অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৩

অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া

সৃজার ধরে রাখা হাতটা আলতো করে রেখে, চুলে হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু বসিয়ে ইহসান লাগোয়া বারান্দায় চলে আসে৷ যথাসম্ভব মেজাজ সামলে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়, “তোর শত্রু।”
ইজহান চমকে উঠলেও বুঝতে না দিয়ে বলে, “ও ভেড়া!
তো সকাল সকাল কী?”
“প্রয়োজনে।”
“ফাজলামো হচ্ছে? আমার কাছে তোর আবার কী প্রয়োজন?”
“ইস্মিতাকে।”

ক্ষ্যাপাটে কণ্ঠস্বরের চেঁচানো শোনা গেল, “কীহ? আমার বউকে তোর দরকার? কু* বাচ্চা তোর ভাইয়ের বউ লাগে।”
জানা কথা, ইস্মিতার কথা শুনলে ইজহান ফালতু বকবক ঝাড়বে! তাই ওকে সে সুযোগ না দিয়েই ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমার শ্বশুরমশাই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল বাদ ফজর। এই মুহূর্তে পরিবারটার অবস্থা খুবই করুণ! সবাই শোকের ঘোরে আছে। এতগুলো মেয়েমানুষকে আমি কীভাবে সামলাব ভেবে কূল পাচ্ছি না, আর তো কেউ নেই, আমি তাই ইস্মিতার হেল্প চাচ্ছি…উনি এলে সামলাতে পারলে কিছুটা অন্তত সাহায্য হবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইজহান কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকে এরপর জোর গলায় বলে উঠল, “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুর্দা জান্নাতবাসী হোক। কিন্তু তুই ভাবলি কী করে, ইস্মিতার এ অবস্থায় আমি ওকে জার্নি করতে দেব?”
ধীর স্বরে বলল ইহসান, “তুই জাস্ট গাড়ি করে নিয়ে আসবি, রাস্তা ভালো। আধঘন্টা লাগবে বড়জোর!”
ইজহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর ক্যাটকেটে গলায় বলল, “তোর মতলব বুঝি না আমি? হেল্পের নাম করে ওকে খাটানোর ধান্ধা! এই, আমার বউকে কী বান্দি মনে হয় তোর যে…”
ইহসান কথাগুলো হজম করল অতিকষ্টে। ফেটে পড়া রাগ না দেখিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “দেখ, অহেতুক ঝগড়া করবি না। আমি এখন ঝগড়ার মুড়ে নেই।”
ইজহান থামলো ঠিকই, কিন্তু একটু পরেই বলল, “না না ওকে দেব না, মরা বাড়ি সামলানো ওর কাজ না।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল ইহসানের। বেজায় ক্ষেপে গেল সে। স্থান, কাল-পাত্র বিবেচনা না করেই মুখের লাগাম ছুটে গেল ওর, “আসলেই তুই একটা বাই*, শালা কু*, নূন্যতম কমনসেন্স নাই তোর, কোথায়, কখন, কী বলতে হয় এখনো শিখিস নাই? রিকশা দিয়ে আসতে বলেছি তোকে? হারামি! তোর এত্তবড় প্রাডো, রাস্তা দাপিয়ে বেড়াস ওটা কীসের জন্য? আমাকে জেলাস ফিল করাবি তারজন্য? কচু জেলাস হই আমি! শালা ডাস্টবিনের গন্ধময়লা, উজবুক, তোর কুকীর্তি, তোর যে প্রেমিকা, তাকে যে তুই চুমা*ইছিলি, তার হিস্ট্রি আমি যদি তোর বউকে না বলছি, মনে রাখিস…”

ইজহান হতভম্ব হয়ে গেল। সেই কবে, কোন বছর এক্স গার্লফ্রেন্ডকে চু’মু খেয়েছিল সে, এটা ইস্মিতাকে বলার কী আছে? না না। তার বউ জানে না, তার একটা এক্স আছে। ও যদি জানে তাহলে ইজহান জীবনে চোখ তুলে তাকাতেই পারবে না ওর দিকে। তাছাড়া এই অবস্থায় যদি এসব শুনে বাইচান্স মেয়েটার কিছু হয়ে যায়, যদি স্ট্রোক করে বসে? না না এ হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই ভেড়া যদি বলে দেয় ইস্মিতাকে? ভেড়াটাকে খুব বিশ্বাস করে আবার ওর বউটা। ইজহান কোনো সমাধান খুঁজে না পেয়ে আমতাআমতা করে বলে, “খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু, হুমকি… ”
“চুপ শালা! অজ্ঞান হস দিনে দশবার, তোকে হুমকি দেওয়ার কী আছে? তোকে তো আমি বাঁশ দেব!”
“ইস্মিতার এটা সেনসেটিভ সময়…”
ভাইয়ের কাঁচুমাচু কণ্ঠস্বর শোনে একটু থামে ইহসান। বড় করে শ্বাস নিয়ে চুল টেনে ধরে একহাতে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে এরপর রাশভারি গলায় যতটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে, “আমি খাটানোর জন্য আনতে বলছি? শুধু বলেছি ইস্মিতাকে পাঠা এখানে, আসবে শুধু মেয়েগুলোকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য! তাছাড়া পরিস্থিতি এখনো সেই স্টেজে পৌঁছায়নি যাতে পাশের এলাকায়ও আসতে পারবে না, তেমন হলে আমি নিজেই কখনোই বলতাম না। এটা সেনসেটিভ
সময় আমি জানি, সৃজারও সেনসেটিভ সময়,

এ সময় এমন একটা মানসিক ধাক্কা…সামলানোর জন্য কাউকে দরকার…”
শেষ কথাটা শুনে ইজহান বিস্ময়ে ফেটে পড়ল ফোনের ওপাশে। চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই বাপ হবি নাকি?”
“কেন, তুই শুধু একলা বাপ হবি? বাপ হওয়ার অধিকার পৃথিবীতে একমাত্র তোরই?”
কর্কশ শোনাল এবার ইহসানের গলা। শুনে চরম বিস্ময়ে ইজহান হা হয়ে গেল, ভেড়াটা তলে তলে এত্তবড় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেই ফেলল? যে-ই দেখল ইজহান বাবা হবে, ব্যস! নিজেরও হতে হবে। ইহসান শেখ ধান্ধাবাজি ভালোই শিখেছে! বিস্মিত ইজহানের হঠাৎ মনে পড়তেই সে হালকা কেশে সন্দেহ নিয়ে
জিজ্ঞেস করল, “তোর পাওয়ার প্ল্যান্ট আদৌ ঠিকঠাক কাজ করল?”
পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন? চরম অবমাননা! কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক পুরুষ এমন প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকতে পারে না। ইহসান চরম রেগে গেল। ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “করলই না, ডাবল করল!”
”ডাবল মানে…”
গর্জন করে উঠল ইহসান, “হারামি, একজনের মৃত্যু সংবাদ শুনেও বজ্জাতি করে যাচ্ছিস সেই থেকে! এদিকে আমি মহাসাগরে গলা অবধি ডুবে আছি,

আর তুই আছিস লুলামি নিয়ে… রাখ শালা হনুমান…”
ইহসান আচ্ছামত গালি ঝেড়ে ফোন রেখে দিলো। এই উজবুকটার সাথে কেন কথা বলতে গেল ও? এর যে ঘিলু নেই, এ যে পৃথিবীর বাইরের প্রাণী কেন ভুলে গেল সে? মেজাজটাই বিগড়ে গেল ওর! পকেটে ফোনটা ভরে কেবিনে এসে সৃজার মাথার কাছে বসলো কতক্ষণ। স্যালাইন চেক করল। শেষ হতে ঘন্টাখানিক লাগবে। ততক্ষণ কী এখানে বসে থাকবে? কিন্তু ওদিকে যে অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব! এখনি যেতে হবে, কিন্তু মেয়েটার কাছে কাকে বসিয়ে রেখে যাবে? ইহসান তৎক্ষনাৎ এলিজাকে গিয়ে নিয়ে এলো। ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অসহায় গলায় বলল, “এলিজ, তুই একটা শক্ত মেয়ে। যেকোনো পরিস্থিতিতে কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পড়িস না। তোকে আমি ওভাবেই পছন্দ করি। প্লিজ, এখনো ভেঙ্গে পড়িস না। আমি জানি এটা খুব কঠিন সময়, খুব। কিন্তু কঠিন সময়টাকে তো আর আঁকড়ে ধরে বসে থাকা যায় না। আমি তোর উপর আমার সৃজাকে দেখে রাখার দায়িত্বটা দিয়ে গেলাম। এই মুহূর্তে তোকে ছাড়া অন্য কাউকে ভরসা করতে পারছি না। ভাইয়া স্বার্থপর! কিন্তু কী করব বল…ওদিকটা তো সামলাতে হবে নাকি! আমাকে যেতে হবে। খুব বেশি সময় নেব না, নিজেকে একটু শক্ত রাখ, আমি ফিরলে তুই না-হয় আবার কাঁদিস! অবশ্য কান্না চোখের এলিজকে একদম মানায় না!”

এলিজার চোখগুলো মুছে দিলো ইহসান। মেয়েটা যে ভেতরে ভেতরে কতটুকু কষ্টে নিপতিত হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারল এক লহমায়। ও শুধু ব্যাকুল হয়ে একটু সাহায্য চাইল মেয়েটার কাছে। এলিজা মাথা নাড়ল, পরিস্থিতিটা ওর বোধগম্য! ভাইয়া একা একা সব করছে। ওর বাবার জন্য করছে, বোনের জন্য করছে, ওর পরিবারের জন্য করছে। শুরু থেকেই করছে। আর কত চাপিয়ে দেবে, একটু তো পাশে থাকা চাই! আব্বু চলে গেছে বলে আপু, ফুপি কতই না কষ্ট পাচ্ছে! এখন নিজেও যদি শোক নিয়ে বসে থাকে, তাহলে কীভাবে সামলাবে ওদেরকে? নাহ, এলিজাকে একটুর জন্য হলেও শোক ভুলতে হবে, সামলাতে হবে সবাইকে! মেয়েটা নিজের কান্না চাপলো বহুকষ্টে। ভেজা চোখ মুছে সৃজার শিয়রে বসে ইহসানকে আশ্বস্ত করল ওর পাশে থাকার। ইহসান মলিন মুখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, বেরিয়ে গেল!

ইজহান তোয়ালে পরে ঘরময় পায়চারি করছে। ওকে দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে, কপালে গাঢ় ভাঁজ। যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে! ভাইয়ের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্ক হলেও ইজহানের এক মন বলছে, ভেড়াটা যখন একবার সাহায্য চেয়েছে, তখন খোঁচা দেওয়ার জন্য হলেও সাহায্যটা করা উচিৎ। আবার অন্য মন তা চাচ্ছে না। তবুও একটা শোকাগ্রস্ত পরিবারের কথা চিন্তা করে ইজহান আজিজ শেখকে বলেছিল সালেহা বেগমকে পাঠাতে, কিন্তু আজিজ শেখ রাজি হননি। বেশ বাঁকা বাঁকা কথাও বলেছেন। দেখে মনে হয়েছে তিনি এ খবরটাতে বেশ ভালো বোধ করেছেন। বাবার এ ব্যাপারটা ইজহানের ভালো লাগেনি মোটেও। ইমরানকেও বলেছিল মিতুকে নিয়ে একবার যেতে, কিন্তু না, মিতু সুন্দর করে সেজেগুজে ইমরান হাঁদাটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। সালেহা বেগম যদিও আড়ালে ইজহানের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, কিন্তু বাবা যে আচরণ করে সালেহা বেগমের সাথে, সে কথা মনে করে আর তাতে সায় দেয়নি ইজহান। আর সেজন্যই মূলত ইজহান বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে, যাবে কি যাবে না! এদিকে ইস্মিতাও কান্নাকাটি করে একাকার, খুব করে যেতে চাইছিল, তার ধমক খেয়ে এখন চুপ! তবে ইজহান উঁকি দিয়ে দেখেছে, ইস্মি কাঁদছে! ভালো লাগে না তার ইস্মির কান্না। ইজহান ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো। বেশ বিপাকেই পড়েছে সে!

ইস্মি মলিন মুখে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, ওর চোখদুটোতে পানি, বালিশ ভেজা। কতক্ষণ আগে কান্নাকাটি করে নাকমুখ লাল করে ফেলেছে। তবুও রাজি করাতে পারল না ইজহানকে, সৃজাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষবার জোরাজোরি করে প্রকান্ড এক ধমক খেয়েছে, ইস্মি তাই আর কথাই বলছে না। ওর মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে। সৃজা এ অবস্থায়, ওখানে কীভাবে আছে কে জানে! মেয়েটার মা নেই। ছোট একটা বোন আর ফুপিকে নিয়ে কীভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠবে? নিজের খেয়াল রাখবে নাকি অন্যদের? ভেবে ভেবেই ইস্মির আগের কথা মনে পড়ছে, প্রথম বাচ্চা হারানোর অভিজ্ঞতা! কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ওর দিনগুলো কেটেছিল! ভাবতেই বুক কাঁপে!
নির্দয় লোকটা কথাই শোনে না ওর। ইস্মি ফুঁপিয়ে উঠল। ইজহান পায়চারি থামিয়ে দিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “কান্নাকাটি করা বারণ তোমার।”
ইস্মি সে অবস্থাতেই ফুঁসে উঠল, “নিষ্ঠুর লোক, মানুষের বিপদে পাশে থাকে না! কথা বলবেন না একদম আপনি আমার সাথে৷ অবিবেচক কোথাকার!”
ইজহান হা হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে ওর সাথে আবার এভাবে কথা বলছে!

শূন্য কক্ষ, মেঝেতে সকালের রোদ লুকোচুরি খেলছে। আবহাওয়া শীতল, কিন্তু আরামদায়ক নয়। ওড়নাটা গায়ে চাদরের মতো জড়িয়ে এলিজা একপলক সৃজার দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা, যেন রক্ত নেই! নরম, সিল্কি চুলগুলাও দেখো জট পাকিয়ে আছে! গালে অশ্রু শুকিয়ে লেগে আছে। সৃজা কাঁদে, তবে এভাবে না। এলিজার ভালো লাগে না আপুকে কাঁদতে দেখলে! আজ একটু জড়িয়েও ধরতে পারল না আপুকে, বলতে পারল না আপু এভাবে কেঁদো না! এলিজা সৃজার হাতে নিজের মাথায় ঠেকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখদুটো বন্ধ করে অভিযোগের স্বরে বলল, “তুমি খুব স্বার্থপর হচ্ছ দিনদিন! কেঁদেকুটে বেডে শুয়ে আছ, দুর্বল শরীরে। এদিকে দেখো, আমিও দুর্বল! অথচ কান্নার সুযোগ নেই। তোমার জন্য কাঁদার সুযোগ পাচ্ছি না, আম্মু চলে যাওয়ার সময়ও দু-ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দেওয়ার সুযোগ হয়নি আমার, অবশ্য তখন তো জানতামই না! ভাগ্যটা বুঝলে, খুব জ্বালাচ্ছে আমাকে!”
কয়েক বছর আগের বীভৎস স্মৃতিপট! একটা গাড়ি, একটা ধাক্কা, একটা এক্সিডেন্ট, র’ক্তাক্ত দেহ, কালো পিচঢালা পথটা বড্ড লাল দেখাচ্ছিল! এরপর… বহুদিনের স্মৃতি এলিজার কাছে গচ্ছিত নেই। সে সময়টুকুতে মা হারিয়ে গেল ওর কাছ থেকে, জানতেই পারল না! মস্তিষ্ক যখন কাজ করা শুরু করল তখন মা হারানোর সাতাশ দিন! এলিজার কেন যেন রাগ হলো নিজের প্রতি। ধরে আসে গলা। সেভাবেই ভাঙা কণ্ঠে বলে, “কে আমাকে মায়ের গল্প শোনাবে, আমার রেজাল্ট শুনে কাঁদবে? কলেজ যাওয়ার সময় কে ডেকে বলবে ‘দুটো ভাত খেয়ে যা দোয়া, দশটা টাকা নিয়ে যা পকেট থেকে!’ জানো, আব্বু সেদিন ছানার পায়েস খেতে চেয়েছিল। ফুপি ওটা বানাতে পারে না, তাই আমিই ইউটিউব দেখে বানালাম, খেয়ে পায়েসের প্রশংসা না করে আমার প্রশংসা করল! কেন জানো, দোয়া রান্না শিখে গেছে বলে! আমাকে দোয়া বলে ডাকার মানুষটা চলে গেছে…কে আমাকে দোয়া বলে ডাকবে আপু…”
এলিজা টের পেল ও আবার কাঁদছে, চোখ থেকে নিশ্চুপে ঝরা জলের ফোটা সাদা বিছানাটা ভিজিয়ে ছাইরঙ ধারণ করেছে। ও দ্রুত চোখ মুছে নিলো৷ এরপর আবার সৃজার হাতটা শক্তভাবে মুঠোয় ধরে মাথাটা ঠেকিয়ে বসে রইল। রোদ তখন ওর বাদামি চুলে কুচি কুচি আভা ফেলছে!

জ্ঞান ফেরার পর সৃজা আবিষ্কার করলো ও শ্যাওড়াপাড়ার নিজেদের বাসায়, নিজ ঘরে শুয়ে আছে। ও একা। আর কেউ নেই ঘরে। গেল কোথায় সবাই? সৃজা উঠতে যাবে, সূক্ষ্ম আঘাত অনুভব করল হাতে। তাকিয়ে দেখল, ক্যানোলা সেট করা, স্যালাইন চলছে। সৃজা কিছুটা সময় চোখমুখ কুঁচকে স্থবির থেকে আচমকাই উঠে বসলো। অসচেতন ভাবে উঠে বসায় পেটে চাপ পড়ল ওর। আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। চোখ ছাপিয়ে জলধারা নামলো। তীব্র অবসাদে ওর শরীর ভেঙ্গে আসছে। পুরো পৃথিবীটা মনে হচ্ছে ঘুরছে। আচ্ছা আব্বু কী সত্যিই চলে গেছে? সৃজার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। বিছানা থেকে নামতে গেল ও, আব্বুকে দেখবে!
হাতে টান পড়ল, ক্যানোলাটা সৃজা বিরক্তি নিয়ে একটানে খুলে ফেলল, কিছুটা রক্ত ছলকে বেরিয়ে এলো। ব্যথা অনুভব করল না সৃজা। গায়ে ওড়না দেওয়ার কথাও মনে রইল না। ও দরজা পর্যন্ত এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো, পর্দা সরিয়ে বেরুবে সেই মুহূর্তেই অনেক মানুষের শোরগোল শোনা গেল। এত মানুষের কণ্ঠ, কেন এসেছে ওরা? সৃজার খুব রাগ লাগল! ও একছুটে বেরিয়ে এলো বসার ঘরে। সেখানে কেউ নেই। সিঁড়িঘর থেকে পদশব্দ আসছে অনেক, ইহসান-এলিজার গলাও শোনা যাচ্ছে। সৃজা সেদিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ দেখলো, রান্নাঘরের ওখানে পাশের বাসার কুচুটে মালিকের স্ত্রী একপাশে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে পাশেরজনকে বলছে, “বুঝলা আপা, এদ্দিনে শান্তি হইছে, বেশ হইছে! পঙ্গু হইয়া সারাজীবন বিছানাতে পইড়া থাকনের চেয়ে মইরা যাওন ভালা। মাইয়া দুইডারে শান্তি দিয়া গেল…ন’টা বছর কী কম? আর কত টানব পঙ্গু ব্যাডারে, ওগো নিজেগো তো জীবন আছে! বড়ডার লাইগা কতবার প্রস্তাব দিলাম, দিলো না…”

রক্ত চড়ে গেল সৃজার মাথায়। ছুটে গিয়ে রুক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে ও, “তাতে আপনার কী? আপনি কেন আব্বুকে পঙ্গু বলবেন? তাও আমার বাসায় দাঁড়িয়ে, আমার আব্বুকে! নয়টা বছর তো কিছুই না, সারাজীবনও যদি বিছানায় পড়ে থাকে, আমরা সারাজীবনই তার দেখভাল করে যাব একটুও কষ্ট না রেখে। সারাজীবন টানব…আব্বুর জন্য আমরা সব করতে পারি। আপনি মাফ চান গিয়ে আমার আব্বুর কাছে…”
মহিলা ভড়কে গিয়ে প্রথমে আমতা-আমতা করে উঠলেও এবার কাঁৎ করে উঠলেন, “এই বেয়াদ্দব মাইয়া! কারে কী কও তুমি? আমার সাথে গলা উঁচাও! মাফ চাইতে কও কারে? সাহস তো কম না…কই বাপ মরছে সংযত হইব না গলা উঁচায়, অবশ্য আর কী আশা করব!” বলে একবার আপাদমস্তক সৃজাকে দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যসূচক হেসে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করে বলল, “হিস্টোরি দেখন লাগব না…”
ক্রোধে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেছে সৃজার, “হিস্টোরি মানে? কী বলতে চান আপনি… ”
“তোমার লাগি তোমার বাপের আযাব হইব।”

সৃজা বাকরুদ্ধ বনে গেল, আযাব হবে মানে? ওর জন্য আব্বুর আযাব হবে? ও যেন কিছু বলতে পারল না। বিস্ময়ে, হতাশায় নিমজ্জিত হলো। পা দু’টো জমে গেল। সৃজা ভারাক্রান্ত মুখে এদিকওদিক কাউকে খুঁজল, কেউ নেই। ঠিক তখনি মহিলাটা ওর চুপ থাকার সুযোগ নিয়ে আবার বলল, “গায়েগতরে ওড়না না দিয়া মুরুব্বির সামনে আইছ, আবার চেঁচাইতাছো! তোমার না বাপ মরল? বাপ মরা মাইয়ার অত গলার তেজ কেন! গলা নামাইয়া এরপর থেইক্কা কথা কইবা। তোমারে তো নিতে পারি নাই। একটা বইন আছে না তোমার, ওরে নিব আমরা! এখন তো আবার এতিম, বাপহারা তোমরা!”
সৃজা এসব শুনে ক্রোধপূর্ণ চোখে তাকাল, “আমরা বাপহারা না।”

“শোকে আছ তাই কইতাছ! যাইহোক, শোক কাটলে ভাইবা দেইখো, তোমার ছোট বোনটার জন্য প্রস্তাব দিলাম!”
মানুষের কী বিবেক বোধ! একটা মানুষের চলে যাওয়া, কারোও একেবারে সর্বস্ব হারানো, এতিম হয়ে যাওয়া অন্যদের কাছে কিছুই নয়। তারা সবসময় সুযোগ খুঁজে ফায়দা লুটার। সৃজা জ্বলন্ত চোখে তাইব্র গলায় বলল, “বের হোন আপনি, আর কখনো আমাদের বাসায় আসবেন না। বের করার আগে নিজে থেকে বেরিয়ে যান…”
মহিলাটা তৎক্ষনাৎ ফুঁসে উঠে ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে ও সৃজাকে কিছু একটা করতে, ঠিক তখনি কোথা থেকে ছুটে এসে সৃজাকে আগলে নিলো ইহসান। ওর মাথাটা বুকে চেপে রক্তবর্ণ চোখে মহিলার দিকে তাকিয়ে গর্জন করে বলল, “সাহস তো কম না আপনার? আমার শ্বশুরবাড়ি এসে, আমার বৌয়ের গায়ে হাত তুলছেন?”
ইহসান হাতটা মুচড়ে ধরল মহিলাটার। ভয়ে এবং ব্যথায় মহিলা চিৎকার করে উঠল৷ ইহসান ছাড়লো না, আরো কিছুক্ষণ ওভাবে ধরে রেখে মচকে দিয়ে তবেই ছাড়ল! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“ছোঁকছোঁক করে নষ্ট
ছেলের জন্য মেয়ে না খুঁজে, ছেলেটাকে লবণ খাইয়ে মে’রে দিন। সব জ্বালা থেকে বেঁচে যাবেন!”
“এ আবার কোন নাটক? তোর বউকে মারতে চাইল কেন?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৪২

পেছন থেকে ইজহানের রুক্ষভাষী কণ্ঠস্বর শোনা গেল! তার পাশেই ইস্মিতা বিচলিত মুখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে, তার পাশে শেফালি বুয়া। সেও অবাক! এ বাড়িতে এসেই এমন একটা দৃশ্যের সাক্ষী হতে হবে কল্পনাও করেনি। এদিকে ইজহানের কথায় ইহসান মহিলার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “ফকিন্নি খালাম্মা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলের জন্য বউ ভিক্ষে করে বেড়ায়! আজ মুর্দা বাড়িতেও ভিক্ষে চাইতে এসেছে, তাই না?”
ওদিকে একই চেহারার দু’জনকে দেখে মহিলা স্তম্ভিত! ভয়ে নিজের হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন পাশেরজনকে নিয়ে। ইজহান সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বলল, “আসলেই ফকিন্নি।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৪