অশ্রুবন্দি পর্ব ৫০
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসানের মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। চোখের দৃষ্টি ঝকঝকে মেঝেতে। কী ভাবছে এই মুহূর্তে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাইরে থেকে হতাশ দেখালেও এই মুহূর্তে সে জ্বলছে বিক্ষিপ্ত রাগে। তার হাতের মুঠোয় ইনজানের লেখা নোট। পালানোর আগে ইনজান নিজেই নোট লিখে গেছে। গত পাঁচদিনে ইহসান অনেকবার পড়েছে সেটা। পড়েই কাগজটি দুমড়েমুচড়ে ফেলে তবে ছিঁড়ে ফেলে না একেবারে। কেননা, এই কাগজের দিকে যতবার ওর চোখ যাচ্ছে ততবারই ওর ভয়ংকর রাগে সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রাগটা জিইয়ে রাখার জন্যই নোটটাকে বারবার পড়ে। লেখার নমুনা এরকম,
ওয়ার্মব্লাডেড এনিমি,
আরসালান বহুদিন পর বাংলায় নোট লিখছে তাও আবার কার কাছে? তার বিগ ব্রো’য়ের কাছে।
তোমার কাছে সামথিং ইজ ফিশি টাইপ ব্যাপার মনে হচ্ছে না? আচ্ছা যাইহোক, অনেক দিন হয়ে গেছে তোমাকে দেখছি না, ফ্ল্যাটে আসছ না। কোথায় হারিয়ে গেছ? খুব কি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ? না কি তোমার ভাইকে যে তুমি বন্দি বানিয়ে রেখেছে সেটাই ভুলে গেছ? আমি কিন্তু তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিনি। তোমার হাতের চা খুব থেকে শুরু করে তোমার রক্তিম চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং শক্তপোক্ত ঘুষি সবকিছুই ভীষণ ভাবে মিস করছি। বলা যায়, তোমাকে না দেখে একপ্রকার বিরক্ত হয়েই আমি এ সিদ্ধান্তটা নিয়েছি এবং অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই নোট যখন তুমি পড়ছ, আমি তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, তোমার নাগালের বহু দূরে। হাউ লাভলি!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়? আরসালানকে যে কেউ মারবে আর সে চুপচাপ বসে মার খাবে? সে দুর্বল? তার গায়ে জোর নেই? উহু, ভুল। সেদিন আমি চুপচাপ তোমার মার খেয়েছি কারণ, তুমি আমার মায়ের পেটের বড় ভাই৷ এই দায়েই আমি তোমার গায়ে হাত দিইনি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে তার অবস্থা অবশ্যই তোমার শ্বাশুড়ির মতো হতো, অথচ তুমি বলেই…তো যাইহোক, যে কারণে তোমাকে নোটটা লিখতে বসা, তোমার ভাই মানে আমি আরসালান ইনজান শেখ, এতদিন বাধ্য হয়ে বন্দি থেকেছি তুমি আমার লিগামেন্টের বারোটা বাজিয়েছ বলে। রিকভার করার জন্য নিজেকে সময় দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটাই দিয়েছি এতদিন তোমার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে। যদিও পুরোপুরি রিকভার হয়নি এখনো, তবে অতি শ্রীঘ্রই হয়ে যাবে। তাই নিজের অলস মস্তিষ্কটাকে কাজে লাগিয়ে ভাবলাম পুরোপুরি ফিট এণ্ড ফাইন হয়েই তোমার সামনে আসি। বহুদিন তো ফাঁকা মাঠে তুমি গোল দিয়েছ, এবার একটু আমার সাথে খেলো না হয় বিগ ব্রাদার! কথা দিচ্ছি, আমাকে বাদ দিয়ে তোমার তৈরিকৃত ‘হ্যাপি ফ্যামিলির’ ‘হ্যাপি’ মানুষগুলোকে শুধু একটু জ্বালাব, একটুই! এখন থেকেই তুমি ভাবতে থাকো, মুখোমুখি হবার দিন ঠিক কোথায় বন্দুকটা তাক করবে। আমার মাথায় না কি বুকে? সরাসরি হৃদয় ভেদ করবে? শুনেছি, বুকে গুলি লাগলে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয়! তুমি তাহলে ওখানেই ট্রিগার চেপো…
নোটটা এখানেই শেষ করে দিতাম, তবে একটা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় না লিখেও পারছি না।
শুনলাম তুমি হবু বাবা হতে চলেছ—আবার আশা করোনি তো যে, আমি তোমাকে শুভেচ্ছা জানাব? ফা ক দ্যাট! আই হেইট বেবিস! পৃথিবীতে আট বিলিয়ন হোমো সেপিয়েন্স আছে, তার মধ্যে আজিজ শেখের মতো আবার তুমি কিছু আনছ, পৃথিবীর বোঝা বাড়াতে চাচ্ছ! নিজের স্বার্থ, বংশ রক্ষা আর পিতৃত্বের অহংকার পূরণ করতে! আই হেইট দিস। গড হ্যাভ মের্সি! আমি হলে এসব উটকো বোঝা পৃথিবীতে আনতাম না, কখনো না। ডিরেক্ট মেরে ফেলতাম।
ইওর ওয়ার্মব্লাডেড এনিমি,
— আরসালান ইনজান শেখ।
বিশ্রি, কদচ্ছিকার ও হুমকিসহ এই নোট পড়ে রক্ত গরম হয়ে গেছে ইহসানের৷ যে স্পর্ধায় ইনজান তার অনাগত সন্তানদের উটকো ঝামেলা বলেছে, সেই স্পর্ধার জোর কতটুকু সে দেখে নেবে। মেরে মমি বানিয়ে রেখে দেবে একদম। ভাই বলে আর কোনো দয়া সে দেখাবে না। যথেষ্ট হয়েছে। ইহসান নিশ্চিত, কোনো একটা ঘট ইনজান ঠিকই পাকাবে, যাতে করে সে চরমভাবে হেনস্তা হয়, তার প্রিয়জনদের ক্ষতি হয়! পাঁচদিন হয়েছে ওর লাপাত্তা হওয়ার, অথচ এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ইনজানের। যেন রাতারাতি এক যুবক কর্পূরের মতো উবে গেছে।
ইহসান অবশ্য লোক লাগিয়েছে ইনজানের খোঁজ এনে দেওয়ার জন্য, তাতে অবশ্য নিরাশই হতে হচ্ছে ওকে। ইহসানের ক্ষীণ সন্দেহ, এসবের পেছনে আজিজ শেখের হাত আছে৷ ছোট ছেলের প্রতি তার অসম্ভব টান। বিগত কয়েকদিন যাবৎই কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল ওকে বাড়িতে নেওয়ার জন্য, ইহসান একবাক্যে বিরোধিতা করেছিল। তাই তিনি এ কাজ করলে মোটেও অবাক হবে না সে।
এই মুহূর্তে ইহসান বসে আছে লাইফ কেয়ার হসপিটালের ফোর্থ ফ্লোরের একটি কেবিনে।
বেডে হাতে-পায়ে, মাথায় চোট নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় শায়িত রশিদ। তার অবস্থা ভয়াবহ।
ইনজান ওকে মেরে হাত- পায়ের হাড় ভেঙেছে, আঙুলগুলো ভেঙেছে। পেছন থেকে ভারি কোনো বস্তু দ্বারা মাথায় আঘাত করেছে। এরপর ধারালো কিছু দিয়ে ওর সারা শরীরে আঁকিবুঁকি করেছে। স্কোপোলামিন ড্রাগের মাধ্যমে দুর্বল করে এরপর এই অমানবিক অত্যাচার গুলো করেছে। অথচ রশিদের সাথে ইনজানের কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই,
কোনো বিবাদ নেই। এরপরেও কী অবস্থা করেছে ওর! একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে রশিদ। তবে বেঁচে ফিরলেও এখনো তার জ্ঞান ফিরেনি ঠিকঠাক। কয়েকবার আধো আধো জ্ঞান ফিরেছে, টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে শারীরিক কন্ডিশন নিয়ে ডাক্তারদের সাথে। তবে অতোটা প্রেশার দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি ওকে। এই মুহূর্তে সেটা ঠিকও হবে না। নিজের অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীর এই অবস্থাটা হজম করতে পারছে না ইহসান। ভাইয়ের প্রতি রাগ, বিতৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে!
ইহসান বিক্ষিপ্ত মেজাজে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যের একটু পর। সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরের দরজায় আসতেই তার পা দুটো আপনাআপনি থেমে গেল ইজহানকে ঘরের দরজার সামনে ভাতের থালা হাতে ঘুরঘুর করতে দেখে। ভাইয়ের এ অদ্ভুত কাণ্ডে ইহসানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠল কৌতূহল। এ সময়টা ইস্মি এ ঘরে এসে সৃজার সাথে একটু বসে, শেফালি বুয়া আর রান্নার খালাও থাকে। সবাই মিলে টুকটাক গল্পে মজে। ইজহান এই সময়ে এখানে মানে ইস্মির জন্যই এসেছে। ব্যাপার কী? এই পাগলকে উপেক্ষা করিয়ে ইস্মি বসে থাকবে এই ঘরে, এখন অবধি তো কখনো এমন ঘটেনি। ইহসান ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে পেছনে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?”
পেছনে ফিরে তাকাল ইজহান। ভাইকে দেখেই মুখে তার আঁধার নেমে এলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে রক্তাক্ত চোখ করে তাকাল। ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে গর্জে উঠল, “মুখ সামলে কথা বল। আমার যেখানে খুশি সেখানে ঘুরঘুর করব। কারো কাছে কৈফিয়ত দেব না।”
বিস্মিত হয়ে গেল ইহসান ভাইকে ঝাঁঝিয়ে উঠতে দেখে। খানিকটা রেগেও গেল, “আমার উপর চেঁচাচ্ছিস কেন? পাত্তা পাচ্ছিস না; না কি?
ননসেন্স।”
“পাত্তা মানে? কীসের পাত্তা? আমার কী এতই খারাপ দিন এসেছে যে তোদের পাত্তার জন্য হাপ্যিতেশ করছি?”
শেষ কথাগুলো বলার সময় একটু তোতলে গেল গলাটা ইজহানের। আসলেই যে সে কারো জন্য হাপ্যিতেশ করছে তা বেশ বোঝা গেল। ইহসান ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনমেজাজ ঠিক থাকলে এখানে একটা বিতন্ডতা তৈরি হয়ে যেতো এতক্ষণে। কিন্তু আজ সেই মুড নেই। কথা না বাড়িয়ে ভাইকে এড়িয়ে পাল্লা ঠেলে ঘরে ঢুকল সে। ওকে দেখে মেয়েলি আড্ডার আসরে ভাটা পড়ল। শেফালি বুয়া আর রান্নার খালা ধীরেধীরে বেরিয়ে গেল। ইস্মিও
উঠতে নিলো। ইহসান গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে রাশভারি স্বরে ইস্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “উজবুকটা বোধহয় না খেয়ে দিনাতিপাত করেছে আজ। আপনি একটু দেখেশুনে নিন। বলা তো যায় না, কখন আবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আমার কিন্তু মুড নেই।”
ইহসানের মুখে এসব আজগুবি কথা শুনে ইস্মি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারে। ও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বেরিয়ে দরজার কাছে এসে দেখল ইজহান ঘুরঘুর করছে, হাতে ভাতের থালা। ওকে দেখেই কেমন চোখমুখ শক্ত করে ঘরে চলে গেল। ইস্মি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। কতক্ষণ পর নিজেও ঘরে গেল। গিয়ে দেখল ভাতের থালা টেবিলের উপর রাখা। ইস্মি চোখ পাকিয়ে ইজহানের দিকে একবার তাকাল এরপর রাগ চাপা দিয়ে হাত পরিষ্কার করে এসে ভাতের থালা হাতে নিলো। লোকমা মেখে ইজহানের মুখের সামনে ধরল।
চুপচাপ সেই লোকমা ইজহান মুখে নিলো। কোনো একটা বাক্য বিনিময় না করে এই পর্ব শেষ হলো ধীরেসুস্থে। হাত ধুয়ে বারান্দা থেকে কতক্ষণ ঘুরে এসে ইস্মি দেখল ইজহান ঘুমে ডুবে গেছে। গাঢ় শ্বাস পড়ছে।পাশেই একটা গিফট বক্স রাখা। তার উপর জরিওয়ালা কাগজে সুন্দর করে লেখা ‘Forgivness’। চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল ইস্মির। রেগে থাকলেও কৌতূহলের তাড়নায় গিফট বক্স আনর্যাপ করল ও। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বাচ্চাদের চমৎকার একটা প্রিন্সেস ড্রেস, সাদা রঙের। এত সুন্দর! চোখ ধাঁধিয়ে গেল ইস্মির। জামাটা বুকে চেপে গিফট বক্সে তাকাল আবার সে, এবার পেল একটা মখমলি কাপড়ের, নীল রঙের গয়নার বক্স। ইস্মি সেটা খুলতেই দেখল বেশ দামী একটা চমৎকার ডায়মন্ডের নেকলেস, পুরোটা ছোট ছোট সাদা পাথরের তৈরি হলেও মাঝখানে বড় একটা হার্টশেইপের স্টোন বসানো। ঘরময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেটা। ঝলমল করছে নেকলেসটা, ইস্মি হাতে নিয়ে কতক্ষণ মুগ্ধ চোখে দেখে গেল। মুগ্ধতা শেষে নেকলেসটা জায়গামতো রাখতেই একটা চিরকুট পেল সে। হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে দেখল ইজহানের হাতের লিখা, ‘পাপিষ্ঠ এক লোক তার নিষ্পাপ স্ত্রীকে বেশ কষ্ট দিয়েছে, অনাগত সন্তানকে নিয়েও বাজে কথা বলেছে। পাপিষ্ঠ লোকের এখন মন পুড়ছে এসবের জন্য, অপরাধবোধ হচ্ছে। অপরাধবোধে সে কিছুই খেতে পারছে না, গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
মন খারাপ নিয়ে সে তার স্ত্রী আর অনাগত মায়ের জন্য একটু কেনাকাটা করেছে। তাঁরা কী গ্রহণ করবে সেসব? না কি তাকে আরো কিছুদিন অনাহারে রেখে শাস্তি দিবে? অবশ্য দেওয়াই উচিৎ। পাপিষ্ঠ লোকের মুখ দিয়ে অলক্ষুণে সব কথা বেরিয়েই যাচ্ছে।
তাই তার কোমল মনের স্ত্রীর কাছে অনুরোধে, মনেমন সে যেন তার স্বামীর ভুলচুক ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখে, তবে স্বীকারোক্তি যেন গোপন রাখে। স্বীকার করলেই পাপিষ্ঠ লোক গলে যায় আর কর্তৃত্ব বসায় তার কোমলমতি স্ত্রীর উপর। এবার তাই একটু শাস্তি চোখেই দেখা হোক!’
ইজহানের ঘুমন্ত মুখটা নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। অথচ সে আস্ত এক উলটপালট বই! কখন, কী করে, বলে নিজেই জানে না। ইস্মি ওর ঘুমন্ত মুখটাকে দেখল প্রাণভরে, কপালে চুমু খেল। বিড়বিড় করে বলল, “ভুলচুক ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখা হলো, কিন্তু স্বীকারোক্তি গোপন রইল। নয়তো আবার অলক্ষুণে কথাবার্তা বলে আমাকে কষ্ট দিবেন!”
সৃজা লক্ষ করছে ইহসান কয়েকদিন যাবৎ অদ্ভুত আচরণ করছে। হাসছে না। আগের মতো ওকে ধমক দিচ্ছে না। কেমন যেন আছি আছি, নেই নেই টাইপের ব্যাপার। হুট করে তাকালে দেখে ওর মুখের দিকে অনাহারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়লে সে চোখ সরিয়ে নেয়৷ লুকোনোর চেষ্টা করে কিছু।
সৃজা ধরতে পারছে না ওর সমস্যাটা, তবে আন্দাজ করে নিজের মতো। বাচ্চা দুটো পেটে আসার পর থেকে ওভাবে কাছে আসা হয়নি দু’জনের। ইহসান কী ওর কাছাকাছি আসতে চায়? হয়তো চায়। কিন্তু শারীরিক কন্ডিশন আর বেবিদের বিপদের কথা ভেবেই হয়তো মুখফুটে কিছু বলে না। সৃজা আজ তাই নিজের ওর কাছাকাছি ঘেঁষল। ওর ঠোঁটে মুখে চুমু বসালো, পুরুষালি কণ্ঠমণিতে ঠোঁট ছোঁয়াল!
টি-শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে খুব করে আদর করে দিলো পুরুষালি বুকটাতে। দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক চিন্তাধারা হারানো ইহসানও সাড়া দিলো। দিতে দিতে হুট করেই তার মস্তিষ্ক সচল হলো। ওষ্ঠপুটের একাত্মতা থামিয়ে সে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। সৃজা উদরে ঠোঁট বসিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল, “তোমাদের গর্দভ আব্বা খুব ভুল করে ফেলছিল, দুঃখিত আব্বাজানেরা।”
সৃজা রুষ্ট গলায় বলল, “এমন করলে কেন? একটু আদর নিলে কী এমন ক্ষতি হতো?”
“ক্ষতি হতো না, তবে আমি ভুলও করতে চাই না।”
একটু মন খারাপ হয়ে গেল সৃজার। এ সময়ে সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ, তাতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু একটু আদরে খুব একটা ক্ষতির ভয় তো ছিল না। ও মনমরা কণ্ঠে বলল, “কিছু হয়েছে? তুমি কী আমার উপর রাগ করে কাছে আসছ না?”
“আবার শুরু করে দিলি…”
“না না। আমি সেই প্রসঙ্গে সন্দেহ করছি না। আজ কয়দিন ধরে দেখছি তুমি একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কেমন বিষন্ন চেহারা নিয়ে ঘুরছ! ঠিকঠাক কথাবার্তা বলছ না৷ আমি ভেবেছি কাছাকাছি আসা হচ্ছে না তাই ওরকম…”
বলতে বলতে সৃজা চোখ নামিয়ে ফেলল লজ্জায়। ইহসান ওর মুখটা দু’আঙ্গুলে তুলে নিয়ে চোখে চোখ রাখল, “তাই আমার বাচ্চাদের আম্মা আমাকে সিডিউস করতে উঠেপড়ে লেগেছিল! মাই গড সৃজা, তোর তো দেখছি সন্তানপ্রীতি থেকে স্বামীপ্রীতি বেশি।”
লজ্জা পেলেও সৃজা এবারে চোখ সরায় না। ওভাবেই চোখে চোখ রেখে স্বীকারোক্তি দিলো, “যে আমার সন্তানদের নিয়ে আমার থেকেও বেশি ভাবে, তাঁর জন্য প্রীতি বেশি থাকবে না? যেমন করে তুমি আমার আর আমার সন্তানদের খেয়াল রাখো, যত্ন করো সত্যি বলছি আমি সৃজা এতোটাও পারি না, পারব না। তবে তোমার মতো অতো গভীর করে ভালোবাসতে না পারলেও তোমায় আমি ভালোবাসি৷ আমি ভালোবাসি তোমাকে ইহসান শেখ!”
ইহসানের বুকটা একটু কাঁপল বোধহয়। একটুখানিও ভয়ও পেল সে। এই মেয়েটা, আদুরে মেয়েটা তার জীবনের ধ্রুবসত্য! বাকিসব মিথ্যা, তার জন্মও মিথ্যা। অথচ তার জীবনের ধ্রুবসত্য আর প্রাণভোমরাকে নিয়ে তার ভাইটা কী এক নাটকে মেতেছে, অথচ ভালোবাসার মানে কী ঐ শ য় তানটা জানেই না। অবশ্য যার প্রধান আকর্ষণ মেয়েলোকের দেহ, সে এসব অনুভূতির মূল্য কীভাবে বুঝবে? ইহসান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, সৃজাকে ইনজান ভালোবাসে না; শুধু তাকে জ্বালানোর জন্যই সে এসব বলে। নিজের জেদ বজায় রাখতে লুলুপ দৃষ্টি আর লালসার শিকার বানিয়ে নিজেকে প্রেমিক হিসেবে দেখাতে চায় ইহসানের কাছে। কত্তবড় হা রা মি! ইহসান যখন মনে মনে গালি দিচ্ছিল ইনজানকে উদ্দেশ্য করে, কাকতালীয় ভাবে তখনই ওর ফোনের নোটিফিকেশন বাজল। অগ্রাহ্য করল না ইহসান, সৃজার কপালে দুটো চুমু বসিয়ে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে প্রাইভেট নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে দেখেই ইহসান বুঝে গেল এটা ইনজান ছাড়া আর কেউ নয়। সে ধীরেসুস্থে, নিজের ক্রোধ সামলে নিলো। ইনজানের পাঠানো ম্যাসেজ সে পড়ল সৃজাকে বুকে নিয়ে। পড়ল আর ক্রোধ চাপা দিলো ভেতরে ভেতরে। ইনজান ইংরেজিতে লিখেছে,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৪৯
‘মনে আছে, একবার প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে গিয়েও তুমি প্রাণে মারতে পারোনি, হাত কাঁপছিল আর শেষ মুহূর্তে কেঁদে ফেলেছিলে? তোমার চোখে আমি নিজের জন্য ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই দেখিছিলাম। যেটা আর কারোর মধ্যে দেখিনি। তবুও ফর্মালিটি রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করেই ফেলি, সেদিন কেন কেঁদেছিলে বোলো তো, তুমি কী তোমার ছোটো ভাইকে খুব ভালোবাসো? ভেবেচিন্তে উত্তর দাও তো। এই উত্তরের উপর অনেককিছু নির্ভর করছে, তাই ভেবেচিন্তে দিও। গুড নাইট! উহহো…আমার গুড নাইট তো তুমি আবার নাও না, তো যেটা নাও সেটাই দিলাম….স্লিপ টাইট, ব্যাড নাইট।’