অশ্রুবন্দি পর্ব ৪০
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সৃজার মনে হলো ও দমবন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। বহুকষ্টে
নিজের হাসি আটকালো ও। মুখ নামিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিয়ে উল্টাপাল্টা বলা আটকাল। ঔষধের প্রভাব থাকায় সহজেই ঘুম ভাঙল না ইহসানের। সৃজা সাবধানে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে সেখানেও একটা চুমু খেল, “এমিলি ইয়াসমিনের এই ছেলেটা
পাগল দেখছি!”
অগোচরে ইহসানের উপর থেকে রাগ কমালেও
সৃজা ওর সাথে শীতল সম্পর্কটা বজায় রাখলো প্রায় মাসখানিকের মতো। এই দিনগুলোতে সৃজা ওর অনুমতি সহিত সব করতে লাগল। ঘর গোছানো, ধোয়া-মোছা, বইপত্র ধরা, জামাকাপড় ধরা, আলমারি গোছানো এমনকি বারান্দায় পর্যন্ত ইহসানের অনুমতি নিয়ে যেতে লাগল। বাড়িতে না থাকলে ফোন করে অনুমতি চাইতো। কী
বাজার হবে, কী রান্না হবে এসবেও ছাড় দিলো না সৃজা, সেসবেও ইহসানের অনুমতি নিতো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইহসান ওর এই আচরণে প্রচন্ড তিতি বিরক্ত হয়ে গেল ভেতরে ভেতরে। অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে গেল। সে রাগের বশে কী এমন বলেছে, তাতে এই মেয়ে এমন করছে! রাগে ওর হাত-পা, মুখ লাল হয়ে যেতো। সৃজা দেখেও না দেখার ভান করতো। কেন দেখবে সে? কেন? ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইহসান যা করেছে, বলেছে সৃজা কস্মিনকালেও আশা করেনি তা। ও সবসময় চেয়েছে সবকিছু খোলা বইয়ের মতো, পরিষ্কার! সেখানে কারোর পার্সোনাল স্পেস থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা শান্তভাবে না বুঝিয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মতো কদর্য কাজ করবে কেন? তাছাড়া ওর অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে একেকটা দিন সৃজা কীভাবে কাটিয়েছে, কী কী অপমান, অপবাদ আর লাঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ওকে জানে কী এই লোক? বিয়ের এই এতগুলো মাসেও যেখানে আজিজ শেখ ওকে কখনো সামনা-সামনি কিছু বলার সাহস করেনি, সেই লোক ওর অসুস্থ বাবা, মৃত মা’কে তুলে পর্যন্ত কথা বলেছে। আর্থিক অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করেছে, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, লোভী বলেছে ওকে।জানে কী ইহসান? কতটুকু দুর্বিষহ যন্ত্রণায় সৃজা কাটিয়েছে গত হয়ে যাওয়া দিনগুলো? না, জানে না। তাই এটুকু শাস্তি ওর প্রাপ্য!
ইদানীং ইস্মির ঘুম প্রকট হয়েছে। যখন তখন মেয়েটার ঘুম পায়, দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে চায়। সন্ধ্যার একটু পরপরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। রাতে আর খায় না। জোর করে খেতে গেলে বমি হয়ে যায়। ইজহান এ বিষয়টা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে থাকে, তবে বউয়ের কষ্ট বুঝে সে রাগ করতে পারে না। আজও অফিস থেকে ফিরে দেখল তার বউ ঘুমাচ্ছে। ইজহান কিছুক্ষণ অভিমান নিয়ে বসে থেকে এরপর জামাকাপড় ছেড়েছে। সময় নিয়ে গোসল সেরেছে। পেটে ক্ষিধে থাকায় মকবুলকে ডাকিয়ে খাবারদাবার এনে নিজের হাতে মেখেই ভাত খেয়েছে।
দু’বার গলায় ভাতও আটকেছে। খুকখুক করে কেশেছে, এরপর নিজেই পানি নিয়ে খেয়েছে!
তবুও ঘুমন্ত ইস্মিতাকে সে ডাকেনি। খেয়ে দেয়ে ইস্মিতা রাতের ঔষধ খেয়েছে কি-না সেটা চেক করেছে, বারান্দার শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করে ড্রয়ারে তুলে রেখেছে। এরপর মিজুকে ফোন করে কতক্ষণ বকাঝকা করেছে ভার মনটাকে সতেজ করার জন্য! ওদিকে বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে থাকা মিজু ফোনের ওপাশে চুপচাপ স্যারের বকাঝকা গিলেছে। সে জানে, তার স্যারের মাথায় গন্ডগোল আছে! মিজুকে সাইজ করে মনের ভার একটু কমে যেতেই ইজহান বিছানায় ইস্মির পাশে এসে শুয়েছে। ওকে কাছে না টেনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ওকে জড়িয়ে শুয়েছে। রুক্ষ হাত বাড়িয়ে চুলে বিলি কেটেছে, একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখেছে আগের চেয়েও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠা ইস্মিতাকে।
কিন্তু যখনই উঁচু হয়ে থাকা ফর্সা উদরে চোখ গেল, তখনই গলা শুকিয়ে অস্থির হয়ে গেল ভেতরটা! বারবার চোখ সেদিকেই চলে যেতে লাগল ইজহানের। চেয়েও নজরলে শাসন করতে পারল না সে! ইচ্ছে করল ঐ সুন্দর পেটে আগের মতো মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে, মুখ ডুবিয়ে চুমু খেতে। কিন্তু একটা কারণেই সে তা করতে পারছে না। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা তার শূন্য, একবার যদি আদর শুরু করলে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে ইজহান। তাতে বাচ্চার কম, ইস্মিতারই যদি কিছু হয়ে যায়? মূলত এই ভয়েই ইজহান নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু এই মাঝরাতে, বউ বুকে নিয়ে তার সুধাময়ী রুপের নেশা কাটানো যে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে না পোড়ার বাহানা করা, তা উপলব্ধি হতেই পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে ইজহান ইস্মিতাকে ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে।
তার কাছে ইস্মিতা পুরোই একটা আদর, ভালোবাসা। অনেক মান-অভিমানের পর মেয়েরুপে একটা মা পাবার লোভে বাচ্চাটা রাখতে কোনো ঝামেলা করেনি সে! আর তো কয়েকটা মাস! এরমধ্যে কোনো ভুলচুক করে আবারো কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে চায় না সে। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই আবারো পাশ ফিরে ইস্মিতার মুখোমুখি হয়ে শুলো। আস্তেধীরে হাতটা রাখলো ফোলা পেটে। এরপর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল! এরপর এক মুহূর্ত, দুই মুহুর্ত…এমনি করে কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই হঠাৎ কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকল। কিছু একটা নড়নচড়ন অনুভব করল, ধাক্কা দিলো তার হাতে! ইজহান সটান চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছুটা চিন্তিত হয়ে সে ইস্মিকে আলতো করে ডেকে ফিসফিস করে বলল, “ইস্মিতা, খারাপ লাগছে..উঠো তো…তোমার পেটে কি যেন লাফিয়ে উঠল টের পেলাম! উঠো দেখি… ”
বিচলিত কণ্ঠস্বর কানে বাজতেই ঘুম কেটে গেল ইস্মিতার। মুচকি হাসলো ও। ঘুমঘুম স্বরে বলল,
“হুম! আমিও আজ বিকেলেই টের পেলাম।”
“কী?”
“আপনার মা আমার পেটে নৃত্য করছে!”
ইজহানকে বিভ্রান্ত দেখালো। বিভ্রান্ত হয়ে একই বাক্য দ্বিতীয়বার বলল। একবার প্রশ্নবোধক আরেকবার বিস্ময়সূচক! পরপর লাফিয়ে উঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কান ঠেকাল ইস্মির পেটে। তখনি আবার পেটের ভেতর থাকা ছোট্ট মনুষ্য অবয়বটির তেজ টের পেল। একনাগাড়ে অনেকটা সময় সে মা’কে সে ভেতরে বসে আঘাত করতেই থাকলো। ইজহান হতবিহ্বল হয়ে কম্পিত স্বরে ওভাবেই ইস্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ব্যথা পাচ্ছ?”
ইস্মি এতক্ষণ চুপচাপ উপভোগ করছিল ব্যাপারটা। এবারে ওর হাসি পেল। ইজহানের চুল শক্ত করে টেনে ধরে বলল, “আমার আনন্দ হচ্ছে।”
“এটা তো মনে হচ্ছে ছেলে—এতজোরে কে কিক করে? মেয়েমানুষ হয় ভদ্র সভ্য, এরা এতজোরে কিক করবে না।”
ইস্মি হাসি চেপে বলল, “কেন আপনার কী হিংসা হচ্ছে আমি আব্বা বলে ডাকব কাউকে, তাই?”
ইজহান কথাটা এড়িয়ে গেল। মুখে আঁধার নেমে এলো ওর, “আমি মেয়ে চেয়েছিলাম ইস্মিতা!”
“ছেলে হলে কী কোলে নেবেন না?”
ইজহান রোষাগ্নি চোখে তাকাল, “না, আমি শুধু মেয়েকে নেব!”
“তাহলে মেয়ে হলে আমিও তাকে কোলে নেব না।”
ইজহাম রাগী গলায় বলল, “কেন তুমি আমার মাকে কোলে নেবে না? ও তো তোমার ভেতর থেকেই বেরুবে!”
“কেন আপনি আমার ছেলেকে কোলে নেবেন না? ও তো আমার পেট থেকেই বেরুবে!”
ইস্মি বাঁকা গলায় বলল। যুক্তিতে না পেরে এ পর্যায়ে ইজহান চুপ করে গেল। পেটে যেভাবে কিক কিক খেলা করছে এতে আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়াই সে নিশ্চিত, এটা তার মতোই কোনো ছেলে শিশু। কিন্তু সে তো তার মতো কোনো ছেলে চায় না! মায়ের মতো, ইস্মিতার মতো রসগোল্লা দেখতে মেয়ে চায়! ইজহানের মন খারাপ হয়ে গেল, আবার ইস্মির পেটে কান পেতে ওটাকে অনুভব করতেও ইচ্ছে করল! লোভ সংবরণ করতে না পেরে অবশেষে কান পাতলো ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে আর কেউ কিক করল না। ইজহান কিছুটা অবাক ও বিরক্তি নিয়ে বলল, “ওটা তো আর নড়ছে না।”
ইস্মি শক্ত মুখে বলল, “আপনার কথা শুনে ওর মন খারাপ হয়েছে, তাই নড়চড় বন্ধ!”
ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তিত হয়ে গেল। সে
কী এমন বলেছে যে ঐ পুঁচকা নড়চড় বন্ধ করে দিয়েছে? এ তো মহা জ্বালা! সে নিজেও তো ইস্মিকে এত জ্বালায় না। পুঁচকাটা কী নিজের বাপকে ট্যাকেল দেওয়ার চেষ্টা করছে নাকি? নাহ! এটাকেও ছোট থেকেই হাতে-কলমে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে সামলে রাখতে হবে, ইজহান কিছুতেই ইস্মিকে এই পুঁচকার সঙ্গে ভাগ করবে না, তবে মেয়ে হলে অন্য কথা! ইজহান কর্কশ কণ্ঠে বলল, “ছেলে এত খারাপ কেন?”
“ওর বাপ খারাপ তাই।”
“আমি খারাপ?”
“আপনি ভালো?”
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন শুনে ইজহান রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “তুমি কিন্তু খোঁচাচ্ছ আমাকে ইস্মিতা! অথচ সেদিনই বললে আমাকে কখনো খারাপ বলবে না, কারণ আমি খারাপই না। খারাপ হলে তোমার মতো ভালো মেয়ে কপালে জুটতো না।”
ইস্মি সিরিয়াস মুখে বলল, “আমার কোনো দোষ নেই, আমি এগুলো বলছি না। আপনার মেয়ে আমার মুখ দিয়ে বলাচ্ছে।”
“এক্ষুনি বললে ছেলে…”
“মেয়েও হতে পারে। আমি তো জানি না।”
ইস্মি সচেতন গলায় বলল। শুনে ইজহান ভাবুক চিত্তে মুখ ফসকে বলে ফেলল, “যদি দুটোই হয়, মিলেমিশে?”
“তাহলে ভালোই হয়। এদের আপনার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে আমি একটু আরাম করতে পারব। এমনিতে আপনি আমাকে যা জ্বালান, তখন আমার দল ভারী হবে। আমি শোধ নিতে পারব আপনার উপর। দুই পুঁচকা-পুঁচকি মিলে শায়েস্তা করবে আপনাকে।”
সূঁচালো সূঁচালো কথা উপহার দিলো ইস্মি ইজহানকে। এরপর মিটিমিটি হাসতে লাগল। ইজহান অন্ধকার মুখ করে ক্ষেপে গিয়ে বলল, “দল পাকানো হচ্ছে! আর আমাকে হাতকড়া পরানোর ধান্ধা! তুমি অনেক নিষ্ঠুর হয়ে গেছ ইস্মিতা! আমাকে আগের মতো ভালো… ”
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে দিলো না ইস্মি। কারণ জানে, ইজহান কী অভিযোগ করতে পারে! তাই সে সুযোগ না দিয়ে চট করে দু’হাত বাড়িয়ে গলা আঁকড়ে ধরল ইজহানের। চোখে চোখ রেখে বলল, “কাছে আসুন, আদর করে দিই।”
ইজহান বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে?”
“আপনার মেয়ে দেখছে ভেবে থেমে যাবেন!”
ইস্মি আলতো হাসি বিনিময় করে ঠোঁট বসাল ইজহানের বা-গালে, চোখের পাতায়। নরম স্পর্শে ইজহানের রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। চোখে ঘোর লেগে এলো। ধৈর্যচ্যুতি ঘটতেই সে তড়াক করে মুখ নামিয়ে আনলো ইস্মির গ্রীবাদেশে, হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা উদরে। ওখানে আগ্রাসী চুমু খেতে খেতে অস্ফুটস্বরে বলল, “ঐ পুঁচকাটাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে, নড়ছে না কেন ওটা..”
“আবার ভুল করছেন, পুঁচকিও হতে পারে…”
“যেটাই হোক, নড়বে না কেন ও, চুপচাপ বসে থাকতে তোমার পেটে এসেছে নাকি…”
ইস্মি গভীর চোখে তাকিয়ে রইল ভোল পাল্টানো পাগলের দিকে, সেভাবেই তার আদর অনুভব করতে লাগল!
বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছে৷ ঠান্ডা বাতাস আসছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে ইহসান। সামনে চার পদের তরকারি সাজিয়ে ভাত খেতে বসা ইহসান চোরাচোখে বারবার সৃজাকে দেখছে আর চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি লুকাচ্ছে!
ওর ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালদুটো টেনে ধরে শক্ত এক চুমু বসাতে, আগের মতো খুনসুটিতে মেতে উঠতে। কিন্তু সৃজার শীতল ব্যবহারে সহজ হতে পারছে না কেন যেন! ওকে এভাবে দোনা মনা
করতে দেখে সৃজা চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
“ভাত দেব আর?”
“একটু।”
মলিন গলায় বলল ইহসান। কণ্ঠের স্থবিরতা সৃজার বোধগম্য হলো তবে প্রতিক্রিয়াহীনই রইল। থালায় খাবার তুলতে লাগল। ভাত, ডাল, লেবু, ভুনা মাংসের তরকারি দিলো। দিতে গিয়ে কিছুটা ফেলেও দিলো ওর শার্টে। দাগ বসে গেল মাংসের ঝোলের। গামছা ভিজিয়ে এনে সঙ্গে সঙ্গেই মুছে দিলো কিন্তু তাতে দাগটা আরো ছড়ে গেল। তা দেখে সৃজা বিনীত গলায় ইহসানকে বলল, “সরি, আমার খেয়াল করে দেওয়া উচিৎ ছিল।”
সৃজাকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল৷ ইহসান এতক্ষণের অস্বস্তিকর পরিবেশটা ঠিক করার সুযোগ পেয়ে গেল৷ গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, “তোর খেয়াল সবসময়ই কী অন্য কোথাও থাকে? সামান্য তরকারিও দিতে শিখিসনি!”
“আমি সব ভালোভাবে শিখে নেব।”
কথাটা আদতে স্বাভাবিক শোনালেও সৃজার কণ্ঠে অদ্ভুত কিছু একটা ছিল যাতে ইহসান ওর কণ্ঠস্বর শুনে অসহায় নজরে তাকাল। আর কতদিন এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ওকে? আগের সৃজাকে সে কীভাবে পাবে? যে খুনসুটি আর অবান্তর, মিষ্টি ঝগড়া-অভিমানে বারবার নিজের প্রেমে ফেলতো? ইহসান শাণ ধরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোনোমতে থালার খাবারটুকু শেষ করলো। সৃজা এরপর চুপচাপ সব ধুয়েমুছে, গোছগাছ করে রাখতে নিচে চলে গেল। ইহসান বারান্দার খোলা হাওয়ায় গিয়ে বসলো। রশিদকে একটা ফোন দিয়ে আগামী দিনের স্ক্যাজিউল ঠিক করে রাখলো। সেইসাথে ইনজানের ফ্ল্যাটে খাবার আর ঔষধ দিয়ে আসার নির্দেশ দিতেও ভুলল না। রশিদের এতকথা মনে থাকে না, তাই সে সব নোট করে রাখলো। ইহসান কাজের কথা সেরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর রশিদকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যখন ফ্ল্যাটে ছিলাম তখন সৃজা তোমাকে দিনে কতবার ফোন করে আমার খোঁজ চেয়েছে?”
মাসখানিক আগের কথা, স্যার এসব জিজ্ঞেস করছে কেন? রশিদ একটু মনে করার চেষ্টা করে এরপর বলল, “ডেইলি আট-দশবার করে ফোন করে আপনার খোঁজ চাইতো। চারদিন তো রেস্তোরাঁতেও আইসা গেসিল।”
“তখন কী কান্নাকাটি করেছিল?”
“কান্নাকাটি করতো, কিন্তু আমাদের সামনে না। বাড়ি থেকেই কান্নাকাটি শেষ করে চোখমুখ ফুলিয়ে আসতো। অসহায় ভাব থাকতো চেহারায়।”
“ওকে, ফোন রাখো।”
নিচ থেকে ফিরে সৃজা ঘরে পা রাখতেই একটান খেল হাতে। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল ও ইহসানের বুকে। পরক্ষণেই পিঠ ঠেকল দরজায়। সিঁটকিনি আটকাতে আটকাতে ইহসান সৃজার গালে ঠোঁট বসিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল, “সেদিন থাপ্পড় মেরেছিলাম, লেগেছিল তোর?”
মাস পেরিয়ে গেছে, এতদিনে এসে এসব কথা তুলছে ইহসান? আশ্চার্যান্বিত হলেও বুঝতে না দিয়ে সৃজা বলল, “না লাগেনি।”
“সত্যি?”
“হুম।”
“রাগ করে আছিস?”
সৃজা সহজ গলায় জবাব দিলো, “এটা তো আমারই তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, তুমি কী রেগে আছ আমার উপর?”
“তোর উপর রাগব আমি?”
সৃজা মলিন হাসলো, “সেদিন তো এমনি বেরিয়ে যাওনি, গেছো আমারই জন্য! তবে বলা হয়নি যেটা, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিইনি। ওটা আমি পেয়েছিলাম সোফার নিচে ঝাঁট দিতে গিয়ে। বাতিল ভেবে ফেলেই দিচ্ছিলাম, পরে ভাবলাম তোমার দরকারি কোনো ছবি…তাই একটু অতি আগ্রহী হয়ে গেছিলাম। সরি আমি আবারো…”
“এতবার সরি বলতে হবে না।”
বলে ওকে বুকে টেনে শুয়ে পড়ল ইহসান। চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে অস্ফুটস্বরে বলল, “তোকে ছাড়া এতগুলো দিন কীভাবে কাটিয়েছি জানিস?”
সৃজা নিরুত্তর রইল। জানার আগ্রহ দেখাল না নিজে থেকে। অভিমান কমেনি এখনো ওর। ইহসান উত্তর না পেয়ে নিজেই মুখ গোঁজ করে বলল, “খুব, খুব খারাপ কেটেছে।”
সৃজা ইতোমধ্যেই সরে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু ইহসান দিলো না। দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, “আজ দূরে সরিস না প্লিজ। একটু আমার বুকে ঘুমা। অবশ্য আজ লাফালেও কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না তোর। এভাবেই ধরে রাখব।”
শীতলতা কাটেনি সৃজার, কিছু বলেওনি। তবুও ইহসান কিছুটা জোর খাটিয়েই ওর কপালে চুমু খেল সময় নিয়ে। এরপর বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। এতদিন সে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমাবে সে শান্তিতে, প্রশান্তিতে। শেষরাতে সৃজা ঘুমন্ত ইহসানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, “তোমার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনে এক নতুন আলো এসেছে—একটা ছোট্ট খুশি, যে আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ সেই খুশির খবর থেকে আমি তোমাকে বঞ্চিত করেছি, করছি। খবরটা আমি তোমাকে জানাইনি, এত সহজে জানাবও না। কারণ আমি প্র’তিশোধ নিতে শিখে গেছি। কারণ তুমি আমাকে যে কষ্টটা দিয়েছ, সেই ব্যথা এখনও সারেনি!”সৃজার মনে হলো ও দমবন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। বহুকষ্টে
নিজের হাসি আটকালো ও। মুখ নামিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিয়ে উল্টাপাল্টা বলা আটকাল। ঔষধের প্রভাব থাকায় সহজেই ঘুম ভাঙল না ইহসানের। সৃজা সাবধানে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে সেখানেও একটা চুমু খেল, “এমিলি ইয়াসমিনের এই ছেলেটা
পাগল দেখছি!”
অগোচরে ইহসানের উপর থেকে রাগ কমালেও
সৃজা ওর সাথে শীতল সম্পর্কটা বজায় রাখলো প্রায় মাসখানিকের মতো। এই দিনগুলোতে সৃজা ওর অনুমতি সহিত সব করতে লাগল। ঘর গোছানো, ধোয়া-মোছা, বইপত্র ধরা, জামাকাপড় ধরা, আলমারি গোছানো এমনকি বারান্দায় পর্যন্ত ইহসানের অনুমতি নিয়ে যেতে লাগল। বাড়িতে না থাকলে ফোন করে অনুমতি চাইতো। কী
বাজার হবে, কী রান্না হবে এসবেও ছাড় দিলো না সৃজা, সেসবেও ইহসানের অনুমতি নিতো।
ইহসান ওর এই আচরণে প্রচন্ড তিতি বিরক্ত হয়ে গেল ভেতরে ভেতরে। অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে গেল। সে রাগের বশে কী এমন বলেছে, তাতে এই মেয়ে এমন করছে! রাগে ওর হাত-পা, মুখ লাল হয়ে যেতো। সৃজা দেখেও না দেখার ভান করতো। কেন দেখবে সে? কেন? ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইহসান যা করেছে, বলেছে সৃজা কস্মিনকালেও আশা করেনি তা। ও সবসময় চেয়েছে সবকিছু খোলা বইয়ের মতো, পরিষ্কার! সেখানে কারোর পার্সোনাল স্পেস থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা শান্তভাবে না বুঝিয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মতো কদর্য কাজ করবে কেন? তাছাড়া ওর অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে একেকটা দিন সৃজা কীভাবে কাটিয়েছে, কী কী অপমান, অপবাদ আর লাঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ওকে জানে কী এই লোক? বিয়ের এই এতগুলো মাসেও যেখানে আজিজ শেখ ওকে কখনো সামনা-সামনি কিছু বলার সাহস করেনি, সেই লোক ওর অসুস্থ বাবা, মৃত মা’কে তুলে পর্যন্ত কথা বলেছে। আর্থিক অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করেছে, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, লোভী বলেছে ওকে।জানে কী ইহসান? কতটুকু দুর্বিষহ যন্ত্রণায় সৃজা কাটিয়েছে গত হয়ে যাওয়া দিনগুলো? না, জানে না। তাই এটুকু শাস্তি ওর প্রাপ্য!
ইদানীং ইস্মির ঘুম প্রকট হয়েছে। যখন তখন মেয়েটার ঘুম পায়, দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে চায়। সন্ধ্যার একটু পরপরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। রাতে আর খায় না। জোর করে খেতে গেলে বমি হয়ে যায়। ইজহান এ বিষয়টা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে থাকে, তবে বউয়ের কষ্ট বুঝে সে রাগ করতে পারে না। আজও অফিস থেকে ফিরে দেখল তার বউ ঘুমাচ্ছে। ইজহান কিছুক্ষণ অভিমান নিয়ে বসে থেকে এরপর জামাকাপড় ছেড়েছে। সময় নিয়ে গোসল সেরেছে। পেটে ক্ষিধে থাকায় মকবুলকে ডাকিয়ে খাবারদাবার এনে নিজের হাতে মেখেই ভাত খেয়েছে।
দু’বার গলায় ভাতও আটকেছে। খুকখুক করে কেশেছে, এরপর নিজেই পানি নিয়ে খেয়েছে!
তবুও ঘুমন্ত ইস্মিতাকে সে ডাকেনি। খেয়ে দেয়ে ইস্মিতা রাতের ঔষধ খেয়েছে কি-না সেটা চেক করেছে, বারান্দার শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করে ড্রয়ারে তুলে রেখেছে। এরপর মিজুকে ফোন করে কতক্ষণ বকাঝকা করেছে ভার মনটাকে সতেজ করার জন্য! ওদিকে বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে থাকা মিজু ফোনের ওপাশে চুপচাপ স্যারের বকাঝকা গিলেছে। সে জানে, তার স্যারের মাথায় গন্ডগোল আছে! মিজুকে সাইজ করে মনের ভার একটু কমে যেতেই ইজহান বিছানায় ইস্মির পাশে এসে শুয়েছে। ওকে কাছে না টেনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ওকে জড়িয়ে শুয়েছে। রুক্ষ হাত বাড়িয়ে চুলে বিলি কেটেছে, একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখেছে আগের চেয়েও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠা ইস্মিতাকে।
কিন্তু যখনই উঁচু হয়ে থাকা ফর্সা উদরে চোখ গেল, তখনই গলা শুকিয়ে অস্থির হয়ে গেল ভেতরটা! বারবার চোখ সেদিকেই চলে যেতে লাগল ইজহানের। চেয়েও নজরলে শাসন করতে পারল না সে! ইচ্ছে করল ঐ সুন্দর পেটে আগের মতো মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে, মুখ ডুবিয়ে চুমু খেতে। কিন্তু একটা কারণেই সে তা করতে পারছে না। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা তার শূন্য, একবার যদি আদর শুরু করলে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে ইজহান। তাতে বাচ্চার কম, ইস্মিতারই যদি কিছু হয়ে যায়? মূলত এই ভয়েই ইজহান নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু এই মাঝরাতে, বউ বুকে নিয়ে তার সুধাময়ী রুপের নেশা কাটানো যে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে না পোড়ার বাহানা করা, তা উপলব্ধি হতেই পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে ইজহান ইস্মিতাকে ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে।
তার কাছে ইস্মিতা পুরোই একটা আদর, ভালোবাসা। অনেক মান-অভিমানের পর মেয়েরুপে একটা মা পাবার লোভে বাচ্চাটা রাখতে কোনো ঝামেলা করেনি সে! আর তো কয়েকটা মাস! এরমধ্যে কোনো ভুলচুক করে আবারো কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে চায় না সে। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই আবারো পাশ ফিরে ইস্মিতার মুখোমুখি হয়ে শুলো। আস্তেধীরে হাতটা রাখলো ফোলা পেটে। এরপর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল! এরপর এক মুহূর্ত, দুই মুহুর্ত…এমনি করে কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই হঠাৎ কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকল। কিছু একটা নড়নচড়ন অনুভব করল, ধাক্কা দিলো তার হাতে! ইজহান সটান চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছুটা চিন্তিত হয়ে সে ইস্মিকে আলতো করে ডেকে ফিসফিস করে বলল, “ইস্মিতা, খারাপ লাগছে..উঠো তো…তোমার পেটে কি যেন লাফিয়ে উঠল টের পেলাম! উঠো দেখি… ”
বিচলিত কণ্ঠস্বর কানে বাজতেই ঘুম কেটে গেল ইস্মিতার। মুচকি হাসলো ও। ঘুমঘুম স্বরে বলল,
“হুম! আমিও আজ বিকেলেই টের পেলাম।”
“কী?”
“আপনার মা আমার পেটে নৃত্য করছে!”
ইজহানকে বিভ্রান্ত দেখালো। বিভ্রান্ত হয়ে একই বাক্য দ্বিতীয়বার বলল। একবার প্রশ্নবোধক আরেকবার বিস্ময়সূচক! পরপর লাফিয়ে উঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কান ঠেকাল ইস্মির পেটে। তখনি আবার পেটের ভেতর থাকা ছোট্ট মনুষ্য অবয়বটির তেজ টের পেল। একনাগাড়ে অনেকটা সময় সে মা’কে সে ভেতরে বসে আঘাত করতেই থাকলো। ইজহান হতবিহ্বল হয়ে কম্পিত স্বরে ওভাবেই ইস্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ব্যথা পাচ্ছ?”
ইস্মি এতক্ষণ চুপচাপ উপভোগ করছিল ব্যাপারটা। এবারে ওর হাসি পেল। ইজহানের চুল শক্ত করে টেনে ধরে বলল, “আমার আনন্দ হচ্ছে।”
“এটা তো মনে হচ্ছে ছেলে—এতজোরে কে কিক করে? মেয়েমানুষ হয় ভদ্র সভ্য, এরা এতজোরে কিক করবে না।”
ইস্মি হাসি চেপে বলল, “কেন আপনার কী হিংসা হচ্ছে আমি আব্বা বলে ডাকব কাউকে, তাই?”
ইজহান কথাটা এড়িয়ে গেল। মুখে আঁধার নেমে এলো ওর, “আমি মেয়ে চেয়েছিলাম ইস্মিতা!”
“ছেলে হলে কী কোলে নেবেন না?”
ইজহান রোষাগ্নি চোখে তাকাল, “না, আমি শুধু মেয়েকে নেব!”
“তাহলে মেয়ে হলে আমিও তাকে কোলে নেব না।”
ইজহাম রাগী গলায় বলল, “কেন তুমি আমার মাকে কোলে নেবে না? ও তো তোমার ভেতর থেকেই বেরুবে!”
“কেন আপনি আমার ছেলেকে কোলে নেবেন না? ও তো আমার পেট থেকেই বেরুবে!”
ইস্মি বাঁকা গলায় বলল। যুক্তিতে না পেরে এ পর্যায়ে ইজহান চুপ করে গেল। পেটে যেভাবে কিক কিক খেলা করছে এতে আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়াই সে নিশ্চিত, এটা তার মতোই কোনো ছেলে শিশু। কিন্তু সে তো তার মতো কোনো ছেলে চায় না! মায়ের মতো, ইস্মিতার মতো রসগোল্লা দেখতে মেয়ে চায়! ইজহানের মন খারাপ হয়ে গেল, আবার ইস্মির পেটে কান পেতে ওটাকে অনুভব করতেও ইচ্ছে করল! লোভ সংবরণ করতে না পেরে অবশেষে কান পাতলো ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে আর কেউ কিক করল না। ইজহান কিছুটা অবাক ও বিরক্তি নিয়ে বলল, “ওটা তো আর নড়ছে না।”
ইস্মি শক্ত মুখে বলল, “আপনার কথা শুনে ওর মন খারাপ হয়েছে, তাই নড়চড় বন্ধ!”
ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তিত হয়ে গেল। সে
কী এমন বলেছে যে ঐ পুঁচকা নড়চড় বন্ধ করে দিয়েছে? এ তো মহা জ্বালা! সে নিজেও তো ইস্মিকে এত জ্বালায় না। পুঁচকাটা কী নিজের বাপকে ট্যাকেল দেওয়ার চেষ্টা করছে নাকি? নাহ! এটাকেও ছোট থেকেই হাতে-কলমে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে সামলে রাখতে হবে, ইজহান কিছুতেই ইস্মিকে এই পুঁচকার সঙ্গে ভাগ করবে না, তবে মেয়ে হলে অন্য কথা! ইজহান কর্কশ কণ্ঠে বলল, “ছেলে এত খারাপ কেন?”
“ওর বাপ খারাপ তাই।”
“আমি খারাপ?”
“আপনি ভালো?”
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন শুনে ইজহান রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “তুমি কিন্তু খোঁচাচ্ছ আমাকে ইস্মিতা! অথচ সেদিনই বললে আমাকে কখনো খারাপ বলবে না, কারণ আমি খারাপই না। খারাপ হলে তোমার মতো ভালো মেয়ে কপালে জুটতো না।”
ইস্মি সিরিয়াস মুখে বলল, “আমার কোনো দোষ নেই, আমি এগুলো বলছি না। আপনার মেয়ে আমার মুখ দিয়ে বলাচ্ছে।”
“এক্ষুনি বললে ছেলে…”
“মেয়েও হতে পারে। আমি তো জানি না।”
ইস্মি সচেতন গলায় বলল। শুনে ইজহান ভাবুক চিত্তে মুখ ফসকে বলে ফেলল, “যদি দুটোই হয়, মিলেমিশে?”
“তাহলে ভালোই হয়। এদের আপনার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে আমি একটু আরাম করতে পারব। এমনিতে আপনি আমাকে যা জ্বালান, তখন আমার দল ভারী হবে। আমি শোধ নিতে পারব আপনার উপর। দুই পুঁচকা-পুঁচকি মিলে শায়েস্তা করবে আপনাকে।”
সূঁচালো সূঁচালো কথা উপহার দিলো ইস্মি ইজহানকে। এরপর মিটিমিটি হাসতে লাগল। ইজহান অন্ধকার মুখ করে ক্ষেপে গিয়ে বলল, “দল পাকানো হচ্ছে! আর আমাকে হাতকড়া পরানোর ধান্ধা! তুমি অনেক নিষ্ঠুর হয়ে গেছ ইস্মিতা! আমাকে আগের মতো ভালো… ”
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে দিলো না ইস্মি। কারণ জানে, ইজহান কী অভিযোগ করতে পারে! তাই সে সুযোগ না দিয়ে চট করে দু’হাত বাড়িয়ে গলা আঁকড়ে ধরল ইজহানের। চোখে চোখ রেখে বলল, “কাছে আসুন, আদর করে দিই।”
ইজহান বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে?”
“আপনার মেয়ে দেখছে ভেবে থেমে যাবেন!”
ইস্মি আলতো হাসি বিনিময় করে ঠোঁট বসাল ইজহানের বা-গালে, চোখের পাতায়। নরম স্পর্শে ইজহানের রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। চোখে ঘোর লেগে এলো। ধৈর্যচ্যুতি ঘটতেই সে তড়াক করে মুখ নামিয়ে আনলো ইস্মির গ্রীবাদেশে, হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা উদরে। ওখানে আগ্রাসী চুমু খেতে খেতে অস্ফুটস্বরে বলল, “ঐ পুঁচকাটাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে, নড়ছে না কেন ওটা..”
“আবার ভুল করছেন, পুঁচকিও হতে পারে…”
“যেটাই হোক, নড়বে না কেন ও, চুপচাপ বসে থাকতে তোমার পেটে এসেছে নাকি…”
ইস্মি গভীর চোখে তাকিয়ে রইল ভোল পাল্টানো পাগলের দিকে, সেভাবেই তার আদর অনুভব করতে লাগল!
বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছে৷ ঠান্ডা বাতাস আসছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে ইহসান। সামনে চার পদের তরকারি সাজিয়ে ভাত খেতে বসা ইহসান চোরাচোখে বারবার সৃজাকে দেখছে আর চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি লুকাচ্ছে!
ওর ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালদুটো টেনে ধরে শক্ত এক চুমু বসাতে, আগের মতো খুনসুটিতে মেতে উঠতে। কিন্তু সৃজার শীতল ব্যবহারে সহজ হতে পারছে না কেন যেন! ওকে এভাবে দোনা মনা
করতে দেখে সৃজা চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
“ভাত দেব আর?”
“একটু।”
মলিন গলায় বলল ইহসান। কণ্ঠের স্থবিরতা সৃজার বোধগম্য হলো তবে প্রতিক্রিয়াহীনই রইল। থালায় খাবার তুলতে লাগল। ভাত, ডাল, লেবু, ভুনা মাংসের তরকারি দিলো। দিতে গিয়ে কিছুটা ফেলেও দিলো ওর শার্টে। দাগ বসে গেল মাংসের ঝোলের। গামছা ভিজিয়ে এনে সঙ্গে সঙ্গেই মুছে দিলো কিন্তু তাতে দাগটা আরো ছড়ে গেল। তা দেখে সৃজা বিনীত গলায় ইহসানকে বলল, “সরি, আমার খেয়াল করে দেওয়া উচিৎ ছিল।”
সৃজাকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল৷ ইহসান এতক্ষণের অস্বস্তিকর পরিবেশটা ঠিক করার সুযোগ পেয়ে গেল৷ গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, “তোর খেয়াল সবসময়ই কী অন্য কোথাও থাকে? সামান্য তরকারিও দিতে শিখিসনি!”
“আমি সব ভালোভাবে শিখে নেব।”
কথাটা আদতে স্বাভাবিক শোনালেও সৃজার কণ্ঠে অদ্ভুত কিছু একটা ছিল যাতে ইহসান ওর কণ্ঠস্বর শুনে অসহায় নজরে তাকাল। আর কতদিন এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ওকে? আগের সৃজাকে সে কীভাবে পাবে? যে খুনসুটি আর অবান্তর, মিষ্টি ঝগড়া-অভিমানে বারবার নিজের প্রেমে ফেলতো? ইহসান শাণ ধরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোনোমতে থালার খাবারটুকু শেষ করলো। সৃজা
এরপর চুপচাপ সব ধুয়েমুছে, গোছগাছ করে রাখতে নিচে চলে গেল। ইহসান বারান্দার খোলা হাওয়ায় গিয়ে বসলো। রশিদকে একটা ফোন দিয়ে আগামী দিনের স্ক্যাজিউল ঠিক করে রাখলো। সেইসাথে ইনজানের ফ্ল্যাটে খাবার আর ঔষধ দিয়ে আসার নির্দেশ দিতেও ভুলল না। রশিদের এতকথা মনে থাকে না, তাই সে সব নোট করে রাখলো। ইহসান কাজের কথা সেরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর রশিদকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যখন ফ্ল্যাটে ছিলাম তখন সৃজা তোমাকে দিনে কতবার ফোন করে আমার খোঁজ চেয়েছে?”
মাসখানিক আগের কথা, স্যার এসব জিজ্ঞেস করছে কেন? রশিদ একটু মনে করার চেষ্টা করে এরপর বলল, “ডেইলি আট-দশবার করে ফোন করে আপনার খোঁজ চাইতো। চারদিন তো রেস্তোরাঁতেও আইসা গেসিল।”
“তখন কী কান্নাকাটি করেছিল?”
“কান্নাকাটি করতো, কিন্তু আমাদের সামনে না। বাড়ি থেকেই কান্নাকাটি শেষ করে চোখমুখ ফুলিয়ে আসতো। অসহায় ভাব থাকতো চেহারায়।”
“ওকে, ফোন রাখো।”
নিচ থেকে ফিরে সৃজা ঘরে পা রাখতেই একটান খেল হাতে। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল ও ইহসানের বুকে। পরক্ষণেই পিঠ ঠেকল দরজায়। সিঁটকিনি আটকাতে আটকাতে ইহসান সৃজার গালে ঠোঁট বসিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল, “সেদিন থাপ্পড় মেরেছিলাম, লেগেছিল তোর?”
মাস পেরিয়ে গেছে, এতদিনে এসে এসব কথা তুলছে ইহসান? আশ্চার্যান্বিত হলেও বুঝতে না দিয়ে সৃজা বলল, “না লাগেনি।”
“সত্যি?”
“হুম।”
“রাগ করে আছিস?”
সৃজা সহজ গলায় জবাব দিলো, “এটা তো আমারই তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, তুমি কী রেগে আছ আমার উপর?”
“তোর উপর রাগব আমি?”
সৃজা মলিন হাসলো, “সেদিন তো এমনি বেরিয়ে যাওনি, গেছো আমারই জন্য! তবে বলা হয়নি যেটা, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিইনি। ওটা আমি পেয়েছিলাম সোফার নিচে ঝাঁট দিতে গিয়ে। বাতিল ভেবে ফেলেই দিচ্ছিলাম, পরে ভাবলাম তোমার দরকারি কোনো ছবি…তাই একটু অতি আগ্রহী হয়ে গেছিলাম। সরি আমি আবারো…”
“এতবার সরি বলতে হবে না।”
বলে ওকে বুকে টেনে শুয়ে পড়ল ইহসান। চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে অস্ফুটস্বরে বলল, “তোকে ছাড়া এতগুলো দিন কীভাবে কাটিয়েছি জানিস?”
সৃজা নিরুত্তর রইল। জানার আগ্রহ দেখাল না নিজে থেকে। অভিমান কমেনি এখনো ওর। ইহসান উত্তর না পেয়ে নিজেই মুখ গোঁজ করে বলল, “খুব, খুব খারাপ কেটেছে।”
সৃজা ইতোমধ্যেই সরে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু ইহসান দিলো না। দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, “আজ দূরে সরিস না প্লিজ। একটু আমার বুকে ঘুমা। অবশ্য আজ লাফালেও কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না তোর। এভাবেই ধরে রাখব।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৯
শীতলতা কাটেনি সৃজার, কিছু বলেওনি। তবুও ইহসান কিছুটা জোর খাটিয়েই ওর কপালে চুমু খেল সময় নিয়ে। এরপর বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। এতদিন সে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমাবে সে শান্তিতে, প্রশান্তিতে। শেষরাতে সৃজা ঘুমন্ত ইহসানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, “তোমার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনে এক নতুন আলো এসেছে—একটা ছোট্ট খুশি, যে আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ সেই খুশির খবর থেকে আমি তোমাকে বঞ্চিত করেছি, করছি। খবরটা আমি তোমাকে জানাইনি, এত সহজে জানাবও না। কারণ আমি প্র’তিশোধ নিতে শিখে গেছি। কারণ তুমি আমাকে যে কষ্টটা দিয়েছ, সেই ব্যথা এখনও সারেনি!”