অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৬

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তার বাচ্চাদের দেখে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই ওর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল বাবা হওয়ার মতো দামি অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আব্বাজানেরা, বলতে পারেন আমি লোভী। আপনাদের আম্মার বুকে দেখব বলেও শেষ পর্যন্ত লোভী মনটাকে থিতু করতে পারিনি, দশঘণ্টা পরে এসে আপনাদের দেখতে এলাম। এরজন্য আমাকে মাফ করবেন না জানি, কিন্তু আমার অভিযোগ যে আপনাদের প্রতি অনেকগুলো—সেগুলো বলতে এসেছি। কেন এত দ্রুত, এত ছোট্ট অবয়ব নিয়ে এলেন? আমি তো চেয়েছিলাম, আপনাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধটা আপনাদের ওজনে ভেঙে পড়ুক, আমার সত্তাও যেন কাঁপে। আপনারা আপনার আম্মার মতো বুকের মাঝে জলোচ্ছ্বাসের মতো ঢুকে পড়বেন, আমি ঝড় হয়ে আগলে রাখব আপনাদের। কিন্তু… কি থেকে কী হয়ে গেল, সব এলোমেলো। আমি আপনাদের জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি, তবে ভয় হচ্ছে, আমি সামলাতে পারব তো আপনাদের? আপনাদের মাকে? ঐ নিষ্ঠুর নারী দেখুন আমাকে কীভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আপনাদের পেটে আনার পরেও, পেট থেকে বের করার পরেও…”

“আস্তাগফিরুল্লাহ!”
আবেগ বহিঃপ্রকাশের মুহূর্তে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথার পর ইজহান ধরেই নিয়েছিল ইহসান এবার ক্ষেপে যাবে। কিন্তু ওর ভুল ভাঙল পরক্ষণেই; যখন নিজের পিঠে দুটো শক্ত হাতের চাপ বিচরণ করল। কাঁধে একটা অসহায় দীর্ঘদশ্বাস পড়ল, একফোঁটা অশ্রু গড়িতে পড়ল। মাথাটা ধীরে গুঁজে গেল আরো। সৃজা বাদে এভাবে কাউকে জড়িয়ে ধরেছে এর আগে মনে নেই ইহসানের। দুর্বলতা প্রকাশ ওর স্বভাবে নেই। কাউকে ছুঁয়ে ভরসা নেওয়ার অভ্যাস ওর নেই। আগে তো বহু দিন গেছে, গলা আটকে এলে, বুক চাপা কষ্টে ভেঙে গেলেও পাশে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ইজহানের সঙ্গে তো তার আজন্ম শত্রুতার সম্পর্ক—অহেতুক অথচ অনিবার্য! দু’জনের মিলমিশ হয়ে উঠেনি কখনো। বিবাদ লেগেই থাকতো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে, একটা সময়ের নির্লিপ্ত, আত্মকেন্দ্রিক ইজহান ওর অনুপস্থিতিতে যেভাবে বাচ্চাদের ব্যাপারটা সামলেছে, সৃজাকে প্রটেক্ট করেছে, আজিজ শেখের চক্ষুশূল
দৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছে তা ইহসানকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অথচ ইজহান এমন নয়। সে কেবল নিজের স্বার্থ দেখে৷ নিজের আরাম-আয়েশ ছাড়া কিছু ভাবতে চায় না, নিজের বউ ছাড়া কিছু বোঝে না। আজ ওর মধ্যে এই পরিবর্তন এতটাই অপ্রত্যাশিত যে কৃতজ্ঞতা শব্দে ধরা যাচ্ছে না। ইহসান কিছু বলতে পারছে না। আড়ষ্টতায় চেপে আছে ইহসানের গলার স্বর, চোখের ভাষা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে ইজহান ছিল আগের মতোই স্থির। কিছু না বলে, শব্দ না করে বিস্মিত সে নিঃশব্দে ভাইয়ের বুকের সাথে মিশে রইল। এই সেই ভাই, যাকে ভেড়া বলে খোঁচানোয় অদ্ভুত আনন্দ পায় সে। যার চোখে শত্রুতা খুঁজে নিতে নিতে বড় হয়েছে। সেই ভাইটির হৃদযন্ত্র আজ যেন বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে। মুখে কোনো কথা না, নত হওয়া না, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না, না কোনো ব্যাখা! তবুও ইজহান বুঝতে পারল,
এই জড়িয়ে ধরার ভেতর এক পৃথিবী কৃতজ্ঞতা মিশে আছে। ঠোঁটের কোণে এক বিচিত্র হাসির রেখা ফুটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটোতেও টলটলে একটা ঝিলিক খেলে গেল সেই মুহূর্তেই। এই তো, এই ইহসান শেখ—যার সঙ্গে তার নাম, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ, এমনকি ডিএনএ-ও মিলে যায়! অথচ জন্ম থেকে ওর সাথেই লেগে আছে এক নীরব প্রতিযোগিতা, এক অব্যাখ্যাযোগ্য দ্বন্দ্ব। কেন? প্রশ্নটা বহুবার করেছে নিজেকে, উত্তর পায়নি কখনো। কখনো
মনে হয়েছে বাবা-মায়ের পক্ষপাতিত্ব দায়ী, কখনো আবার শুধুই নিজের অভিমান, ঈর্ষা।
কিন্তু এসব ভাবনার বাইরেও, আজ বুকের গভীরে একটা শীতল প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ইস্মিতাকে বুকের কাছে পেলে হয়। এমনটা কেন হচ্ছে? সে তো ভাইকে ভালোবাসে না! অন্তত এতদিন সেটাই ভেবেছে। তাহলে এই প্রশান্তি, এই অদ্ভুত আবেগ; এসবের মানে কী? বিভ্রান্ত ইজহানের মাথায় হঠাৎ সময়ের কথা আসতেই সে ফিসফিসিয়ে বলল, “টাইম ওভার! এলাউ করবে না আর, বাইরে যাই? বাইরে গিয়ে জড়াজড়ি করি? টনা-মনা দেখছে!”

পাঁচ মিনিটের সময়টুকু ইহসানের কাছে যেন এক মিনিটও মনে হয়নি। আশ্চর্য! এত দ্রুত সময় কেটে গেল? যদি আরও কিছু সময় পেত, বাচ্চাদের আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারত, প্রাণভরে দেখতে পারত। ইহসানের ভেতর চাপা এক রাগ দানা বাঁধল৷ এত ছোট্ট বাচ্চা তারা, অথচ জন্মের পরপরই সে তাদের কোলে নিতে পারেনি। যখন কোলে নেবে, তখন আর সেই প্রথম অনুভূতিটা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। সে ইজহানকে ছেড়ে সরে গেল। ইনকিউবেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আপনাদের স্থান এখানে—আমার বুকে। খুব তাড়াতাড়ি কঠিন সময়টা কাটিয়ে উঠুন, মা’কে নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। আপনারা চলে গেলে, আব্বা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।”
একটু থমকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে পুনরায় বিড়বিড় করে বলল, “বাইরে এলিজ কাঁদছে। যদি আপনাদের কিছু হয়, ওর কাছে আব্বার মুখ থাকবে না…”

ইহসান না আসা পর্যন্ত কেউ শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে খবর পাঠায়নি। ও ফেরার পরই খবর পাঠানো হয়েছিল। এলিজা তখন ভার্সিটিতে। গুরুত্বপূর্ণ টপিকের উপর ক্লাস নিচ্ছিল রজব স্যার, যিনি খুব কড়া মানুষ। তার ক্লাসে এটাই নিয়ম যে, কেউ ক্লাসের সময় কথা বললে বা এটেন্ড না করলে শাস্তি পেতে হয়। এমনকি সঠিক সময়েই ক্লাসে না উপস্থিত হলে ডাস্টারও ছোঁড়া হতে পারে। তার ক্লাসের মধ্যে সবসময় পিনপতন নীরবতা থাকে, সবাই ভয়ে থাকে যেন কিছু না ভুল হয়ে যায়। তবে আজ সেই নীরব মুহূর্ত টুকু ভেঙে দিয়ে সশব্দে বাজতে শুরু করে এলিজার ফোন। সাইলেন্ট মোডে না রাখার কারণে ফোনের রিংটোন কানে যেতেই এলিজা চমকে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত হলেও, ক্লাসের সকলের নজর তার দিকে পড়তেই বুঝতে পারে যে, তার ব্যাগে ফোন বাজছে। রজব স্যার ততক্ষণে রেগে আগুন।
এলিজা নাম্বার চিনতে না পেরে কল কেটে দ্রুত ফোন সাইলেন্ট করে দেয়।

অপরাধী চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলতেই, তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন এবং বেরিয়ে যেতে বলেন। গুরুত্বপূর্ণ টপিকের ক্লাস মিস হওয়ার ভয়ে, এলিজা স্যারের কাছে অনেক অনুরোধ করে তাকে কনসিডার করার জন্য। কিন্তু বদমেজাজি রজব স্যার ওর কোনো কথাই শোনেননি, ডিরেক্ট বের করে দিয়েছেন। হতাশ হয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে একনাগাড়ে বাজতে থাকা ফোনটা রিসিভ করে, ধমক দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে ইহসানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ফোনেই ইহসান জানায় সৃজার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার খবর। তবে সৃজার ইনটেনসিভ কেয়ারে (আই.সি.ইউ) ভর্তি হওয়ার কথা এলিজাকে বলার সাহস পায় না। কিন্তু ওটুকু শুনেই এলিজা অস্থির হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না। হাসপাতালে ছুটে আসার পথে তার ভেতর একরাশ দুশ্চিন্তা, ভয়ের অনুভূতি ছিল। কিন্তু এখানে এসে যখন জানতে পারল সৃজা এবং তার বাচ্চা সকলেই বিশেষ পর্যবেক্ষণ, তাও প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা ধরে, এলিজার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

কোনোমতে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলালেও, বুকের ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল ওর। হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। মা মারা যাওয়ার পর, তেরো বছরের সেই বাচ্চা মেয়েটি যেভাবে এলিজাকে সামলেছিল, সেই তেরো বছরের মেয়েটির মুখটা বারবার এলিজার চোখে ভাসছিল; আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। মা নেই, বাবা নেই, নীলু ফুপি অসুস্থ। আজকাল তিনি আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে, কেউ তাকে ডাকছে, মরহুম স্বামী তাকে নিতে আসছে, কিছু খারাপ হতে চলেছে। ফুপির এসব কথা শুনে এলিজা ভয়ে, দুশ্চিন্তায় রাতে চোখের পাতা এক করতে পারে না। তাই বোনকে হারানোর আতঙ্ক ঘিরে ধরায় শক্ত মনের এলিজা নিজেকে আর আটকাতে পারেনি। বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, কতো আর পারা যায়? এলিজাও পারেনি। নিজের আবেগ, অনুভূতি, দুর্বলতা সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে। ইস্মি আর সালেহা বেগম তাকে সামলানোর চেষ্টা করলেও, ওর কান্না নিঃশব্দ এক আকুতি হয়ে সবার বুকে বিঁধছিল, আর ইহসানের বুকের ভেতর হাহাকার জমা হচ্ছিল। এলিজাকে সচরাচর ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায় না। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত রাখে বলে মেয়েলি নমনীয়তাটা একেবারেই চোখে পড়ে না। আর ওর এই গুণটার জন্য ইহসান ওকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, ভালোবাসে। কিন্তু আজ যেভাবে ও কেঁদেছে, তাতে স্পষ্ট যে, এই মেয়েটা বোনের জন্য কতটা নমনীয়তা পুষে রেখেছে।

ইহসান এখনো এলিজার সামনে যায়নি। তার সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ নেই। যতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে সৃজাকে দেখে রাখার কথা বলেছিল, আজকের বাস্তবতা সেই আত্মপ্রবঞ্চনাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভাঙা কিছু নিয়ে সে এলিজার সামনে দাঁড়াতে চায় না। দাঁড়িয়ে কী বলবে সে? “তোর বোনকে আমি দেখে রাখিনি, এই অবস্থায় একা ফেলে ভাইকে খু ন করতে গেছিলাম, আমাকে সাধুবাদ জানা!” এসব বলবে? ছিহ! তবুও শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধাতস্থ করে, নিঃশব্দে এগিয়ে এলিজার পাশে বসে মাথা নিচু করে খুব আস্তে বলল, “কাঁদিস না প্লিজ, এলিজ!”
এলিজা মাথা তুলে তাকায় না, বরং চোখের পানি
গাল বেয়ে পড়তেই থাকে, “আপু যদি না ফিরে আসে ভাইয়া… আম্মু-আব্বুর মতো যদি চলে যায়…”
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে ওর, আর কিছু বলতে পারে না। সেইখানেই থেমে গিয়েও আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।
ইহসানের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলেও কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে ওর মাথায় রাখে, “উহু! কেউ যাবে না। না তোর আপু, না আমার সৃজা আর আমার ছেলে-মেয়ে। কেউ না। তুই ওদের জন্য দোয়া করবি… আমার বিশ্বাস আছে, আল্লাহ আমাদের এই পরীক্ষা থেকে পার করে নেবেন।

তবে তোকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তুই ভাঙলে আমি আর কাকে ভরসা করব বলতো?”
এলিজা চোখ তুলে তাকায় ইহসানের দিকে। অসহায়, বিধ্বস্ত, কিন্তু তবুও আশায় টিকে থাকা দুই জোড়া চোখ একে অপরকে দেখতে থাকে।
“তুই আমার ছোটো, কিন্তু আমার চেয়ে সাহসী। এখন তুই এভাবে কাঁদলে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারবো
না এলিজ।”
ইলেকট্রিক বাতির নিচে, কান্নায় ভেজা চোখ মুছে এবার আস্তে করে মাথা হেঁট করে ফেলে এলিজা। ইহসান ওর গাল থেকে অশ্রুবিন্দু মুছে দেয়, “ভিজিটিং আওয়ারে আমি যাব না। তুই ওকে দেখে আসবি। তোর আপু তোর কণ্ঠ চেনে। তুই ডাক দিলে ও শুনবে…বলবি আমি প্রচন্ড রেগে আছি ওর উপর। গুণে গুণে চারটা থাপ্পড় খাবে সুস্থ হওয়ার পরে…”

এলিজা চোখ মুছে নিয়ে মাথা নেড়ে ইহসানকে
আশ্বস্ত করে, সে আর কাঁদবে না। ওর প্রতিশ্রুতি ইহসানকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইজহান দীর্ঘ সময় ধরে ওদের ভাই-বোনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার চোখে কোনো বিরক্তি নেই, বরং এক অজানা টান অনুভব করছে সে, ইহসান, সৃজা, এলিজা… এদের প্রতি, বাচ্চাদের প্রতিও। এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। নিজেকে ইজহান জানে, সে স্বার্থপর। তার দুনিয়াতে মনোযোগের
কেন্দ্রে শুধু একজনই আছে, সেটা তার ইস্মিতা।
তবু ওদের জন্য আজ মন কেমন কেমন করে বলে
সে ওখানে আর দাঁড়ায় না। চুপচাপ কেবিনে চলে আসে। এসে দেখে কেউ নেই আশেপাশে। ইস্মি মুগ্ধ চোখে চুপচাপ বসে বাচ্চাদের ছবি দেখছে। ইজহানের কী হলো কে জানে, হঠাৎ করেই দস্যুর মতো ইস্মিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর গাল, গলা ভিজিয়ে ফেলে চুমুতে চুমুতে। প্রথমে চমকে গিয়ে ইস্মি ওকে ঠেললেও ওর শক্তির সাথে পেরে
উঠে না। বরং ইজহান জবরদস্তি করে ওর ঠোঁটে
ঠোঁট রেখে দেয়।ওর স্পর্শে ইস্মির শরীর অবশ হয়ে আসে। ওকে আর আটকায় না।

ঠিক এর কয়েক মুহূর্ত পরই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসেন সালেহা বেগম। বের হয়েই ওদের এমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বিব্রত হয়ে বাইরে চলে যান। কাঠ হয়ে থাকা হতভম্ব ইস্মি কেঁদে ফেলে। ইজহান ভেবে পায় না সে তার বউকে আদর করেছে, চুমু খেয়েছে এতে লজ্জার কি আছে? বিরক্ত সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “কান্নাকাটি করে নাটক শুরু করবি না। আমি তোর বর—ভুলে যাস না যেন।”
ইজহানকে ভাবলেশহীন ও বিরক্ত হতে দেখে ইস্মি রেগে উঠে, “স্থান-কাল বিবেচনা করেন না আবার মেজাজ দেখাচ্ছেন? আম্মা কি ভাবল? অবিবেচক, নির্লজ্জ!”
ইজহান উত্তেজিত হয়ে গেল, “জোর করি না বলে মাথায় উঠে গেছিস? কতদিন আদর দিস না তুই? আমি কি নপুংসক? ফিলিংস নেই? রাতে ঘুমাতে পারি না, খবর আছে? আজ যেচে পড়ে হ্যাংলা হয়েছি তাই চোখ রাঙাচ্ছিস? শেইম অন ইউ, ইস্মিতা…”

আসলেই ইজহান সেই রাগারাগির ঘটনার পর থেকে ইস্মিকে যন্ত্রণা দেয় না। বরং যথেষ্ট স্পেস দেয়।
তবে এতে যে মহাশয় নিজেকে কীভাবে সামলায় তা মনে করেই ইস্মির হাসি পেয়ে যায়। ও ঠোঁট টিপে হাসি চেপে বলল, “আমাকে শেইম দিলে কী হবে? সংসার তো আমার সাথেই করতে হবে, আমার বাচ্চার বাবাও হতে হবে।”
এই কথাটা ভারী পছন্দ হয় ইজহানের। তাই মেজাজটাও হালকা হয়ে যায় তার। প্রসঙ্গ বদলে সে বলল, “বউকে শেইম অন দিলে কী পাপ হয়?”
ইস্মি হাই তুলতে তুলতে বলল, “প্রায়শ্চিত্ত না করা অবধি পাপ হয়।”
ইজহান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওর গা ঘেঁষে বসে দুটো ভয়ের ঢোক গিলে নমনীয় কণ্ঠে বলল, “মায়ের মা, আমাকে মাফ করে দিন।”
“হবে না।”
“কেন?”
“পাপ করতেই থাকবেন।”
“করব না।”
“ভুলে যান আপনি বারংবার।”

“ভালোবাসা কমিয়ে দিলেই তো আমি পাপ করে ফেলি! আমার কী দোষ? আমি নির্দোষ।”
মুখ কালো করে কথাগুলো বলল ইজহান। ইস্মি আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ওকে। অভিযোগের শেষ নেই এ লোকের। ভালো হয়ে যাব বললেও এ লোক ভালো হবার নয়। অন্তত আদরের ক্ষেত্রে তো নয়ই। হতাশ ইস্মি ওর শার্টের কলার ধরে টেনে এনে টপাটপ ওর ঠোঁটে পরপর কয়েকটা চুমু বসিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আপনার অভিযোগ, আদরের খোঁটা শেষ হবে না এ জীবনে। তাই আদর দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। আমি বাচ্চাদের ছবি দেখছি। দয়া করে আর জ্বালাবেন না।”
কথাগুলো দারুণ পছন্দ হলো ইজহানের। ইস্মি নিজে
থেকে আদর দেওয়ায় সে সব ভুলে নিদারুণ আগ্রহ নিয়ে বাচ্চাদের ছবি দেখতে লাগল!

তিনটা নিষ্পাপ প্রাণের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় একে একে কেটে গেছে দুটো দিন। সবকিছু ফেলে অস্থিরতার সহিত ইহসান ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে যাচ্ছে তার প্রিয় প্রাণগুলোকে সুস্থভাবে দেখার আশায়। ইস্মির এমন অবস্থায় বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও নিজে হাসপাতাল থেকে একচুলও নড়েনি ইহসান। তবে ওর সাথে জেদ ধরে এলিজাও কোথাও যায়নি। নীলু ফুপিকে ভাড়াটিয়া আন্টির আয়ত্তে রেখে নিজে এখানে পড়ে আছে। দিনের অন্তিম প্রহর চলমান। সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারিপাশ। ব্যস্ত শহরের কৃত্রিম আলোর সাথে তাল মিলিয়ে অন্ধকার খেলছে আলো-আঁধারির খেলা। তারমধ্যে একটু আগেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। হসপিটালের ওয়েটিং লাউঞ্জের জানালার পাশে বসে চুপচাপ বৃষ্টি দেখারত অবস্থায় একজন স্টাফ ইহসানকে খুঁজতে খুঁজতে এসে জানাল, সৃজা রেহমানের জ্ঞান ফিরেছে।

বৃষ্টির ঝিম ধরা শব্দে গুমোট মন নিয়ে বসে থাকা এলিজা টের পেল গত দুটো দিন সে এ খবরটা শোনায় প্রতীক্ষায়ই ছিল। কান্নায় ওর চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডিসপেনসারিতে স্যাম্পল আনতে যাওয়া ইহসানকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে চঞ্চলা পাখির মতো ছুট লাগাল ইন্টেসিভ কেয়ারের দিকে। তবে আপুর সঙ্গে দেখা করার পারমিশন পেল না। ইহসান এসে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার পর জানা গেল, আজ দেখা করার অনুমতি পাওয়া যাবে না। যদিও পেশেন্টকে নিয়ে এখন চিন্তার কিছু নেই। তবে কিছু কমপ্লিকেশনস আছে যেগুলোর জন্য অবজারভেশনে রাখতে হবে ওকে। তাছাড়া নরমাল বেডে শিফট করার পরে আরো কয়েকদিন হসপিটালে থাকতে হবে।

শারীরিক যন্ত্রণা আর নানা কম্পলিকেশন্সের কারণে বেশিরভাগ সময় সেডেটিভের প্রভাবেই ছিল সৃজা। সাধারণ বেডে ওকে শিফট করা হলো চব্বিশ ঘন্টা পরে। বেডে দেওয়ার আরো কয়েকঘন্টা পর ওকে দেখার পারমিশন পাওয়া গেল। ইহসানের জোরাজোরি না মেনে এলিজা আগে ওকেই পাঠাল পরিস্থিতি বিবেচনা করে। যেন দু’জনে একান্তে কিছুটা সময় কথা বলতে পারে। ইহসান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে ধীরপায়ে কেবিনে প্রবেশ করে দেখল মলিন, ফ্যাকাশে মুখে এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে সৃজা। ওর চোখদুটো রক্তিম। শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখেই সৃজা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল। ওকে কাঁদতে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইহসানও। হুঁশ ফিরে আসামাত্রই মারকুটে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সে সৃজার দিকে। চাপা কিন্তু রাগান্বিত স্বরে বলল,
“এই তোর দায়িত্বজ্ঞান আর নিজের প্রতি খেয়াল রাখা? তিনদিন অজ্ঞান থেকে, আমাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে? শান্তি পেলি তো? আমাকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পেলি?”

সৃজা কিছু না বলে শুধু অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তাতে ওর চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ওকে নীরবে কান্না করতে দেখে ইহসান আরো ক্ষেপে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমড়ে একহাত রেখে অন্যহাতে চুলে ব্যাকব্রাশ করার মতো করে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে দাঁড়াল। একপাশের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ‘‘যাহ! আমি কেন তোর কাছে এক্সপ্লেনেশন চাইছি? আমি কে? আমি তো খারাপ, দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী। তোকে না বলে ঘুরতে চলে গেছি। নিজের বউ-বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারিনি যখন, তখন কিছু বলারও অধিকার নেই আমার।
আই এম সরি।”
সৃজা ওকে দেখে, ওর কথা শুনে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় একাকার হয়ে গেল। শব্দ করে কেঁদে উঠে অস্ফুটস্বরে বলল, “বাচ্চারা আমার পেটে নেই কেন? ওরা কোথায়? আমার বাচ্চা কোথায়?”
“আমার কাছে জানতে চাইছিস কেন? তুই নিজেই তো ভালো জানিস ওরা কোথায়!”

সৃজার সাহস হয়নি কাউকে বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করার, যেচে পড়ে কেউ কিছু বলেওনি তাকে। ওর তাই দৃঢ় বিশ্বাস তার বাচ্চারা আর নেই। অবশ্য থাকবেই বা কীভাবে? যেভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তাতে সাড়ে সাত মাসের টুইন প্রেগ্ন্যাসি টেকার কথা না। তাহলে কি ও কষ্ট পাবে বলেই কেউ ওকে কিছু বলছে না? সৃজার সুন্দর চোখদুটো পানিভর্তি হলেও তাতে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ আর অনুশোচনা। যেন খুব বড়ো একটা ভুল করেছে সে, যার কোনো ক্ষমা নেই। ওকে দেখতে এখন ঠিক, আদালতের কাঠগড়ায় তোলা আসামির মতো লাগছে। ইহসান ওর কান্নাকাটি দেখে মৃদুস্বরে ধমকে উঠে, “কান্নাকাটি বন্ধ।”
“ও…ওরা দেখতে কার মতো হয়েছিল?”

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠে ইহসান, “হয়েছিল মানে? ভাববাচ্যে কথা বলে কী বুঝাতে চাইছিস?”
কী বোঝাবে সৃজা? আসলেই কী বোঝানোর মতো ওর কাছে কোনো শব্দ আছে? নেই তো। এতো বড়ো কান্ড ঘটানোর পর কোনমুখে ওদের নাম নেবে সে? সৃজা অপরাধে জর্জরিত মুখটা ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ওর মাতৃসত্তা যন্ত্রণা, হাহাকারে ওকে অতিষ্ঠ করে তুলছে ওকে। সৃজার মনে হচ্ছে ও মরে যাবে। নিজের প্রতি একটু যদি খেয়াল রাখতো, একটু সাবধান থাকতো তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। দু’জনকে পাশে নিয়ে চোখ জুড়াতো। নিজের খামখেয়ালিপনায় বাচ্চাদুটোকে হারিয়ে সৃজার ভেতরটা মরে গেছে। পেটে হাত রেখে ও ব্যাকুল হয়ে কাঁদতেই থাকে।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৫

ওর অবস্থা দেখে মায়া হয় ইহসানের। হতাশ হয়ে এগিয়ে এসে ওর শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে দিলো। চোখ বুজে মৃদু কণ্ঠে বলে, “তুই জানিস আমি মরে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে? তুই না ফিরলে আমার জানাযা হতো?”
সৃজার ঠোঁট কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। অসহায়ের মতো অনুনয় করে সে, “আমার বাচ্চারা কোথায়? কেন বলছ না তুমি?”
“বাচ্চারা এন.আই.সি ইউতে।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৭