অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সকাল থেকেই সূর্যের দেখা নেই। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বইছে। আকাশের আজ মন ভালো নেই। রুক্ষ, শুকনো পাতাগুলো হাওয়ার তালে শুকনো মাটিতে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির সাথে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে। সৃজাদের শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িটাতে বসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে ইস্মি। তার খুব মন খারাপ। ইজহানের সাথে বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি তার। বাপের বাড়ি গেলে শান্তিতে দু’টো দিনও থাকতে পারেনি। সকালে গেলে বিকেল বা সন্ধ্যায় গিয়ে নিয়ে আসতো ইজহান। থাকার অনুমতি সে কখনোই দেয়নি। দিবে কীভাবে! বিয়ের পর থেকে বউ ছাড়া রাতে নাকি সে একা ঘরে থাকতে পারে না। যেখানে বউয়ের হাতের রান্না না খেলে, মুখে তুলে খাইয়ে না দিলে, বউ পাশে না বসলে তার গলা দিয়ে খাবারই নামতে চায় না সেখানে গোটা একটা রাত বউকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে সে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবে না। সেইবার যখন অনাগত বাচ্চাটা কোলে না এসেই চলে গেল, ইস্মি সেই বার বাড়িতে থেকেছিল একটানা অনেকদিন। সেটাও সাড়ে তিনবছর আগের কথা!
এরপর আর তেমন যাওয়া হয়নি, গেলেও সকাল-সন্ধ্যা থেকে চলে এসেছে। বহুদিন পর শেখ বাড়ির বাইরে কোথাও দিনরাত কাটিয়েছে ইস্মি। যদিও নাইমুর সাহেবের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে আসা হয়েছে, তবে এ ক’টা দিন সেই শোকের মাঝেই কেটে গেছে; এখনো বিষন্নতার রেশ কাটেনি। তবুও নীলু বেগম ইজহানকে জোর করলেন ইস্মিকে নিয়ে সে যাতে কয়েকটা দিন বেড়িয়ে যায়। কিন্তু ইজহান রাজি হলো না৷ নীলু বেগম তাও বললেন, ইস্মিকেই নাহয় রেখে যেতে, কয়েকটা দিন থাকুক। কিন্তু তাতেও আপত্তি ইজহানের৷ অফিসে তার প্রচুর কাজ। কাজ সেরে ঘরে ফিরে বউকে না দেখলে হার্ট-অ্যাটাক নিশ্চিত। নীলু ফুপি, এলিজা সবাই কত ভালোবাসছে, কত আপন করে নিয়েছে ইস্মিকে! ঐ বদ্ধ বাড়িতে থাকার চেয়ে এখানে ক’টা দিন থাকার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল ওর মনে। ভয়ে ভয়ে প্রকাশও করেছিল, কিন্তু ইজহান ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার আর কথা বাড়ায়নি। বিষন্ন মনেই গোছগাছ করছিল চলে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি সংক্রান্ত কার্যকলাপ সেরে বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে দুপুরনাগাদ বাড়ি এসে এলিজা যখন দেখল ওরা চলে যাওয়ার জন্য একপ্রকার তৈরিই হয়ে আছে, বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে ভেবে এলিজার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ইস্মিকে থাকার জন্য জোর শুরু করল। কিন্তু মালিক যদি থাকার অনুমতি না দেয়, তাহলে ভৃত্য কীভাবে থাকবে? ইস্মি মনমরা হয়ে সেটাই বলল। এলিজা টুকটাক শুনেছে ইজহানের ব্যবহার সম্বন্ধে, ওর পজেসিভনেস সম্পর্কে! ইস্মিই গল্পে গল্পে বলেছে ওকে। আন্দাজ করতে তাই অসুবিধা হলো না ওর। ইস্মিকে বলে কয়ে ও ইজহানকে রাজি করাতে গেল। ইজহান তৈরি হয়ে তখন মিজুর সাথে ফোনে কথা বলছে, এমন সময়ই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ভাইয়া আসব?”
রিনরিনে কণ্ঠস্বরে কেউ অনুমতি চাইলো। ইজহান অত খেয়াল করল না, অনুমতি দিলো। তবে এলিজাকে দেখেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল সে। ফোনটা কেটে পকেটে রেখে বলল, “তুমি?”
“জি আমি। আসলে একটা কথা বলতে এসেছি, অনুমতি দিলে বলব।”
এত ফর্মালিটি করে কথা বলে হাঁটুর বয়েসী মেয়েটা, যেন মুরুব্বি! এ পর্যন্ত যতবার কথা হয়েছে, ততবার বেশ গোছগাছ করে কথা বলেছে এলিজা ওর সাথে। ইজহান কেন যেন ওর সামনে অপ্রস্তুতবোধ করে খুব৷ কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে অনুমতি দিয়ে বসতে বলল সে এলিজাকে। সোফার একপাশে বসে এলিজা প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, “আমাদের বাসাটা আপনাদের বাড়ির মতো এতো বড় নয় জানি, কিন্তু এমনও নয় যে, খুব খারাপ। বরং থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে। তবুও জিজ্ঞেস করছি, আমাদের এই ছোট্ট বাসাটা কি ভালো লাগছে না আপনার?”
ইজহান রীতিমতো এ কথা শুনে ভড়কে গেল, “মানে? না, ভালো লাগছে। কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“তাহলে আপনি ইস্মিতা ভাবিকে নিয়ে চলে যেতে চাইছেন কেন? থেকে যান না কয়েকটা দিন।”
আবদার শুনে ইজহানের চোখ কপালে, “এতদিন অফিস কামাই হয়েছে, প্রচুর কাজ জমেছে, থাকা পসিবল না।”
“ইস্মিতা ভাবিও কী অফিস করে?”
“না তো, ও বাড়িতেই থাকে।”
“তাহলে তো ভাবি একা একাই বাড়িতে বসে থাকবে, আপুও তো এখন ও বাড়ি যাবে না। আরো কয়েকটা দিন থাকবে। একা বাড়িতে বসে বোর হওয়ার চেয়ে আমাদের এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাক, ভালো না? কথা দিচ্ছি, ফুপি, আমি আপুর মতো ভাবিকেও দেখে রাখব। আপনিও না-হয় অফিস সেরে এখানে চলে আসবেন! আমাদের বাসাটা সবসময় খালিই পড়ে থাকে, আম্মু থাকাকালীন মেহমান আসতো, আব্বুর কলিগরাও আসতো।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিজা, “বহুবছর ধরে আমাদের বাসায় কেউ আসে না, মেহমান, আত্মীয়স্বজন কেউই না। তেমন কেউ নেইও। এখন যেহেতু আপনারা আছেন, এসেছেন, তাহলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান ভাইয়া। আমাদের ভালো লাগবে। প্লিজজ! আপনি না চাইলে আমি জোর করতে পারব না, তবে ছোটো বোন আবদার করেছে বলে যদি ভেবে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনার এই আবদারটা রক্ষা করা উচিৎ।”
কঠিন স্বরে ইমোশনাল ড্যামেজ! ইজহান কী বলবে ভেবে পেল না। বিষণ্ণ গলায় বলল, “রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল…”
“কাইন্ড আ…”
“তোমার মধ্যে টিচার টিচার ভাব আছে।”
“আম্মুও তো টিচার ছিল, খবরদারি তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম। এখন অবশ্য অতো খবরদারি করি না, দেখাইও না…”
“তখন তুমি খুব ছোট।”
“হ্যাঁ, বেশিদিন পাইনি আম্মুকে।”
“আমরাও পাইনি মা’কে…”
মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো ইজহানের। মায়া লাগলো হঠাৎ। আহারে! এতো মিষ্টি একটা মেয়ে, মাকে কাছে পায়নি। সে নিজেও পায়নি। দুঃখগুলো কী এক! তারা ভাইয়েরা যেমন মাকে পায়নি, তেমনি এই বোনেরাও। অবশ্য এই বোনেরা আরো দুঃখী। বাবাও নেই ওদের। তাদের অবশ্য বাবা আছে। ভালো, খারাপ যেটাই হোক না কেন! এখনো আছে, দাপটেই আছে। আচ্ছা, এই দুঃখী মেয়েটার আবদারটা কি রাখা উচিৎ? ভাবনার মাঝেই এলিজার গলা ভেসে এলো,
“কী?”
প্রশ্ন শুনেই সম্বিৎ ফিরলো ইজহানের। এলিজাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখেই মনে পড়লো কী বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে সে। ইজহান দ্রুত কথা কাটানোর চেষ্টা করল, “থাকব, থাকব।”
“কে বলে ভাইয়া আর আপনি আলাদা, দু’জনেই এক। কী আশ্চর্য!”
বলে এলিজা মিষ্টি করে হাসলো, এরপর বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভেড়ার এই ইঁচড়েপাকা শালি কোন প্রেক্ষিতে বলল এ কথাটা? ইজহান বোকার মতো তাকিয়ে থেকে মানে খুঁজে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে ইস্মিকে ডেকে সে যখন থেকে যাওয়ার কথাটা বলল, মেয়েটা বড়োই আশ্চর্য হয়ে গেল। চোখদুটোতে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল। ইজহান মুগ্ধ হয়ে বিড়বিড় করে বলল, “তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর, একদম মাছের বউ মীনাক্ষীর মতো!”
মীনাক্ষীর সাথে তুলনা দিয়েছে ঠিক আছে, মাঝখানে মাছের বউ বলার কী মানে? ডিকশিনারিতে কি মীনাক্ষীর ব্যাখা এভাবেই দেওয়া? আর এই ভুলভাল ডিকশনারি কী এই লোকের কপালেই জুটেছে? প্রশংসার কী ছিঁড়ি! ইস্মি ছোট ছোট চোখ করে চাইল ইজহানের দিকে, “আপনি দিনদিন অতো ভালো হয়ে যাচ্ছেন কেন বলুন তো, আমার কিন্তু অন্যরকম ব্যাপার আছে বলে মনে হচ্ছে।”
“আছেই তো! ছানাপোনা আসছে, না পটালে যদি তুমি দূরছাই করে ছানাপোনা নিয়েই বসে থাকো, আমার দিকে তো নজর দিবে না জানা কথা।”
এই একটা অভিযোগ! শুরু থেকেই আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে ওর পেছনে। শুনতে শুনতে ক্লান্ত! অবান্তর এই অভিযোগের মেয়াদ কবে ফুরোবে কে জানে! ইস্মি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে এরপর আস্তেধীরে ওর বুকে মাথা রাখল, ‘খুব বেশি নজর দিলে আমার সুদর্শন স্বামীর বদনজর লেগে যায়? তাই বেশিবেশি দিই না।’ ইজহানের কী যে ভালো লাগলো প্রশংসা শুনে! সে গদগদ কণ্ঠে আবদার জুড়ল, “একটা চুমু খাই তোমার ঠোঁটে?”
“না।”
“কেন?”
অসন্তোষ নিয়ে জিজ্ঞেস করল ইজহান। সে খুশি নয় ‘না’ শুনে। তখনি বুক থেকে মাথাটা হালকা উঁচু করে ইস্মি ওর চোখে চোখ রাখল, কিছুটা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, “আপনি কোনদিন থেকে অনুমতির ধার ধারছেন, আমি বুঝতেই পারছি না। যাইহোক, কপালে দিন, ওটা বেশি ভালো।”
“কিন্তু আমার তো ঠোঁটে খাওয়ার বাসনা জেগেছে।”
ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলে কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে এরপর ইস্মিতার ঠোঁটদুটো দখল করে নিলো আগ্রাসীভাবে।
একেই তো কয়েকদিন যাবৎ শরীর দুর্বল, তার উপর দুনিয়ার সব প্রেগ্ন্যাসি উপসর্গ, যেগুলো এতমাস যাবৎও প্রকাশ পায়নি। সেসবের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কোনোকিছু গন্ধ নিতে পারছে না, খাবার খেতে পারছে না। বমি করে অবস্থা কাহিল সৃজার। তারমধ্যে সন্ধ্যা নাগাদ বাথরুমে গিয়ে বেখেয়ালে পিছলে পড়ে হাতে-পায়ে বেশ চোট লেগেছে। পেটেও বেশ ব্যথা করছে। হসপিটালে চেকআপ করে সব ঠিকঠাক আছে জেনে আসার পরেও ওর মন থেকে ভয় দূর হয়নি। কান্নাকাটি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। ইহসানের এতো অসহায়বোধ আর কখনো হয়নি। একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। কোথায় মেয়েটা একটু স্থির করেছিল মনটাকে, চেয়েছিল আজ ডিনারে একটু ভালোমন্দ রান্না করবে ইস্মিদের জন্য; তারমধ্যে এই বিপদ। তার নিজেরও যে অস্থির লাগছে না তা নয়, এখনো বুক কাঁপছে। যদি কিছু হয়ে যেতো? সে কী করতো? বোধহয় পাগল হয়ে যেতো। ইহসান সৃজাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। চুলে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অস্থিরতা গোপন করে সে সান্ত্বনা দেয়, “কিচ্ছু হয়নি সৃজা, ইলিয়ানা ম্যাম বলেছে সব ঠিক আছে। ওরা ঠিক আছে। তবুও কাঁদিস কেন!”
“কেন এমন হচ্ছে বলো তো? কী দোষ করেছি আমি, আমার বাচ্চারা? আচ্ছা, তোমার থেকে লুকিয়েছিলাম এজন্য এমন হচ্ছে? তুমি কি মাফ করোনি আমায়?”
সৃজা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ওর৷ ইহসান ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। দু’হাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে অপরাধে জর্জরিত কণ্ঠে বলে, “ওসব কথা অন্যায্য। অন্যায়, ভুল যা সব আমি করেছি! তোর গায়ে হাত উঠিয়েছি। এসবের শাস্তিই পাচ্ছি। আমাকে মাফ কর সৃজা, আমি দোষী, নিকৃষ্ট লোক…”
“না তবুও! আমার উচিৎই ছিল না এমনটা করার। কিন্তু তখন তোমার উপর এতো রাগ হচ্ছিলো আমি কিছু ভাবিনি। জেদের বশে…”
মাঝপথে ইহসান ওকে থামিয়ে দেয়। হাতদুটো একত্র করে মাফ চাওয়ার জন্য তুলে ধরে, “তোর রাগ ন্যায্য এতটুকুই আমি বলব, আরকিছু না। বলার মুখ আমি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু একটু কৃপা কর আমায়!”
চোখেমুখে অস্বাভাবিক অসহায়তা। কণ্ঠ দুর্বল। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে চোখদুটো ইহসানকে এমন করতে দেখে। সৃজা ওর হাতদুটো ধরে ফেলে মাথা ঠেকায়, “এমন করো না। প্লিজ…”
ইহসান শোনে ওর কথা। হাতদুটো সরিয়ে নেয় ওর মাথায় রাখে। আলতো করে হাসে, স্বস্তি ঠিক নেই তবুও দেখানোর চেষ্টা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য দুঃখগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে বলে, “আচ্ছা, ওসব বাদ৷ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া সব ঠিক আছে। কিন্তু রিপোর্টে কী উঠেছে সৃজা? আমার মণ্ডামিঠাই দু’জন এতমাস যাবৎ ঘাপটি মেরে বসে আছে! অথচ টের পেলাম না, এটা কী জাদু?”
এ পর্যায়ে কান্নাভেজা স্বরেও সৃজা হেসে ফেলে, “আমি নিজেও তো টের পাইনি। প্রথমবার টেস্ট করার পরই তো জানলাম ইস্মি ভাবির চেয়েও দু-সপ্তাহ এগিয়ে ওরা। ভাবি তো খুব হাসছিলো তখন, যদিও জানতো না এরা টুইন…”
ইহসানের বুকটা কেমন দ্রিমদ্রিম করে বাজতে থাকে। বাবা হবার মতো আনন্দটা এমন অসহ্যকর সুন্দর কেন? এই সুখটা অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ওর সর্ব দেহে! অথচ মরতে একটুও দ্বিধাবোধ, ভয় কাজ করছে না তার। ইহসান সৃজার চোখের পাতায় সময় নিয়ে চুমু খায়, নিচু কণ্ঠে কানে কানে বলে, “এতবড় উপহারের বিনিময়ে কী চাস? যা চাইবি তাই দেব। শুধু একবার মুখফুটে বলবি, সব তোর পায়ের কাছে এনে রেখে দেব। চাইলে আমার মুণ্ডুটাও। বল তো, বলে ফেল আমার মণ্ডামিঠাইয়ের আম্মা।”
“মণ্ডামিঠাইয়ের আব্বার ভালোবাসা।”
বলতে মোটেও সময় নেয় না সৃজা। ইহসান জবাব শুনে হেসে ফেলে। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে, “চাইতে হবে না, ওটা অলিখিতভাবে তোমার। সেই কবে থেকেই প্রতিই দায়বদ্ধ। অবশ্য দায়বদ্ধ বললেও ভুল হবে। ওটা এমনিই তোমার। ইহসান শেখ পুরোটাই তোমার জান। এবার তার সাথে কী হবে, না হবে সবটাই তোমার ইচ্ছে মোতাবেক।”
নির্মলা এক ঠান্ডা বাতাস, মেঘ ভিজে যাওয়া প্রকৃতির আকাশে শুক্লা দ্বাদশী চাঁদ আর চুকেবুকে যাওয়া অভিমান, সবটাই কেমন অদ্ভুত সুন্দর! সৃজা নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে তার মানুষটাকে, প্রেমানুভূতিতে মরে যায় সে কেমন করে যেন! ইহসান হাসে, হাসিতেও তার মরতে ইচ্ছে করে! ইহসান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “এভাবে কী
দেখছেন মণ্ডামিঠাইয়ের আম্মা?”
সৃজা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে, “দেখছি একটা লোক, যাকে কয়মাস আগেও বড়ভাইয়ের নজরে দেখতাম। সে কীভাবে আমার এতো আপন হয়ে গেল!”
“আসলেই তো! বড় ভাইয়ের নজরে দেখা এই ইহসান শেখ কীভাবে এতো আপন হয়ে গেল যে, আপনার পেটে দু দুটো বাচ্চা দিয়ে দিলো!”
বিস্মিত হবার ভান করে ইহসান, ঠোঁটে অভদ্র হাসি, চোখে দুষ্টু ইঙ্গিত। ঘোর কাটতেই লজ্জায় সৃজার গা শিউরে উঠে। পেটের ভেতর হাজারো প্রজাপতি উড়ে। রক্তিম মুখে হুট করে চলে আসা হাসি লুকিয়ে নাকমুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকায়, “ছিহ।”
“আমি একটা ফুটবল টিম বানাব ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনার যা কন্ডিশন দেখছি জান…আর কখনো বাপ হওয়ার নাম নেব না। এই ক’টা মাস ধৈর্য ধরে শুধু আপনার পেটে আমার বাচ্চাদের একটু বড় হওয়ার জায়গা দিন, ওদের লাথিগুলো সহ্য করুন আর নিজের খেয়াল রাখুন। বিনিময়ে ওদের আব্বা আপনার দাস হয়ে থাকবে।”
ফিসফিস করে নরম, ঠান্ডা এবং বিগলিত স্বরে বলে উঠে ইহসান৷ সৃজা ওর বুকে আছড়ে পড়ে লজ্জিত মুখটা লুকায়। ওর আরক্ত অবস্থা দেখে ইহসান হেসে ফেলে। হৃদয়ে তার প্রশান্তির শীতকাল শুরু হয়। তুষার ঝড়ে তোলপাড় চালায় তার ভেতরে। কেঁপে উঠে বুকটা। সৃজা টের পায় তা, সে বুকের বা পাশে হাত রাখে খুব যতনে। ইহসানের মরে যেতে ইচ্ছে হয়! কেন হবে না? যার পানে তাকিয়ে একটা গোটা একটা পৃথিবীর ভার হালকা মনে হয়, যার স্পর্শ গোটা শরীর-মনকে আন্দোলিত করে দেয়, যার নিষ্পাপ মুখখানির অসহায়ত্ব বুকে লাগে, খুব গোপনে মায়া তো তার জন্যই চলে আসে। যদিও লোকে বলে মায়া খুব তুচ্ছ জিনিস, খুব বেশিদিন টেকে না। উল্টেপাল্টে ভালোবাসা নামক এক বিধ্বংসী অনুভূতিতে রুপান্তর করে ফেলে। তবুও ইহসানের আজকাল মনে হয়, মায়া আর ভালোবাসা দুটো আলাদা অনুভূতি। সে সৃজাকে যতোটা ভালোবাসে, ঠিক ততোটাই মায়া করে। আর ভালোবাসা কেটে গেলেও এই মায়া সে কোনোদিন কাটাতে পারবে না, কোনোদিন না। সে শুধু বলে,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৫
“ভালোবাসি আপনাকে।”
সৃজা হঠাৎ বলে উঠে, “আপনি আজ্ঞে করছ কেন?”
“করব না?”
“না।”
“যথাআজ্ঞা মহারাণী।”
“ইশ! বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছে অথচ দেখো কী আচরণ! নাটকে ওস্তাদ আর কোনোদিকে নজর নেই।”
“নজর তো দিয়েই যাচ্ছি, বড্ড লোভ হচ্ছে। মহারাণীকে কি আদরই করব এ অবস্থায়ও? বহুদিন তো আদর-ভালোবাসা হয়নি! আসব কাছে? একটু স্ল্যাং শোনার পিপাসা পাচ্ছে!”
ফিসফিস করে বলে ইহসান। লজ্জায় হতভম্ব সৃজা পরপরই কানচাপা দেয়। বিড়বিড় করে বলে, “একটা বেহায়া লোকের ঘর করছি আমি!”