অশ্রুবন্দি পর্ব ৫২
ইসরাত জাহান ফারিয়া
অনিতা রেহমানের সঙ্গে ইহসানের খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর ইজহান প্রায়ই নাক সিঁটকাতো। মাঝেমধ্যে ঝগড়াও হতো। কলেজের পাট চুকিয়ে ভার্সিটির গন্ডিতে ঢুকে গেলেও ঝগড়া চলতো তখনো। পুত্রদের সেই ঝগড়া বসে বসে দেখতেন আজিজ শেখ। থামানোর চেষ্টা করলেও লাভ হতো না। ওরা দু’জন কিছুতেই তার কথা শুনে থামতো না, আরো বেশি করতো। ইনজান একদিন রাতে ক্লাব থেকে ফিরে দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখে আজিজ শেখকে জিজ্ঞেস করল, কাহিনী কী? কে এই মহিলা? যাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে এত্ত কথা-কাটাকাটি? আজিজ শেখ তেমন কিছুই জানতেন না অনিতা রেহমানের ব্যাপারে। ঝগড়া বিশ্লেষণ করে তিনি নিজে যা বুঝেছেন তা-ই বললেন ইনজানকে, ‘ওদের এক কলেজ টিচার। ইহসান আব্বারে না-কি মায়ের মতো বুঝ পরামর্শ দেয়, পড়াশোনায় সাহায্য করে। ভালোই না কি সম্পর্ক ম্যাডামের সঙ্গে। তারে নিয়াই ঝগড়া।’
‘এটা ঝগড়ার বিষয়?’
‘হ আব্বাজান। ইহসান ঐ মহিলারে বেশি পাত্তা দেয়, মায়ের সাথে তুলনা করে। তাই ইজহান মহিলারে পছন্দ করে না, কী না কি একটা বলছে। এই নিয়াই ঝগড়া করতেছে।’
এটুকু জেনেই সেদিন রাত্রিবেলা ঘুমাতে পারেনি ইনজান। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে নাস্তার টেবিলে কফির মগে চুমুক বসাতে বসাতে সে ভাবে, ইহসানের মায়ের মতো ম্যাডামটার ব্যাপারে খোঁজ নেবে। কেন তার ভাই এই মহিলাকে মায়ের সাথে তুলনা করল, কেন এতো ভালো সম্পর্ক সে দেখবে! ইহসান ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় যাওয়ার সময় সেও সঙ্গী হলো। জোর করলো অনেক, ‘ব্রো, তোমার ঐ মিসের ডিটেইলস বলো। আমি গিয়ে দেখে আসি কী এমন আছে তার মধ্যে; যারজন্য তোমাদের এত্ত ঝগড়া!’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
যদিও ইহসান বিরক্ত ছিল, ওকে নিয়ে যেতে রাজি ছিলো না, তবুও জেদী ছোট ভাইয়ের আবদার ফেলতেও পারেনি ইহসান। ভার্সিটি যাওয়ার পথে ইনজানকে নিয়ে কলেজে গিয়ে অনিতা রেহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ছোটো ভাই। বলেছিলাম না ওর কথা! আপনি আমাকে ছেলের মতো দেখেন শুনে আপনাকে দেখতে এসেছে। বাড়ির সব ক’টা বুঝলেন, আমাকে নিয়ে হিংসায় জ্বলছে!’
অনিতা রেহমান এসব শুনে মিষ্টি করে হেসেছিলেন ইনজানের দিকে তাকিয়ে। লম্বাচওড়া দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি তো খুব সুদর্শন দেখতে, ছেলেরা এত্ত সুদর্শন হয়? আমার নিজের একটা ছেলে হলো না, তোমাকে দেখে তো আফসোস হচ্ছে!’
বেপরোয়া, বখাটে, মেয়েবাজ ইনজান সেদিন বড্ড অবাক হয়েছিল। নিজের চেহারার প্রশংসা শুনে প্রথমবার লজ্জা পেয়েছিল, ‘আ আপনার হাসিটা আমার মায়ের মতো।’
‘ব্যাপার কী! আমার মধ্যে তোমরা নিজের মা’কে খুঁজে পাও সবসময়! আর তুমি তো দেখছি ইহসানের মতো, প্রথম পরিচয়ে ও তোমার মতো করেই কথা বলেছিল।’
ইনজান শুধু শুনছিলোই। ভালো লাগছিল ওর শুনতে। অনিতা রেহমান ওর পড়াশোনা, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা বলছিলেন। ভবিষ্যতে কী করবে, কোন লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চায় সেসব জিজ্ঞেস করছিল। ইনজান জবাবে বলেছিল, সে ক্লাব খুলতে চায়। যেখানে ছেলে-মেয়েরা রাতভর পার্টি দেবে, আড্ডাবাজি করবে, নাচ-গান এসব হবে। অনিতা রেহমান এসব শুনে হতভম্ব হলেও ওকে বলেছিলেন, এ বয়সটাতে এসবকিছু রঙিন স্বপ্ন মনে হলে আদতে এসব ভালো নয়। এগুলো সমাজ-দেশ ও জেনারেশনের জন্য হুমকিসরুপ। তাই পড়াশোনায় ফোকাস করে মানুষের উপকারে আসা যায় এমন কোনো কর্মে নিজেকে দীক্ষিত করতে। এভাবে কেউ আগে কথা বলেনি ইনজানের সঙ্গে, বোঝায়ওনি ওকে কিছু।
মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারীনি অনিতা রেহমানের স্নেহে ইনজান ভেতরে ভেতরে অনেকটাই গলে গেছিল। বাড়িতে ফিরে সে মনে মনে ভাবল, এই মহিলার মধ্যে আসলেই মা মা ভাব আছে। সত্যিকারের মায়ের মতো, বন্ধুর মতো হওয়ার গুণ আছে। সালেহা বেগম তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, অথচ এসব জ্ঞান তারমধ্যে নেই। হেঁশেল সামলানো, বাড়ির কাজ সামলানো, স্বামীর নির্দেশ মেনে চলা আর মার খাওয়াই তার কাজ। কেমন হয়, যদি অনিতা রেহমানকে বাবার সঙ্গে
বিয়ে দিয়ে তাদের মা করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়? তাহলে তারা সব ভাইয়েরাই একজন ভালো, শিক্ষিত, সুন্দরী, যত্নশীল একজন মা পাবে। কয়েকদিন ভেবে ইনজান এ কথাটা ইজহানকে শেয়ার করলে, সে শুনেই ঠাসিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল। ইহসানকে বলতে, সেও চোখ গরম করে বুঝিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয়বার এ কথা ভাবনাতেও না আনে। আজিজ শেখকে বলতে, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, এইসব কোনো কথা আব্বাজান?
এরমধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আজিজ শেখের কথা। এরপর তিনি এ বিষয়ে মাথা ঘামাননি, আগ্রহ দেখাননি। তবে ইনজান রুষ্ট হয়েছিল খুব। তার কুটিল ও জঞ্জালে ভরপুর অসুস্থ মস্তিষ্ক নিজের জেদেই অটল ছিল। কেউ তার কথা মানছিল না বলে খুব রাগ হচ্ছিলো ওর। এরপরে সে দেখা করে অনিতা রেহমানের সঙ্গে। তখন তিনি কলেজ সেরে বাড়ির পথ ধরেছেন। চৌরাস্তার মোড়ে ইনজানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় হাসিমুখে সৌজন্য বিনিময় করলেন। ইনজানও গোমড়ামুখে সৌজন্যবোধ রক্ষা করে প্রস্তাবটা দেয় সোজাসাপটা, ‘আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলি না, বলতে পারি না, তাই সরাসরি বলছি! আমাদের মা নেই। বাবা আছেন। তার দ্বিতীয় একটা বউ আর মেয়েও আছে। কিন্তু তিনি আমাদের মা নন। আপনি একদম আমাদের মায়ের মতো। আমাদেরও মা লাগবে, আমার একজন মা লাগবে। আপনি কী আমার বাবাকে বিয়ে করবেন? তাহলে আমি একটা মা পাব!’
অনিতা রহমান এ কথা আশা করেননি এতবড়ো ছেলের মুখ থেকে, তিনি ভেবেছিলেন এমনিতেই হয়তো দেখা করতে এসেছে ছেলেটা। তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। তবে প্রথমেই রেগে না গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে দেখে কী তোমার তেমন কেউ মনে হচ্ছে, যাকে তোমার বাবার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারো? না বাবা, আমি অলরেডি বিবাহিত এবং আমার দুটো সন্তানও আছে।’
‘তাতে কী হয়েছে? আপনি আপনার স্বামীকে ছেড়ে আমার বাবার স্ত্রী হয়ে যান। আর না ছাড়তে পারলেও সমস্যা নেই, আপনি ব্যালেন্স করে দুটো সংসার সামলাবেন। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে আপনাকে।’
স্তব্ধ এবং হতবাক হয়েছিলেন তিনি ইনজানের মুখে এ কথা শুনে। রাগান্বিত গলায় বলেছিলেন, ‘তুমি জেনেবুঝে বলছ এসব কথা না কি মজা করছ?’
‘না। আমি সিরিয়াসলি আপনাকে আমার মা হিসেবে চাইছি। আমার বাবা দুটো বিয়ে করেছে, তার দুটো বউ। আপনি হবেন তার তৃতীয় স্ত্রী। আমার বাবা দুটো বিয়ে করতে পারলে আপনিও পারবেন, কেন পারবেন না?’
অনিতা রেহমান ওর অসংলগ্ন কথাবার্তায় রাগে ধৈর্য হারাতে গিয়েও হারাল না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘বুঝেছি তোমার মা লাগবে। তোমার বাবা দুটো বিয়ে করেছে। কিন্তু তোমার ধর্মীয়, সামাজিক জ্ঞান খুব কম। নাহলে তুমি জানতে, ইসলাম ধর্মমতে—একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারলেও একজন নারী তার স্বামী বেঁচে থাকাবস্থায় কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। তাছাড়া, আমি আমার স্বামী-সন্তান নিয়ে খুব সুখী আছি। তাই প্রশ্নই উঠে না তাদের ছেড়ে যাওয়ার। আর যতো ঝড়-ঝাপটাই আসুক না কেন আমি কখনোই কারো তৃতীয় স্ত্রী হবো না। কারণ আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসি, আমার মেয়েদেরকে ভালোবাসি। আমি বুঝতে পারছি তোমার মা দরকার, মায়ের স্নেহ দরকার। কিন্তু দুঃখিত, আমি তোমার বাবাকে বিয়ে করতে পারব না।’
কোনোক্রমেই অনিতা রেহমান রাজি হচ্ছে না দেখে ইনজান জোরালো গলায় হুমকিসরুপ বলেছিল, ‘আমার বাবা খুব বড়লোক, তার টাকাপয়সার অভাব নেই। পাওয়ারফুল সব লোকজনদের সাথে উঠাবসা। আমি বললেই এক কথায় সে আপনাকে কিডন্যাপ করে ফেলবে। তাই ভালোয় ভালোয় আপনি আমার মা হতে রাজি হয়ে যান…’
অনিতা রেহমান প্রচন্ড রেগে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিলেন ওর গালে, ‘এসব কী অভদ্র আচরণ? তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছ? হু আর ইউ? হু ইজ ইওর ফাদার? ইহসানের ভাই তো? তোমার বাবার নাম আজিজ শেখ, বড় ব্যবসায়ী! তুমি কী ভেবেছ? আমি ভয় পাব তোমার মতো পুঁচকে ছেলের হুমকিতে? টাকা আর ক্ষমতার ভয়ে বিয়ে করে ফেলব তোমার বাবাকে এই মাঝবয়েসে এসে, নিজের স্বামী-সন্তান ছেড়ে? ভুল ভেবেছ তুমি! তোমার বাবা তোমাকে পাঠিয়েছে এসব বলতে?’
‘বাবা জানে না। আমার মা হিসেবে আপনাকে পছন্দ হয়েছে, আমি আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছি।’
অনিতা রেহমান রাগে কাঁপছিলেন এই ছেলের স্পর্ধা দেখে, ‘বাহ! কীর্তিমান ছেলে তো তুমি! বাবা জানে না, অথচ তুমি আমার কাছে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, উল্টাপাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছ! বখে গেছ অল্প বয়সেই? ফার্দার এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে একদম সোজা করে দেব। ছেলেপুলে পড়াই, সিধে করার উপায় জানা আছে আমার। মায়ের বয়সী একজন মহিলার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেই ম্যানার্সটা শিখিয়ে দেব। যথেষ্ট বড়ো হয়েছ তুমি, সামলাও নিজেকে। রাস্কেল!’
চৌরাস্তার মোড়ে বহু লোকের সামনে দেওয়ার থাপ্পড়টা ভালো লাগেনি ইনজানের। রাগ হয়েছিল ওর, কোনোভাবেই কমছিল না এই অপমান। পরে এসব জানতে পেরে ইহসান ওকে প্রচন্ড মেরেছিল। আজিজ শেখ যদিও কিছু বলেনি তবে ইজহানও রাগারাগি করেছিল। সব নিয়ে ক্রোধে ফুঁসছিল ইনজান। অনিতা রেহমানের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। ক্লাবের এক বন্ধু ওকে বলেছিল, যার উপর রাগ হয়, তাকে রাগের আগুন দিয়েই ভস্ম করে দিতে হয়।
যাতে আর কখনো রাগানোর সুযোগই না পায়! একটা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল সে অনিতা রহমানের উপর!
কাকতালীয়ভাবে শ্রীঘ্রই একদিন সেই সুযোগও পেয়েছিল। একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে গ্রোসারি শপ থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়েছিলেন তিনি, সিগারেট কিনতে গিয়ে অনিতা রেহমানকে দেখে গাড়ি নিয়ে পিছু করে ইনজান। উদ্দেশ্য ছিল, ছোটখাটো ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেবে অনিতা রেহমানকে। তাতে একটু হাত-পা ছুঁলে যাবে, বেশি হলে ভাঙবে। এরবেশি কিছু হবে না। ভাবনা মতোই কাজ করেছিল সে, কিন্তু পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে রিকশাটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্য লেনে চলে যাওয়ায় ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রাকের সামনে পড়ে ইনজানের উদ্দেশ্যেটাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিল। রিকশাওয়ালা স্পট ডেড, অনিতা রহমানের ক্ষতবিক্ষত দেহ ও মুমূর্ষু অবস্থায় একটু দূরে আট-নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে! ইনজান ঘাবড়ায়নি, বিস্মিত হয়ে গেছিল। এতটাই বিস্মিত যে, তার নিজের গাড়িও যে পেছন থেকে আরেকটা গাড়ির ধাক্কায় চুরমার হয়েছে, তার মাথাটা স্টেয়ারিংয়ে জোরালো ধাক্কা খেয়ে ফেটে গেছে, কাচে লেগে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে—এটাও ধরতে পারছিল না সে। ডান ভ্রু’র মাঝখান থেকে ডান চোখ, গালের ঠিক নিচ অবধি লম্বা যে গভীর কাটা দাগটা, এখনো তার অসৎ উদ্দেশ্যের প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে!
এই ঘটনার সময় ইহসান ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে রাঙামাটি ট্যুরে ছিল। অনিতা রেহমানের এক্সিডেন্টের খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে সেদিনই ফিরে এসেছিল সে। আর এতে যে ইনজান জড়িত, ঘটনাক্রমে এটা সে জেনেছিল দুই সপ্তাহ পর। রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে হসপিটালে এডমিট ইনজান নিজেই গল্পের ছলে তাচ্ছিল্য করে ভাইকে বলেছিল কথাটা। অনিতা রেহমানকে হারিয়ে বিমর্ষচিত্তে দিকহারা, স্তব্ধ ইহসান নিজের ছোটো ভাইয়ের ঔদ্ধত্যপনা সহ্য করতে পারেনি৷ হাসপাতালেই মারধর করেছিল ওকে, হাত-পায়ের ব্যান্ডেজসহ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল হাতের ক্যানোলা, রক্তের ব্যাগ। বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরেই ফেলতো সেসময় যদি না তাকে এসে কর্তৃপক্ষ থামাতো। আজিজ শেখ, যিনি কখনো ছেলেদের গায়ে হাতই তোলেন না তিনি পর্যন্ত ইহসানকে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেছিলেন। ইহসান সেদিন বাবাকেও সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, এতো নিকৃষ্ট লাগছিল বাপ-ভাইকে ওর যে দু’জনের নামেই থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে বসেছিল!
তবে, মোটা অঙ্কের অর্থ খাটিয়ে, পলিটিক্যাল পার্টি ও বড় পজিশনওয়ালা আমলাদের হাত করে রাতারাতি দুর্ঘটনার সব এভিডেন্স ও যাবতীয় তথ্যাদি সবকিছু গায়েব করে, প্রত্যক্ষদর্শীদের এমনভাবে হাত করে নিলেন আজিজ শেখ যে, ইহসান পুরো হতভম্ব হয়ে গেছিল। তার করা অভিযোগ তো ধোপেই টেকেনি উল্টো তাকে ড্রা গ এডিক্টেড হিসেবে চিহ্নিত করে, ঝোঁকের বশে হসপিটালে ভর্তি অসুস্থ ভাইকে মারার চেষ্টা ও বাবার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনয়নের জন্য সাসপেক্ট হিসেবে সাব্যস্ত করা হলো। আজিজ শেখ মামলা করেনি যদিও ইহসানের বিরুদ্ধে, তবে একরাত থানায় কাটাতে হয়েছিল ওকে। ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নিজে গাড়ি করে এসে সারারাত থানায় বসে ওকে বুঝ পরামর্শ দিয়েছিল, সম্পর্কে তো নিজের ছোটোভাই হয়, অপরিণত বয়সে নাহয় একটা ভুল করেই ফেলেছে, অনেকেই এমন করে।
কিন্তু তারজন্য জেলের ঘানি টানবে, ফাঁসিকাঠে গলা দেবে এটা কি ঠিক? কেন নিজের ভাইয়ের শাস্তি কামনা করছে সে? কেন নিজের বাবার সম্মানহানি করাতে চাইছে? অন্য একটা পরিবারকে জাস্টিস পাইয়ে দিয়ে তার কী লাভ হবে? এরচেয়ে ভালো নয়, টাকাপয়সা দিয়ে মিটমাট করে নেওয়া ভুক্তভোগীর পরিবারের সাথে? রিকশাওয়ালা স্পট ডেড, তার ম্যাম অনিতা রহমানও মরেই গেছে৷ শুধু বেঁচে আছে তার ছোট মেয়েটা, আই.সি.ইউনিটে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। সব খরচ তার বাবা আজিজ শেখ বহন করবে, যত অর্থ লাগে লাগুক! বিনিময়ে আইনি ঝামেলা থেকে দূরে থাকুক ভুক্তভোগীর পরিবার, আর সে! শুনে, কিছু বলার রুচি হয়নি ইহসানের।
কাঠ হয়ে বসেছিল সে, মাথায় ঘুরছিল অসহায় নাইমুর সাহেব আর মাতৃহীন সৃজার মুখটা! সকালের দিকে ছাড়া পেয়েছিল ইহসান, আজিজ শেখ নিজেই ছাড়াতে গিয়েছিলেন। মাথায় স্টিচ নিয়ে ছেলেকে নিতে এসে সেই অফিসারকে টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘আদরের ছেলে। একরাত থানায় রাখছেন, তাই এক বান্ডিল কম দিলাম।’
ঘৃণায় শরীর পাক দিয়ে উঠেছিল ইহসানের, বমিই করে দিয়েছিল সে। আজিজ শেখ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছুটে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, কেন এমন হলো! ইহসান মাটিতেই বসে পড়েছিল সেভাবে, ছুঁতে দিচ্ছিল না নিজেকে। আজিজ শেখ রাগেননি। কাষ্ঠ হেসে ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে তোমরা, নিজের ছেলে। যা কিছুই করো না কেন, তোমাদের আগলে রাখাই আমার দায়িত্ব। তাই বলছি, এসব ঝামেলায় থাইকো না আব্বাজান, দূরে দূরে থাকো!’
‘না থাকলে কী করবেন? মারবেন? ক্ষমতার দাপট দেখাবেন?’
‘উহু! তোমরা আমার কলিজার টুকরো, তোমাদের শরীরে আঁচ লাগতে দিব না। তোমরা সুরক্ষিত। তবে আঁচ লাগবে তুমি যাদের দয়া দেখাইতে চাইতেছ, তাদের উপর, তাদের পরিবারে।’
‘মানে?’
‘অনেককিছুই করতে পারি—তার এক ঝলক যদি দেখতে চাও তো বলো, আমার একটা ফোনকল, তোমার প্রিয় ম্যাডামের মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে পারে। দেখবা আব্বাজান?’
বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না ইহসান। কাঁপছিল সে রাগে। এক আকাশ ঘৃণা নিয়ে থু থু ছুঁড়ে দিয়েছিল জন্মদাতার উপর, যত দ্রুত সম্ভব সরতে চাইছিল নিকৃষ্ট লোকটার ছায়া থেকে। সে বয়সে রক্ত গরম ছিল ওর, দিকদিশা বিবেচনা করেনি, বাপকে অমান্য করে লেগেই রয়েছিল কোনো একটা শাস্তির ব্যবস্থা করতে। সে ছুটে গেছিল হাসপাতালে, যেখানে এলিজাকে রাখা হয়েছিল। নাইমুর সাহেব অসহায়ের মতো করিডোরে একা বসেছিলেন।
ইহসান অনুশোচনা আর অপরাধবোধে পায়ে পড়ে গেছিল আঙ্কেলের। নাইমুর সাহেব বড্ড অবাক হয়েছিলেন, কেন এমন করছে ইহসান, কিছুই ধরতে পারছিলেন না তিনি! ইহসান হালকা হতে চাইছিল, পারছিল না সব চেপে রাখতে! লজ্জাবনত, অপরাধে জর্জরিত কণ্ঠে ইহসান বলেছিল সেদিন নিজের ভাইয়ের অপকর্মের কথা! নাইমুর সাহেব চমকে উঠেছিলেন, কারণ তখনও তিনি জানতেন না এটা স্বাভাবিক কোনো দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছেকৃত একটি কাজ। যারজন্য তিনি স্ত্রী হারিয়েছেন, ছোট মেয়েটাও মৃত্যুর সাথে লড়ছে! শান্তশিষ্ট মানুষটা সেদিন রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে ইহসানকে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিলেন, এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করতে পারছিলেন না ওকে। স্ত্রীর ছাত্র হিসেবে ভালো সম্পর্ক থাকলেও জানতেনই না ইহসানের বিষয়ে খুব বেশিকিছু। অবশ্য জানার প্রয়োজনই হয়নি কখনো!
ইহসানও ব্যক্তিগত কথাবার্তা নিজ থেকে বলতো না, অবশ্য বলার মতো তার কাছে ছিলই বা কী! বাপ-ভাই, এদের সবার যা গল্প, এগুলো তো মানুষকে বলে বেড়ানোর মতো না। অনিতা রেহমানও ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতো না, এমনকি ইজহানের কথাও নিজের পরিবারের কাছে বলেননি। ইহসানই মূলত না করেছিল, কারণ সে চায় না তাকে ছাড়া অন্য কারো বিষয়ে কারো আগ্রহ থাকুক। অনিতা রেহমানও তাই বিব্রত করতো না ওকে। তবে চড় খেয়ে সেদিন ইহসান নাছোড়বান্দা ছিল, আঙ্কেলের পা ছাড়ছিল না যতক্ষণ না তিনি রাজি হচ্ছিলেন, আইনিপদক্ষেপ নিবে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, ঠিক ততক্ষণ!
নাইমুর সাহেব বিস্মিত হয়েছিলেন, ওর তোষামোদেই রাজি হয়েছিলেন আইনি পদক্ষেপ নিতে। ইহসানকে নিয়েই সেইমতন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন।
ওদের অটলাবস্থা দেখে আজিজ শেখ ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি দিলেন। কিন্তু কাজ হলো না দেখে শেষে লক্ষাধিক টাকা নিয়ে কাহিনী মিটমাট করতে এসেছিলেন। কিন্তু নীতিবোধ সম্পন্ন নাইমুর সাহেবকে টলাতে পারেননি। এই ক্ষোভ থেকে তিনি অন্য পথ ধরলেন, হসপিটালের বিল দেওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেরার পথে অজ্ঞাতনামা লোকজন নাইমুর সাহেবকে রাস্তায় ধরে মারধর করেন এবং সব টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আকস্মিক এই হামলায় জমানো সব অর্থ হারিয়ে ও মেয়ের চিকিৎসার টাকা যোগান দিতে না পেরে ভেঙ্গে পড়েন নাইমুর সাহেব। তখন ক্যাশ বা সেভিংস ছিল না কিছুই। অফিস থেকে লোন নেওয়া বা পেনশনের ব্যবস্থা করতেও সময় লাগতো অনেক। গ্রামের দিকের জমিও বিক্রি হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার! অপরাধবোধে ক্লিষ্ট ইহসান হতে দেয়নি তা, বাবার অগাধ অর্থসম্পদ, নিজের ব্যাংকে পড়ে থাকা বিশাল অঙ্কের টাকা, সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখেনি। সেসময় নিজের কোনো চাকুরি, ব্যবসা না থাকা স্বত্তেও নিজের জমানো টাকা আর বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় সে ব্যবস্থা করেছিল এলিজার যাবতীয় সব চিকিৎসার খরচ। আজিজ শেখ সেসব শুনে বড্ড ক্ষেপেছিলেন, ইহসান গরম পানির পাতিল ছুঁড়ে মেরেছিল তার নিকৃষ্ট বাপের উপর। পায়ের পাতা ঝলসে গিয়েছিল লোকটার, তবে ইহসানের জ্বালা তাতে একবিন্দুও কমেনি।
আই.সি.ইউতে এলিজার যখন তেইশ দিন, এরমাঝেই
নাইমুর সাহেব দুশ্চিন্তা আর দুর্বলতায় নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, বরণ করেছিলেন পঙ্গুত্ব! আজিজ শেখ দেখতে এসেছিলেন তাঁকে, নাইমুর সাহেব
চিনতেই পারেননি। যাওয়ার সময় বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে ইহসানকে বলেছিলেন, ‘আব্বাজান, থামো এইবার। ঝুটঝামেলা এইখানেই বন্ধ করো৷ দেখছ তো, লাগতে আসার পরিণাম!’
আঙ্কেলের অসুস্থতা একটা ধাক্কার মতো ছিল
ইহসানের কাছে! ওর শক্তি-সামর্থ্য সবই কেমন
ফুরিয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদের ভাষাটুকুও বাইরে বের করার মতো ছিল না। সঙ্গে কেউ নেই, কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার মতো নেই। একটা ভঙ্গুর পরিবারকে সামলানোর মতো কেউ নেই। অনিতা মিসের পরিবারের সাথে যা কিছু হয়েছে, এরজন্য তো তারই আপনজনেরা দায়ী, কী করতো সে? ধব্জভঙ্গ এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া? সাধ্যমতো দাঁড়িয়েও ছিল! তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে, কিন্তু দিনশেষে ব্যর্থই হয়েছিল সে। টাকার কাছে সবাই বিক্রি হয়ে গেছিল প্রশাসনের নীতি-নৈতিকতা, আইন। নীলু বেগম এসব ব্যাপারে জানতেন, তবে কখনোই বলেননি সৃজাকে। সদ্য মা হারানো মেয়েটাকে তখন এতকিছু জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। ব্যপারগুলো নিজের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল ইহসান। কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে যখন নিজের অনুভূতিও পরিবর্তন হচ্ছিলো সৃজার প্রতি। আজন্ম ভয় ঘিরে ধরেছিল ওকে। তাই ভালোবেসে ফেললেও সে কখনো ভাবেইনি, চায়ওনি এই মেয়েকে নিজের করে পেতে!
°
তবে এসব ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর ইনজান যখন সৃজার ব্যাপারটা জানল, ওকে স্টক করা শুরু করল এরমধ্যেই একদিন এসে ইহসানকে বলেছিল, ‘তোমার ভবিষ্যত কচি বউকে দেখলাম বাজার করে ফিরছে। অবশ্য করবেই তো, আমাদের মতো এতিম তো ওরাও, বাপটাও শয্যাশায়ী। বুঝলে ব্রো, তোমার দুঃখিনী প্রেমিকাকে দেখে নতুন নতুন ওকে আমার গার্লফ্রেন্ড বানানোর ইচ্ছে জেগেছে।’
এক্সিডেন্টের কাহিনীর পর থেকে দু-চোখে ওকে সহ্য করতে পারতো না ইহসান। নিজের উপরও রাগ ছিল– ওকে যথাযোগ্য শাস্তির আওতায় না আনতে পারায়!
এরমধ্যে নতুন করে সৃজাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করায়, আক্রোশে ফেটে পড়েছিল ইহসান। ওর
চোয়ালে ঘুষি বসিয়ে ডান হাতের আঙুলগুলো দরজার ভাঁজে ফেলে চাপিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলেছিল, ‘সৃজাকে নিয়ে খেলতে যাবি না। ওর হাসি, কান্না সবকিছু আমি দেখি। ও আমার, শুধু আমার। অন্যকারো স্পর্শের আগে আমার ছায়া পড়ে ওর গায়ে। আমি ঠিক টের পাই, কে ওর চারপাশে ঘোরে… মনে রাখিস, মরার আগে একবার ভাবিস—তুই ওর দিকে তোর নোংরা হাত বাড়ালে তোর লাশ কই পড়বে। একবার ভুল করেছিস, দ্বিতীয়বার আর করিস না। ওর চারপাশে হাওয়া বদললালে আমি বুঝে যাই আর খুব নীরবে আমি অনেককিছু করে ফেলি। জেনে রাখ, ওর ব্যাপারে আমি একদম আলাদা।’
প্রেম-ভালোবাসার মমার্থ না বোঝা ইনজান, হাতের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল তবুও ল্যাভেন্ডারের প্রতি ভাইয়ের অনুভূতি দেখে বেশ মজা পেয়েছিল সে। কখনোই সৃজার সামনে না গেলেও খোঁজখবর রাখতো। সেগুলো আবার ইহসানকে শুনিয়ে বেঁফাস অনেককিছু বলে ফেলতো। ইহসান পারতো না একেবারে ওকে মেরে দিতে। নির্লজ্জ ছিল ইনজান, এসবে পাত্তাই দিতো না।
অশ্রুবন্দি পর্ব ৫১
অনিতা রেহমনের মৃত্যুর এগারো মাসের মাথায় বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে একজনকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়ে আরো একবার নিজের উগ্রতার প্রমাণ দিয়েছিল সে। দু’দিন পর সেই ছেলের লাশ পাওয়া যায় নদীতে। ঝামেলাটা সামলানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল আজিজ শেখের পক্ষে, প্রতিবারের মতো উপরমহলকে টাকাপয়সা খাইয়ে কোনোমতে ঘটনা সামাল দিয়ে ছেলেকে বাঁচাতে পাঠিয়ে দেন দেশের বাইরে! ইহসান কটাক্ষ করেছিল সেসময় — পাপ লুকালেও কোনো না কোনো সময় বেরিয়েই আসে!
ইনজানের ছাগলামো ক্লিয়ার?