অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সৃজাদের চারতলা বাড়িটার বয়স দেড় যুগের কাছাকাছি। সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক, কিন্তু বাইরের দেয়ালে ঘষা সাদা রঙটা চটে মলিন হলুদাভ বর্ণের হয়ে গেছে। সেইসাথে৷ কিছু কিছু জায়গায় পলেস্তারাও খসে গেছে। শ্যাওলাপড়া পিচ্ছিল অংশগুলোতে জন্মেছে আগাছা আর ফার্ন। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ, বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বা শীতের রুক্ষ দিন! অথচ বিবর্ণ এই বাড়িটা ছিলো বলেই মাথার উপর কখনো ছাদের অভাববোধ করেনি কখনো নাইমুর সাহেবের মেয়েরা। বাবা-মায়ের জমানো সম্বলে তৈরি এই বাড়িটা তাই ওদের খুব আপন। তবে বাড়িটা রাস্তার পাশে হওয়ায় বসার ঘরের বড় বারান্দাটা থেকে নিচ দিয়ে মানুষের চলাচল দেখা যায়। ওপাশে একটা বালুর বড় মাঠ, বিকাল হলে সেখানে ছেলেপুলেরা খেলাধুলা করে, সেটাও দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ সময় যখন কেউ থাকে না, পরিবেশ নীরব থাকে, বিকেল বা সন্ধ্যায় এখানে বসে চা খায় সৃজা-এলিজা। এগুলো সবই গল্পে গল্পে এলিজার কাছ থেকে শুনেছে ইস্মি।
সে এখন বসে আছে বারান্দায়। বাজে সকাল দশটা। ইজহান একটু পর অফিসে বেরুবে, ফর্মাল পোশাক পরে তৈরি সে। এখন এসেছে চুপিচুপি বউ থেকে একটু আদর নিতে। কিন্তু ইস্মির নজর তার দিকে নেই। সে তাকিয়ে আছে আকাশে-বাতাসে, রাস্তায়, ফুলের টবে। কয়টা গোলাপ এসেছে, গাঁদার কয়টা কলি ফুটেছে, ক্যাকটাস কতটুকু লম্বা হয়েছে তার দৈর্ঘ্য মাপা নিয়ে। বেশ উৎসুক দেখাচ্ছে ওকে এসবে। ইজহানের যদিও ভেতরে ভেতরে রাগ লাগছে তবুও সে কাতর চোখে চুপচাপ বসে কাহিনী দেখছে। বাড়ি হলে এতক্ষণে এক লাথিতে সবগুলো টব ভেঙ্গে দিতো, ফুলগাছগুলো মেরে দিতো। কিন্তু ভেড়ার শ্বশুরবাড়িতে এসে এমন সিন ক্রিয়েট করলে সেটা নিশ্চয় ভালো দেখাবে না, ভেবে সে চুপ আছে। কিন্তু কতক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারবে নিশ্চয়তা নেই। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সে হাত মুচড়াল কয়েকবার। পায়ে পা ঘষলো। টাই ঢিলে করলো একটানে। গোছানো চুলগুলো একহাতে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিলো। অগোছালো চুল, লালচে মুখ আর মুখ অন্ধকার করে রাগ সামলাতে থাকা ইজহান ইস্মিকে ডাকলো ছোট্ট স্বরে, “ঔষধ খেয়েছ এখন একটু বিশ্রাম নিলে চলে না? এখানে বসে না থেকে ঘরে চলো।”
ইস্মি হেসে অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিলো, “যাব। এখানে একটু বসি। হাওয়াটা ভালো লাগছে। আর এই ফুলগুলো দেখুন, কী সুন্দর! আমাদের বারান্দায়ও এমন গাছ লাগাব।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“প্রশ্নই উঠে না।”
বিড়বিড় করে বলল ইজহান। ইস্মি বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে কী বলেছে, কিন্তু ইজহান আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বুঝালো সে কিছু বলেনি। ইস্মি মাথা নেড়ে আবারো গাঁদা ফুল ডাল কেটে লাগালেই বা পাপড়ি থেকেই কীভাবে গাছ বা কলম তৈরি করা যায় সেসব নিয়ে কথা বলতে লাগলো। মাঝখানে এলিজা এসে ওকে একমগ গরম দুধ দিয়ে গেল। ইস্মির খেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু পাগল সামনে বসে আছে তাই সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে চুমুক বসালো মগে।
তারমধ্যেই হাঁক ছাড়তে ছাড়তে এক ফেরিওয়ালা আচার বিক্রি করছে, বরাবর নিচে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটির ওখানে দাঁড়িয়ে। তরুণ থেকে বাচ্চা, সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে ওখানে আচার কিনতে। ইস্মি হাতের মগটা একপাশে রেখে চমকিত চোখে তাকাল। ছোটবেলায় কত খেয়েছে ফেরিওয়ালা থেকে আচার কিনে! পাঁচ টাকা, দশ টাকার আচার অথচ কী অমৃত স্বাদ! এখনো মুখে লেগে আছে। ইস্মির জিভে একপ্রকার জলই চলে এলো। কিন্তু ইজহানকে বললে কী সে এনে দেবে? যা নাক সিঁটকানো স্বভাব!
কিন্তু তারপরও বলে দেখা যাক! সে অসহায় চোখে ইজহানের দিকে তাকাল, “আচার খেতে ইচ্ছে করছে, শুনছেন?”
বউয়ের অবহেলা পেয়ে ততক্ষণ ফোনে মন দিয়েছিল ইজহান। এবারে সে চোখ তুলে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী! ইস্মি আগের মতোই ভীতি লুকিয়ে বলল, তার আচার খেতে ইচ্ছে করছে! ইজহানের চোখ কপালে উঠল।এখন আচার কোথা থেকে এনে দেবে সে? এ বাড়িতে কী আচার আছে? অবশ্য থাকতেই পারে। এলিজা বসার ঘরের অ্যাকুরিয়াম পরিষ্কার করছিল, ইজহান ওকে জিজ্ঞেস করল। বাসায় হাতে বানানো আচার ছিল, এলিজা সেটা এনে দিলো। কিন্তু ইস্মি সেটা একটু খেয়ে এরপর আমতা-আমতা করে জানাল সে বাইরের আচার খাবে। নিচে ঐ ফেরিঅলা দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে এনে দিলেই হবে। ওর কথা শুনে ইজহান ভ্রু কুঁচকে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখল মাঝবয়েসী কালো মতোন এক লোক। লুঙ্গি পরণে, গায়ে ময়লা ফতুয়া, মাথায় গামছা বাঁধা।
কন্টেইনারে করে কীসব হাবিজাবি যেন বিক্রি করছে। উপর দিয়ে মশা-মাছি উড়ছে। কতগুলো বাচ্চা সেসব কিনছে। দেখেই গা গুলিয়ে উঠল ইজহানের। ছিহ! এসব নোংরা, দেখতে কদাকার কালচে ফলের পেস্টকে ইস্মি নাম দিয়েছে ‘আচার?’ আবার খেতেও চাইছে? মানে খাওয়ার মতো আরকিছু পেল না তার বউ? অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে বাইরে মাথায় করে বিক্রি করা ভংচং খেতে? সে তেঁতিয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। ইস্মি ভড়কে গেল। ইজহান নাকমুখ কুঁচকে বারণ করে দিলো সে এসব এনে দিতে পারবে না, আর ইস্মিকেও খেতে দেবে না। দরকার পড়লে মিজুকে দিয়ে বাড়ি থেকে বানানো আচারের বয়াম নিয়ে আসবে, তাও এসব সে খেতে দেবে না, কভু না! ইস্মি তবুও গো ধরে আবদার করে বসলো, কিন্তু ইজহান ‘না’ তো ‘না’ তেই অটল রয়ে গেল। তার ভাষ্যমতে, এই গরিব-ফকিন্নি গোছের নোংরা লোকটার হাত দেখেই তার এতদূর থেকে বমি আসছে, আর তার হাতে বানানো আচার সে ইস্মিকে খাওয়াবে? মরে গেলেও না। সে কতক্ষণ নিজেই বমি বমি ভাব করে রাগে গজগজ করতে লাগলো। দু’বার লোকটাকে উপর থেকে ডেকে বললও এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে, দূরে গিয়ে বিক্রি করতে। কিন্তু লোকটা তো ওর কথায় পাত্তা দিলোই না, ভান ধরে ওখানে দাঁড়িয়েই বিক্রি করতে লাগল।
এবং কাস্টোমার বিদায় করার পরও লোকটা খুঁটির ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইস্মিও গো ধরে ওকে রাজি করাতেই চাইছিল, কিন্তু কিছুতেই টলাতে পারছিল না বলে এবং ইজহানকে বারবার নাক সিঁটকাতে দেখে সে রাগে-ক্ষোভে দুটো কথা শুনিয়ে অহংকারী লোক বলেছিল, ব্যস! বারান্দায় রাখা এলিজার শখের সাদা গোলাপ গাছের টবটা তুলে নিচে আচার বিক্রি করা ফেরিঅলা লোকটাকে লক্ষ্য করে নিচে ছুঁড়ে মারলো ইজহান। কারণ সেই অনেকক্ষণ যাবৎ সে লক্ষ্য করছিল—ফেরিঅলার বেশ ধরে থাকা লোকটার উদ্দেশ্য ভালো না। হাঁক ছাড়ার বাহানায় একটু পরপরই সে এদিকে তাকাচ্ছিল আর চুল ঠিক করছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁটও ভিজিয়েছে কয়েকবার। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি, নোংরা চাহনি। বউয়ের জ্বালাতন সহ্য করতে করতে ইজহান সবই লক্ষ্য করছিল আর তড়তড় করে মাথায় রক্ত উঠছিল এতক্ষণ।
তবে টব পড়ার পর একটুর জন্য সরে গিয়ে লোকটা বেঁচে গিয়ে দ্রুত কেটে পড়লেও ইস্মি তার পরম, পতিমেশ্বর স্বামীর এই রুপ হজম করতে পারল না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে এরপর কঠোর স্বরে প্রশ্ন করল, “এটা কেন করলেন?”
ফিরে তাকাল ইজহান৷ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো, “ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
“আমি খেতে চেয়েছি, জোর করেছি। দেননি, তবুও মেনে নিতাম। কিন্তু এতে লোকটার কী দোষ? বেচারা গরিব মানুষ, কর্ম করে খায়। মাথায় পড়লে বাঁচতো?”
এবারে ইজহানের নজর তীক্ষ্ণ হলো। ঐ বদমাইশটার পক্ষ নিচ্ছে তার বউ? যে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল এতক্ষণ ওকে! অথচ সে কখন থেকে এখানে বসে আছে এলোমেলো হয়ে, রাগ নিয়ে। ইস্মিতা দেখল তো না-ই, বরং ঐ চোখ দিয়ে মেয়েমানুষ গিলে ফেলা লুচ্চার জন্য মায়া দেখাচ্ছে! মাথাটা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট! সে রাগান্বিত গলায় বলল,
“খুব দরদ না?”
কথার ধরণটা বড্ড আপত্তিকর, ইস্মির ঘৃণা হলো, “ছিহ, আপনি একটুও বদলাননি।”
“বদলাব না। বদলালে কি হবে, তোর জন্য সুবিধা হবে, পরপুরুষের সামনে যেতে পারবি ইচ্ছেমতো, লোকে তাকিয়ে থাকবে তোর সুন্দর চেহারার দিকে, শরীরের দিকে। আর আমি তো বোকা, বলদ স্বামী! তোর আঁচল ধরে ধরে ঘুরব আর অন্যদের সামনে উপস্থাপন করব, এসবই তো চাস তুই! এসবই তো তোর মতে নারী স্বাধীনতা! বেয়াদব!”
ইস্মি কঠিন গলায় বলল, “আমি আপনার স্ত্রী, আপনার বাচ্চার মা।”
“সেটাই, ভুলে যাবি না। আমি থাকতে অন্যদের জন্য দরদ দেখাবি না।”
“আমি কাকে দরদ দেখিয়েছি?”
“এক্ষুনি দেখালি, ঐ বদমাশ ফকিন্নির পুত মোটেও বেচারা নয়, এতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তোকে…নোংরা চোখে। মেয়েরা নাকি দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝে কে তার দিলে তাকিয়ে আছে, নজর দিয়েছে! অথচ বুঝিসনি তুই? কি দেখেও না দেখার ভান করছিস…”
ঝাঁঝালো, উচ্চস্বর ওর। নোংরা চোখে ওকে দেখছিল লোকটা সেটা ও কী-বা জানবে যে ইজহান ওকে এভাবে বলছে? ইস্মি হতভম্ব হয়ে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিচু স্বরে বলল, “এটা আপনার বাড়ি নয়,
তাই বুঝেশুনে কথা বলুন।”
“বলব না আমি বুঝেশুনে কথা…”
বেপরায়া হয়ে উঠল রাগের বশে ইজহান। কণ্ঠস্বর বাঁধনহারা হলো। এদিকে চেঁচামেচি শুনে এলিজা-নীলু বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, কিন্তু তারা ইজহানের এই রুপ দেখে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে! কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। আর এভাবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে অসভ্য ব্যবহার করায় অপমানে ইস্মির গা জ্বলছিলো, কোনো ভাবেই আটকাতে পারছিল না চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা জল। রাগ-বিস্ময় আর ক্ষোভে কান্নারা গলাটাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছিল বারবার। এলিজা আর নীলু ফুপিকে দেখে লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে যেয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল একসময়। এলিজা ইতস্তত করলেও এবারে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ইজহানকে পেরিয়েই বারান্দায় গেল এবং ইস্মিকে গিয়ে হাত ধরে ভেতরর ঘরে নিয়ে গেল। আর নীলু বেগম ভয়ে ভয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো ইজহানের জন্য, গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটা খাও বাবা।”
ইজহান পানির গ্লাস নিলো ঠিক, কিন্তু হাতে নিয়ে বসেই রইল। রাগে এখনো তার গা কাঁপছে, হাতদুটোও!
নির্ঘুম রাত কেটেছে সৃজা আর ইহসানের। একফোঁটা ঘুমও হয়নি ওদের। কারণটা অবশ্য সৃজা। এই মেয়ে প্রেগ্ন্যাসির মতো কঠিন সময় পার করছে, রাতে ঘুম না আসাও এরই একটা যন্ত্রণাময় লক্ষ্মণ। রাতে কেঁদেছেও সৃজা এরজন্য। ইহসান যদিও সান্ত্বনা দিয়েছে, তাতে কী? চোখে ঘুম নিয়েও ঘুমাতে না পারা যে কতটা অস্বস্তিকর সেটা কী এসব নিষ্ঠুর পুরুষজাত বুঝবে? অভিযোগে অভিযোগে ইহসানের আত্মা জর্জরিত করে সকাল হওয়ার পর ঘুমিয়েছে সৃজা, ওকে ঘুম পাড়িয়ে হাফ ছেড়ে বালিশে মাথা ছুঁইয়েছে ইহসানও। কিন্তু বসার ঘর থেকে চেঁচামেচি শুনে সেই ঘুমও ভেঙেছে দু’জনেরই। ঘুমঘুম চোখে উদোম গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জিটা কোনোমতে চাপিয়ে বেরিয়ে এসে দেখল তার ভাই এটাকে নিজের বাড়ি মনে করে তার নিরীহ বউয়ের উপর চোটপাট করছে!
ব্যস! সকাল সকাল আরো একপ্রস্ত ঝগড়া-মারপিট হয়ে গেল দু’জনের, মুখ দেখাদেখিও হলো বন্ধ! ইজহান সিদ্ধান্ত নিলো আর এক মুহূর্ত ভেড়ার শ্বশুরবাড়ি থাকবে না, এক্ষুনি বাড়ি চলে যাবে। স্বামীর এমন অ-আকাঙ্খিত আচরণে ক্রন্দনরত ইস্মিকে গিয়ে আদেশের সুরে বলল তৈরি হতে। কিন্তু বাঁধ সাধলো ইহসান। সে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি হলো না ইস্মিকে। তেমনি সৃজাও বলল, রাগারাগি আর ঝগড়া করে ইস্মিকে নিয়ে যেতে দিবে না ও। ইস্মিও গোঁ ধরে বসে রইল এই অবুঝ, অভদ্র লোকের সাথে সে কোথাও যাবে না। ফলে, বউয়ের কাণ্ডে হতবিহ্বল ইজহান অগোছালো চুল, এলোমেলো, টপ বোতাম ছেঁড়া শার্ট গায়ে চাপিয়ে সেভাবেই বেরিয়ে গেল। বলে গেল, এখানে সে আর কখনো আসবে না। ইহসানও বলল ওকে দেখলে ঠ্যাং ভেঙ্গে রেখে দেবে। দু-ভাইয়ের কাণ্ডে তখন এলিজা-নীলু ফুপি চরম বিস্মিত, বিব্রত! এদিকে
সৃজা ইহসানকে ঘরে নিয়ে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “তুমি ভাইয়াকে আসতে বারণ করে দিলে কেন? এভাবে বেরিয়ে গেল, কী ভাববে!”
“যা খুশি তাই ভাবুক। আর ভাববেই বা কী? ভাববার মতো ঘিলু আছে নাকি! কুত্তাটার স্বভাব আমার ভালোই জানা আছে।”
“এই তুমি মুখ সামলে কথা বলো, কুত্তা কাকে বলো? তোমার ভাই হয় সে। আরেকবার যদি ওসব বলতে শুনি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
“তুই এমন করছিস কেন?”
“কেন করব না? মেহমান আমাদের, খারাপ লাগছে আমার, মানুষটা এভাবে রাগ করে বেরিয়ে গেল!”
“হয়েছে! আর মেহমান বলে সম্মান দেখাতে হবে না। ও পরিবেশ বুঝে? বুঝলে এমন করতো?”
একথা শুনে সৃজা মেজাজ খারাপ করে বলল,
“ভাইয়ার মাথা গরম জানি, একটু ওভার পজেসিভ! লোকটা ওভাবে ভাবির দিকে তাকিয়ে ছিলো বলেই তো রেগে গেল। তুমি হলে রাগতে না?”
এ পর্যায়ে ইহসান আমতাআমতা করে উঠল, “তুই বেশিই ভাবছিস…”
“তুমি কথা বলবে না আমার সাথে।”
সৃজা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ইস্মির ঘরে চলে গেল। ইহসান মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল সোফায়। এমনিতেই রাতে ঘুমাতে পারেনি, মেজাজ চরমে, তার উপর দুনিয়ার নাটক! ভেবেছিল সৃজাটাকে নিয়ে একটা গাঢ় ঘুম দেবে, কিন্তু হলো কী? এই মেয়ে ওর উপরই চোটপাট করে বেরিয়ে গেল। ইচ্ছে করছে কপাল ঠুকতে দেয়ালে। রাগে-বিরক্তিতে গা ম্যাজমেজ করছে ওর। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা একটানে খুলে সে উপুড় হয়ে পড়ে রইল বিছানায়। কিছুক্ষণ পর উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকলো সৃজাকে। পাত্তা দিলো না ওর ডাকে মেয়েটা। ধৈর্য হারিয়ে ডাকতে থাকলোই সে। অনেকবার ডাকার পর বিরক্ত হয়ে ঘরে এলো সৃজা। ঢুকতেই ইহসান ওকে টেনে এনে দরজা আটকে উদোম গায়েই চেপে ধরল সৃজাকে। কোলে তুলতেই চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা, “পাগল হয়েছ তুমি? এমন করছ কেন? ছাড়ো…তোমার সাথে আমার কথা নেই।”
“আমার আছে।”
“শুনতে ইচ্ছুক নই।”
ইহসান ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো জোর করে, “কিন্তু আমি বলতে ইচ্ছুক।”
“শুনব না।”
“শুনবে।”
“নাটক কম করো।”
“সিনেমা করব তাহলে? রোমান্টিক?”
“কিছুই করতে হবে না। ঘাসে মুখ দিয়ে থাকো।”
“ঘাসে মুখ দিয়ে আছি বলেই তো সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরজামাই হয়ে থাকছি, বউয়ের কাছাকাছি থাকতে চাইছি।”
সৃজা ওর চুল টেনে দিলো দু’হাতে। বুকে কিল-ঘুষি দিলো অনেকগুলো। বড় বড় নখ বসিয়ে দিলো পিঠে। ইহসান প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে যেন কিছুই হয়নি ওমন ভান ধরে বলল, “যা খুশি তাই করো জান। আটঘন্টা মাস্ট ঘুমাতে হবে তোমার। ছাড়াছাড়ি নেই, কোনো কথা শুনব না।”
সৃজা ওর সাথে গায়ের জোরে না পেরে বলল, “আগে ভাইয়াকে ফিরিয়ে আনো। তারপর বাকিসব।”
ইহসান হাই তুলতে তুলতে বলল, “ফিরিয়ে আনতে হবে না। নিজেই ফিরবে।”
সৃজা ওর ভাবলেশহীন অবস্থা দেখে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। ইহসান ভ্রুক্ষেপহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রসঙ্গ বদলাল, “আব্বারা পেটে খেলাধুলা করেছে
তো ভালোভাবে? কষ্ট হয়নি তো আপনার?”
“কষ্ট হলেই কী? তুমি ভাগ নেবে?”
“ওদের আম্মাজান দিতে চাইলে অবশ্যই নেবে। কিন্তু সে তো ভাগ দিতেই রাজি না। কিছুই বলে না আমাকে।”
সৃজা রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল। ইহসান বেশি কথা বাড়াল না, চুপচাপ ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
রাত আটটার দিকে দো-তলার ভাড়াটিয়া এসে জানাল, শুকনো কাপড় আনতে গিয়ে তার ছোট মেয়ে ছাদে কাকে একটা দেখেছে, লম্বাচওড়া, শক্ত-সামর্থ্য! স্যুট-টাই পরে অন্ধকারে বসে আছে। জিজ্ঞেস করেছিল তাদের ছোট মেয়েটা, কিন্তু লোকটা কিছুই নাকি বলেনি। ভয় পেয়ে তাই মেয়েটা চলে এসেছে বাইরে দিয়ে গেইট আটকে দিয়ে! এখন মালিকপক্ষ গিয়ে দেখে আসুক ওটা কে, চোর-ডাকাত কিনা!
ইহসান তখন বাসায় নেই, কাকে পাঠাবে নীলু বেগম? এলিজা বলল সে যাবে, দোতলার আন্টি আর তার ছেলেটাকে নিয়েই গেল সে টর্চ আর লাঠি নিয়ে। উদ্দেশ্য চোর হলে এটা দিয়ে মেরে তক্তা বানাবে। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে, শব্দ না করে গেইট খুলে ছাদে প্রবেশ করে একপাশে খুঁজে কাউকে না পেয়ে অন্যপাশে যেতেই লোকটাকে চোখে পড়ল তাদের! ভয়ে আঁৎকে উঠল দোতলার আন্টি আর তার ছেলে। এলিজা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল৷ আন্টিকে ভরসা দিয়ে অবয়বটার উপর টর্চ ফেলতেই দেখল ওটা আর কেউ নয়, ইজহান! হতভম্ব এলিজা! ফ্ল্যাটে না গিয়ে এখানে এসে বসে আছে কেন ভাইয়া? কখন থেকে? ও বিস্ময় নিয়ে ছুটে গেল আলুথালু বেশে বসে থাকা ইজহানের কাছে। জিজ্ঞেসও করল কারণ—ইজহান শুধু একবার ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। এলিজা অনেক অনুরোধ করল ওকে বাসায় যেতে, কিন্তু ইজহান বলল সে যাবে না। ইস্মিকেই শুধু নিতে এসেছে সে। নিয়ে চলে যাবে।
এলিজা নিচে এসে এই কাহিনী বলল সবাইকে, সৃজা হেসে ফেলল। ইস্মি বহুদিন পর জেদ দেখাল, থাকুক ওখানে বসে। সে কোথাও যাবে না। বাধ্য হয়ে নীলু বেগম গেলেন ইজহানকে নিয়ে আসতে। বুঝিয়েশুনিয়ে নিয়েও এলেন। ইস্মি গিয়ে দরজা আটকে বসে রইল ঘরে। আর ইজহান শক্ত মুখ করে বসে রইল বসার ঘরে, এলিজা ওকে শরবত এনে দিলো। ইজহান কাঁচুমাচু করল, “ইস্মিতা দুপুরে খেয়েছে?”
এলিজা মাথা নাড়ল, “খেয়েছে।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৬
ইস্মিতা নিজেও জানে, রাগ করে থাকলে ইজহান
খায় না। কিন্তু এখানে এসে ডানা গজিয়েছে, মুখে খই ফুটেছে। তাই দরজা আটকে বসে আছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা হলো ইজহানের। বউ খেয়েছে সে খুশি, দুশ্চিন্তামুক্ত! কিন্তু তারপরও তার বুক জ্বলছে। কারণ সে খায়নি!