অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসান হতাশ হয়ে এগিয়ে এসে সৃজার শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে দিলো। চোখ বুজে মৃদু কণ্ঠে বলল, “তুই জানিস আমি মরে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে? তুই না ফিরলে আমার জানাযা হতো? তুই এসে আবার আমার জান বাঁচিয়ে দিয়েছিস, নয়তো আজ আমাকে আর দেখতে পারতি না।”
সৃজার ঠোঁট কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। অসহায়ের মতো অনুনয় করে সে, “আমার বাচ্চারা কোথায়? কেন বলছ না তুমি?”
“বাচ্চারা এন.আই.সি.ইউতে।”
কথাটা শোনার পর সৃজা এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাসই করতে পারল না যে তার সন্তানরা আছে, সত্যিই আছে! ওর চোখ দুটো স্রেফ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। শরীরে যতটুকু যন্ত্রণা আর কষ্ট ছিল, এক ঝটকায় সব যেন হারিয়ে গেল। খুশিতে চিকচিক করে উঠল ভেজা চোখদুটো। ইহসানের বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে গেল ওর এই আনন্দটুকু দেখে। সে সৃজার কপালে ভেজা একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যেভাবে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিস তোরা, শাস্তি হিসেবে এবার থেকে তিনজনকে সামলাতে হবে তোর। আমি কিন্তু আর কাউকে সামলাতে পারব না৷ এবার আমার ছুটি, আর নেই এসবে…”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“তোমার মতো করে আমি তো পারব না সবকিছু একা হাতে সামলাতে। উল্টো আরো ঝামেলা করব!”
“মারব একটা চড়! কী পরিমাণ চিন্তায় রেখেছিস তুই আমাকে, অন্য কেউ হলে এতক্ষণে টপকে যেত! আসলে আগের সৃজাই তুই ভালো ছিলি, নিজেকে একটু হলেও সামলাতে পারতি। অতি ভালোবেসে, তোকে যত্মে রেখে আহ্লাদী বানিয়ে সব ভুল আমি করেছি। এবার তাই ভুল শুধরাব।”
নিজের মানুষটার অভিযোগ, অনুযোগ শুনে সৃজা একটুও অভিমান করল না। উল্টো মেঘ ভেজা বাতাসের মতো শীতলতা ছড়িয়ে ওর চোখের পাতা কাঁপছিল, “ওরা কী দুটো মেয়ে? নাকি দুটো ছেলে?”
প্রশ্নের জবাবে ইহসান ফিসফিস করে নিজেই প্রশ্ন করে বসে, “তুই কী চেয়েছিলি?”
“আমি তো সুস্থতা ছাড়া অন্যকিছু চাইনি।”
“বাপ-মা দিয়েছিস তুই আমাকে।”
বলে আরো একটা গাঢ় চুমু খায় সে সৃজাকে। চোখ বন্ধ করে আদরটুকু নিতে নিতেই সৃজা অনুভব করে, তার পুরো পৃথিবীটা আচমকাই সুন্দর হয়ে গেছে! বসন্ত দিনের রঙিন পাতায় চারপাশ সবুজ হয়ে গেছ, গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে গেছে তার হৃদমাঝার! সেই সময়টাতেই ইহসান নিজের মাথা গুঁজে দিলো ওর কাঁধে। এরপর দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়ায় ওর কাঁধ-গলা পুড়িয়ে অস্পষ্ট, অপরাধী স্বরে বলতে থাকে, “অথচ আরেকটুর জন্যই আমি ওদের হারিয়ে ফেলছিলাম। আসলে যতোই আমি তোর উপর রাগ দেখাই না কেন, ভুলটা তো আমারই! আমি যদি সেই রাতে আরেকটু সাবধান থাকতাম, আরেকটু খেয়াল রাখতাম। তোকে ছেড়ে কোথাও না যেতাম তাহলে এই দিন দেখতে হতো না…”
“কিন্তু তুমি গেছিলে কোথায়?”
“একজনকে মারতে।”
আঁতকে উঠে সৃজা, উচাটন গলায় বলে, “কাকে?”
“আমার জীবন ছিনিয়ে নিতে চাওয়া কুলাঙ্গারটাকে…”
হতবিহ্বল সৃজা ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। লোকটা কী মজা করছে? এসব নিয়ে কেউ মজা করে? কে ওর জীবন ছিনিয়ে নিতে চায়? কাকে মারতে গেছিল ও সেদিন? এই মানুষটার এতবড়ো শত্রুটাই বা কে? সৃজা কণ্ঠে বিস্ময়, ভয় ঢেলে প্রশ্ন করে, “মানে? কে সে? কাকে মারতে গেছিলে তুমি? এইইই!!”
সৃজার নড়াচড়ায় ইহসান কিছুটা বিরক্ত হয়ে গলা থেকে মুখ তুলে তাকায়, প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে? বাঁধা দিচ্ছিস কেন?”
“তুমি এক্ষুনি কী বললে?”
ইহসান ভ্রুকুটি করে, “কী বললাম?”
“এক্ষুনি যে বললে আমার এক্সিডেন্টের রাতে কাকে মারতে গেছিলে, কেউ তোমার জীবন নিতে চায়। কী বলছ এসব?”
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কে আমার জীবন নিবে? কাকে মারব আমি! আশ্চর্য!”
অবোধের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইহসান। এই মেয়েকে সে কখন বলেছে এসব? মনে পড়ছে না তো! ইহসান মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করল, মনে পড়ল, ঘোরের মাঝে থেকে একটু আগেই সে সৃজাকে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছে। আরেকটু সময় পেলে হয়তো ইনজান যে ওর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাও বলে দিতো! সম্বিৎ পুরোপুরি ফিরতেই রাগে মুখটা তেঁতো ঠেকল ইহসানের। মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিল। চোখেমুখে অন্যমনস্কতা আর বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে, রুক্ষ স্বরে বলল, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কে আমার জীবন নিবে? আমি কাকে মারতে যাব? আমি তো ঝামেলা মেটাতে গেছিলাম। সেই রাতে কারখানায় একটা ইমার্জেন্সি ছিল, নতুন একটা ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক লঞ্চের কাজ আটকে গিয়েছিল, সেটা সামলাতে গেছি। অনেক রাত হয়ে গেছিল বলে তোকে ঘুম ভাঙিয়ে আর বলিনি। ভেবেছিলাম, সকালে ফিরে তোকে সব বলব।”
একটু থেমে ঠাণ্ডা গলায় যোগ করল, “একবার তোর ঘুম একবার ভাঙালে তো আর ঘুমাতে পারিস না। তাই চুপচাপ চলে গেছিলাম। এর মধ্যেই যা ঘটালি, আমাকে সব ফেলে ছুটে আসতে হলো। তোর চিন্তায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল …এখনো হচ্ছে।”
শুধু মুখে না, চোখের ভাষাতেও একটা পরিশ্রান্ত ভালোবাসা মিশিয়ে দিল ইহসান। মিথ্যে হলেও খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সৃজা। এদিকে মুখ ফসকে সব সত্যি বলে দেওয়ায় ইহসান নিজের মাথাটাকে দেয়ালে ঠুকার জন্য কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল। ভিতরে ভিতরে নিজেকেই গালি দিল, ‘কথা বুঝেশুনে বল! এখনি তো একটা ভুল করে বউকে সন্দেহের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলি ডাফার!’
এলিজা জানে না, কতক্ষণ সে বোনের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন ওর বুকের ভেতর থেকে ফেটে পড়ছিল। কাঁদতে কাঁদতে যখন ওর হিঁচকি উঠে গেল, দম আটকে আসছিল, তখন সৃজা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল, “এই রকম কান্না তো আগে দেখিনি তোর! আরেকটু কাঁদ না এলিজ! নাকের জল, চোখের জল এক কর দেখি, কতখানি দুঃখ জমেছে তোর ছোট্ট বুকে… ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া আমার
এত্তো বড়ো মেয়েটাও যে এভাবে কাঁদতে পারে, জানতাম না তো!”
বোনের মৃদু ঠাট্টায় এলিজার কান্না থামেনি, বরং বেড়েছে, “তুমি হাসছ? আমি তো ভেবেছিলাম সব শেষ হয়ে যাচ্ছে… একা হয়ে যাচ্ছি… তোমাকে হারালে আমার বাঁচার আর কিছু থাকত না আপু…”
সৃজা ওর মাথাটা দু’হাতে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরল। গলার ভিতর কাঁটার মতো বিঁধে থাকা কষ্টটাকে ঠেলে বলল, “এসব কথা মুখে আনিস না এলিজ! আমি থাকি বা না থাকি, তুই থাকবি। তুই থাকলেই আমি বেঁচে থাকব কোথাও, কোনোভাবে। তুই তো আমার সবকিছু… মায়ের শূন্যতা আর বাবার অসহায়তার ভিতর দিয়ে তোর ছোট্ট হাত ধরে তোকে বড় করেছি। তুই ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার।”
এলিজা ভাঙা গলায় বলল, “তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাববে না।”
সৃজা তার মুখটা দু’হাতে তুলে চোখের জল মুছে দিল,
“ইশ! মুখটা কী লাল হয়ে গেছে…লাল আলুর মতো লাগছে তোকে! এভাবে আর কাঁদবি না, কাঁদলে তোকে আমার বোন মনে হয় না। কাঁদব শুধু আমি, আমাকে সামলাবি তুই। বুঝেছিস?”
এলিজা ভেজা চোখে মাথা নাড়ল, “তুমি খুব নিষ্ঠুর।”
ওকে একটু ধাতস্থ হতে দেখে, সৃজার প্রাণ যেন একটু হালকা হলো। আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওদেরকে দেখেছিস? দেখতে কার মতো হয়েছে?”
এলিজা ছোট্ট করে মুখ গোমড়া করে বলল,
“আমার মতো।”
সৃজা চোখ বড় বড় করে তাকাল! মা সে, বাবা ইহসান। তাহলে এলিজের মতো দেখতে হলো কেন? ও বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই এলিজা বলল, “শুরুতে একেবারে আমার মতো ছিল। তবে এখন ভাইয়ার ছায়া ফুটে উঠছে। ডাক্তার-নার্স সবাই বলছে… ভাইয়ার মতো দেখতে হবে… শুনে ভাইয়ার মন খারাপ। ইজহান ভাইয়াও তো মেজাজ দেখাল, তাদের দু-ভাইয়ের চেহারা না কি ভালো না। ও আমার মতো দেখতে হয়েও আবার কেন চেহারা পালটে ওদের মতো দেখতে হচ্ছে…এই নিয়ে আফসোস!”
এ কথা শুনে সৃজা বিস্ময় নিয়ে বলল, “ওদের দু-ভাইয়ের চেহারা ভালো না? এটাও শুনতে হলো আমার? হায় আল্লাহ! এদের দু-ভাই এতো মিথ্যাবাদী কখন থেকে হলো? ছেঁড়া শার্ট, ছেঁড়া লুঙ্গি পরলেও তো মনে হয়, র্যাম্পওয়ার্ক করতে যাচ্ছে!”
এলিজা বলল, “আমিও তো সেটাই বলেছি ওদের৷ কিন্তু দু’জনেই মানতে নারাজ! তারা খুবই আপসেট, আমার চেহারা মুছে কেন তাদের চেহারা ভাসলো! আমি নাকি বেশি মিষ্টি, রুপবতী দেখতে!”
তারপর একটু হেসে ম্লান গলায় বলল, “অবশ্য আমি চাই না ওদের কেউ আমার মতো হোক, আমার মতো বেড়ে উঠুক! ভাইয়াদের মতো হলেই বেশি খুশি হব আমি…”
সৃজা খেয়াল করল এলিজার চোখ ভিজে উঠেছে আবার। অথচ মেয়েটা তা দেখাবে না বলে অন্যদিকে মুখ করে বসে রয়েছে৷ ও নিজের কাঁপা হাতটা দিয়ে এলিজাকে জোরপূর্বক নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর গালে হাত রাখল, গাল দুটো আবারও মুছে দিয়ে বলল, “তুই কী জানিস, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটা কে?”
অকপটে বলল এলিজা, “তুমি।”
“উহু! এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বুঝদার মেয়ে আমার এলিজ। তুই এতোটা ভালো, এতোটা অন্যরকম যে, আমার মতো হাজারো সৃজা তোর কাছে ম্লান! এলিজ, তোর মতো হৃদয় নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসে…”
“একটু বেশিই হয়ে গেল না?”
সৃজা ফিসফিস করে বলল, “বরং একটু কম হয়েছে।”
সবকিছুর মধ্যেও কোথাও একটা অস্বস্তি ছিল সৃজার মধ্যে। বারবার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক নেই। ইহসানের চোখের দিকে তাকালেই সন্দেহ আরও জোরালো হচ্ছিল। কয়েকবার সরাসরি প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর পায়নি, শুধু কপালে দুটো শক্ত চুমু ছাড়া। তবে ব্যাকুল সৃজা যখন নার্সের মাধ্যমে জানতে পারল, নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ারেও নানা জটিলতার কারণে বাচ্চারা ঝুঁকির মধ্যে আছে। ওজন কম, হৃদপিণ্ডে সমস্যা, শ্বাস-প্রশ্বাস বিঘ্ন এবং পুষ্টির ঘাটতি তার বাচ্চাদের—এসব শুনে সৃজার শরীরে একধরনের অবসাদ ছড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতরটা শূন্য হয়ে গেল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল সে।
সৃজা যখন নার্সের কাছ থেকে এসমস্ত তথ্য জেনেছিল তখন ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্টেন্ট করছিল ইহসান। যার কারণে সে উপস্থিত ছিল না সেখানে। তাই কেবিনে ফেরার পর সৃজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে, ওকে ওমন করতে দেখে মেঝেতেই ওর পা দুটো আটকে গেল। সুদর্শন মুখটাতে ব্যাকুলতা মেশানো একধরনের অসহায়ত্ব নিয়ে যতই সে বুঝাতে চাইল, সৃজার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের মানসিক অবস্থাও ততই জটিল হয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছিল সৃজার চোখে পানি দেখে। সৃজার মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে নিয়ে যতই প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছিল ততোই মেয়েটার কান্না বাড়ছিল।
এসব দেখে ইহসানের মাথা দপদপ করছিল। এই মেয়ের চোখের জল তার বুকের ভেতর দহনক্রিয়া, রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে বহু আগে থেকেই। একদম নিতে পারে মা সে সৃজার চোখের পানি। এই একটা জায়গায় সে ভীষণ দুর্বল, ভীষণ।তাই কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেকে খানিকক্ষণ একা রাখতে সে চলে গেল হসপিটালের ছাদে। এলিজা তখন আপুকে বুঝাল, যেখানে বাচ্চাদের বাঁচারই সম্ভাবনাই ক্ষীণ ছিল সেখানে এখন অবধি যতটুকু সার্ভাইব তারা করেছে সেটা কী শুকরিয়া আদায় করার জন্য যথেষ্ট নয়? এরজন্য তো আরো খুশি হওয়ার কথা, কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাহলে আপু এত ভেঙ্গে পড়ছে কেন? সব হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে কাঁদছে কেন? সে কাঁদবে একমাত্র দুটো কারণে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় এবং বাচ্চারা এখনো
বেঁচে থাকায়!
নিজেকে দোষারোপ করতে থাকা সৃজা তার এলিজের কথায় একটু ধাতস্থ হয়েছিল। আসলেই তো! সে কাঁদছে কেন? এতো বড়ো দুর্ঘটনার পরেও ওরা যে এখনো পর্যন্ত তাকে ছেড়ে যায়নি এটাতেই তো তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এটাই তো ওর সবচেয়ে বড়ো উপহার! সে ব্যাকুল হলো বাচ্চাদের দেখতে। ইহসান এসে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিলো। বাচ্চাদেরকে যখন সৃজার বুকে দেওয়া হলো এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হলো পুরো পৃথিবীটা সে নিজের কাছে ধরে রেখেছে। সবকিছু তার হাতের মুঠোয়।
উহু! এই জীবনে আরকিছু চাওয়ার নেই ওর। নিজের ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, যাদেরকে নেই বলেই ভেবেছিল সে, অপ্রত্যাশিতভাবে তাদেরকে নিজের বুকে পেয়ে সৃজার দু’চোখের জল বাঁধ মানছিলোই না। সে সৃষ্টিকর্তার নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। গত কয়েকদিন না খেয়ে, নির্ঘুম কাটানো রাত্রিগুলো ইহসান ভুলে গেল তার সৃজার চোখের সেই আনন্দাশ্রু দেখে!
সৃজার শারীরিক অবস্থা ত্রুটিমুক্ত হওয়ায় ওকে রিলিজ করে দিলেও বাচ্চাদেরকে আরো কিছুদিন এডমিট রাখতে হবে। কিন্তু সৃজা জানাল, সে এখান থেকে কোত্থাও যাবে না। বাচ্চাদের হার্টবিট স্ট্যাবিলাইজেশন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও মায়ের সঙ্গে বন্ডিং তৈরি করার জন্য ওদেরকে সে কয়েক বেলা নিজের কাছে রাখতে পারে, বাড়ি চলে গেলে এসব
সে করতে পারবে না। সৃজা হাসপাতালেই রয়ে যাবে বলে ঠিক করল। ইহসান অগ্রাহ্য করল না, সে
নিজেও তো পারবে না ওদের না দেখে থাকতে!
প্রতিদিনই ইজহান হাসপাতালে ছুটে আসে তার টনা-মনাকে দেখতে। যতোবার আসে ততবারই তার সঙ্গে থাকে দুটো করে গিফট বক্স। সেগুলোতে জিরো সাইজ থেকে শুরু করে ওয়ান ইউক, টু উইক, থ্রি উইকের বেবিদের জন্য পোশাক আর খেলনা থাকে। তবে বেবিদের জন্য এই গিফট বক্স আনলেও এগুলো খোলার অনুমতি সে এখনো কাউকে দেয়নি। ইহসান ওর কান্ডে বিরক্ত হয়ে গিফট বক্সে কী আছে তা দেখতে চাইলে প্রতিবারই ইজহান তাতে বাঁধা দিয়ে শক্ত গলায় জানায়, টনা-মনা যতদিন না সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে ততদিন এগুলো খোলা নিষেধ!
ইহসান ওর নিষেধাজ্ঞা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলেছে,
বাড়ি ফিরেই যখন খুলতে হবে তাহলে সে এগুলো হাসপাতালে নিয়ে আসছে কেন? বাড়ি নিয়ে গেলেই হয়! প্রতুত্তরে ইজহান বলেছে, বাড়ির গিফট বাড়িতে। হসপিটালের গিফট হসপিটালে! এরমধ্যে ইস্মি ফোনে জানিয়েছে, ইজহান বাড়িতেও নাকি প্রতিদিন দুটো করে গিফট বক্স নিয়ে যাচ্ছে, আজিজ শেখও না কি বাড়িভর্তি করে ফেলেছে বাচ্চাদের জিনিস দিয়ে। কোনো মানে হয় এসবের? সৃজা আর এলিজা তাদের দু’ভাইয়ের বাকবিতন্ডা চুপচাপ বসে বসে দেখে। মাঝেমধ্যে ওরা ভুলে যায় এরা দুই ভাই আদৌ মানুষ না কি এলিয়েন? এলিয়েনই হবে হয়তো! নয়তো ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে এসেও ছোটোদের মতো একে-অপরের পেছনে লেগে থাকতো না। যেমন আজকেও, সন্ধ্যাবেলা ইজহান অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছে দুটো বিশাল সাইজের গিফট বক্স নিয়ে। এতদিনে এতো এতো বক্স জমা হয়েছে যে, কেবিনে সেগুলো রাখার জায়গা নেই। ইহসান তাই যথেষ্ট ভালোভাবে ওকে সেগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে বলায়, ইজহান ক্ষেপে একশো একটা কথা শোনানো শুরু করলে ইহসান আর রাগ কমাতে পারেনি। কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেও দ্বন্ধে লিপ্ত হয়ে গেল সে। ইজহান ক্ষোভের মাথায় ইহসানের চোয়াল বরাবর ঘুষি মারতেই সেও ভাইয়ের কলার চেপে ধরল। এভাবে ধরাধরি করতে করতে কখন যে, দু’জনেই ল্যাবের ভেতর ঢুকে পড়ল সেটা খেয়াল করল না তারা। একজনের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে আরেকজন গিয়ে যখন টেবিলে ধাক্কা খেল, কাচের বিকার মেঝেতে পড়ে শব্দ হলো তখনই টনক নড়ল দু’জনের।
“এক্সকিউজ মি! আপনারা কে? এখানে কী করছেন? এখানে ঢুকতে দিলো কে, এক্ষুণি বেরুন…রমিজ কোথায়? রমিজ এই রমিজ…”
মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকাল দুই ভাই। ডাক্তার নাবিলাতুজ জোহা দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারা রাগান্বিত। তবে এ মুহূর্তে অতি বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। বিস্ময়ে হা হয়ে পরণের মাস্কটা একহাতে টেনে নিচে নামাতে নামাতে তিনি চমকানো গলায় বললেন, “আ আপনারা? মিস্টার শেখ…একি! আপনাদের দু’জনের চেহারাই তো এক! তার মানে…”
“ভাই হয়।”
ইহসান ইজহানের হাত ধরে টেনে ল্যাব থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কথাটা বলল। নাবিলাতুজ জোহাও পেছনে বেরিয়ে এলেন ওদের সাথে। করিডোরে এসে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললেন, “আপনারা টুইন?”
“দেখতেই পাচ্ছেন!”
এবারে বিস্ময় কেটে গিয়ে হাসি ফুটল নাবিলাতুজ জোহার চোখেমুখে, “টুইনের টুইন! বাহ! মজার ব্যাপার তো…”
ইজহানের মুখে নেমে এলো কালো ছায়া৷ ইহসানের হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, “আমার টু-ইন না। মেয়ে হবে।”
গর্বিত শোনাল ওর গলা। নাবিলাতুজ জোহা হাসলেন,
“কংগ্রাচুলেশনস!”
“থ্যাংক্স!”
“সেদিন তাহলে আপডেট দেওয়ার সময় উনিই ছিলেন, আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল!”
ইহসানও তার কথায় সায় জানিয়ে সেদিনের ব্যাপারটা খোলাসা করল। সাথে ক্ষমাও চাইল আবার সেদিনের রুক্কজ ব্যবহারের জন্য। নাবিলাতুজ জোহা দু-ভাইয়ের সঙ্গে বেশ আলাপচারিতায় মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইর্মাজেন্সি তার ডাক পড়ায় তিনি অল্প কথায়ই সাক্ষাৎ শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। তিনি যেতেই ইহসান ইজহানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোর মেয়ে হবে?”
“ডাউট আছে তোর?”
“কে বলল তোকে?”
“কেউ বলবে কেন? ইস্মিতা, আমি—আমরা মেয়েই চাই। ছেলে চাই না।’’
ইহসানের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই। মেয়ে চেয়েছিস ঠিক আছে। কিন্তু ছেলে চাই না মানে কী? এসব কী কারো হাতে থাকে না কি? একে বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে এখন মেয়ে ধরে বসে আছে, পরে ছেলে হলে ইস্মির সাথে ঝামেলা শুরু করে দেবে। ও কর্কশ গলায় বলল, “ইজহান— আমি এখন নাটক, সিনেমা কোনোটার মুডেই নেই। অহেতুক আমার মাথা গরম করে রাগিয়ে দিস না। ছেলে চাই না যে বলছিস; প্রাণ দেওয়ার, লিঙ্গ নির্ধারণ করার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। মাথায় রাখ।”
সর্বশেষ কখন ইহসান ওকে ‘ইজহান’ বলে ডেকেছিল মনে পড়ে না ইজহানের। এক পৃথিবী বিস্ময় সে গলায় ঢেলে বলল, “ওসব বাদ দে। কিন্তু তুই এক্ষুনি কী বললি, আরেকবার বলতো! তুই কী আমার নাম ধরে ডাকলি?”
অতি বিস্মিত চোখজোড়ার দৃষ্টি দেখে ইহসান শক্ত গলায় বলল, “ডাকলাম।”
“ডাকলি? আসলেই?”
“ডাকলাম।”
“কেন ডাকলি?”
“কেন ডাকলাম সেটা বড়ো কথা না, বড়ো কথা তোকে সম্মান দিলাম।”
“যেমন?”
“আমার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতিটা সামলানোর জন্য। আমার সৃজার খেয়াল রাখার জন্য, আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে কনসার্ন থাকার জন্য। আমার হয়ে সো কল্ড বাপের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। আর আর, আর কী করেছিস জানি না, কিন্তু যা করেছিস তারজন্য তোকে নাম ধরে ডাকার সম্মান তো দেওয়াই যায়। তাই আমিও দিলাম।”
ইহসানের কথা শেষ হতেই ইজহান তীর্যক হাসলো, “তোর কী ধারণা, তোর এই ঠুনকো সম্মান পাওয়ার লোভে আমি এসব করেছি?”
“না।”
“তাহলে দিচ্ছিস কেন সম্মান, আমি চেয়েছি?”
রাগে লাল হয়ে গেছে ইজহানের চেহারা। গলার রগ ফুটে উঠছে। ইহসান রুদ্ধ স্বরে বলল,
“আচ্ছা দিলাম না তোকে সম্মান—কী চাই বল!”
“যা চাইব তাই দিবি? আছে তোর ক্ষমতা?”
“ক্ষমতার মালিক আল্লাহ! সাধ্যে যা আছে তা থেকে যা চাইবি তা-ই দেব!”
“ওকে, দ্যান তোর মেয়ে আজ থেকে আমার। ওকে আমি পালব, ভালো স্কুলে পড়াব, আমার কাছে কাছে রাখব! ও আমাকে বাবা ডাকবে। তুই ওকে দাবি করতে পারবি না।”
ভয়ংকর সব কথা, ভয়ংকর চাওয়া। বলা শেষ হওয়ার আগেই ইহসান গর্জে উঠল তীব্র রাগে, “ভালো কাজ করেছিস বলে যেই না এপ্রিশিয়েট করেছি ওমনি সুযোগ বুঝে আমার জানে হাত বাড়িয়ে নিজের রুপটা দেখিয়ে দিলি তো? আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে হাত বাড়ানোর স্বভাবটা তোদের কারোরই গেল না। একটা আড়ালে বসে বউ কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করছে আর তুই আমার মেয়েকে নিয়ে নেওয়ার…আদৌ যদি বড়োআব্বা হওয়ার শখ থাকে তাহলে ওসব কুচিন্তা বাদ দে। নয়তো ওদের আশেপাশে ঘেঁষতে পারবি না তুই!”
ইজহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেল ইহসান। যেন গোণায়ই ধরে না ওকে। পেছনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ক্ষোভ ঝাড়ল ইজহান, “মেয়ে পেয়ে আকাশে উঠেছিস…আমাকে কাছে ঘেঁষতে না দেওয়ার তুই
কে রে? কচুর একটা ডাঁটি তুই!”
রাগের বশবর্তী হয়ে পাশে থাকা একটা ভারী ফুলের টবে লাথি মারলো ইজহান। টবটা শব্দ করে একপাশে কাত হয়ে পড়ে গিয়ে ফেটে গেল। করিডোর তখন খালি! হতবিহ্বল ইজহান এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ দেখেছে কি-না! কেউ দেখেনি নিশ্চিত হতেই সে পেছন ফিরল। আর ফিরতেই দেখল, হতভম্ব মুখে এলিজা দাঁড়িয়ে। ইজহান অপ্রস্তুত হয়ে গেল ওকে দেখে। বোকার মতোন মাথা চুলকে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আসলে, আমার একটা মেয়ে লাগবে তো…তাই! আমিও তো বাবা হই, তাই না বলো?
আমি আমার মেয়েকে চাইতে পারি না? এই শালা ভেড়া বুঝতেই চায় না! আমাকে শুধু শুধু রাগিয়ে দেয়।”
এলিজা ওর স্বীকারোক্তি শুনে, ওর কান্ড দেখে বহুকষ্টে নিজের হাসি আটকে চলে এলো। ওদিকে ইজহান ঘরের ল্যান্ডলাইনে ইস্মিকে ফোন দিলো,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৬
“এই মহিলা! ভেড়াকে বল আমাকে একটু টনা-মনাকে কোলে নিতে দিতে। কু* আমাকে আশেপাশে ঘেঁষতে
দিচ্ছে না।”
“নিশ্চয় আপনি এমনকিছু করেছেন বা বলেছেন যারজন্য আপনাকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। ঠিক হয়েছে, উচিৎ হয়েছে একদম।”
ওপাশ থেকে কথাটা বলে ইস্মি ওর মুখের উপর ফোন কেটে দিলো। ইজহান বিস্মিত হলো তার বউয়ের সাহস দেখে। রাগান্বিত সে আবারো কল ব্যাক করতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, “কেউ কিছু না দিলে, ছিনিয়ে নিতে হয় ব্রাদার!”
আরকিছু পর্ব! ধৈর্য ধরুন, মন্তব্য করুন! শেষ করে দেব৷ আর এন্ডিং নিয়ে ভেবে লাভ নেই। প্লট অনুযায়ীই হবে।