অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসান মাথা গরম অবস্থায় সবগুলো ঘর খুঁজল একে একে। ইনজানকে পেল একেবারে শেষ মাথার ঘরটায়। দরজা চাপানো ছিল। ইহসান ঠেলে ঢুকলো। ঢুকেই নাক চেপে ধরল সে। ম দের বিশ্রি গন্ধ ভাসছে। এসি অন করা। ইনজান এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উদোম গায়ে। বুকের নিচে বাঁধাই করা বড় একটা ছবি, ইহসান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা টেনে বের করে হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে গেল। সৃজার একটা ছবি, তাও অনেক বছর আগের। ওর ছবি বুকে করে ঘুমাচ্ছে ইনজান? ইহসানের মাথায় তড়তড় করে রক্ত উঠে গেল। তার বউয়ের ছবি নিয়ে, তার ঘুম হারাম করে ইনজান এখানে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে? পকেট থেকে হ্যান্ডগা-নটা বের করে উদোম, ফর্সা পিঠে গানের নলটা ঠেকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “দিব? দেই? চিরশান্তির ঘুমে পাঠিয়ে দেই?”
কর্কশ কণ্ঠ আর সূক্ষ্ম কিছুর খোঁচা পিঠে লাগতেই একটু নড়ল ইনজান। তবে উঠে গেল না। কপালে লেপ্টানো চুলের ভাঁজ থাকা ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল তার। বিরক্ত দেখাল তাকে। বন্ধ চোখের পাতা না খুলেই সে অস্পষ্ট শব্দ করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “নীত! সিরিঞ্জ আর ডিংক্স রেডি রাখ, উঠেই এক সিপ নেব। গা ব্যথায় জন্য রাতে জমেনি। রাগ হচ্ছে আমার… ”
ইনজানের কথাগুলো শুনে ইহসান মোটেও অবাক হলো না। এসবের সঙ্গে সে পরিচিত। ভাইয়ের ব্যবহার তার জানা। তবে অবাক না হলেও সে বিরক্ত হলো প্রচন্ড। হ্যান্ডগানটা আরো জোরে চেপে ধরল ওর মেরুদন্ড বরাবর, এরপর সেটা ধীরেধীরে ওর সম্পূর্ণ পিঠ, ঘাড় বেয়ে মাথার পেছনে ঠেকাল। এরপর ওর কানের কাছে গিয়ে নিম্ন স্বরে বলল, “অনেকক্ষণ হয়েছে আমি তোর ডেরায় এসেছি, ওয়েলকাম না করে পরেপরে ঘুমাচ্ছিস! রাগ তো আমারও হচ্ছে জান! আমার বউয়ের ছবি তুই বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিস…ইচ্ছে তো করছে তোর শরীরের প্রতিটা হাড়-মাংস জ্বালিয়ে নিজেকে শান্ত করি। তুই কী উঠবি, না কি এভাবে ঘুমিয়ে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবি?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কানের কাছে নিঃশ্বাসের গরম ছোঁয়া আর অতি পরিচিত, আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বরের হুমকি শুনতেই ইনজান চোখ খুলে তাকাল। তাকাতেই শক্ত, গম্ভীর ও রাগান্বিত চেহারাটি ওর চোখে অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। ঘুমের রেশ না কাটায় কয়েকবার চোখ কচলে নিয়ে এরপর শীতল কণ্ঠে বলল, “এভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব? সিল্লি না?” ইনজান ঠোঁটের কোণে একটুকরো ব্যঙ্গ হাসি টেনে নিয়ে চোখে চোখ রাখল ইহসানের। “ব্রো, তুমি চাইলে গুলি করতে পারো… বাট ফ্রম হোয়ার আই স্ট্যান্ড, মরে গিয়ে তোমার হিরো বানানোর শখটা পূরণ করতে পারব না। আর ল্যাভেন্ডারের ছবিটা বুকের নিচে ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা শুয়ে ঘুমোনোর জন্য না, ভেতরের আগুনটাকে জিইয়ে রাখার জন্য।”
ইহসান গর্জে উঠল, “তুই কী বলছিস ঠিক করে বল!”
এবার আস্তে করে উঠে বসল ইনজান। চাদর না গায়ে দিয়ে এলোমেলো চুলে, উদোম গায়ে হালকা এক নেশাগ্রস্ত অথচ হিমশীতল চাহনি নিয়ে ওর দিকে তাকাল, “তুমি জানো না, আমার ভেতরের একেকটা হাড়, একেকটা শিরা, ল্যাভেন্ডারের নাম ধরে হাঁকে রাত-বিরেতে। আমি একজন এডিক্টেড। ড্রা গ স
এবং ল্যাভেন্ডারে! দুটোতেই আসক্ত…”
ইহসান সটান ওর কপালে গানটা এবারে চেপে ধরে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখল। রাশভারি স্বরে সে স্বগোতক্তি করল, “আর আমি শুধুই ওর প্রতি আসক্ত!”
“গ্রেট জব!”
“আমার আসক্তিকে দুর্বলতা ভেবে বারবার ভুল করেছিস তুই।”
“ভুলের শাস্তি দিতে চলে এসেছ?”
বিকৃত চাহনিতে ইনজান তাচ্ছিল্যভরে তাকাল। যেন মজার কথা শুনেছে, এমন করে দুলে দুলে হাসলো সে। ইহসান পুরো সময়টা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওকে এমন প্রতিক্রিয়াহীন দেখে থেমে গেল ইনজান। চোখের দৃষ্টি প্রথমে তাক হলো ব্যারেলে, এরপরই ভাইয়ের মুখের দিকে। ইহসানের চোখদুটো তখ উদ্বেলিত। ছলছল করছে যেন এক সমুদ্র জলে। ইনজান বুঝতে পারল না সেটা রাগের কারণ, না কি স্নেহের পরশ! বিভ্রান্তি নিয়ে পাশে থাকা একটা কাচের গ্লাস চেপে ধরল হাতের মুঠোয়। গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “তুমি কী পেয়েছ ওর মধ্যে? কেন ছাড়তে পারছ না ওকে আমার জন্য?”
“জীবন খুঁজে পেয়েছি। পরিপূর্ণ জীবন। যে জীবনে ও একমাত্র আমার নিজের কেউ, যাকে আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে দাবি করতে পারি, অধিকার দেখাতে পারি। অথচ একটু অভিযোগ না করেও ও আমার সব দাবিদাওয়া মেনে নিতে পারে সেই জীবন। সৃজা একদম আমার নিজের। লিখিত, অলিখিত সবভাবেই। ও আমাকে ভালোবাসা-সম্মান দিচ্ছে, নিঃস্বার্থভাবে। আমাকে আমার পরিচয় দিচ্ছে, আমার বাচ্চাদের নিজের গর্ভে ধারণ করেছে, জানিস তুই? এটা কতবড় উপহার আমার জন্য? আমার অশুদ্ধ রক্তকে ও শুদ্ধ করে দিচ্ছে, সব কলঙ্ক মুছে দিচ্ছে—ওদের দ্বারা। ও যখন জেনে গেল, আমি একটা অশুদ্ধ মানুষ। ওর চোখে আমার জন্য করুণা, ঘৃণা ভাসেনি। বরং আমার প্রতি ওর ভালোবাসা আর দৃষ্টি গাঢ় হতে দেখেছি। আমাকে হারানোর ভয় পেতে দেখেছি।
আর এজন্যই ও আমার আসক্তি, ভালোবাসা সব।
ওকে ছাড়া সব কেমন দুঃস্বপ্ন লাগে, এই দেখ,
তোকেও লাগছে!”
কঠোর এবং পরিপক্ক স্বরে কথাগুলো বলে একটু থেমে ইহসান এবারে নিচু গলায় বলল, “এভাবে আগলে রাখার, সম্মান দেওয়ার, ভালোবাসার এমন কেউ তোর নেই, আমার আছে। আর ওটাই তুই নিতে পারিস না ইনজান! সেই ছোটো থেকে তোর লোভ আর আকৃষ্টতা আমার সব জিনিসের প্রতি। অথচ তুই কখনো অর্জনই করার চেষ্টা করিসনি, চেয়েছিস আদায় করে নিতে। যার জন্য তোর অবস্থান আজকে এখানে, একজন নিঃস্ব’র মতোন। ইজহানের তো তাও ইস্মিতা আছে, যতোই পাগলামি-ছাগলামো করুক নিজের আপন কাউকে লোফারটা খুঁজে নিয়েছে। অথচ তুই আমার জিনিস কেড়ে নেওয়ার ধান্ধায় থাকতে থাকতে এমন পর্যায়ে গেছিস যে বাপ নামক নোংরা লোকটা ছাড়া আপন কাউকে খুঁজেই নিতে পারিসনি। আর এখানেই তুই জীবনে গো হারা হারলি এবং এভাবেই হারবি…শুধুমাত্র তোর এই নোংরামোর জন্য!”
ইনজানের আচরণ অস্বাভাবিক। দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ। কাঠিন্যতা ভর করেছে সুদর্শন মুখটাতে। চোয়াল জোড়া শক্ত। রক্তাভ হয়ে গেছে চোখ। এ কথাগুলোকে সে ঘৃণা করে, যতোটা ঘৃণা করলে একজন মৃত নারীকে জীবিত করে তাকে আবারো
ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে, ঠিক ততোটাই। নেই,
নেই এবং নেই— শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত, ত্যক্ত বিরক্ত। ইনজানের হাতের চাপ শক্ত হলো৷ গ্লাসটাকে সে ততক্ষণ চেপে ধরে রাখল যতক্ষণ না সেটা বিদীর্ণ হলো। এরপর প্রচন্ড জোরে আচমকা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল, নিস্তব্ধ ঘরটাতে বজ্রপাতের মতো বাজল শব্দটা। গ্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে এসে পড়ল ওর চোখেমুখে। ইহসান তীক্ষ্ণ চোখে চুরমার হওয়া গ্লাসটা দেখে নিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ইনজানের দিকে তাকাল। ঠোঁটে রক্ত আর চোখে আগ্রাসী রাগ নিয়ে ইনজান তখন কাঁপছে। কণ্ঠস্বরে উন্মত্ততা,
“আর আমার তোমার সেসব কিছুই চাই যেগুলো তুমি আমার হতে দাওনি। যেগুলো আমারও পাওয়ার কথা ছিল, অথচ তুমি একা পেয়েছ।”
ইহসান বাঁকা হেসে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলো, গানটা এবারে ঠিক বুকের বাঁপাশে ঠেকিয়ে বলল, “সারাজীবন তোরা আমাকে এরজন্যই হিংসা করে গেছিস অথচ চেষ্টাও করিসনি সেগুলো অর্জন করার। আজ যেসব আমি পেয়েছি আর পাইনি, নিয়তিতে লিখা ছিল বলেই। যেমন ধর, সৃজা! নিয়তি ওকে আমার জন্য বরাদ্দ করে রেখেছিল বলেই ওকে আমি পেয়ে গেছি! আর নিয়তি যখন নিজের কাজ শুরু করে, তার পথকে কেউ থামাতে পারে না। সৃজা আমার৷ আমারই থাকবে। ”
ইনজান হালকা হেসে বলল, “খুব নিয়তির গল্প করছ না? তাহলে শোনো… নিয়তির একটা জঘন্য দিক আছে, সে কাউকে চিরকাল একজায়গায় রাখে না। যেমন তুমি ভাবছো, তোমার বউ তোমারই থাকবে, এমনও হতে পারে নিয়তি একদিন তাকে তোমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কারো বুকে তুলে দেবে। তখন আমার আজকের অবস্থান, এই শূন্যতা তুমি খুঁজে পাবে নিজের মধ্যে।”
“একটা প্রবাদ আছে, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। অনেকবার প্রমাণ পেয়েছি। তাই আমি একটুও ভয় পাচ্ছি না ইনজান।”
“তোমার সৃজা তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে, তোমার
ভাই তার সুযোগ নেবে, এই ভয় তো ঠিকই পাচ্ছ!”
ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই নিজের কল্পনায় বাস করিস, ইনজান! আমি কখনোই ও হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে তোকে ভয় পাই না। তুই ওর ক্ষতি করে দিবি বলে ভয় পাই। রিয়েলিটিতে যদি সৃজা জানে
যে, আমার ছোটোভাই তোর মতো কোনো কুলাঙ্গার! তাহলে ওর গা গুলিয়ে উঠতো। তাই বিকৃত চিন্তাভাবনা আর হিংসায় জ্বলা জিভ দিয়ে আমার বউয়ের নাম উচ্চারণ করবি না!”
“তাই?” ইনজান আবার ব্যঙ্গ করল, “খুব জ্বলে? অধার্মিক মনে হয় আমাকে? খুব নিকৃষ্ট লাগে? আচ্ছা, তুমি কী ইনসিকিউরড ফিল করছ যে, তোমার বাচ্চাদের মা আমার হ্যান্ডসামনেসের প্রেমে পড়ে যায় তাহলে..”
ওর নোংরা কথাটা শেষ হতে দিলো না ইহসান। ঘৃণাভরে বলল, “ও যদি কোনোদিন তোর দিকে তাকায়ও, সেটা ঘৃণা এবং ঘৃণাই হবে… ভালোবাসা
তো দূর কি বাত।”
ইনজান কপালে হাত দিল, ওর চোয়াল কাঁপছে ভয়ানক রাগে। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে বলল, “ভালোবাসা আর ঘৃণার মাঝখানে একটা রেখা আছে ব্রো, সেখানেই আমি দাঁড়িয়ে থাকব না হয়! দেখব কী আছে ওর মধ্যে, কেন ঘায়েল তুমি ওর প্রতি…ওর মা’কে কিন্তু আমার ভারী পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু বেচারি আমার এতো ভালো প্রস্তাব না মেনে অকালে প্রাণটা খোয়ালো। অথচ প্রস্তাবটা মানলে চারটা ছেলের মা হতো, আমরা একটা মা পেতাম। ল্যাভেন্ডার আমাদের বোন হতো, তখন ওকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো না আমাদের, দু-ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো থাকতো…”
নোংরা ইঙ্গিত, বেপরোয়া কথাবার্তা এবং পুরোনো ক্ষতে আঁচড় পড়তেই ইহসানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল এবার। চোখ আরও কঠিন হলো। গভীর ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ল সে। গলার শিরাগুলো ফুলে উঠল, ট্রিগারের উপর রাখা আঙুলটা দৃঢ় হয়ে উঠল।
চোখের পলকে ট্রিগার টিপে দিলো ইহসান। ঠাস করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হলো। ইনজানের শরীরটা ছিটকে গেল একটু পিছনে, কিন্তু পড়ে গেল না। শেষ মুহূর্তে ইহসানের মতিগতি বুঝে একটুখানি সরে যাওয়ায় গুলিটা লেগেছে ঠিক ওর বাঁ কাঁধের কাছে। কাঁধটা একটু দুলে উঠল, চাদরের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল গাঢ় রঙের লাল রক্ত। তবে ঘাবড়ে গেল না। ওর চোখে অন্যরকম উত্তাপ। অথচ মুখে বিকৃত হাসি, রক্তমাখা ঠোঁটের কোণ উঁচু করে বলল, “একটুর জন্য মিস করে গেলে। নেক্সট টাইম হার্টে মেরো, না হলে মরব না!”
ইহসানের চোখে আগুন। এমন প্রতিক্রিয়ায় সে অভ্যস্ত না। তার চোখের দৃষ্টি কাঁপছে, হাত জোরে কাঁপছে, কিন্তু সে নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে সংবরণ করছে। একটা লাথি বসিয়ে দিলো সে ইনজানের কোমড়ে। চুলের মুঠি একত্র করে জোরালো আঘাত করল মেঝেতে। ইনজান তাতেও দুর্বল হলো না। কাঁধের একপাশ চেপে ধরে আজেবাজে বকতেই ব্যস্ত,
“তুমি জিতেছ ভালোবাসা পেয়ে, আমি জিতব সব ছিনিয়ে নিয়ে। তোমার যতটা না ভালোবাসা, আমার ততটাই ক্ষত।”
রাগান্বিত, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ইহসান ওকে আচ্ছামত মেরে আবারও ওকে শুট করে ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ করতে উদ্যত হলো ঠিক তখনি পেছন থেকে নীতিন চিৎকার করে উঠল, “মাইরেন না, মাইরেন না ভাইজান। ছোটো স্যার মইরা যাইব। আপনের ভাই লাগে হ্যায়, এমনে মারবেন? ভাইজান একটু শুনেন আমার কথা, আপনের আব্বা ফোন দিসে, আপনের লগে কথা কইতে চায়, ছোটো স্যাররে ছাইড়া দেন…”
ক্র্যাচে ভর দিয়ে একহাতে ফোন নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে তখন নীতিন। তার করুণ দৃষ্টি মেঝেতে পড়া ইনজানের দিকে। অনুনয় করতে লাগল সে বারবার ইহসানকে ওকে না মারার জন্য। কাজের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটানোয় ইহসান প্রচন্ড বিরক্তি আর রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকাল। ওর ভয়ঙ্কর চাহনি দেখে নীতিন ঢোক গিলে ফোনটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “জরুরি কথা ভাইজান, এক্ষুণি কইতে হইব..”
ইহসান এক মুহূর্ত থেমে গাঢ় শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করল। চুলগুলো ঠেলে পেছনে সরিয়ে
কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল। হাতে থাকা গানটা আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরে ইনজানকে আরো একটা লাথিতে ছিটকে সরিয়ে দিলো, নীতিন আবারও হায় হায় করে উঠল। কাঠের ক্র্যাচদুটো চালিয়ে দ্রুত ছুটে এসে ইহসানের কাছে দাঁড়াল সে ভয় নিয়ে। ফোনটা লাউড স্পিকারে দেওয়া, ওপাশ থেকে আজিজ শেখের চিন্তিত, ভয়ার্ত গলা শোনা গেল। নীতিনের কাছ থেকে সব শুনেছে বোঝাই যাচ্ছে। তিনি ইহসানকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাচ্ছেন, “আব্বাজান
তুমি যদি ওরে কিছু করো, তোমার বউরে কিন্তু আমি বাঁচাই রাখমু না। এমনিতেও বাঁচার অবস্থায় নাই, আমার কিন্তু বেশি কষ্ট করতে হইব না ওরে পিষে দেওয়ার জন্য। তুমি যদি ওর জানটুকু চাও, তাইলে আমার জানরে নিস্তার দিয়া দ্রুত চইলা আসো। তোমার বউয়ের অবস্থা ভালো না, হসপিটালে আছে…”
এক মুহূর্তের জন্য ইহসান স্থবির হয়ে গেল। পা দুটো থেমে গেল, বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর। বিভ্রান্তি আর সন্দেহ নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “হসপিটালে মানে? সৃজার কী হয়েছে?”
“তোমার পাকনা বউ পাকনামি করতে গিয়া আছাড় খাইয়া পইড়া গেসে। যে বান্দির বাচ্চারে দেখাশোনার জন্য দিয়া গেসিলা, সে মরার মতো এমন ঘুম দিসে যে কিছুই কইতে পারে নাই। এখন তোমার বউ আর আমার নাতিপুতির জীবনমরণ নিয়া টানাটানি।”
ইহসানের মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল সে, “কখন ঘটল এসব? কেউ আমাকে কিছু জানায়নি কেন? সৃজার কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ব না।”
“তোমারে তো বড়বৌ ফোন দিতাছে সেই রাত থেইকা, নেটওয়ার্ক নাই। আমি আন্দাজ করছিলাম তুমি আমার ছোটোবাপের কাছে যাইবা, আন্দাজটাই ঠিক হইসে। নীতিন না জানাইলে তো… যাইহোক, এখন ভাবো, ঠিক করো কী করবা…”
ভাবার মতো এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করল না ইহসান। যে কাজে এখানে এসেছিল, সেটা
অসমাপ্ত রেখেই একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ইহসান যেতেই নীতিন ছুটে এসে ধরল গুলিবিদ্ধ, জ্ঞানশূন্য ও রক্তাক্ত ইনজানকে।
দশ ব্যাগ রক্ত লাগবে সৃজার। ডোনার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজিজ শেখ কিছু ডোনার জোগাড়
করে এনেছেন, কিন্তু তাতেও দুই ব্যাগ কম পড়ল। ইমার্জেন্সি ডোনার খুঁজে না পাওয়ায় তখন ইজহান রক্ত দিলো সৃজাকে। ইতোপূর্বে কখনো কাউকে রক্ত না দেওয়া ইজহানকে আজ নিজে থেকেই এত উচাটন হতে দেখে ইস্মির চোখে জল চলে এলো। মানুষটা বারবার বাবার সাথে ঝগড়া করছে সৃজার সুস্থতার জন্য, বাচ্চাগুলোর জন্য। এমনকি রক্ত দেওয়ার পর বিশ্রাম না দিয়ে, কিছু না খেয়ে সে ও.টির সামনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে শুধুমাত্র মা, বাচ্চা তিনজন সুস্থ আছে কি না সেই খবর জানতে।
ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, ওদেরকে নাজেহাল করে তুলছে একটুকুতেই। সারাজীবন স্বার্থপর ভেবে আসা মানুষটার এমন রুপ দেখবে, ইস্মি কখনো ভাবেইনি। এমনকি ও.টি শেষ হওয়ায় পর ছুটোছুটি করে ফ্রেটারনাল টুইনসদের এন.আই.সি.ইউতে শিফট করার সময়, ইজহান
এতোটা ব্যস্ত হয়নি ওদের জন্য, যতোটা না সৃজা
সুস্থ আছে কি না জানতে হয়েছে। সৃজার অবস্থা ক্রিটিকাল। বর্তমানে পোস্টপার্টাম হেমোরেজ-এর কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার প্রেসার ড্রপ করেছে। রক্তের গ্রোথ স্বাভাবিক করার জন্য কয়েক ব্যাগ রক্ত ট্রান্সফিউশনের পরও ওর হিমোগ্লোবিন স্থিতিশীল হয়নি। ডাক্তাররা বলছেন, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি শরীর রক্ত ধরে রাখতে পারে এবং ইনফেকশন না হয়, তাহলে সম্ভাবনা আছে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনো সে অচেতন, সাড়া দিচ্ছে না। যারজন্য ওকে আই.সি.ইউতে রাখা হয়েছে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে। আজিজ শেখ ওর বিষয়ে মোটেও ভাবছেন না, তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে নাতি-নাতনিদের নিয়েই ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। ইজহান যখন আরো একবার কথা-কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে গেল তার সাথে, তখনি ওর ফোন বেজে উঠল। তিক্ততা নিয়ে ইজহান ফোন নিয়েই দেখল ইহসান কল করেছে। সে রিসিভ করেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কু* বাচ্চা, কোন গর্তে লুকাইছিস যে কোটি কোটি ফোনও যায় না? যায় না যখন ফোন করিস না আর, একেবারে বউয়ের খতম পড়াতে আসিস।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৩
ফোনের ওপাশ থেকে অস্থির ইহসানের কর্কশ ও রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করল, “অশুভ! তোর মুখের চোপা ভেঙে ফেলব উল্টাপাল্টা কথা বললে। তুই কোথায় আর আমার বউ কেমন আছে সেই খবর দে। তোর আব্বাজান কিন্তু ওকে মারার তালে আছে। আমি কিন্তু সৃজার কিছু হলে তোর বউকেও মেরে দেব। তাই বলছি, ওকে কয়েকঘন্টার জন্য দেখে রাখ, তোর বউও বেঁচে থাকবে।”
ইজহান এবারে রাগলো না ওর উপর, গালাগালিও ছুঁড়ল না। বলল, “তোর বউবাচ্চা সবাই ইন্টেনসিভ কেয়ারে আছে।”
ফোনের ওপাশে থাকা ইহসান থমকে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। স্টেয়ারিংয়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে সে বলল, “ওহ গড!”