অশ্রুবন্দি পর্ব ৪২
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসানের গলা ধরে এলো, এলোমেলো হয়ে এলো
শব্দগুচ্ছ। তীব্র বিস্ময়ে ও কম্পিত দু’হাতে সৃজার মুখটা আগলে নিয়ে বিচলিত চোখে তাকাল। বিস্মিত, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, “বা বাচ্চা—আমার? আমি বাবা হচ্ছি?”
সৃজা মুখ নামিয়ে রাখে। চোখ তুলে তাকায় না। ইহসান
ওকে নিয়ে ফাঁকা করিডোরে চলে আসে। উৎকন্ঠিত, উত্তেজিত অবস্থায় আবারো জিজ্ঞেস করে বাবা হওয়ার খবরটা সত্যি কিনা! সৃজা নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে আসা কান্নাগুলো খুব করে লুকাতে চায়। রাগ, অভিমান করে সে ঠিক করেছিল বাবা হওয়ার সুসংবাদ নিজ মুখে দেবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের কথা থেকে সরে এসে নিজেই বলে দিলো। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে— সৃজার অস্থির লাগছে ভীষণ! অবচেতন মন বলছে, ইহসানের থেকে তাঁর সন্তানদের খবর লুকাচ্ছে বলে, তার থেকে বাবা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছে সৃষ্টিকর্তা! ওর বুকের ভেতরটা ভয়ে জমে আছে আব্বুর জন্য! সেই ভয় থেকেই সৃজা অস্ফুটস্বরে কোনোমতে বলে, “টু-ইন!”
এতক্ষণ জবাব না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে যাওয়া অসহ্য ইহসান থমকায়। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে পরপর সৃজাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়! অস্থিরতার দরুণ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে। বিস্ময়ে কতক্ষণ কথাই বলতে পারে না সে। নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজাকে সে অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, “কবে জানলি?”
সৃজা জবাব দেয় না। ইহসানের রাগ লাগে খুব! অস্থিরতায় ছেয়ে যায় ভেতরটা। রাগান্বিত ভঙ্গিতে উঠে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “বলবি না?”
সৃজা ঠোঁট কামড়ে অস্থিরতা লুকোয়। কপালের ঘাম মুছে ওড়না দিয়ে। ঢোক গিলে সচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “রাগ করে যে ক’দিন বাইরে ছিলে,
তার মধ্যে একদিন।”
“এটা কী আমার শাস্তি ছিল?”
“প্রাপ্য ছিল না?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সৃজা অশ্রুসিক্ত চোখের কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে কথাটুকু বলে। ইহসান জবাব না দিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সৃজার পেটের দিকে। বোঝা যাচ্ছে না…একটু কি ফোলা? হ্যাঁ, ফোলাই তো! ওখানে তাঁর বাচ্চারা আছে! এটা কী করে ফেলল সৃজা? মেয়েটার এত সাহস, ও একমাস যাবৎ গোপন রেখেছে কথাটা! আর ও কিছু বুঝতেই পারেনি! ইহসানের বুকের ভেতরটা দ্রিমদ্রিম শব্দে কাঁপতে থাকে। সৃজাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে বলে, ‘প্রাপ্য ছিলো। আমি তোকে ভাবনার চেয়েও বেশি আঘাত করেছিলাম। নাহ, তুই ঠিক করেছিস। আমি যোগ্য না এই চমকপ্রদ খবরটা শোনার।’ কিন্তু মুখে বলে, “এত কেন জেদী তুই? আমি কোনমুখে নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব সৃজা?”
মেয়েটা ভেজা গাল মুছে এ পর্যায়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠে, “আব্বু বাঁচবে তো? ডাক্তার কী বলল? আমাকে বলো, আমি তোমায় ক্ষমা করে দেব, আচ্ছা দিলাম মাফ করে। তুমিও আমায় মাফ করে দাও বাচ্চাদের কথাটা গোপন করার জন্য। কিন্তু হ্যাঁ, ওরা যে টুইন, এটা কিন্তু আমি শুধু তোমাকেই বলেছি। বাকিরা জানে না। তুমি রাগ করে থাকলে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবে, তখন যদি আব্বুর কিছু…”
সৃজাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেয় ইহসান, কপালে চুমু খেয়ে স্থবির কণ্ঠে বলে, “উল্টাপাল্টা বকিস না, কুসংস্কার মাথায় ঢুকেছে তোর! সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তাররা চেষ্টা করছে তো…”
সৃজা অবুঝের মতো জানতে চায়, “সত্যি ঠিক হবে?”
“হুঁ।”
ছোট করে জবাব দিয়ে ইহসান মনে মনে সাহস হারায়। সে মিথ্যে বলছে সৃজাকে, আঙ্কেলের অবস্থা ঠিক নেই, কিছুই ঠিক নেই। কিন্তু সে সত্যিটা বলতে পারছে না। সৃজা সহ্য করতে পারবে না। এমনিতেই কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা করছে! ইহসানের একটু স্পেস দরকার, ফাঁকা জায়গা দরকার, একা সময় কাটানো দরকার! এখনো সবটা হজম হচ্ছে না ওর। ভেতরটা পুড়ছে অসহ্য যন্ত্রণায়! আচ্ছা, সে কী ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেনি সৃজার সাথে? কথা বলে সব মিটমাট না করার কী এটাই শাস্তি? এই বুক পোড়া যন্ত্রণা?
মেয়েটা নিজের গর্ভে ধারণ করেছে ইহসানের রক্ত, ওর সন্তান… সে বাবা হতে চলেছে, অথচ! অদৃষ্টের উপর রাগ হলো ভীষণ ইহসানের! শরীরটা ক্রোধে কাঁপছে! উফ, খোদা! সে কাপুরুষের মতো একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে? অথচ সেই মেয়েটা সৃজা! যাকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে! কীভাবে হাত তুলেছিল সে মেয়েটার উপর? কোন কাপুরুষের ভূতে ধরেছিল? বাচ্চাটাও নিশ্চয় অনুভব করেছে, বাবা তার মাকে মেরেছে? ইহসান ওয়াশরুমের দেয়ালে মাথা ঠুকে। ভুলতেই পারছে না সে, চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার সেদিনের রাগারাগির ব্যাপারগুলো! গায়ে হাত তোলা—নয় দিন বাড়ি না থাকা, নিজের একটা খোঁজ না দেওয়া, অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হলেও একবার মুখ ফুটে না বলা, মাফ না চাওয়া! মেয়েটাকে কতটুকু মানসিক চাপ দিয়েছে নিজেকে নিঁখোজ করে!
আহ! চরিত্রের এ অধঃপতনে সে কীভাবে গর্বিত পিতা বলে দাবি করবে নিজেকে? কোন মুখে জবাবদিহি চাইবে সৃজার কাছে, ‘এক মাস পর কেন আমাকে আমার বাচ্চার খবর দিলি? এই সাহস তোকে কে দিলো?’ প্রশ্নগুলো করার মুখই তো নেই ওর! একরাশ তিক্ততা ইহসানকে গ্রাস করে, ওর বুক ঝাঁঝরা করতে থাকে একটু একটু করে! ইস্মিতার মা হবে শোনার পর থেকে ইজহানের মতো বর্বরটা যেখানে মেয়েটার গায়ে হাত তুলেনি, সেখানে সে সৃজাকে… আচ্ছা, সে কী ইজহানের থেকেও অধম? ভাইকে লুজার বলে, সে নিজেও কী লুজারের চেয়ে কম কিছু? মনে মনে নিজেকে না চাইতেও তুলনা করে ফেলে ইহসান! নিজের চিরাচরিত ভাবনা, ‘বউ হলো ফুল, যে ঝরে পড়ে গেলেও মাটি থেকে তুলে যত্ন করে বুকপকেটে রাখতে হয়,’ কথাটা একবারও ভাবল না কেন সে? অপরাধবোধে ক্লিষ্ট হয়ে মুঠোবন্দি হাতে পাশের দেয়ালে পরপর কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেয় সে। আঘাতে শরীরের প্রতিটা রোমকূপে বিষাক্ত ব্যথা ছড়িয়ে গেলেও ইহসান টের পায়, গ্লানির ব্যথাটুকু এর কাছে কিছুই না!
বাইরে থেকে রশিদ ডাকছে, অনেকক্ষণ যাবৎ। এখন কারো সঙ্গে কথা বলার মতো ইচ্ছা হচ্ছে না ইহসানের। কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু… পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। ওর কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব, একটা পরিবারের দায়িত্ব! যে পরিবারটাকে ও খুব ভালোবাসে, নিজের পরিবারের থেকেও বেশি! সৃজাটার কান্না, মলিন মুখ সে আর নিতে পারছে না। অথচ সামনে গেলেই দেখতে হবে! চোখেমুখে পানি ছিঁটিয়ে, বুক ভরে শ্বাস টানে সে, তবুও সব দমবন্ধ লাগে! অস্থির মন-মস্তিষ্কে সে বেরিয়ে আসে বাইরে। রশিদ ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে, ইহসান প্রশ্নোক্ত চোখে চাইতেই নিচু স্বরে বলে, “অবস্থা তো ভালো বলে না স্যার, তেমন আশা দিতেছে না…”
“আঙ্কেলকে কী এখান থেকে অন্য কোথাও রেফার করব? খোঁজ নাও তো একটু। আমার মাথায় কিছু আসছে না!”
“কী বলেন স্যার? আর কোথায় নিবেন! এটাই তো শহরের বেস্ট হাসপাতাল! যথেষ্ট অভিজ্ঞ, নামকরা ডাক্তাররা সব চেষ্টা করতেছে… তাছাড়া এখান থেকে অন্য কোথাও নিতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে, এই সময়ে টানা-হেঁচড়া ঠিক হবে না।”
ইহসান কিছু ভাবতে পারে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। বেরিয়ে আসতে গিয়ে কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়ে, ঠান্ডা গলায় রশিদকে বলে, “খবর শুনেছ রশিদ?”
রশিদ একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, কী বলবে স্যার? সে কী ভুল কিছু করেছে কাজে? সবসময় এভাবে ঠান্ডা গলায়ই তো বাঁশগুলো দেয় ওকে। ও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়লেও মুখে হাসি টেনে বলে, “কী খবর স্যার?”
“আমি বাবা হচ্ছি! ভাবতে পারো আমার মতো একটা লুজার বাবা হচ্ছে?”
প্রথম বাক্যটা শুনে রশিদের মুখে হাসি ফুটেছিল, শুভকামনা জানাতেই যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ বাক্যটা ওকে দ্বিধায় ফেলে দিলো। ‘লুজার’ মানে? এটা কী স্যার নিজেকে বলল? সবসময় তো ইজহান স্যারকে গালাগাল করে ‘লুজার’ বলে! আজ হঠাৎ নিজেকে বলল যে, স্যার কী খুশি না বাবা হবে শুনে? আশ্চর্য! রশিদ কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহস পেল না স্যারের রক্তবর্ণ চোখ দেখে, থেমে গেল!
হাই ডিপেডেন্সি ইউনিটে রাখা হয়েছে নাইমুর সাহেবকে। কিন্তু উন্নতির লক্ষ্মণ দেখা তো দেয়ই না, উল্টো অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে সময়ের এক একটি কাঁটা। অক্সিজেন স্যাচুরেশন অস্বাভাবিক! রক্তে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নেই। অনেকগুলো টেস্ট দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টগুলো নিয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে ইহসানকে। একবার দশতলায়, একবার তিনতলায় একবার ডিসপেনসারিতে! এরমধ্যে সামনে পেলেই সৃজা বারবার ওর সঙ্গে যাওয়ার জেদ ধরছে! দুশ্চিন্তায় মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ! একটু আগেই বমি করে ভাসিয়েছে, এ অবস্থায় ইহসান পারলে ওকেই এডমিট করিয়ে দেয়!
সেখানে এ অবস্থায় মেয়েটা ছুটোছুটি করার জেদ ধরছে, বিকট একটা ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলো ইহসান। নীলু বেগম এসে বকলোও খুব, প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল সৃজা, এলিজা এসে বোঝাল ওকে! ইহসান সামনে থেকে চলে গেল। এলিভেটরে উঠে খারাপ রিপোর্টগুলোর দিকে তাকিয়ে শুধু দোয়া করল, আঙ্কেল যাতে ঠিক হয়ে যায়, অন্তত তাঁর মেয়েদুটোর জন্য হলেও! কিন্তু তার সেই প্রার্থনা টিকলো না। ফজরের কিছুটা সময় পরে শরীর ও আত্মার লড়াইয়ে আত্মাকে জিতিয়ে দিয়ে নাইমুর সাহেব পরাজয় বরণ করলেন। কার্ডিয়াক মনিটরের স্ক্রিনে থেমে থেমে হার্টবিট তুলতে থাকা ‘বিপ বিপ’ থেমে একনাগাড়ে ‘বিপপপপপপপ’ শব্দ শোনা গেল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন সেখানে শূন্য দেখাল, হার্ট রেট সম্পূর্ণ সমতল দেখাল। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘নেই’ বুঝিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন আরো কিছুক্ষণ পর, এসেই সৃজা-এলিজার দিকে তাকিয়ে গোপন শ্বাস ফেলে ইহসানকেই দুঃসংবাদটা দিলেন, “সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ পেশেন্টকে তাঁর কাছেই নিয়ে গেছেন। উই আর সরি…”
নীলু বেগম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে একসময় চিৎকার করে ওঠেন। এলিজা অবিশ্বাস্য চোখে একবার কর্তব্যরত চিকিৎসক দিকে তাকিয়ে এরপর ছুটে গিয়ে ফুপিকে ধরে, ওর বিশ্বাসই হয় না আব্বু আর নেই। দু’দিন আগেই যে লোকটা সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করেছে হঠাৎ করে কেন চলে যাবে সে? সৃষ্টিকর্তা এতটাও নিষ্ঠুর নয়। এলিজার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠে, ও প্রাণপণে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। গলা রোধ হয়ে বেরুতে চাওয়া কান্নাটুকু গিলে নেয়। ফুপিকে বুকে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। পাশের কেবিনে থাকা পেশেন্টের বাড়ির মানুষগুলো বড্ড অমায়িক! গতকাল থেকেই খোঁজখবর রেখেছিল ওদের। সেভাবেই একটু আলাপ হয়েছিল। নাইমুর সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে তারা একপ্রকার ছুটেই এসেছে। মহিলাদের মধ্যে দু’জন এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়, আপা আপা বলে নীলু বেগমকে সান্ত্বনা দেয়, এলিজাকে মৃত্যুর মমার্থ বোঝায়! কিন্তু এলিজার কানে সেসব কিছুই ঢোকে না, বরং শক্ত থাকার চেষ্টা করা মেয়েটা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে। কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইহসানের মেয়েটাকে থাপ্পড় দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “তুই কাঁদলে কী করে হবে এলিজ? তোর বোনকে কে সামলাবে? ও দেখ কাঠ হয়ে আছে! আমার তো এত সাহস হচ্ছে না ওকে সামলানোর!”
করুণ চোখজোড়া সৃজার উপর পড়তেই অস্থির লাগে ওর ভীষণ! অভিমানী মেয়েটা আগের মতোই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে! ওর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিজোড়া কাচের দরজায়, যেটা দিয়ে ভেতরের কার্যক্রম দেখছে। ভেতরে, সিটে শোয়া সাদা চাদরে মুখ ঢেকে দেওয়া লম্বাটে পুরুষটা, সম্পর্কে ওর জন্মদাতা! নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে আছে, চিরজীবনের মতো! সৃজার বুকটা ধক করে উঠে! আব্বু, আব্বু কী অবশেষে চলেই গেল ওদের একা রেখে? একবারও ভাবলো না ওদের কথা? ওরা কীভাবে থাকবে ভাবলো না একবারও? কিছু বলেও গেল না? মায়ের মতো নিষ্ঠুর হয়েই বিদায় নিলো? এসব দেখার জন্যই হাসপাতালে এনেছিল আব্বুকে? অথচ আব্বুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত লড়াই-ই না করেছে ওরা! মা’কে হারিয়ে সেই ছোট্ট বয়সেই সবকিছু বুঝতে শিখেছে, দায়িত্ব নিতে শিখেছে।
আবেগ বিসর্জন দিতে শিখেছে। কীভাবে সংসার চালাতে হয় শিখেছে। ওদের বয়সী অন্য সবাই যখন সুন্দর জামা-জুতো, খাবার-দাবার, সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে মেতে থেকেছে তখন তারা দু-বোন বাড়ি ভাড়ার টাকা আব্বুর চিকিৎসা-ওষুধের জন্য, বাজার করার জন্য, স্কুল-কলেজের ফি দেওয়ার জন্য টাকা বাঁচিয়েছে। বছর পার করেছে সস্তার জামা দিয়ে, জুতো ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে বছর পার করেছে। তাতেও কোনোদিন আফসোস করেনি। কারণ—একেবারে তো এতিম হয়ে যায়নি তারা, এখনো তো বাবা বেঁচে আছে। আব্বু বলে ডাকার মতো নিজের কেউ আছে! হোক না সে পঙ্গু, অচল! বাবা তো! মাথার উপর ছায়া তো!
ছায়ার নিচে থাকার লোভে তারা দু’বোন তো কোনোদিন একটা চকলেটের আবদারও করেনি আব্বুর কাছে, তাহলে কোন দোষে মানুষটা ওদের এতিম করে দিয়ে হারিয়ে গেল? আব্বুর দয়া হলো না ওদের উপর? সৃজার বড্ড অভিমান হয়, রাগ হয়। মুখ লাল হয়ে উঠে ওর। খরখরে শুকনো চোখ দুটো ভিজে আসে। বুকের ভেতর আগুনের উত্তাপ নিয়ে মেয়েটা মুখ বুজে রয়। ওর বুক ভেঙেচুরে আসে। অথচ গাল চকচক করছে যন্ত্রণা হয়ে ঝরে পড়া এক একটি অশ্রুবিন্দুতে! স্বচ্ছ কাচের দরজাটায় তাকাতে পারে না আর ও, চারদিক ঝাপসা লাগে। বুকের ভেতর সবকিছু খালি ঠেকে, পৃথিবী শূন্য মনে হয়। দাঁড়ানোর মতো শক্তি পায় না দু’পায়ে। ও ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে! কপালটা ঠুকে যায় স্টিলের চেয়ারটার কোণায়। ব্যথা পেয়েই যেন মেয়েটা হু হু করে কেঁদে উঠে!
ওয়ার্ড বয় কথা বলছিল ইহসানের সাথে, কিন্তু ওর মনোযোগ ছিল না সেদিকে। ব্যথিত দৃষ্টি শুধু সৃজার দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। দেখছিল মেয়েটার আমূল পরিবর্তন! এ পর্যায়ে দ্রুত কদমে ছুটে এসে আগলে ধরে ওকে। আর ও ধরতেই সৃজা ফুঁপিয়ে উঠে। অস্পষ্ট কণ্ঠে অভিযোগ তুলে, “আব্বু চলে গেল, কেন গেল? আম্মুও ছোটবেলায় ফেলে গেল! আমাদের তো কেউ নেই! তুমি তো বলেছিলে সব ঠিক আছে, তাহলে কেন গেল? আমার আব্বুকে এনে দাও…”
“হুঁশশ! এভাবে কাঁদে না, একদম না।”
ইহসান ওকে আষ্টেপৃষ্টে বুকে ঢুকিয়ে নেয়, জবাব দেওয়ার মতো ও শব্দ খুঁজে পায় না। কিন্তু হৃদয়ের দখলদারিনীর এ অবস্থা ওর মোটেও সহ্য হচ্ছে না। সব ফাঁকা ঠেকছে। ওকে একটু সামলানো দরকার! সে কোনোদিন কাউকে সান্ত্বনা দেয়নি, অভিজ্ঞতা নেই। কীভাবে সদ্য একজন বাবা হারা মেয়েকে বুঝ দেবে সে জানে না। তবুও বলে, ‘‘আমাদের সবাইকেই তো একদিন যেতে হবে, আগে- পরে, যে-কোনো সময়! মানুষ তো অমর নয়! আমিও একদিন যাব, তুইও যাবি। পরপারে আবার দেখা হবে আঙ্কেলের সাথে। এখন এভাবে কাঁদলে তোর যেমন ক্ষতি, তোর মধ্যে যে আছে তারও ক্ষতি। সেইসাথে আঙ্কেলও কষ্ট পাবে, মানুষটার রুহটাকে এভাবে কষ্ট দিস না সৃজা… আঙ্কেল তো জানে তার মেয়েরা তার জন্য কতটুকু কী করেছে, কত স্ট্রং!”
“কীসের স্ট্রং? হু? আব্বু ভুল জানে। আমি কোনোভাবেই স্ট্রং না, হতে পারবও না। আব্বু কেন আমাকে কিছু বলে গেল না, না বলে চলে গেল? আম্মুও এমন করেছে, কেন করে ওরা এরকম! এত নিষ্ঠুর কেন ওরা…না, আমি হতে পারব না স্ট্রং, তুমি আমার আব্বুকে এনে দাও…”
ক্রন্দনরত সৃজার গলায় তেজ, তবে তেজটুকু ঢাকা পড়েছে করুণ স্বরের নিচে। মেয়েটার চোখমুখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে, আগুনের মতো ঠেকছে ইহসানের হাতের তালুতে৷ ও ডানহাতে সৃজাকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে ওর এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে রুক্ষ স্বরে ছোটখাটো ধমক দেয়, “মার খাবি আমার হাতে? শক্ত মার দেব কিন্তু! থাম, এভাবে কাঁদতে নেই।”
কিন্তু কান্না থামে না সৃজার। বরং আরো বেড়ে যায়। ইহসানের হতাশ লাগে খুব, ও যথাসাধ্য বোঝানোর জন্য, চেষ্টা করে ওর কষ্টটুকু ভাগ করার জন্য! না পারতেই ধমকে থামাতে চায়, আচমকাই সৃজা শরীরের সমস্ত ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে একেবারে চুপ হয়ে যায়। ইহসান উৎকন্ঠা আর ভয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে সৃজাকে। পরপর তুলে গালে হালকা থাপ্পড় বসাতে বসাতে চিৎকার করে উঠে, “না না, চোখ বুজিস না। তাকা আমার দিকে, আমার দিকে তাকা, কিচ্ছু হয়নি। তাকা তুই৷ আমি আছি তো, তাকা বাবু…সিস্টার, ডাক্তার! উফ! কোথায় এরা? এই রশিদ কাউকে ডাকো না…”
ইহসান চেঁচিয়ে উঠে বলতে থাকে। কিন্তু সৃজা তাকায় না, তাকাতে পারে না। সেই শক্তিই নেই মেয়েটার মধ্যে। ও চোখ বুজে ফেলে। নিস্তেজ ভঙ্গিতে দুর্বল হাত ছেড়ে যায় ইহসানের শার্টের আস্তিন। করিডোরে থাকা ডাক্তারটা এখানে নেই, চলে গেছে একটু আগেই। রশিদ এদিকওদিক তাকিয়ে তাঁকে দেখতে পায় না। সে ছুটে যায় কাউকে ডাকতে। ততক্ষণে সৃজাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় ইহসান।
নীলু বেগমের অবস্থা ভালো নয়। ইহসান পাশের কেবিনের মহিলাগুলোকে অনুরোধ করে একটু তাঁদেরকে দেখতে বলে এলিজা, নীলু বেগমকে। ওরা ওকে আশ্বস্ত করে দেখবে বলে। ইহসান একটু স্বস্তি পায়। পাশ্ববর্তী একটি কেবিনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয় সৃজাকে। গতরাতেই কেবিনটা বুক করেছিল সে, এতগুলো মানুষ তো আর করিডোরে বসে থাকতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই এখানে আসেনি, ইহসানও জোর করেনি। খাবার আনিয়েছিল সে, সব বক্সে সেভাবেই পরে আছে। একটা লোকমাও কেউ মুখে তুলেনি, সৃজাকে জোর করে নীলু বেগম দু-লোকমা তুলে দিয়েছিল, বমি করে সেসবও বের করে দিয়েছে। ইহসানের কথাই শুনেনি।
রশিদ একজন মহিলা ডাক্তারকে নিয়ে এসেছে। তিনি সৃজার কন্ডিশন জেনে নিয়ে ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে জানালো, আকস্মিক বাবার মৃত্যু সংবাদ ওর মস্তিষ্ক নিতে পারেনি, যারজন্য এই অবস্থা! স্যালাইন আর সেডেটিভ দিয়ে রাখা হলো সৃজাকে। চিৎকার, কান্নাকাটি করলে বাচ্চাটার ক্ষতি হবে। আপাতত ঘুমে থাকুক। কোনো স্ট্রেস নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় নেই মেয়েটা। এদিকে ইহসানের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, হাসফাঁস লাগছে। এই অবস্থায় এই মেয়েকে এখানে রেখে সে কীভাবে যাবে? কার কাছে রেখে যাবে? নীলু বেগম তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না, একমাত্র ভাইয়ের শোকে তারই হার্ট-অ্যাটাকের অবস্থা! এলিজা পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে! শোকে তাপে একেকজনের নাজেহাল অবস্থা! ইহসান একা একা কীভাবে সামলাবে সবাইকে? ডেডবডি সামলানোর জন্য তার পাশে একটা মানুষও নেই। সব দায়িত্ব তার একার। আংকেলের মৃত্যুটা তার নিজের জন্যও কম ধাক্কার না। মানুষটাকে সে ভালো অবস্থা থেকে চেনে, অমায়িক লোক! হাসি ছাড়া, ‘বাবা’ ডাক ছাড়া কখনো কথাই বলেনি ওর সাথে। প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পরেও মাঝেমাঝে বলতো, ‘তোমার উপর অনেক ঋণ জমেছে আমার বাবা, আমার মেয়ে দুটোকে নিজের বোনের মতো দেখছ, পড়াচ্ছ। তোমার মিস. দেখলে কী বলতো জানো? পাগলটা আমার ছেলেই।’
অথচ আজ তাঁরই মৃত্যুর সাক্ষী হতে হলো! সেইসাথে তার ভঙ্গুর পরিবারটাকে সামলানোর দায়িত্বও ওর ঘাড়েই দিয়ে গেল! ইহসান কিছু বলার মতো জোর খুঁজে পায় না। শব্দ হাতিয়ে রশিদকে সে কোনোমতে বলে, ছাড়পত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে! সে একটু সৃজার পাশে বসবে! রশিদ বেরিয়ে যায়। ইহসান দরজাটা ভিড়িয়ে এসে বসে, একরাশ দুশ্চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে নির্ঘুম রাত্রি কাটানো সৃজার মলিন চেহারাটা এখন বিধস্ত দেখাচ্ছে। গর্ভে বাচ্চা, অথচ একফোঁটা পানিও পড়েনি মেয়েটার পেটে, এ অবস্থায় এতবড় একটা ধাক্কা… ইহসানের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়, বুকে চিনচিন ব্যথা করে!
বাইরে ভোর কাটছে। সূর্যের মিষ্টি আলো দেখা যাচ্ছে। ইহসান চিন্তা করে ভেবে পায় না কী করবে, বাড়িতে কাউকে বলা দরকার! সে কাকে ডাকবে? সালেহা বেগমকে? কিন্তু আজিজ শেখ তো আসতে দেবে না, উল্টো ঝামেলা করে গায়ে হাত তুলবে! ইমরান হাঁদাটাও বৌয়ের চ্যালা, এরা আসবে না। ইজহান লুফারটাকে বলবে ইস্মিতাকে একটু নিয়ে আসতে? কিন্তু মেয়েটাও তো এখন সুস্থ না…আচ্ছা সামলাতে তো পারবে সৃজাকে! পাশে বসে থাকতে পারবে তো! তাতেই চলবে! হন্তদন্ত হয়ে পকেট হাতড়ে ফোন বের করে ইহসান। ডায়াল লিস্ট থেকে খুঁজে বের করে ইজহানের ফোন নাম্বারটি, কল লাগানোর অনেকক্ষণ পর ওপাশ কেউ রিসিভ করে। ঘুম ঘুম রুক্ষ স্বর ভেসে আসে, “কে?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৪১
সৃজার ধরে রাখা হাতটা আলতো করে রেখে, চুলে হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু বসিয়ে ইহসান লাগোয়া বারান্দায় চলে আসে৷ যথাসম্ভব মেজাজ সামলে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়, “তোর শত্রু।”
ইজহান চমকে উঠলেও বুঝতে না দিয়ে বলে, “ও ভেড়া!
তো সকাল সকাল কী?”
“প্রয়োজনে।”
“ফাজলামো হচ্ছে? আমার কাছে তোর আবার কী প্রয়োজন?”
“ইস্মিতাকে।”