অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৯

অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইজহান ইস্মিকে নিয়ে হাঁটছে। চারপাশ শূন্য, কোথাও কেউ নেই। আকাশে তপ্ত রোদ্দুর। চোখে বড্ড লাগে। তাকানো যায় না। ইজহান শক্ত করে ইস্মির হাত ধরে রাখল ওকে, যাতে না ছুটে যায়। কিন্তু হঠাৎই আকাশ হয়ে গেল কালো। চারদিক সন্ধ্যের অন্ধকারে ডুবে গেল। বালিঝড় শুরু হলো। ঝড় শেষ হলে দেখা গেল, ইস্মি ওর পাশে নেই। কোথাও নেই। ইজহান হারিয়ে ফেলেছে ইস্মিকে। সে পাগলের মতো খুঁজল ইস্মিকে, চিৎকার করল শূন্য মরুভূমিতে, কিন্তু ইস্মি ফিরে এলো না। ইজহান ঘুম থেকে উঠল চিৎকার করে।

গত দু’দিন বৃষ্টি ছিল, সাথে ঠান্ডা বাতাস। আকাশে রোদের দেখা মিলেনি মেঘ ছিল বলে। আজও মুষলধারে বৃষ্টি , স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তবে আরামদায়ক আবহাওয়া। হাফ ডে অফিস সেরে ইজহান বাড়ি চলে এসেছে। খেয়েদেয়ে ভাতঘুম দিয়েছিল সে ইস্মিকে নিয়ে। আধঘন্টা ঘুমিয়ে উঠার
পর সৃজার সাথে বিকেল পর্যন্ত বসে গল্প করেছে ইস্মি। মাগরিবের আযান হওয়ায় মাত্র ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই ইজহানের অপ্রত্যাশিত কান্ডে ভড়কে গেল ইস্মি। বিচলিত ভঙ্গিতে পেটে হাত চাপা দিয়ে আস্তে করে এগিয়ে এসে ধরল ওকে। কাঁপতে থাকা ইজহানের হাত মুঠোয় নিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে? এমন করছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন? এভাবে কাঁপছেন কেন?”
ইজহান তখনো স্বপ্নের ঘোরেই আছে, “ইস্মিতা কোথায় তুমি, আমার দমবন্ধ লাগছে…”
ইস্মি জাপ্টে জড়িয়ে ধরল ওকে, “এইতো আমি। আপনার কাছে। কোথাও যাইনি তো।”
রিনরিনে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেল এবার ওর মস্তিষ্কে। ইজহান চোখ খুলে তাকাল। এরপরই নিজেকে আবিষ্কার করল ইস্মির বুকে, ও তৎক্ষনাৎ গায়ের ভর ছেড়ে দিলো, “কোথায় হারিয়ে গেছিলে আমাকে রেখে, জানো আমি কত ভয় পেয়েছি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মানে? হারিয়ে গেছি আপনাকে রেখে? কী বলছেন এসব?”
ইস্মি হতবুদ্ধি। কী বলছে ইজহান সে বুঝতে পারছে না। তবে লোকটা যে স্বপ্নের ঘোরে আছে এটা বুঝল। ইস্মি ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “আপনি ঘুমের ঘোরে আছেন! হুঁশে আসুন। আপনার পাশে বসে আছি, এইতো আমি। তাকান না!”
ইজহান এবার টকটকে লাল চোখে তাকাল, পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল। এরপর আবার আচমকা জাপ্টে ধরে চেঁচাল, “আমি খুব ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখলাম। কেন দেখলাম? কেন এমন হলো? আমি তো এখন ভালো হয়ে গেছি তাই না?”
“হ্যাঁ মহাশয় আপনি ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু আমাকে খারাপ বানানোর ধান্ধায় আছেন যারজন্য উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছেন। আচ্ছা, মেয়ের বাপ হবেন আপনি, এত ভয় পেলে মেয়ে কী বলবে বলুন তো।”
ইজহানের তখনো বুক কাঁপছে, “আমার সব ভয় তো তোমাকে নিয়েই। মেয়েটেয়ে লাগবে না আমার। ডেলিভারিতে যদি তুমি মারা যাও, আমি মরে যাব! বাচ্চা এতিম হয়ে যাবে, কী দরকার এতিম বাচ্চা দুনিয়ায় আনার? পরে আমার মতোই কষ্ট পাবে।!”

অসহায় শোনাল ওর গলা। ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এভাবে চললে কেমন করে কী হবে? ও নিজেকেই তো ঠিক রাখতে পারবে না। ভয় কি ওর কম হচ্ছে? ইজহানের পাগলামো দেখলে সারাক্ষণ অশুভ চিন্তা মাথায় আসে, যদিও ইস্মি পাত্তা দেওয়ার চেষ্টা করে না সেসব বিষয়ে তবুও একটা পোড়া অনুভূতি, বিষন্ন ভয় ওকে ঘিরে রাখে আজকাল। একটু করে বদলে যাওয়ার চেষ্টা করা ইজহান, তার অহেতুক অস্থিরতা, ইস্মির কাছে নত হওয়া সবই ওর চোখে জল এনে দেয়। এত এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য মনে করে না নিজেকে ইস্মি, হুট করে এতসব পেয়ে গিয়েই যেন ওর মনটাও এসব মানতে পারে না। তবুও ইস্মি মনে মনে প্রার্থনা করে তাদের যাতে সত্যিই একটা মেয়ে হয়। ইজহানের যাতে নিজের একটা মা হয়, কাঙাল ভেবে আসা জীবনে অন্তত মেয়ের ভালোবাসা পাক, একটু হলেও! ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবনা থেকে বের হয়ে ইজহানের কপালে হাত বুলিয়ে চুল সরাতেই বুঝে ওই লোক ঘেমে একাকার। ইজহানকে বুক থেকে সরিয়ে পরণের গেঞ্জিটা খুলে দেয় সে, তোয়ালে ভিজিয়ে এনে ওর ঘামে ভেজা বুক, পিঠ, কপাল, মুখ, সমস্ত শরীরটা মুছে দিয়ে একগ্লাস পানি খাইয়ে ওকে শান্ত করতে চাইল, “দুঃস্বপ্ন সত্যি হয় না। আপনি এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না।”

কিন্তু অস্থির ইজহান বলল, “আমার নিঃশ্বাস তুই, ভুলভাল বকে বুঝ দিবি না। আমি কিন্তু নিজেকে
শেষ করে ফেলব তোর কিছু হলে। আমার দরকার নেই কোনো বাচ্চার। তুই হলেই চলবে।”
ইস্মিও এবার কঠিন গলায় বলল, “না চলবে না। আমি নারী, মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার, মা হবার অধিকারও আমার আছে। ক্ষমতা থাকতে আমি কেন এই সুখ পাব না? একবার পেয়েও হারিয়েছি, এবার আর হারাতে পারব না। পাগলের প্রলাপ বাদ দিন।”
“তোর সুখ আমি!”
“সাথে মাতৃত্বও।”
“সোজাসাপ্টা বল!”
“বললাম তো! ”
“ধৈর্যহীন করে ফেলছিস। আমি বাপ হতে চাই না, মা লাগবে না আমার। আমি শুধু তোকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমাদের ভালো থাকার মাঝে কোনো তৃতীয়পক্ষ চাই না। তাই মরুক ঐ বাচ্চা, আমার কিছু যায় আসবে না যতটা না তোর কিছু হলে যায় আসবে…”

এত পাগলামো করার মাঝে কেউ যদি এমন একটা কথা বলে নিজের অনাগত সন্তান সম্বন্ধে, তাহলে কি কোনো মায়ের মাথা ঠিক থাকে? ইস্মির হঠাৎ কি হলো জানে না, সে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইজহানের গালে। ফর্সা গালে সঙ্গে সঙ্গেই রক্তিম ছাপ বসে গেল। ইজহান ঝড় শেষ হয়ে যাওয়া প্রকৃতির মতো থমকে গেল। ইস্মি ভেজা তোয়ালে ওর মুখে ছুঁড়ে মেরে ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আপনি একজন মায়ের সামনে কীভাবে তার অনাগত বাচ্চার মৃত্যুর কথা তুলতে পারেন? একজন মায়ের কেমন লাগে আপনি বুঝেন? অবশ্য বুঝবেন কেমন করে, আপনি তো আর পেটে ধরেননি। শুনুন, দু-ফোঁটা রক্ত-বীর্য দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না। বাবা হতে গেলেঅনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়, নমনীয় হতে হয়, একবুক ভালোবাসা থাকতে হয় বুকে, প্রাণটা দেওয়ার জন্যও তৈরি থাকতে হয়। অথচ আ আপনি বলছেন ও মরুক? আপনার কিছু যায় আসে না? ছিহ…বাবা নামের কলঙ্ক আপনি। আপনার জন্য, আপনার জন্য আমি প্রতিবার এত চাপের মধ্য দিয়ে যাই তবুও দয়া হয় না আপনার, এখনো যেহেতু হয় না আর হবেও না। আপনি বড্ড স্বার্থপর, নিজেরটা ছাড়া আর কারোরটা বোঝেন না, আমারটাও না। এত স্বার্থপর বলেই আপনার কাছে কিছু থাকে না, আর থাকবেও না।”

রক্তিম হয়ে গেছে ইস্মির চোখ, দৃঢ় কণ্ঠস্বর। শরীর কাঁপছে ভয়ানক রাগে। ইজহান স্তব্ধ মুখে বসে রইল, রাগে তারও গা কাঁপছে। ইস্মি দেখল সেটা, তবে আর একটা বাক্যও ব্যয় করল না। নিজের ঔষধের বক্সটা খুঁজে নিয়ে বের করে একটা ঔষধ গিলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ না, আর সে নমনীয় ব্যবহার করবে না এই লোকের প্রতি, যে তার বাচ্চার ভালো চায় না। এদিকে ইজহান উত্তপ্ত চোখে বউয়ের অবাধ্য কান্ড দেখে রাগে লাথি বসালো টি-টেবিলে, “গায়ে হাত তুলিস তুই আমার? এতবড় স্পর্ধা? কিছু করি না বলে দিন দিন সাহস বাড়ছে? হাত ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দেব তোর আমি। অসভ্য নারী।”
ইস্মি না ফিরেই দৃঢ় স্বরে বলল, “সাহসের কী দেখেছেন আপনি? কিছুই দেখেননি। কষিয়ে আরো দুটো চড় দেওয়া উচিৎ ছিল আপনাকে।”

ক্ষোভে ইজহানের চোখ বেরিয়ে আসার উপম হলো এবার, কী! তার বউ তাকে কষিয়ে থাপ্পড় মারতে চায়?এতবড় কলিজা হয়ে গেছে এই নারীর পেটে বাচ্চা ধরে? তাহলে এই বাচ্চা এলে তো আরো মাথায় চড়ে বসবে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। সে তীব্র গলায় বলল, “তেজ দেখানো শিখে গেছিস? স্বামীকে সম্মান করিস না! বেশি তেড়িবেড়ি করলে বাচ্চাকে আমি এতিমখানায় দিয়ে আসব দেখিস।”
“আর সেদিনই আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটবে।”
তেড়েফুঁড়ে গিয়ে চেপে ধরলো সে ইস্মির চোয়াল, “তার আগেই মেরে দেব তোকে!”
“দয়া করে এই পুণ্য কাজটা করুন, আমিও অশান্তি থেকে মুক্তি পাই।”
ইজহানের হুঁশ হলো, যে সে কি বলেছে এতক্ষণ! ইস্মিকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কী? আমি তো রাগের কারণে এটা বলেছি। সত্যি তো আমি মারব না।”

ইস্মি ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আপনি আর আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। কথা বলার চেষ্টা করলে বুঝব, আপনি একটা বুদ্ধিহীন মানুষ। যে আস্ত একটা অফিস চালায়, কিন্ত কোথায় কি বলতে হবে, কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় সেটুকু কমনসেন্স নেই। আর কমনসেন্স বিহীন লোকের সাথে আমি কথা বলতে চাই না।”
রাগে খেই হারাল ইজহান, “আরে যা যা, বয়েই গেছে তোর সাথে আমার কথা বলতে। স্বামীর মন বুঝিস না, ভয় বুঝিস না দরকার নেই এমন বউয়ের।”
“কে যেন একটু আগেই আমি হারিয়ে গেছি বলে মেয়েদের মতো কান্নাকাটি করল!”
তাচ্ছিল্য ঝড়েঝড়ে পরল ওর কণ্ঠস্বরে। ইজহানের গা দিয়ে আগুন বেরুলো। কতবড় বুকের পাটা তাকে ব্যঙ্গ করে এই মহিলা, একটু দুর্বলতা দেখিয়েছে বলে! সে ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে রইল। ইস্মি ভয় পেল না, সে জানে একটু পরেই এই লোক সোজা হয়ে যাবে। তবে এবার সে অত সহজে গলবে না, কোনোমতেই না।

শেষ বিকেল। বৃষ্টির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। সবুজ ঘাসে একজোড়া পা ধীরগতিতে হাঁটছে। তুলতুলে, নরম ও রক্তিম কাদামাখা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে ইহসান একদৃষ্টিতে। হতাশ সে বসে বসে কদম গুণছে বউয়ের। এতক্ষণে তেত্রিশ কদম হাঁটা হলো সৃজার। পঞ্চাশ কদম হলে এসে একবোতল পানি খাওয়ার শর্ত দিয়েছে ইহসান। এই মেয়ে আজকাল পানি খায় না। খেলেও খুব কম খায়। না খাওয়ার পেছনে অবশ্য কারণ আছে৷ ইদানীং পানি শরীর ফুলে গেছে ওর। ওজন বেড়ে গেছে। গায়ে রঙ খুলে মাতৃত্বের অপার সৌন্দর্য ভর করেছে দেহে। যতবার ওর দিকে তাকায় ততবার ওকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ইহসানের৷ বহুকষ্টে সে নিজেকে সামলায়। অথচ সৃজা এতসব বুঝতেই চায় না। ওজন বেড়ে যাচ্ছে বলে নিজেকে কুৎসিত মনে করে হায়-হুতাশ করে। সৌন্দর্য চলে যাওয়ার জন্য ইহসান ওকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করবে বলে সারাক্ষণ সন্দেহ করে।

শরীরের ফোলা ভাব আর ওজন কমাতে তাই আজকাল খাবার খুব কম খায়৷ মেপেঝুঁকে খায়। তাতে শরীরের যে বারোটা বাজছে সেদিকে খেয়াল নেই। এই নিয়ে ঝগড়া করে গত দু’দিন যাবৎ কথা বলেনি ইহসান ওর সাথে। সৃজা যদিও ওর রাগ ভাঙানোর জন্য পেছন পেছন ঘুরেছে, তবে এত সহজে রাগ ভাঙেনি ইহসানের। সে শর্ত দিয়েছে এসব উল্টাপাল্টা চিন্তাধারা বাদ দিয়ে যদি ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করে, নিজের যত্ন নেয় তাহলেই যেন ওর কাছে আসে। নয়তো এত আদিক্ষেতার দরকার নেই ওর। বাচ্চাকাচ্চা যদি সুস্থভাবে না আসে, তাহলে তাদের নিয়ে সে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসের পথ ধরবে। এর কোনো নড়চড় হবে না।

মাতৃত্ব শরীরে জেঁকে বসার পর দিনদিন সদ্য কৈশোরে পদার্পণ করা আবেগী কিশোরীর ন্যায় অদ্ভুত আচরণ করে সৃজা। সারাক্ষণ স্বামীকে আঁচলে বেঁধে রাখার চিন্তাভাবনা ঘুরে ওর মনে। এই মনে হয় ইহসান ওকে দেখছে না, ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না, টান কমে যাচ্ছে প্রতি তো এই মনে হচ্ছে ইহসান দ্বিতীয় বিয়ে করবে ওকে রেখে, এই ঘর থেকে বের করে দেবে ওকে। এসব অবশ্য ওর মাথায় এমনি এমনি ঢুকেনি। ঢুকিয়েছে শেফালি বুয়া আর মিতু। শেফালি বুয়া যদিও এমনি এমনি বলে, ‘ভাবিজান, পুরুষ মানুষ হইসে ছোঁকছোঁক করা জাতি। বৌয়ের প্রতি টানের থেইক্কা বাইরের মা* গো লাগি ওদের বেশি টান কাম করে। পোয়াতি বউয়ের কাছে শান্তি না পাইলে অদের ত্থুইয়া বাইরের বাসি বিরিয়ানিতেই মুখ দেওয়া ওগো স্বভাব। ভাবিজান আফনে ভাইজানের উপরে দখল রাইখেন। যদিও আমাগো ভাইজান এমুন না, তাও আপনে তারে বাঁইধা রাইখেন৷’

আর নিজের বোনকে ইহসানের গলায় ঝুলাতে না পেরে হিংসার জ্বলতে থাকা লিথুর বড়বোন মিতু সৃজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, কার বর কাকে ছেড়ে গেছে প্রেগ্ন্যাসিতে সৌন্দর্য হারানোর ফলে, কে দ্বিতীয় বিয়ে করে বউকে তাড়িয়ে দিয়েছে, একসময় বউয়ের কথায় উঠবস করা বউপাগল লোকও কিভাবে বউকে দিনের পর দিন কাছে না পেয়ে পরকীয়ায় মেতেছে এসব নিয়েই ওর যত কথাবার্তা। একদিন তো খোঁচা মেরে সৃজাকে বলেই বসল, ‘ভাইয়া এহনো তোমারে আদর করে? সন্তুষ্ট হয়? আজকাল যে তার মুখটা শুকনো দেহি! দেইখো, আবার যেন অন্য কারোতে
না মজে।’
সৃজা অযাচিত কথা নিতে না পেরে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল ওর গালে। সম্পর্কে ইস্মি-সৃজা বড় হলেও বয়সে মিতু ওদের বড়। তাই অপমানটাও বেশ লেগেছিল মিতুর। এসব নিয়ে মিতু কম নাটক করেনি। কেঁদেকুটে একাকার করেছিল। অভিশাপ দিয়েছিল ওকে। সৃজা যদিও ম্যাচিউর আচরণ করার চেষ্টা করে তবুও কীভাবে কীভাবে যেন মাথায় ঢুকে গিয়েছিল মিতুর কথাগুলো। এরপর থেকে এই সন্দেহ করা রোগটা পেয়ে বসেছে ওকে। ইহসান কোনোভাবেই বোঝাতে পারে না নতুন করে রুপ খোলা এই মেয়ের প্রতি সে কতটা দুর্বল হচ্ছে দিনদিন, কতটা আকৃষ্ট হয় প্রতিবার। ছোট করে বুকে ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়, কামড়ে খেতে ইচ্ছে হয়। এসব বোঝাতেই পারে না সে।

“কার কথা ভাবছ?”
গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ইহসান। সামনে ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সৃজাকে দেখে নড়েচড়ে উঠে বোতলের ক্যাপ খুলে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটা শেষ কর!”
সৃজা হাত বাড়িয়ে না নিয়ে শক্ত গলায় বলল, “আগে প্রশ্নের উত্তর দাও।”
ইহসান ধৈর্যহারা হয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। একহাতে টান মেরে কাছে এনে ঠেসে ধরলো বোতলটা ওর মুখে, “একটা কথা বলবি তো এখানেই পুঁতে দেব। চুপচাপ খা।”
সৃজা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পানিটা শেষ করল। না করে উপায় ছিল না। যেভাবে চেপে ধরেছিল তাতে রেহাই ছিলো না ওর। পানি খাওয়া শেষ হলে ইহসান ওকে ছাড়ল। দেখল অনেকটা পানি পড়ে ভিযে গেছে সৃজার গলা, বুকের ওড়না। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে কপাল চেপে ধরে বিড়বিড় করল, “শালা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করলে এমনেই মরবি।”
“এবার বলো কী ভাবছ।”

পানির বোতলটা রাগে ছুঁড়ে মারলো দূরে ইহসান। এরপর হুট করেই কোলে তুলে নিলো সৃজাকে। আতঙ্কিত হলেও সৃজা আঁকড়ে ধরলো ওর কলার। ইহসান রাগী গলায় সামনে এগুতে এগুতে বলল, “জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছিস আমাকে। তোর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমি। বয়স হচ্ছে কুড়ির বেশি, ভাব ধরিস সদ্য পয়দা হওয়া মেয়ে মানুষের!”
সৃজা থমথমে চোখমুখ করে তাকিয়ে রইল। অভিমানে ওর কান্না পাচ্ছে। জানে, ইহসান কিছু করবে না তবুও মনে শ য় তা নে নাড়া দেয় ওকে। ও কী করবে? ঘরে এনে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো ইহসান। সেদ্ধ ডিম দিয়ে তৈরি করা সালাদের বাটিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ শেষ করতে বলে চিরুনি নিয়ে বসলো ওর চুল আঁচড়ানোর জন্য। ঘন চুলগুলো খোঁপা মুক্ত করে সে কতক্ষণ মুখ গুঁজে রইল চুলের ভেতর। মিষ্টি সুঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে গেল মুহূর্তেই। নাক ডুবিয়ে সে মাতোয়ারা কণ্ঠেই বলল, “তোর চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মরে গেলেও আফসোস থাকবে না আমার জান।”

“চুলগুলো কেটে ফেললে বেশি ভালো হতো। ভালো লাগছে না। গরম লাগে বেশি।”
“আগে তো আফসোস করতি টাক হয়ে যাচ্ছিস বলে, এখন কী? বাচ্চারা চুল এনে দিলো এখন রাখতে চাইছিস না। আশ্চর্য! শত্রুতা শুরু করেছিস দেখছি।”
সৃজা শুনে মুখ গোঁজ করে ফেলল এবারে। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই থেমে গেক পেটে হাত দিয়ে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, “বাচ্চারা নড়ে।”
“নড়ুক। তোকে আগে সামলাই পরে ওদের সামলাব।’’
“আমি কী বেশি জ্বালাই?”
“নিজেকে কর প্রশ্নটা।”
“আমার ওজন আরো এক কেজি বেড়েছে।”
“বাড়ুক, একশো ক্রস করুক। আমি তোকে কোলে নিয়ে হাঁটব, কোনো সমস্যা নেই।”
“তখন ঠিকই পরকীয়া করবে।”

আকাশ কাঁপিয়ে ধমকে উঠল ইহসান, “হুঁ, করব তো। অবশ্যই করব। তোকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিয়ে সুন্দরী, মোটাতাজা গাভী নিয়ে আসব। যার শরীরে ভরপুর মাংস থাকবে, জড়িয়ে ধরলে ফাঁকা জায়গা থাকবে না। যাকে পিষে মারতে বেশি মজা। ঘাসপাতা, পানি, যা দেব তাই খাবে বেশিবেশি। বুঝেছিস আহাম্মক! উফ আল্লাহ! আমি এই মেয়েকে কেন গলায় ঝুলালাম, এত প্যারা কেন দিচ্ছে আমাকে! হএ পরওয়ারদিগার, তুমি আমার অবুঝ বউকে বেশি
বেশি বুদ্ধি দান করে ম্যাচিওর করো, আমার আগের বউকে ফিরিয়ে দাও। আমার বাচ্চারা যেন একেকজন চারকেজি ওজনের হয়ে পৃথিবীতে আসে। এক হাজার
মিসকিন খাওয়াব আমি৷ আমার জীবন রক্ষা করো৷ আমিন!”

সৃজা বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে শুনে গেল কথাগুলো। হা হয়ে রইল। ঠোঁট নাড়িয়ে প্রতুত্তর করতে যাবে ইহসান ফট করে ওর মুখ বন্ধ করে দিলো ঘাড় টেনে। মিনিটখানিক পর ছেড়ে দিয়ে এরপর অসহায় গলায় বলল, “চুলটা বাঁধি? বকবকানিটা কম করে রেহাই দে অন্তত।”
অতঃপর সৃজা দ্বিরুক্তি করল না। ইহসান স্বস্তির শ্বাস ফেলে ওর চুল নিয়ে বসলো। কাঠের চিরুনিতে চুলের সব জট ছাড়িয়ে আস্তেধীরে তেল ম্যাসাজ করল, বেণী করে দিলো সময় নিয়ে। ততক্ষণে সৃজার অর্ধেক খাওয়া শেষ, অবশিষ্ট খাবারটা খেতে চাইলো না আর। জোর করেও পারা গেল না। ইহসান ওকে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে এঁটো খাবারটা নিজেই নিয়ে খেল। খেতে খেতেই ওর ফোনে টুং শব্দে বেজে উঠল৷ ইহসানত তাতে অতো একটা গা করল না।

দেখলও না কীসের ম্যাসেজ এটা। উদাসীন ভঙ্গিতে ধীরেসুস্থে খাবার শেষ করে এরপর ঘুম দিলো সৃজাকে নিয়ে। অনেকটা সময় ঘুমিয়ে যখন সৃজার নড়াচড়ায় ঘুম ভাঙলো, ওয়াশরুমের কাজ সেরে এসে বেখেয়ালি হয়েই ফোনটা সে হাতে নিলো। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে এগারোটা। স্ক্রিনে ভেসে আছে একটা ভয়েজ ম্যাসেজ আর একটা ফোনকল। দুটোই রশিদের। ইহসান উদাসীন ভঙ্গিতে কল ব্যাক করল রশিদের, রেসপন্স পেল না। বন্ধ দেখালো। ইহসান খানিকটা চিন্তিত হয়ে এবার ম্যাসেজ চেক দিলো।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৮ (২)

ভয়েজ ম্যাসেজ, অন করতেই রশিদের উত্তেজিত ও দুর্বল গলা ভেসে এলো। যা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে বসলো, নিজের প্রতি রাগে কিলবিল করে উঠল সে। ভয়েজ ম্যাসেজের টাইমিং দেখাচ্ছে এখন থেকে আরো কয়েক ঘন্টা আগে। আর সে এটা দেখছে এই রাত সাড়ে এগারোটায়? ইহসান নিজের প্রতি রাগে, দুঃখে ফোনটা আছাড় মারলো মেঝেতে। ভয়েজটা তখনো বেজেই চলেছে, ‘ছোট স্যার ফ্ল্যাটে নাই স্যার, আমাকে মেরে চলে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।’

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫০