অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সৃজাকে রেখে এক মুহূর্ত দূরে যেতে চায় না ইহসান।ওর দায়িত্বও কারো উপর চাপাতে চায় না, অন্যের উপর একফোঁটা বিশ্বাস নেই ওর। নিজে যেভাবে নিঁখুতভাবে সৃজার কাজগুলো করে, অন্যকেউ সেভাবে করবে না। তাছাড়া এই মেয়ে নিজের প্রতি বড্ড উদাসীন। খেতে চায় না, জেদ করে। বাচ্চাদের মতো জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়। এসব নিয়ে সারাদিন চিন্তায় কাটানো ইহসান বুঝতে পারছে না ওকে একা রেখে ইনজানের খোঁজ করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না! মনটা যদিও একদম সায় দিচ্ছে না, তবুও সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। ইনজান যা শুরু করেছে তাতে কোনদিন কী ঘটনা ঘটায় কে জানে! এই বিকৃত মস্তিষ্কের ভাইটাকে নিয়ে সে আছে মহা যন্ত্রণায়।
তখনকার ফোন কেটে যাওয়ার পর ইনজান আবারো ম্যাসেজ পাঠিয়েছে তাকে। সৃজার ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছে। এসব নিয়েই ইহসান দুশ্চিন্তায় আছে। যতক্ষণ না ওকে একটা শিক্ষা দিতে পারছে ততক্ষণে অবধি ওর শান্তি নেই। লোকেশন যখন একবার ট্রেস করা গেছে, অতি শ্রীঘ্রই ওকে ধরা দরকার। নয়তো আবার কোথাও ঘাপ্টি মারবে কে জানে! এখন বাজছে রাত একটা। একটু পরই ইহসান বের হয়ে যাবে৷ সৃজা ঘুমিয়ে। নাইমুর সাহেব মারা যাওয়ার পর থেকে রাতে সৃজার গাঢ় ঘুম হয় না। বহুকষ্টে ঘুমালেও পুরোপুরি হয় না, ছাড়াছাড়া ঘুম হয়। একবার ডাকলে আর ঘুম হবে না সারারাত। ঘুমন্ত সৃজাকে এভাবে রেখে যেতে ওর মন সায় দিচ্ছে না। মনটা ‘কু’ ডাকছে। যদিও এসবে সে বিশ্বাস করে না তবুও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তবে কিছু করার নেই, যেতেই হবে। আর সৃজাকে না বলেই যেতে হবে। বলে গেলে মিথ্যে বলতে হতো, যা সে চায় না। শেফালি খালাকে অবশ্য বলা আছে, সে খেয়াল রাখবে সৃজার। ইহসান ছোট্ট একটা কাগজে নিয়ে তাতে নোট লিখল, ‘আমি খুবই দুঃখিত একটা দিন তোর খেয়াল রাখতে পারছি না তাই। এই একটা দিন আমার হয়ে আমার সৃজার খেয়াল রাখিস সোনা।একটা কাজে বেরুলাম, খুব দ্রুত ফিরে আসব।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— তোর ইহসান।
★ তুই ঘুমিয়েছিলি, বলে যেতে পারলাম না তাই ফিরে এলে কান মলে দিস। ‘টু’ শব্দও করব না।
নোটটা বেড সাইডে গ্লাসের নিচে চাপা দিয়ে রাখলো ইহসান। ঘুম থেকে উঠে সৃজা পানি খায়, ওর খোঁজ করলে তখন নোটটা পাবে। ইহসান ওটা রেখে সৃজার কপালে চুমু খেয়ে শেফালি বুয়াকে ডেকে এনে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
বাইরে ঝড়ো আবহাওয়া। ঠান্ডা বাতাসে সবকিছু শীতল হয়ে আছে। একটু ঠান্ডা লাগতেই ঘুম হালকা হয়ে গেল সৃজার। তবে চোখ খুলল না। ঘুমের ঘোরেই ধীরেধীরে পাশ ফিরে শুতে শুতে ইহসানকে ডাকলো, “ইহসান ভাই, শুনছ? পানি খাব!”
ইদানীং ঘুমের মধ্যে গলা শুকিয়ে যায় সৃজার। কয়েকবার উঠে পানি খাওয়ায় ইহসান। সাথে দু-একটা ফলও জোর করে খাওয়ায়। নিত্যদিনের কাজ এটা। অথচ আজ ইহসান ডাকেনি ওকে। সৃজা গুঙিয়ে উঠে আবার ডাকল ইহসানকে, তবে এবারেও সাড়াশব্দ পেল না। সৃজা পাশে হাত বাড়াল। হাতড়ে হাতড়ে ইহসানকে খুঁজল, ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকল না, পাশটা ফাঁকা অনুভব হলো। এবারে সৃজা চোখ খুলে চাইল। বেডসাইডে জ্বলা আধো-আলোতে দেখল পাশটা শূন্য, ইহসান বিছানায় নেই। সৃজার ভাবল হয়তো বাথরুমে গেছে। তাই এতো বেশি মাথা ঘামাল না, অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু এক মিনিট, দু-মিনিট, তিন মিনিট…একে একে মিনিট বিশেক কেটে যাওয়ার পর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সৃজার ভ্রু কুঁচকে গেল। এতো সময় তো লাগার কথা নয়! কোথায় গেল মানুষটা? কিছু কী হয়েছে? সৃজা দু’বার ডাকল ওর নাম ধরে। কিন্তু সাড়াশব্দ, প্রতুত্তর নেই।
এবারে চিন্তিত হয়ে সাবধানে পেটে হাত চাপা দিয়ে উঠে বসলো সে। ওকে রেখে রাতে কোথায় এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় না ইহসান। কখন, কী লাগে এই ভেবে বেশিরভাগ নির্ঘুম রাত কাটায়, সারাক্ষণ অস্থির থাকে। চাওয়ার আগেই সব হাজির করে। কিছু করতে দূর একা একা বিছানা থেকে নামতেও দেয় না। যা করে সব নিজে করে। চোখের আড়ালে যায় না। আজ তাহলে কী হলো? এতোটা সময় অবধি সাড়া নেই। সৃজা এদিকওদিক তাকিয়ে ঘড়ি দেখল। এরপর ঠিক করল ঘরের বাইরে দেখে আসবে, এতোরাতে ওকে না বলে কোথায় গেল মানুষটা! সৃজা বিছানা থেকে নামতে যাবে তার আগেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল খানিকটা, নিচে মাদুর পেতে শেফালি খালাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।
এতরাতে খালা এইখানে? মানে কী? সৃজা হতভম্ব হয়ে খালাকে ডাকল কয়েকবার। কিন্তু সারাদিন ফায়-ফরমাশ খেটে ক্লান্ত শরীরটা গাঢ় ঘুমে ডুবে থাকায় ওর ডাক শুনতে পেল না। সৃজা হতাশ হলো। হয়তো ক্লান্ত তাই গভীর ঘুমে আছে। ডাকবে না আর ভাবলো। গলা শুকিয়ে আছে, পানি খেয়ে নিজেই একবার দেখে আসবে ইহসান কোথায়। বেডসাইড থেকে গ্লাসটা নিতে গিয়েই চাপা দিয়ে নোটটা পেল সে। ভ্রু কুঁচকে তুলে এনে সেটা পড়লো এরপর বিচলিত হলো। এভাবে না বলে, ঘুমে রেখে কোন কাজে গেল ইহসান?
এজন্যই খালাকে দিয়ে গেছে? অভিমান হলো সৃজার! আনমনে পানির গ্লাসটা নিতে যাবে হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল সেটা। শব্দ হলেও শেফালি বুয়ার ঘুম ভাঙল না। বাধ্য হয়ে সৃজা নামলো। মেঝেতে পা স্পর্শ করল বটে তবে পরক্ষণেই ঘটনাটা ঘটল! বেড সাইডের হলদে আলো-আঁধারিতে চোখ না সওয়ায় স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে কদম ফেলতেই পানিতে পিছলে মাদুরের ভাঁজে পা বাঁধল ওর। পা দু’টো পিছলে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আতঙ্কে চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেল সৃজার। তৎক্ষনাৎ বেডসাইড ড্রয়ারের হাতল ধরার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারল না নিজেকে। বরংচ বেডসাইড টেবিলটার টান খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। উপরে থাকা ল্যাম্পটা সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ঘরটাও আঁধারে ডুবে গেল। সেইসাথে সৃজার শরীরটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। কোমড়সহ পেটে আঘাত লাগল, ডান পা মচকে গেল। চোখদুটো বুজে পেটে হাত দিয়ে তীব্র ব্যথায় সৃজা চিৎকার করে উঠল।
শব্দ আর চিৎকার শুনে শেফালি বুয়া ধরফড়িয়ে উঠলেন। চোখ কচলে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই গোচর হলো না। তার কানে শুধু সৃজার আর্তনাদের শব্দ ঠেকল। শেফালি বুয়া কিছুই বুঝে উঠলেন না, ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। হাতড়ে হাতড়ে কিছু একটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে
করতে বললেন, “কী হইসে ভাবিজান? সব এমুন আন্ধার হইয়া আছে ক্যান? আমি বাত্তি জ্বালাইতাছি।”
বলতে বলতে আন্দাজে সে উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাল; এরপরই হতবাক হয়ে গেল। বিছানার পাশেই মেঝেতে পড়ে আছে টেবিল, ভাঙা কাচের ল্যাম্প, পানির গ্লাস, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঔষধের বক্স, চামচ ইত্যাদি। আর সৃজার অবস্থা তো ভয়াবহ। ব্যথায় চোখমুখ নীল হয়ে এসেছে মেয়েটার। সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে পেট চেপে, পা গড়িয়ে তরল গড়াচ্ছে। শেফালি বুয়ার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। একছুটে গিয়ে ধরল সৃজাকে। কেঁদে ফেলল নিমিষেই। ধীরেধীরে সৃজাকে তোলার চেষ্টা করতে করতে বিলাপের সুর তুলল, “আল্লাহ গো! এইডা কী হইসে? বেশি কষ্ট হইতাছে গো ভাবিজান?”
সৃজা চোখে সব অন্ধকার দেখছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। পেটে তীব্র চাপ, মোচড়ানি আর কাঁপুনি। ব্যথায় আর্তনাদ করছে, অথচ কথা বলার শক্তি নেই ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চটচটে রক্তে ওর পা ভিজে গেছে। আচ্ছা, বাচ্চারা কী ঠিল আছে? সৃজার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে দুনিয়ায় নেই।
এদিকে এতোরাতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ইস্মির বদৌলতে বাড়ির সকলে জেগে গেছে। জড়ো হয়েছে বাইরের দরজায়। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। শেফালি বুয়া এতক্ষণ এতোটাই হতভম্ব হয়েছিলেন যে, বাড়ির কাউকে যে ডাকবে এ ব্যাপারটাও তার মাথায় আসেনি। জোরালো শব্দ শুনেই তা-ই সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। বাইরে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইজহান-ইস্মি, ইমরান-মিতু, আজিজ শেখ-সালেহা বেগম, রান্নার বুয়া, মকবুলের মা। শেফালি বুয়া তাদের দেখে বিলাপ শুরু করল, “ও চাচাজান, ও ভাইজান গো, ভাবিজানের দ্যাহেন কী হইসে? কেমন করতাছে! আল্লাহ গো! কী সর্বনাশ হইছে!”
তার কান্নাকাটি দেখে বকতে গিয়েও থেমে গেল ইজহান, ইমরান আর আজিজ শেখ। বিচলিত হয়ে থাকা ইস্মি আর সালেহা বেগম হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন। মিতুও ঢুকল। সালেহা বেগম সৃজার অবস্থা দেখে মুহূর্তেই ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। ইস্মি ছুটে গিয়ে সৃজাকে ধরল, ততক্ষণে ভারসাম্য হারিয়েছে সৃজা। ইজহান ভেতরে ঢুকে এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল, আজিজ শেখ রাগে কাঁপতে কাঁপতে শেফালি বুয়াকে ধমকে উঠলেন, “এই হারামির বাচ্চা, এই অবস্থা কী করে হইলো ওর?”
“আমি নিচে ঘুমাই আছিলাম, হঠাৎ শব্দ শুইন্না উইঠা দ্যাহি ভাবিজানের এই অবস্থা…”
“ইহসান কই? তুই এতরাতে এইখানে কী করছিলি?”
“ভাইজান কই জানি গেসে, আমারে কইয়া গেসিল ভাবিরে একটু দেইখা রাখতে… আমি পারি নাই গো চাচাজান। কী জবাব দিমু, আমারে মাইরা ফালাইব ভাইজানে…”
“ওয় কী করব? আমার নাতি-পুতির কিছু হইলে তোরে আমি নিজেই মারমু ফকিন্নির ঝি…”
কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ শেফালি বুয়ার। আজিজ শেখ পারেন না তাকে চিবিয়ে খেতে। তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন। এদিকে ইজহান সৃজার অবস্থা দেখে ঢোক গিলছে বারবার! তার মাথা ঘুরাচ্ছে। সবার আর্তনাদে সেও চোখে সব অন্ধকার দেখছে। যেমন দেখছিল, তাদের প্রথম বাচ্চাটার বেলায়! এরকমই হয়েছিল ইস্মির সাথে…সে প্রচন্ড ধাক্কায় ইস্মিকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল! ইজহান দরজা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল, চোখ খুলে আচমকা ভঙ্গুর গলায় চিৎকার করে উঠল, “আমি গাড়ি বের করছি, ওকে হসপিটালে নিতে হবে ইমিডিয়েটলি…”
সাড়ে সাত মাসের টু-ইন প্রেগ্ন্যাসি। ব্লাড প্রেশারের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পেশেন্ট। পেট বড়ো হয়নি পর্যাপ্ত। পায়ে পানি এসেছে, ওজন বেড়েছে। বাচ্চারা এখনো পরিপুষ্ট হয়নি, সঠিক সময় আসেনি দুনিয়ায় আসার। অথচ আজ এতবড়ো দুর্ঘটনা! বিচলিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে সবাই। সৃজার ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন, টেস্ট রিপোর্ট এখনো আসেনি। তবে আপাতদৃষ্টিতে যা দেখেছেন তাতেই অবস্থা ভয়াবহ! ডাক্তাররা ধারণা করছেন সবকিছু ঠিক নেই। এক্ষুনি ও.টি রেডি করতে হবে। প্রি-ম্যাচিউর বেবি। এন.আই.সি.ইউ’তে রাখতে হবে। তবে অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, মা-বাচ্চাদের মধ্যে যে কাউকে বেছে নিতে হতে পারে! এবং এটা নিয়েই আজিজ শেখের সাথে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে ডাক্তার এবং ইজহানের!
তিনি চাইছেন যে-কোনো অবস্থাতে তার নাতি-নাতনি যেন ঠিক থাকে, সৃজার কী হলো না হলো, মরলো না বাঁচলো তাতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ইজহান আর ডাক্তাররা এর ঘোর বিরোধিতা করছে। তাদের এক কথা, এমন সিচুয়েশনে মা-বাচ্চার মধ্যে মা’কেই প্রায়োরিটি দেবেন তারা। ইজহান বাবার একচোখামো আর স্বার্থপরতা দেখে তার উপর চরম ক্ষিপ্ত! রাগে লাল হয়ে গেছে সে। এ কেমন মানুষ? কোন বোধে এই লোক ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে এমন কথা বলতে পারে? সৃজার জায়গায় ইস্মিতা হলেও কী বাবা এমন করতো? ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতো? ইজহান ভাবতে পারছে না কিছু। তার এক কথা, যদি তার বাবা নিজের বংশধর রক্ষার জন্য স্বার্থপর হোন, তাহলে তারচেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
শূন্য বাড়িতে কাজের লোক আর মিতুর ভরসায় ইস্মিকে রেখে আসতে পারেনি ইজহান। সালেহা বেগমের সাথে সেও এসেছে। একটা কেবিন বুক করে দিয়েছে ইজহান। সেখানেই অস্থিরতা নিয়ে বসে আছে তারা। বাবার উপর চোটপাট করে ইজহান কেবিনে এসে দেখল ইস্মি ফোনে ব্যস্ত। দেড় ঘন্টা যাবৎ সে চেষ্টা করছে, ইহসানের নাম্বারে। কিন্তু ফোন ঢুকছে না। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তিত ইস্মি ইজহনের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বোঝাল, ইহসানকে এখনো রিচ করতে পারেনি সে৷ অস্থির হলো ইজহান, মেজাজটাও খারাপ হলো ভীষণ। চেয়ারে একটা লাত্থি বসিয়ে সে মাথা চেপে ধরল। কু* বাচ্চাটা এতরাতে, কাউকে কিছু না বলে কোন ক্ষেতে মূলা খেতে গেল যে নেটওয়ার্ক লাগছে না? আরে বাবা, তুই বাপ হতে যাচ্ছিস, তোর বউ-বাচ্চা মরতে বসেছে…এতদিন তো যাসনি বউ ছেড়ে, আজই গেলি আর এমন বিপদে পড়তে হলো! দুনিয়ার যত নোংরা গালিগালাজ জানা ছিল সব ছুঁড়তে লাগল সে ইহসানকে উদ্দেশ্য করে। ইস্মি হতভম্ব হয়ে গেল। ইতোপূর্বে সে যত খারাপ অবস্থায়ই পড়ুক, এ ধরণের অশ্লীল, নোংরা গালাগালি কখনো শোনেনি ইজহানের মুখে। সে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে।
ইনজানের বাংলোতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেল ইহসানের। পৌঁছে সে কতক্ষণ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। মোজাইকের দেয়ালে বহুদিনের পুরোনো নেমপ্লেটের দিকে চোখ পড়তেই সে থমকে গেল ‘অরণ্যবীথি’ নামটা দেখে। থমকানো ভাবটা কাটতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। তবে শান্ত থাকার চেষ্টা করল। লোহার গেইটটা ভেতর থেকে বন্ধ। ইহসান কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করবে বুঝতে পারল না। সঙ্গী করে যাদের এনেছে তাদের মধ্যে একজন বলল সে প্রাচীর বেয়ে ভেতরে গিয়ে গেইট খুলে দেবে। সবাই তাতেই রাজি হলো। ইহসান মাথা নাড়তেই লোকটা রাস্তার পাশের একটা আমগাছ বেয়ে উঠে গেল। বেশিক্ষণ সময় নিলো না, দ্রুতই গেইটটা খুলে দিলো। ইহসান তাদের সবাইকে একসাথে ভেতরে যেতে বারণ করল, প্রথমে সে যাবে। পরিস্থিতি বুঝে উল্টাপাল্টা কিছু হলে বাকিরা যাবে। সবাইকে সব বুঝিয়ে ধীরেধীরে ‘অরণ্যবীথির’ ভেতরে প্রবেশ করলো সে। ঘাস মাড়ানো বিশাল লন পাড়ি দিতে দিতে ওর মানসপটে ভেসে উঠল মায়ের মুখটা! এই বাংলোতেই বন্দি ছিল চারমাস তার বাবার কাছে! অকথ্য যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল এই বাংলোতেই।
আর ইনজানটাও ঘাপ্টি মেরে আছে এখানে, সে কী জানে এ ব্যাপারটা? ইহসান রাগ চাপা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে চমকে গেল তখনই যখন নীতিনকে দেখল ক্রাচে ভর দিয়ে তড়িঘড়ি করে ভেতরে যাচ্ছে, মুহূর্তেই ছুটে গিয়ে ওকে এক লাত্থিতে নিচে ফেলে দিলো। ক্রাচের সাহায্য নিয়ে হাঁটাচলা করা নীতিন চোখের সামনে ইহসানকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ইহসান ওর কোমড়ে লাথি বসিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই এখনো ওর সাথে আছিস? পায়ের জোর নেই, লুলা হয়ে আছিস এরপরেও ওর সঙ্গ দিচ্ছিস বাস্টা*? তোকে জানে বাঁচিয়ে একটুও লাভ হয়নি দেখছি!”
নীতিন ব্যথায় চিৎকার করে উঠল৷ ভয়ে চুপসে গিয়ে বলল, “মাইরেন না ভাইজান…মইরা যাব আমি!”
“তোর মরাই উচিৎ।”
“বিয়া করি নাই এহনো ভাইজান, একটা বউ নাই আমার৷ লুলা কইরা দিসেন কেডায় আমারে বিয়া করব?”
নীতিন চিৎকার শুরু করল। ইহসান রাগান্বিত স্বরে বলল, “ডাকাতের মতো চেহারা তোর, এমনিতেও মেয়ে দিবে না কেউ। ভয়েই মরে যাবে৷ লুলা করে আমি বরং পূণ্যের কাজ করছি। এখন বল হারামিটার সঙ্গ ছাড়িস নাই কেন? আমি ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম না?”
সবাই চেহারা ছবি দেখে নীতিকে কালো বলে, হুদকা বিলাই বলে, ডাকাত বলে। ছোটোবেলার কালো হওয়ায় কালু ডাকলেও কেউ ডাকাত বলতো না৷ বড় হয়ে যখন টুকটাক অপরাধে জড়িয়ে গেল, গা জা খাওয়ার বদৌলতে যখন টকটকে লাল হয়ে গেল চোখ, তখন থেকেই সকলে ওকে ডাকু নীতিন বলে ডাকে৷ তবে ইনজান স্যার বেশ ওর ডাকাত মার্কা চেহারার বেশ প্রশংসা করে তার সেনাপতি হওয়ার অফার করেছিল। অফারে রাজি হওয়ায় দুটো লুঙ্গি কিনে দিয়ে ফাইভ স্টারে নিয়ে খাইয়েছিল ইনজান, সোনারগাঁও হোটেলে স্যুট-টাই পরে সাহেব সেজে নরম বিছানায় এক রাত কাটিয়েছে সে। ছোটো স্যারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুইমিংপুলে ছবি তুলেছে। ফর্সা, সুদর্শন ছোটো স্যারের এই ব্যবহারে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল নীতিনের মনটা। আর কেউ যেই দাম তাকে দেয় না, ছোটো স্যার দিচ্ছে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কখনো অবাধ্য হবে না ছোটো স্যারের। ওসব টুক টাক মার খেয়ে বড়ো ভাইজান কীভাবে ভাবলো, সে ইনজান স্যারের সঙ্গ ছেড়ে দেবে? পা গেছে যাক, হাত গেলেও যাক, প্রাণ গেলেও যাক! ছোটো স্যারের সঙ্গ সে আজীবন দেবে। মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নীতিন চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে ইহসানকে বলল, “কাজকাম পাই না, পেট চালাইতে ছোটো স্যারের সঙ্গ দিতাছি বাধ্য হইয়া ভাইজান…”
নীতিনের কাহিনী সবটা জানে ইহসান। তাই ওর কথা বিশ্বাস করল না। চুলগুলো মুঠোবন্দি করে টেনে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “তোকে আমার চেনা আছে।
তুই হচ্ছিস নেড়ী কুত্তা। ছোটো স্যারের ডানহাত তুই। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে ওর সঙ্গ ছাড়াতে পারিস না সেসব কাহিনী বেশ জানা আছে আমার৷ এখন বল, ইনজান কই?’’
চুলে টান খেয়ে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে নীতিন বাধ্য হয়ে বলে দিলো, “উপরের ঘরে…”
ইহসান ওকে ছেড়ে দিয়ে পা বাড়ালো ভেতরে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে নীতিন ডেকে অসহায় গলায় বলল, “সারা শইল্যে ছোটো স্যারের বেদনা…রাইতে ঘুমাইতে পারে নাই। আপনে কী করবেন…”
ইহসান জ্বলন্ত চোখে নীতিনকে একবার দেখল এরপর এসে চোয়াল বরাবর ঘুষি বসালো, “এত দরদ দেখাবি না, চুপচাপ থাক হারামি।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৫২
বলে উপরে চলে গেল। মাথা গরম অবস্থায় সবগুলো ঘর খুঁজল একে একে। ইনজানকে পেল একেবারে শেষ মাথার ঘরটায়। দরজা চাপানো ছিল। ইহসান ঠেলে ঢুকলো। ঢুকেই নাক চেপে ধরল সে। ম দের বিশ্রি গন্ধ ভাসছে। এসি অন করা। ইনজান এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উদোম গায়ে। বুকের নিচে বাঁধাই করা বড় একটা ছবি, ইহসান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা টেনে বের করে হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে গেল। সৃজার একটা ছবি, তাও অনেক বছর আগের। ওর ছবি বুকে করে ঘুমাচ্ছে ইনজান? ইহসানের মাথায় তড়তড় করে রক্ত উঠে গেল। তার বউয়ের ছবি নিয়ে, তার ঘুম হারাম করে ইনজান এখানে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে? পকেট থেকে হ্যান্ডগা-নটা বের করে উদোম, ফর্সা পিঠে হ্যান্ড-গানের নলটা ঠেকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দিব? দেই? চিরশান্তির ঘুমে পাঠিয়ে দেই?”