অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৫

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৫
ইসরাত জাহান ফারিয়া

কয়েক ঘন্টা জার্নি করে হাসপাতালে পৌঁছে বাড়ির কারো সাথে দেখা না করে, কোনোদিকে না তাকিয়ে কাউন্টার থেকে ইহসান সোজা এলিভেটরের দিকে গেল। কিন্তু এলিভেটর খালি না পেয়ে ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে।
একসাথে দুই-তিন ধাপ লাফিয়ে উঠতে লাগল। হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে হঠাৎ এমন ছুটে চলা দেখে কয়েকজন থমকে তাকালেও সে কারো দিকে ফিরেও তাকাল না। ষষ্ঠ তলার ইন্টেসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে গিয়ে থামার পরই ওর পা দুটো থামল। জনসাধারণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চারপাশ জনশূন্য, নীরব। আলো-অন্ধকারের খেলায় করিডোরটা দীর্ঘ আর ভুতুড়ে লাগছে। বুকের ভেতরে জমে থাকা ভয়, অজানা এক আশঙ্কা ওকে অস্থির করে তুলছে। গলার ভেতর আটকে আছে শব্দগুলো। পা জমে যাচ্ছে। ভর দিয়ে হাঁটলেও মনে হচ্ছে মেঝে নিচে দেবে যাচ্ছে। দেয়ালে টাঙানো ওয়ার্নিং সাইনগুলো চোখে লাগছে বেশি। বারবার মাথায় ঘুরছে একটা কথা, ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ঢোকা মানে চুক্তি করা। জীবনের সাথে অথবা মৃত্যুর সাথে।

ঘর্মাক্ত দেহ, আর আতঙ্কে বুক ধরফড় করতে থাকা ইহসান দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চেষ্টাটুকুও বিফলে গেল সম্পূর্ণই। টেনশনে ওর গলা শুকিয়ে গেছে৷ পানি পান করা দরকার। কিন্তু সৃজাকে এক পলক না দেখলে এক সমুদ্র পানি পান করলেও ইহসানের এই অস্থিরতা কমবে না। পাগল পাগল হয়ে সে বাইরে থেকে এন্ট্রান্স ডোরে নক করল কয়েকবার। কিন্তু তৎক্ষনাৎ সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতর থেকে কেউ না আসায় আতঙ্ক আর রাগ ওকে গ্রাস করে ফেলল ভেতরে ভেতরে। রাগান্বিত হয়ে কয়েকটা লাথি বসিয়ে দিলো দরজায়, “হে! কেউ আছেন? ওপেন দ্য ডোর!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওর চিৎকারে পুরো করিডোর কেঁপে উঠল এবং অল্প সময়ের মধ্যে কিছু স্টাফ দৌড়ে এলো। তাদের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কড়া গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহসান চেঁচিয়ে উঠল, “কতক্ষণ যাবৎ ওয়েট করছি আমি? কোথায় ছিলেন আপনারা? দরজা খুলছিলেন না কেন? আমি দেখা করব পেশেন্টের সাথে। দেখি সরুন।”
বলে সটান হাঁটা ধরল ভেতরে প্রবেশের জন্য। ওর চিৎকারে মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যাওয়া স্টাফদের এবারে টনক নড়ল। দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর আগেই ওরা ইহসানকে থামিয়ে দিলো। একজন বিরক্ত গলায় জানাল, আইসিইউ-তে কারো প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু ইহসান সেটা মানতে চাইল না, সে যেকোনো প্রকারে ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু স্টাফরা চায় ওকে এখান থেকে বের করে দিতে। ওকে সরাতে পারছে না দেখে একজন বেশ দম্ভ নিয়ে ওর কলারে হাত রাখতেই ইহসানের মাথা ঘুরে গেল রাগে। ঘুষি বসাল ছেলেটার নাকে। বেচারার নাক দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগল। কলিগের এ অবস্থা মেনে নিতে পারল না বাকি দু’জন। শুরু হয়ে ঝামেলা। এক, দুই করতে করতে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। এই সময়েই ইন্টেনসিভ কেয়ারের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সদ্য জয়েন করা ডাক্তার নাবিলাতুজ জোহা। বাইরে এমন অস্থির অবস্থা দেখে তিনি ধমকি দিয়ে লোকজনদের সরতে বললেন। আর ঝামেলার মধ্যমণি উদ্ভ্রান্ত যুবককে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনি এখানে ঝামেলা করছেন কেন? একটু আগেই তো পেশেন্টের কন্ডিশন তার বাড়ির লোকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

রাগে ফুঁসতে থাকা ইহসানের মস্তিষ্ক তখন এতকিছু ভাবছে না। সে তেঁতো স্বরে জবাব দিলো, “আমাকে কিছুই জানানো হয়নি।”
নাবিলাতুজ জোহা কপাল কুঁচকালেন, “আশ্চর্য! আমি যখন বলছিলাম আপনি সেখানেই ছিলেন। অথচ বলছেন আপনি জানেন না!”
“না, জানি না। কানে যায়নি আপনার?”
ওর গলার রুক্ষতা, চোখের অস্থিরতা, বেয়াদবি আচরণ দেখে নাবিলা তুজ জোহা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এইতো আধঘন্টা আগে মা আর বাচ্চাদের কন্ডিশন, লাস্ট আপডেট এই পেশেন্টের বাড়ির লোকদের জানিয়ে এসেছেন, তখন এ লোকটাও ছিল। অথচ এখন অস্বীকার করছে? মাথায় সমস্যা আছে না কি স্ত্রী-সন্তানের দুর্দশা দেখে এ অবস্থা লোকটার? হয়তো তাই। তিনি আর কথা বাড়ালেন না এ ব্যাপারে। পরিস্থিতি সামলানোর নিমিত্তে পরখ করতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নাম?”
“ইহসান শেখ।”
“পেশেন্টের কে হোন?”
উত্তরটা দিতে গিয়ে গলার স্বর ভেঙে গেল ইহসানের, “হাজব্যান্ড।”

নাবিলাতুজ জোহা আবারও অবাক হলেন, তখন যা বুঝলেন, এ লোকটা পেশেন্টের বড়ো ভাইয়ের মতো হয়, অথচ এখন বলছে স্বামী? মানে কী? সব এতো উলটপালট লাগছে কেন? তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না তবে এটা বেশ বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো লোকটা কতটুকু অস্থিরতা পুষছে বুকের ভেতরে। অবশ্য এখানে আসা প্রত্যেকটা পেশেন্টের কাছের মানুষদের রিয়েকশন আতঙ্কগ্রস্তই থাকে। তবে এই লোকের চোখেমুখে অন্যরকম উন্মত্ততা, এক ধরনের অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে,

যা তিনি এর আগে খুব কমই দেখেছেন। কিন্তু এটা তার কাজের জায়গা৷ রুলসের বাইরে তিনি যেতে পারেন না। তাছাড়া কাজে যোগ দিয়েছেন সপ্তাহও পেরুয়নি, এরমধ্যে আবেগে পড়ে রুলস ভঙ্গ করাটা অনুচিত। তাই গলার স্বর যথাসম্ভব নম্র করে বললেন, “আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি মিস্টার শেখ…কিন্তু আমাদের হসপিটালের কিছু রুলস, রেগুলেশন আছে যেগুলো পেশেন্টের ভালোর জন্যই আমরা সেটা ভঙ্গ করতে পারি না। তাই সরি, আমরা এখন আপনাকে এলাউ করতে পারছি না। যখন সময় হবে তখন দেখা করবেন। পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করুন।”
“আমার আচরণের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না। না মানে না। এক্ষুনি, এ মুহূর্তে ওকে দেখতে চাই ডক্টর, ব্যবস্থা করুন। প্লিজ, এই দেখুন আমার শ্বাস আটকে আসছে! আমি আমার বাচ্চাদেরও দেখিনি, ওকে না দেখে ওদের কাছে যেতে পারব না আমি…”

ভীষণ অসহায় কণ্ঠে কথাগুলো বলল ইহসান। বলতে বলতে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল ও। নাবিলাতুজ জোহা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন। আবেগের তাড়নায় বাস্তবতা ঢাকা পড়ে গেল তার। নিজের পেশাগত দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে, তিনি বললেন, “মিস্টার শেখ, আমরা বুঝি আপনার অনুভূতি। কিন্তু রুলস রুলসই। পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আপনি চাইলে এখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখতে পারেন। তবে এক মিনিটের বেশি নয়। সিনিয়ররা ব্যাপারটা খুব ভালো চোখে দেখবে না, ঝাড়ি খেতে হবে আমার।”
রিকগনিশন পেয়ে একটু শান্ত হলো ইহসান।

পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট পরে, এন্ট্রান্স ডোর পেরুল। কাচের দরজার সামনে দাঁড়াল অস্থির হয়ে। কেবিনের ভিতরে অগণিত তারের জটলা, ভেন্টিলেটরের শব্দ। বেডে শোয়া সৃজা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। পুরোপুরি চেহারা দেখা যাচ্ছে না ওর। অজস্র ইন্ট্রাভেনাস লাইন দ্বারা বেষ্টিত দেহটা পুরোপুরি নিস্তেজ এবং নির্জীব, একটুও নড়চড় নেই। এক রাতের ব্যবধানে অভিমানী, জেদী মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দেখে ইহসানের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। হাতের নখ মুঠোয় চেপে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে, “বেশি আদরে বাঁদড় বানিয়ে ফেলেছি যে এতো বড়ো কান্ড ঘটানোর আগে একবারও তোর বুক কাঁপেল না? একটা রাতই তো একা রেখে গেছিলাম, এরজন্য এতবড়ো শাস্তি দিলি? নিজের একটুও খেয়াল রাখলি না? একবার সুস্থ হো; ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্নাবান্না সব আমি তোকে দিয়ে করাব, করাবইই।”

মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। শ্বাস ভারী ঠেকে ওর। গলা কাঁপতে থাকে। একটু থেমে বড়সড় একটা ঢোক গিলে চাপা স্বরে আটকে আটকে বলে, “আমার ছোট্ট বুকটা খা খা করছে, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, তুই কেন ওভাবে শুয়ে থাকছিস? উঠে পড় না সৃজা, বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড় না আমার এই হতভাগা বুকটাতে। শুনছিস তুই? আমি কিন্তু তোর বাচ্চাদের দেখিনি, তোর কোল ছাড়া দেখবও না। ভালো হয়ে এ নিয়ে দোষ দিতে আসলে তোর চেহারার মানচিত্র বদলে ফেলব আমি।”

ইজহান শক্ত মুখ করে ইহসানকে দেখছে। এই মুহূর্তে রাগে ওর সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটা ঘুষি মেরে ভেড়টার চোয়াল ভেঙে দিতে। মানে একটা মানুষ এতোটা ইররেসপন্সিবল কীভাবে হয় যে, তার প্রেগন্যান্ট বৌকে রাত-বিরেতে একা, ঘুমে রেখে, কাউকে কিছু না জানিয়ে আরসালানের মতো পাগলকে বধ করতে যায়? কোনো মানে হয় এসবের? সে তো ইস্মিতাকে এ অবস্থায় রাতে একা রেখে কোথাও যায় না। গেলেও সবাইকে একশোবার করে জানিয়ে দিয়ে যায় তার বউয়ের দিকে যেন নজর রাখে, নয়তো সবাইকে শেষ করে দিবে। আর মহামান্য ভেড়া মহাশয় শেফালি খালাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে, যার কি না ঘুমই ভাঙে না। ইজহান সেসব ভেবেই ককটেল হয়ে আছে। তবুও দুইবার নিজে গিয়ে সেঁধেছে, বাচ্চাদের দেখে আসতে। হারামি, মীরজাফর আবার ডায়লগ দিচ্ছে, সে না কি বৌয়ের কোল ছাড়া বাচ্চাদের দেখবে না। কোনো মানে হয় এসবের?।এরপর আবার ভং ধরে কিছু না খেয়ে করিডোরে বসেই আছে ঘাড় সোজা করে। ইজহান মনে মনে ভাবছে, ঘাড়টা ধরে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের দেখিয়ে আনতে! কিন্তু সে পারছে না, ভেড়ার শুকনো মুখ দেখে। আরসালানের ব্যাপারটা আপাতত সে তুলছে না সেজন্যই। কয়েক পাক ঘুরে এসে ইজহান অস্থিরতা নিয়ে গিয়ে আবারও সাঁধল, “অনেক হয়েছে, এইবার চল। বাচ্চাদের বয়স কিন্তু একদিন হয়ে যাচ্ছে…”

“যাব না একবার বললাম তো। কানে শুনতে পাসনি?”
“তুই এখন দুঃখের মুডে আছিস, তাই তোর কথা গোণায় ধরা প্রয়োজন বলে মনে করছি না। ঠেকায় পরে বারবার সাধছি। পরে তো খোঁটা দিয়ে বলবি, তোকে তোর বাচ্চাদের প্রথম প্রথম মুখদুটো
দেখতে দিইনি।”
ইহসান ওর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল, “আমাকে একা থাকতে দে।”
বলে চলে এতে উদ্যত হতেই আচমকা ইজহান চট করে ওর ঘাড় চেপে ধরল, ইহসান প্রতিরোধের চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। ইজহানের নির্দেশে মিজুও এসে একপাশ থেকে ওকে ধরল। দু’জনে মিলে জোর করে নিয়ে যেতে লাগল এন.আই.সি.ইউ ইউনিটে, বাচ্চাদের কাছে। ইহসান পা দিয়ে কয়েকটা লাথিও বসাল, রাগের আগুন ঝরাল দু-চোখ দিয়ে, গালাগাল ছুঁড়ল। কিন্তু যখন বাচ্চাদের কেবিনের সামনে এলো সঙ্গে সঙ্গেই চুপ
হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একজন ডাক্তার
এসে ওদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে এরপর
ইজহানকে বলল, “পাঁচমিনিটের বেশি এলাউ করা যাবে না। দূর থেকেই দেখবেন।”
ইজহান প্রচন্ড বিরক্ত মুখে বলল, “ওকে ফাইন। আপনি বিদায় হোন।”

অতঃপর দুই ভাই প্রথমবারের মতো বাচ্চাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ইনকিউবেটরের স্বচ্ছ কাচের ভেতরে শুয়ে থাকা ছোট্ট দুটি মানবশিশু, অকালপ্রসূ জন্মের পরও জীবনতাড়নায় স্পন্দিত। ক্ষীণদেহ, মাথাভর্তি ঘন কালো চুল, টকটকে লাল ঠোঁট, ক্ষীণ হাতে-পায়ে টুকটাক নড়চড় সব মিলিয়ে এক অপার্থিব আবেগে থমকে গেল দু’জনের হৃদয়। অভিজ্ঞতা নেই, প্রস্তুতিও নেই—তবু এটাই তাদের প্রথম পরিচয়, প্রথম মুখদর্শন। ইজহানের হঠাৎ বুকের ভেতর হাহাকার উঠল কী উষ্ণ এক ভালোবাসা, সে বোঝে না। আচমকা ইহসানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “ওরা তোর রক্ত, তোর প্রতচ্ছবি, তোদের অঙ্গজ। ইস্মিতা ওদের বড়োআম্মা, আমি ওদের বড়োআব্বা। কংগ্রাচুলেশনস ব্রাদার! টনা-মনার মধ্যে তোর আর আমাকে দেখতে পাচ্ছি। এরা এরা যেমন , তেমনি থাকতে দে৷ আমাদের মতো যেন অভাগা, হতভাগা না হয়। শুনছিস তুই? যদি শত্রুতার জন্য ওদেরকে আমাকে ধরতে না দিস তাহলে খবর করে ফেলব…’’

বঅলতে বলতে আরো শক্ত করে ইহসানকে জাপ্টে ধরল ইজহান। ওর এমন কান্ডে কোনোরুপ বাক্য বিনিময় করল না, বিস্মিতও হলো না ইহসান। চোখের কোণে জমা এক ফোঁটা পানি অতি গোপনে মুছে নিয়ে সে শুধু অপলক তাকিয়ে রইল তার রক্ত, উত্তরসূরি, অস্তিত্ব, ভবিতব্যদের সবচেয়ে বড় কথা তার সৃজার দিকে। ক্ষীণ হাতে ছোট্ট আঙুলগুলো যেভাবে নড়ছে, ছোট পা দুটি যে কাঁচ ছুঁয়ে তার কাছে আসতে চাইছে; ইহসান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে শুধু সেসবই দেখে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই ওর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল বাবা হওয়ার মতো দামি অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আব্বাজানেরা, বলতে পারেন আমি লোভী। আপনাদের আম্মার বুকে দেখব বলেও শেষ পর্যন্ত লোভী মনটাকে থিতু করতে পারিনি, দশঘণ্টা পরে এসে আপনাদের দেখতে এলাম।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৪

এরজন্য আমাকে মাফ করবেন না জানি, কিন্তু আমার অভিযোগ যে আপনাদের প্রতি অনেকগুলো—সেগুলো বলতে এসেছি। কেন এত দ্রুত, এত ছোট্ট অবয়ব নিয়ে এলেন? আমি তো চেয়েছিলাম, আপনাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধটা আপনাদের ওজনে ভেঙে পড়ুক, আমার সত্তাও যেন কাঁপে। আপনারা আপনার আম্মার মতো বুকের মাঝে জলোচ্ছ্বাসের মতো ঢুকে পড়বেন, আমি ঝড় হয়ে আগলে রাখব আপনাদের। কিন্তু… কি থেকে কী হয়ে গেল, সব এলোমেলো। আমি আপনাদের জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি, তবে ভয় হচ্ছে, আমি সামলাতে পারব তো আপনাদের? আপনাদের মাকে? ঐ নিষ্ঠুর নারী দেখুন আমাকে কীভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আপনাদের পেটে আনার পরেও, পেট থেকে বের করার পরেও…”
“আস্তাগফিরুল্লাহ!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৬