অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বেরুতে বেরুতে সাড়ে চারটা বেজে গেল সৃজার। ঘর্মাক্ত বদনে, ক্লান্ত শরীরে গেইটের কাছে বেরিয়ে আসতেই লম্বাটে পুরুষটিকে দেখল সে। যে হাত উঁচু করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে ওর। সৃজা একপলকের জন্য থেমে দেখল উচাটন ভঙ্গিতে, কালো টি-শার্ট পরে বাইকের উপর বসে থাকা মানুষটাকে। যার কপালে অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে চুল, শীতল বাতাসের দাপটে যেগুলো উড়ছে। সৃজার খুব ইচ্ছে করল চুলগুলো গুছিয়ে দিতে, ওড়না দিয়ে ক্লান্ত মুখের বিষাদ মুছে দিতে। কিন্তু নাহ, এরকম করা যাবে না। সে এখন কাঠিন্যতার বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। তাই এত গদগদ আচরণ করা ঠিক হবে না। সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল ইহসানের দিকে। ওকে দেখেই চওড়া হাসি ঠোঁটে টেনে ইহসান পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, “ক্লাস শেষ?”
ঢকঢক করে পুরোটা পানির বোতল খালি করে সৃজা ছোট্ট জবাবে বলল, “হু।”
এরপর বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে স্ট্যান্ডে পা রেখে উঠে বসল বাইকের পেছনে। ওড়না গুছিয়ে নিয়ে ইহসানের কাঁধে হাত রেখে বোঝাল যাত্রা শুরু করতে। হ্যান্ডেলে হাত রেখে বসে থাকা ইহসান বউয়ের আচরণ দেখে বিমূঢ় হয়ে গেল। পানিটা ও একাই খেয়ে নিলো? ওকে একবারো সাধল না? তার উপর ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে বাইকে উঠে বসেছে, জড়িয়ে না ধরে কাঁধে নামেমাত্র হাত রেখেছে? ওর ঠোঁটে দৃশ্যমান হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল ব্যস্ত রাস্তা ধরে। মাঝেমধ্যে গতি বাড়াল, কিন্তু সৃজা আগের মতোই অনড় হয়ে বসে রইল। জাপ্টে ধরল না, বারণ করল না। ভীতি নিয়ে সাবধানও করল না ওকে। সৃজার শীতল আচরণ হজম করতে পারছে না ইহসান। বড় রাস্তায় উঠার পর স্বাভাবিক ব্যবহার পাওয়ার আশায় জিজ্ঞেস করল, “কেএফসিতে বসব?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“নাহ।”
“পার্কে যাবি? চটপটি-ফুচকা খেলি? থামব?”
“উহু।”
“হাবু মামার দোকানে সাতরঙা চা হয়, যাব?”
“না।”
“নদীর পাড়?”
“না।”
“কেন?”
“বোরিং প্লেইস।”
দারুণ একটা বিষম খেল ইহসান। নদীর পাড় তো সৃজার খুব প্রিয় জায়গা। আগে যাবার জন্য নিজেই বায়না করত। জোরাজুরি করতো। অথচ এখন বলছে বোরিং প্লেইস? ও ধৈর্যহারা হয়ে গেল, “তাহলে আমার
ওখানে চল।”
“ইচ্ছে করছে না।”
“সবকিছুতে না না কেন করছিস?”
বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়ল ওর সেই কণ্ঠে। রাগ উঠে যাচ্ছে। কপালের রগ ভেসে উঠছে সেই রাগের পারদে। বুকে অসহনীয় বিষাদ। সৃজা ওর কণ্ঠস্বরের তেজ বুঝে নিয়ে কাঠ গলায় বলল, “সরি, অবাধ্য হওয়া উচিৎ হয়নি। যাও যেখানে ইচ্ছে করে। সরি এগেইন।”
দু’লাইনে কথা শেষ করে চুপ হয়ে গেল সৃজা। আর ওর সরি, সরি শুনে রাগে ইহসানের হাত মুঠোবন্ধ হয়ে যেতে চাইল, কিন্তু সম্ভব হলো না সেটা। সে চোখমুখ শক্ত করে বাইকের গতি বাড়িয়ে একটা বাসকে ওভারটেক করতেই সৃজা চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। শুধু মেয়েলি হাতটা ওর শার্ট খামচে ধরে মুখফুটে বলল, “সাবধানে চালাও।”
বাইকটা থামলো একটা টং দোকানের সামনে। খুব ছোট্ট এক দোকান, জীর্ণশীর্ণ সাইনবোর্ডে লিখা, ‘হাবিব ভাইয়ের টি-স্টল।’ খড়ের চাল আর বেড়া দিয়ে তৈরি দোকানটি সাজানো বনরুটি, কুকিজ, আটার বিস্কুট আর বিভিন্ন চিপসের প্যাকেট, বাচ্চাদের লজেন্স দিয়ে। তবে এখানের মূল আকর্ষণ যে বিভিন্ন ধরনের চা তা টাঙিয়ে রাখা লিস্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনে বসার জন্য দু’পাশে দুটি কাঠের একটা বেঞ্চ রাখা। ইহসান সৃজাকে সেখানে বসিয়ে এগিয়ে গিয়ে দোকানিকে বলল, “হাবু মামা, তোমার দোকানের স্পেশাল চা বানাও।”
আরো কীসব হাবিজাবি অর্ডার দিয়ে এসে সৃজার পাশে ধপ করে বসল ইহসান। সৃজা তখন সামনের একটা ফুলের দোকান দেখছিল। তাই হুট করে কেউ পাশে বসায় ও চমকে তাকাল। একান্ত স্বামী পুরুষটিকে দেখে পরক্ষণেই আবারো নজর ঘুরালো। ইহসান চটপটে গলায় ওকে বলল, “হাবু মামার চায়ের স্বাদই অন্যরকম। খেলেই বুঝবি।”
“আচ্ছা।”
অন্যদিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল সৃজা। ইহসান চোখ ছোট ছোট করে সৃজার দৃষ্টি অনুসরণ করতেই ওর চোখ গেল পাশের ফুলের দোকানটায়। তৎক্ষনাৎ ওর মাথায় কিছু একটা খেলে গেল। মন উৎফুল্ল হলো। এই মেয়েকে এখন বাগে আনবে সে। আর এমন কঠিন কঠিন, এড়িয়ে যাওয়া আচরণ করতে দেবে না। সৃজার এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে আসা কিছু চুল হিজাবের ভেতর গুঁজে দিয়ে বেশ সহজ গলায় বলল, “তুই একটা গোলাপ ফুল সৃজা।”
“থ্যাংকিউ।”
ইহসান এবার উল্লসিত কণ্ঠে বলল, “না না, তুই ফুলের চেয়েও সুন্দর! অবশ্য দেখতে হবে না কার বউ! এই আমার, ইহসান শেখের।”
“হুম।”
“তুই এখানে বস, আমি ফুল নিয়ে আসছি।”
“আনতে হবে না।”
“কেন?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব এলো, “ফুলগুলো বাসি, নষ্ট হয়ে গেছে।”
এটুকু বলে সৃজা আবার আগের মতোই চুপচাপ হয়ে গেল। ইহসানের এত মেজাজ খারাপ লাগল! ইচ্ছে করল ঐ ফুলের দোকান, হাবু মামার দোকান সব ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিতে। সৃজাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিতে। পিচঢালা রাস্তায় শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা বাস-ট্রাকের নিচে লাফিয়ে পড়তে। ও সৃজার হাত মুঠোয় চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করতেই সৃজা অবাক চোখে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? হাত ধরেছ কেন? কোনো সমস্যা?”
ইহসান অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “চায়ে ক’চামচ চিনি দিতে বলব?”
“চিনি ছাড়া খাব।”
কটমট করে বলল ইহসান, “দিনদিন তেঁতো হয়ে যাচ্ছিস…”
“আচ্ছা, তাহলে তুমিই ঠিক করে দাও ক’চামচ চিনি খাব! ওয়েট, আমিই বলে আসছি।”
ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে কথাটুকু শেষ করে সৃজা উঠে গেল। ইহসান মুখ গোঁজ করে বসে রইল। ওর সবকিছু বিরক্ত লাগছে, তেঁতো ঠেকছে! হাবু দোকানদার ইহসানকে চেনেন৷ মাঝেমাঝেই এখানে চা খেতে আসে বলে ভালোই আলাপ আছে ওর সাথে। কিন্তু আজ সাথে করে এই সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এসেছে, মেয়েটা কে হয় ওর? পাঁচ চামচ চিনি চাইল যে? কৌতূহল নিয়েই তিনি সৃজাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ইহসান বাবার কী হও গো মা?”
সৃজা বিব্রত কণ্ঠে বলল, “বউ হই মামা।”
“মাশাল্লাহ! বিয়ের খবর আগেই শুনছিলাম, দেখার সৌভাগ্য হয় নাই মা!”
“দোয়া করবেন মামা।”
হাবু দোকানদার উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, “হ হ, করমু।”
দুটো কাপ নিয়ে একটা ইহসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে পাঁচ চামচ চিনি মেশানো চায়ে চুমুক দিয়েই চোখমুখ বিকৃত করল সৃজা। এত মিষ্টি! মনে হচ্ছে পায়েস! বিস্বাদ ঠেকল চা’টা। কিন্তু ইহসান ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে বলে কিছু বলল না। চুপচাপ চা শেষ করল। এরপর চেয়ে এনে পানি খেল। ইহসান অবশ্য এক চুমুকেই চা শেষ করে বিল মেটাতে গেল। হাবু মামা বিল তো রাখলোই না উল্টো সৃজাকে ডেকে ওর হাতে কুকিজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, “স্বামী সোহাগী হইও গো মা, তোমার জামাইডা বড়ই দিলখোলা, বড় মনের মানুষ। তারে জীবনে কষ্ট দিও না।”
সৃজা চরম বিব্রতবোধ করল। অপ্রস্তুত হাসলো। হাবু মামা এরপর ইহসানকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, “মাইয়া মানুষ বাপের সংসার ছাইড়া আইছে তোমার সংসারে। তুমি তার লগে লগে থাকবা। একটা কথা মাথায় রাইখো, মাইয়া মানুষ আদরে গলে, বেশি শাসনে কাঠ হইয়া যায়। বউরে কাঠ হইবার সুযোগ দিও না গো বাজান। ভুলত্রুটি করলে আদর কইরা বুঝাইও।”
ইহসান গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি কী মাইন্ড রিড করতে পারো নাকি? মানে মনের কথা পড়তে পারো?”
হাবু মামা হেসে ফিসফিস করে বললেন, “তোমরা যে কাইজ্জা করছ, চেহারা দেখলেই বুঝা যাইতেছে। বৌমারেও দেখলাম মুখ ভোঁতা কইরা বইয়া আছে আইবার পর থেইক্কা। পরখ কইরা বুইঝা নিলাম।
এহন কও, আমি ঠিক না ভুল?”
হাবু মামার কথা শুনে ইহসান মাথা নাড়লো, “ঠিক মামা।”
“তোমার হাবু মামা ঠিক কথাই কয়।”
বিছানা গোছাতে, কাপড় ভাঁজ করতে সৃজাকে সাহায্য করেছে ইহসান। আগে সৃজা কাজের পাশাপাশি কথার ঝুড়ি খুলে বসতো, খিলখিল করে হেসে মুগ্ধতা ছড়াতো ঘরময়। হৃদযন্ত্রে ব্যথা ধরিয়ে দিতো ওর। কিন্তু সৃজা এখন তেমন কিছুই করছে না। গোসল সেরে এসেও অনেকক্ষণ সৃজার চঞ্চলতা দেখতে না পেয়ে একপর্যায়ে উঠে গিয়ে বই গোছাতে থাকা সৃজাকে টেনে বাহুডোরে আবদ্ধ করল ইহসান, “এত চুপচাপ কেন?”
সৃজা প্রথমে ভড়কে গেলেও এবার স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো, “কাজ করছি।”
“এরজন্য কথা বলা বারণ নাকি?”
সরু গলায় কথাটা বলতেই সৃজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “অহেতুক বকবক করলে তোমার মাথা ধরবে।”
“একথা বলেছি আমি?”
“না। তবে অনুমতিও পাইনি।”
ইহসানের মেজাজ খারাপ লাগল। অনুমতি মানে? কীসের অনুমতি? সৃজা কীসব উল্টাপাল্টা বলছে ওকে? বুকে অহেতুক ছুঁড়ি বসাচ্ছে! ও বিরক্তি ফুটালো চোখেমুখে। কর্কশ গলায় বলল, “আমার এসব ভালো লাগছে না।”
“কোনসব?”
সৃজা বিস্মিত ও প্রশ্নোক্ত চাহনিতে তাকাল। ভাবলেশহীন কণ্ঠ ওর। ইহসান একহাতে নিজের কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঠোঁটের কোণে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে লম্বা একটা চুমু খেল। সৃজা অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ইহসান হতাশ হয়ে ছেড়ে দিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল, “দেখ, আমার শ্বাস চলছে না। বুকে হাত দিয়ে দেখ!”
“প্রেশার ফল করল নাকি? বসো, বসো চেক করে দিচ্ছি।”
এবারে খানিকটা বিচলিত দেখালো সৃজাকে। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ইহসান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রেগে আগুন হয়ে গেল। টি-টেবিলে জোরেশোরে একটা লাত্থি বসিয়ে রাগ ঝাড়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বিনিময়ে পায়ের আঙুলে প্রচন্ড ব্যথা পেল। ধপ করে ব্যথা পা নিয়ে বিছানায় বসে
কিড়মিড় করল ইহসান। থাবা বসালো খাটের পাশে। স্ফিগম্যানোমিটার আনতে গেছে সৃজা? প্রেশার মাপবে? এরচেয়ে চাকু দিয়ে চিঁড়ে ওর বুকের ভেতরটা দেখতো,
শান্তি লাগতো তাতে!
ইহসান ধপ করে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে। এরপর চোখদুটো বুজে শ্বাস ছাড়ল। মাথার ভেতরটা ঘট পেকে আছে। এই ঘট সৃজাবিহীন অন্যকেউ ছাড়াতে পারবে না। সৃজা এলো মিনিট খানিক পর৷ এসে ওকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে কপালে হাত রেখে চিন্তিত গলায় ডাকলো, “বেশি খারাপ লাগছে নাকি?”
সৃজার নরম হাতের স্পর্শে অন্য পৃথিবীতে হারিয়ে গেল ইহসান। চিত্তে শুরু হলো দুর্নিবার ঘূর্ণিঝড়। ঘোরগ্রস্ত হলো সে। ওর হাত টেনে চুমু বসিয়ে এরপর মৃদু স্বরে বলল, “হুম।”
সৃজা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রেশার চেক করতে বসল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফলাফল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইহসানের দিকে। স্বাভাবিকের চেয়ে দু’পয়েন্ট বেশি, ঝুঁকিপূর্ণ নয় কিছুতেই। তবে এটাকেই অস্বাভাবিকের পর্যায়ে ফেলল ইহসান, “দেখলি কত বেড়েছে? শরীরটা একদম ঠিক লাগছে না। একগ্লাস পানি দে তো। আর দরজাটাও চাপিয়ে আয়।”
সৃজা সূঁচালো চাহনিতে ওকে পরখ করল। কিছুই বুঝতে বাকি নেই ওর। বাধ্য মেয়ের ন্যায় উঠে গেল। পানি দিলো, ঔষধ দিলো। দরজাটাও চাপিয়ে এলো। ইহসান আধশোয়া অবস্থায় ওকে ডেকে কাছে এনে ওর ঘাড়ে মাথা রেখে বলল, “একটু গল্পগুজব করতে ইচ্ছে করছে।”
“এখন কোনোভাবে গল্প করার সময় না, ঘুমানোর সময়। ঘুমালেই প্রেশার ঠিক হয়ে যাবে। গল্পগুজব করলে আরো বাড়বে। দেখি শুয়ে পড়ো, আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি!”
কঠোর গলায় বলে সৃজা উঠতে গেল, ইহসান কঁকিয়ে উঠল তখনি। সৃজা হতবিহ্বল হয়ে গেল, “কী হলো?”
“পা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়…”
সৃজা কপালে ভাঁজ ফেলে চাদর সরিয়ে দেখল পা পরীক্ষা করে দেখল পায়ের পাতা ফুলে লাল আছে। আঙুল ছোঁয়াতেই ব্যথায় আত্ম চিৎকার করে উঠল ইহসান। সৃজা হতভম্ব হয়ে তাকাতেই ইহসান চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “দেখলি তো কেমন লাল হয়ে আছে…”
একবার ওর মুখের দিকে একবার পায়ের দিকে তাকাল সৃজা। কাঁচুমাচু পুরুষালি চেহারা নজর এড়াল না ওর। আন্দাজে ধরে ফেলল ঘটনাটা। রয়েসয়ে শক্ত গলায় বলল, “কী করে হলো? আমি যাবার আগেও তো ঠিক দেখে গেলাম!”
ইহসান আমতাআমতা করে বলল, “জানি না, তুই একটু বোস না।”
“বসলে কী হবে? পা ভালো হয়ে যাবে?”
“কথা বললেই হবে।”
শুকনো গলায় বলল ইহসান। এদিকে ওর সাথে কথা বলার জন্যই যে এমন ছটফট করছে, সেটা বুঝতে বাকি নেই সৃজার। তবে এত সহজে তো হবে না। ছোট্ট একটা বিষয়ে সিনক্রিয়েট করে এতদিন যোগাযোগ বন্ধ রেখে সৃজাকে যেমন ছটফট করিয়েছে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, সৃজাও তেমনি করবে। বুঝাবে কাছের মানুষ এড়িয়ে গেলে, কষ্ট দিলে কেমন লাগে! সৃজা সটান উঠে দাঁড়াল। ড্রয়ার খুঁজে একটা মলম এনে পায়ের পাতায় দু’মিনিটে মালিশ করে, বালিশে শুইয়ে দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলল, “চুপচাপ ঘুমাও। আর কোনো কথা নয়।”
আলো-আঁধারিতেই ইহসান ব্যাকুল হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুই কাছে বসবি না?”
“আমার পড়া আছে।”
বলে বইপত্র নিয়ে নিয়ে সোফায় চলে গেল। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে চতুর ইহসানকে দেখতে ভুলল না। এখনো ঘুমায়নি, না ঘুমিয়ে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে চাদরে অর্ধেক মুখ ঢেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে অন্ধকারে কোনো শেয়াল তাকিয়ে আছে। সৃজার ভীষণ হাসি পেল। বেশ হয়েছে! নাস্তানাবুদ হোক, বুজুক মজা। এরপর অনেকটা ক্ষণ পেরিয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে টিকটিক করছে। অ্যাসাইনমেন্ট গুছাতে মগ্ন সৃজা হঠাৎই চমকে গেল ইহসানের কণ্ঠস্বর শুনে। ও তড়িঘড়ি করে উঠে শিয়রে গিয়ে বসল। তাকিয়ে দেখল গভীর ঘুমে মগ্ন ইহসান, কিন্তু ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। বোধগম্য হচ্ছে না বিধায় সৃজা কান পাতলো। শুনলো ঘুমের ঘোরেই ইহসান বলছে, “ঠিক করে কথা বলিস না আমার সাথে? মে’রে ফেলব তোকে সৃজা, মে’রে এরপর আমার বুকে ঢুকিয়ে ফেলব। নতুন কাউকে পেয়েছিস মনে হয় আমি না থাকায়? না না। তেমন তুই করবি না। আমি লুজার না। সন্দেহ করি না তোকে। তুই আমার বুকে চাকু চালিয়ে দে, আমি তাতে খুশি হব। শুধু…আগের মতো হয়ে যা!”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৮
সৃজার মনে হলো ও দমবন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। বহুকষ্টে নিজের হাসি আটকালো ও। মুখ নামিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিয়ে উল্টাপাল্টা বলা আটকাল। ঔষধের প্রভাব থাকায় সহজেই ঘুম ভাঙল না ইহসানের। সৃজা সাবধানে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে সেখানেও একটা চুমু খেল, “এমিলি ইয়াসমিনের এই ছেলেটাও পাগল দেখছি!”