে! তৃতীয়বারের মতোন আকাঙ্খিত পুরুষটির কণ্ঠস্বর শুনে সৃজার মনে হলো বুক থেকে পাথর নেমে গেছে। আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ও ফুঁস করে ছাড়ল। গাল মুছে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দরজার সিঁটকিনিতে হাত রাখতে গিয়ে ঠিক করল ফিরেছে তো ফিরুক! এই পাষন্ড লোকের কাছে সে কিছুতেই নিজের গদগদ ভাব আর প্রকাশ করবে না। কী ভেবেছে সে? সৃজা মূল্যহীন? যা খুশি তাই করা যায় ওর সঙ্গে? সময়ে আদর করবে আবার সময়ে ছুঁড়েও ফেলবে? অনাকাঙ্খিত কান্ডের জন্য গায়ে হাত তুলবে এরপর নিজেই রাগ করবে? কিছু না বলে লাপাত্তা হয়ে যাবে? কোনো খোঁজ না রেখে, না দিয়ে দিব্যি যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে? অন্যদের কাছে ওকে দোষী সাব্যস্ত করবে? উহু!

সৃজা অতোটাও সস্তা হবে না। নিজেকে সামলে চোখেমুখে কাঠিন্যতা নামিয়ে সৃজা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দিয়ে অবশ্য দাঁড়াল না ওখানে। ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও তাকালও না এক সেকেন্ডের জন্য, সরে এলো! ঘরে প্রবেশ করেই তৃষ্ণার্ত চোখে একপলক ইহসান দেখল সৃজাকে। দেখেই সে শান্ত হলো। যাক বাবা! রশিদের কথামতো উল্টাপাল্টা কিছু দেখতে হয়নি তাকে। কিন্তু মেয়েটা এমন মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওর কি মন ভালো নেই? অবশ্য থাকবেই বা কী করে? একে তো থাপ্পড় দিয়েছিল সেদিন, তার উপর কয়েকটা দিন বড্ড চিন্তায় রেখেছে মেয়েটাকে সে এতদিন! সে কথা মনে পড়তেই ইহসানের অস্বস্তি লাগল বেশ। বাইরের নিভে আসা অন্ধকার, নিঃস্তব্ধতা সব মিলিয়ে অস্বস্তিতে সে গাঁট হয়ে যাচ্ছিল। ইহসান সোফায় বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা খাকারি দিয়ে সৃজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ঘুমাচ্ছিলি?”

“শুয়েছিলাম।”
“ডিস্টার্ব করে ফেললাম মনে হচ্ছে?”
কথাটা শুনে সৃজা চোখ তুলে তাকাল ইহসানের দিকে। সেই চোখের ভাষায় তীব্র ব্যাকুলতা আছে ঠিকই কিন্তু বিরক্তিও আছে। সৃজার বলতে ইচ্ছে করল, ‘ডিস্টার্ব তো অবশ্যই করেছ তুমি, কিন্তু তারচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছ। মন বিষিয়ে দিয়েছ। আমি তোমাকে এরজন্য একটা শিক্ষা দেবই।’ কথাগুলো মনে আওড়ে নিয়ে সৃজা বিড়বিড় করল। ইহসান আবারও একই প্রশ্ন করলে সৃজা অন্যমনস্ক গলায় বলল, “না।”
ইহসানের মনে পুলক জাগলো। সৃজা কি তাহলে ওর অপেক্ষা করছিল? তার মতোই রাত জেগেছিল? মিস করছিল ওকে ওর মতোই? ও উৎফুল্ল মনে ইতস্তত স্বরে বলল, “সত্যিই জেগে ছিলি?”
“জাগা বারণ নাকি?”

সৃজার কাঠ স্বর, শুনে হকচকাল ইহসান। হাসার প্রচেষ্টা করে বলল, “তা নয়, কিন্তু কেন?”
সৃজা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বিছানায় চাদর সরাতে সরাতে জবাব দিলো, “মুভি দেখছিলাম।”
ইহসান অপ্রত্যাশিত জবাব পেয়ে বড়বড় চোখ করে চাইল ওর দিকে। এই মেয়ে বলছে কী? এতক্ষণ মুভি দেখছিল? এই, এত রাত অবধি! তাও আবার ওর অনুপস্থিতিতে! সে কপাল কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। চারটা বেজে ঊনপঞ্চাশ মিনিট। ভোর হতে শুরু করেছে। একটা রাত মেয়েটা মুভি দেখে কাটিয়ে দিলো অথচ সে আশা করল সৃজা এতক্ষণ ওর জন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে! মনে মনে বেজায় রাগ হলো ওর। তবে তা বাইরে প্রকাশ করল না। মোজা গুলো ছুঁড়ে ফেলে পায়ে স্যাণ্ডেল চাপিয়ে সে ফ্রেশ হতে গেল। ও যেতেই সৃজা এতক্ষণের আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে, টুকটাক কাজ গুছিয়ে সুন্দর করে গায়ে চাদর টেনে একপাশে শুয়ে পড়ল! ফ্রেশ হয়ে এসে ইহসান আবার ধাক্কা খেল যখন দেখল সৃজা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করেনি! ভেবেছিল মেয়েটার সাথে দু’টো কথা বলবে, অথচ, অথচ‌!! ইহসান মুখ কালো করে ফেলল সৃজার আচরণ দেখে।

বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে টেবিলের কাছে গেলেই চোখে পড়ল শুকনো খাবার আর পানির উপর। দেখেই এতক্ষণে গরম হয়ে যাওয়া মেজাজটা ঠান্ডা হলো ওর। মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। যাক! এই অভদ্র মেয়েটাকে এরজন্য ক্ষমা করে দেওয়াই যায়! সে তড়িঘড়ি করে দু’টো ড্রাই কেক আর পানি পেটে চালান করে সৃজার পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওকে বুকে টেনে নিলো। বুকে চেপেই শান্তি হলো। এই ক’দিনে সে ঘুমাতে পারেনি এই মেয়েটার জন্য! একটা সৃজার নিদারুণ শূন্যতায় ভুগেছে সে। এখন বুকটা ভরা ভরা লাগছে। ইহসান সৃজাকে দু’হাতে আলতো করে জড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। চুলে নাক ঘঁষলো। মিষ্টি ঘ্রাণে চোখদুটো বুজে এলো। তবে মিনিটখানেক পরই সৃজা নড়চড় শুরু করল, এপাশ-ওপাশ করার বাহানায় সন্তপর্ণে ওর হাতের বাঁধন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুলো। ইহসান অবাক হয়ে মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “হলোটা কী?”

সৃজা ঠিকঠাক করে শুতে শুতে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “ঘুমাতে পারছি না।”
“কিন্তু তুই তো এভাবেই ঘুমাস। এখন…”
“এখন আর ঘুমাই না।”
সৃজা মন্থর কণ্ঠে ছোট্ট করে উত্তর দিলো। ইহসান বিস্মিত হয়ে গেল৷ আগের মতো ঘুমায় না? ঘুমায় না মানে? অভ্যাস পালটে ফেলছে এই মেয়ে? ইহসান রাগ চাপা গলায় শান্ত স্বরে বলল, “কেন?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৭

প্রশ্ন করে ইহসান কান খাড়া করে রইল কিছু শোনার জন্য, কিন্তু উত্তর শোনার বদলে সে সৃজার গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পেল। ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা! ইহসান বালিশে ধপ করে মাথা রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কী হলো ব্যাপারটা, সৃজা কি ওকে এড়িয়ে গেল?

অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৯