অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৮

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইজহান বিস্মিত হলো তার বউয়ের সাহস দেখে। রাগান্বিত সে আবারো কল ব্যাক করতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, “কেউ কিছু না দিলে, ছিনিয়ে নিতে হয় ব্রাদার!”
পেছন থেকে কারো তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে বলা কথাটা যেন বুক চিরে এলো। ইজহান ঝটকা খেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই চোখদুটো বিস্ময়ে ছলকে ওঠে, করিডোরের দেয়ালে স্যুট পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখে। ইজহান স্তব্ধ গলায় বলে ওঠে, “তুই?”

এলিজা যখন কেবিনে ফিরে ইজহানের কান্ডগুলো বলে সৃজা শুনে বিস্মিত হলেও মজা পেয়ে হাসল কতক্ষণ! প্রশংসাসুলভ বলে, আসলেই ইজহানের মনটা শিশুসুলভ। উপরে উপরে যতোই হম্বিতম্বি করুক, তার মনটা কোমল। তাছাড়া প্রতিদিন যেভাবে উপহার এনে ঘর ভরিয়ে ফেলছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে বাচ্চাদের জন্য সবার থেকে বেশি সে-ই এক্সাইটেড। সৃজা ঠিক করে, বাচ্চারা এন.আই.সি.ইউ থেকে সুস্থ হয়ে বেরুলে দুটোকে একসাথে ইজহানের কোলে দিয়ে বসিয়ে রাখবে। তখন ওর রিয়েকশন ভিডিয়ো ধারণ করা হবে। একটা আধপাগল লোক, যে বাচ্চা চাইতো না সে কীভাবে তার ভাইয়ের বাচ্চাদের প্রতি পাগলামো করেছে, এই স্মৃতি রেখে দেবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রিপোর্টের উপর চোখ বুলানোর ভান করে ইহসান দুই বোনের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। তার মুখ শুকনো ও অন্ধকার। সৃজার এত আদিক্ষেতা তার সহ্য হচ্ছে না। বাচ্চাদের নিয়ে নিজের স্বামী কতোটা কনসার্ন তা দেখেছে তো এই মেয়ে? না দেখেনি৷ বোঝেওনি। ওরকম পাগলামো চাপা দিয়ে রাখে বলে তাকে রিজার্ভড পার্সন ভাবছে না কি? ইহসানের চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। ঈর্ষায় গলা জ্বলছে তার। হাতে হাত ঘষছে সে। মনকে বোঝায় সে ইডিয়টটার প্রতি ঈর্ষান্বিত না। কিন্তু মন ঠিকই বলে, ইয়েস! ইউ’আর ইনসেইনলি জেলাস অফ দ্যাট ইডিয়ট। ইহসান ফুঁসে উঠে তার মনের কথায়। সে তার মেয়ের ভাগ কাউকে দেবে না, ছেলেরও না। আচমকা দু-বোনের গল্পের মধ্যিখানে অসহ্য হয়ে সে তার খাড়া নাকটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে, “যাকে নিয়ে হাউকাউ করছিস, সে যে নাম্বার ওয়ান ইডিয়ট তুই ভুলে গেছিস?”

সৃজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে, “এখানে এসব প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
“আসবে না-ই বা কেন? সে আমাকে কী বলে গেছে জানিস? আমার মেয়েকে লিখেপড়ে দিয়ে দিতে। সে বড় করবে। তাকে মা ডাকবে। আমি কোনো দাবি করতে পারব না। হাহ!”
চোখমুখ ঈর্ষায় লাল হয়ে গেছে ইহসানের। সৃজা বুঝতে পারে সেটা। ওর কিছুটা মজাও লাগে দুই ভাইয়ের কান্ডে। তবে ইহসানকে বোঝাতে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “বেবিদের জন্য খুব এক্সাইটেড, তাই হয়তো বলেছে। দেখো না, প্রতিদিন কীভাবে ওদের জন্য পাগলামো করছে, এত্ত এত্ত গিফটস আনছে ধারণা করতে পারছ বাচ্চাদের কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে? ডেলিভারির সময় আমাকে নিয়ে কী ছুটোছুটি, রক্ত পর্যন্ত দিয়েছে। ইস্মিতা ভাবী তো ফোনে এসব বলে বলে খুশিতে কাঁদে। ভুলত্রুটি অন্যায় যা করেছে আগে করেছে। এখন তো না। তাই এপ্রিশিয়েট করা উচিৎ সবারই। তাছাড়া গতকাল তো আমাকে বলেই গেল, তোমার মেয়ের নাম ভাইয়া রাখবে। আমিও তো হ্যাঁ বললাম।”

এলিজাও বোনের কথায় সমর্থন জানালো। ইহসানের চোখদুটো জ্বলে উঠল। ডেলিভারি টাইমে যা করেছে তাতে ইহসান চিরকৃতজ্ঞ ওর কাছে। সে স্বীকারও করে। কিন্তু তাই বলে তার মেয়ের নামও ঐ ইতরটা রাখবে? ইহসান সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠে। রিপোর্টটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলে, “আমার মেয়ের নামও তিনি রাখবেন? বাব্বাহ! আমার বউ আমাকে না জানিয়ে আমার ভাইকে পারমিশন দিয়ে দিলো আমার মেয়ের নাম রাখতে? বেশ ভালো ব্যাপার তো! তো বাপের নামের জায়গায় ওর নামটাই লাগিয়ে দিস, আমি আর কে হই তোদের? খারাপ সময়ে ফুর্তি করছিলাম, রক্তের ব্যবস্থা করতে পারিনি বউয়ের জন্য ; আমার কী আর মেয়ের নাম রাখা সাজে …”
সৃজা ভেবেছিল ইহসান খুশিই হবে ভাইয়ের পরিবর্তনের কথাগুলো শুনে। কিন্তু ও যে এভাবে মাইন্ড করে ফেলবে বোঝেনি। এবারে ওর রাগ দেখে চুপসে গিয়ে বলে, “তুমি এমন করছ কেন? আমি তো এতকিছু ভেবে বলিনি…কাল টেডি নিয়ে এসে আমাকে বলল কথাটা। চাচা ভাতিজির নাম রাখবে। আমি মুখের উপর না করতাম কীভাবে?”
ক্ষেপে যায় ইহসান। ওর গা জ্বালা করছে। ঈর্ষায় ফেটে পড়ে সে, “ ওহ! তার মানে গিফটস দিয়েই তাহলে আমার মেয়ের দখল নিয়ে নিতে চাইছে? সব এই গিফটসের জন্য তো? এই এলিজ চল আমার সাথে…”

“কোথায়?”
“এখন থেকে আমিও উপহার আনব প্রতিদিন, আর আমার বউয়ের থেকে বাচ্চাদের এটা করার, ওটা করার পারমিশন চাইব। দেখি এবার, তিনি কাকে গ্র‍্যান্ট করেন।”
চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে বিস্মিত এলিজার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল ক্ষুদ্ধ ও ঈর্ষান্বিত ইহসান। সৃজা শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। পাগল হয়ে গেল না কি তার স্বামীটা, সে বুঝে পেল না। তবে পুরো ব্যাপারটা আবারও ভাবতেই মজা পেল ভীষণ যখন বুঝল, ইহসান শেখ ইজ জেলাস অফ হিজ ওউন ব্রাদার!

হসপিটালের তিনতলায় আধুনিক সাজে সজ্জিত ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসা দুই ভাই। হালকা খাবার অর্ডার করেছে তারা, তবে মূল উদ্দেশ্য আলাপ করা। ইজহানের চোখমুখ গম্ভীর। সে শাণিত চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। আর ইনজান ঠেস দিয়ে চেয়ারে বসা। তার স্যুটের বোতাম খোলা। সামনে বসা বড়ো ভাইয়ের কঠিন মুখখানা একপলক দেখে নিয়ে একটু হেসে পিৎজার উপর কাটার চালাতে চালাতে বলে, “ব্রো খুব স্বার্থপর। সে সবকিছু নিজের দখলে রাখতে ভালোবাসে। ভাগ দিতে চায় না। যেমনটা মাম্মার বেলায় করেছে, তেমনটা ঐ দুটো বাচ্চার সাথেও করছে। দেখলে না, তুমি ওর মেয়েকে চেয়েছ, মেয়েকে মা বানাবে বলে চেয়েছ। অথচ কী রকম রিয়্যাক্ট করল? সবার সাথে ও এরকম করে। সাচ আ হিপ্রোকেট। একটা স্বার্থপর। তাই বলছি তুমি ওর মেয়ের ভাগটুকু ছিনিয়ে নাও, নিজের মতো বড়ো করো… যা খুশি করো। শুধু খেয়াল রেখো যেন, ব্রো তার মেয়েকে না পায়। মেয়ের ভালোবাসা না পায়। তার যে বুকভরা স্নেহ সেসব যেন সে মেয়েকে দিতে না পারে…”

পাগলামো কথাবার্তা। এমন হয় না কি? সে এতোটাও ছাগল নয় সে এই সাইকোর কথায় কান দেবে। ইস্মিতা তার প্রতি এখন অনেকটা সদয়, অনেকটা ভালোবাসে ওকে। সে এমন কিছু করে বৌয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে চায় না যেখানে ইস্মিতা নিজেই তাকে মেয়ে দেবে। তাছাড়া ভেড়ার সাথে তিক্ততা যেটুকু আছে থাকুক, আর বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তার। পরে দেখা যাবে বুমেরাং করে সে তার আর ইস্মিতার মেয়েকেই ছিনিয়ে নেবে। তাছাড়াও টনাটাও তো আছে, ভাতিজাকেও সে আদর করতে চায়। উল্টাপাল্টা কথায় কান দিয়ে সে বড়োআব্বা হওয়ার সুযোগ খোয়াতে পারে না। সে এতোটাও বোকা না। এদিকে ইনজান তাকে ব্রেন ওয়াশ করার চেষ্টায় বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে, যেগুলো শুনে ইজহান একপর্যায়ে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে, “স্টপ দিস ননসেন্স।”

পিৎজার টুকরোয় কামড় বসিয়ে একগালে রেখে ইনজান থমকে যায়, “ভালো না? অন্য বুদ্ধি দেব?”
“তোর বুদ্ধির দৌরাত্ম্য আমার জানা আছে। তাই থ্যাংক্স, আমি আগ্রহী নই তোর এসব উল্টাপাল্টা
বুদ্ধি শুনতে।”
এতো ভালো ভালো বুদ্ধি দিলো অথচ বিগ ব্রাদার টু মানলোই না? ইনজান যেন দুঃখ পেল। হতাশ গলায় মতো বলে, “এজ ইয়র উইশ।”

এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা। দুই ভাই নিশ্চুপ। কেউই কথা বলে না। ইনজানের পেটে ক্ষিধে, তাই সে খাচ্ছে। একঘন্টা সময়ে দুটো আস্ত পিৎজা, দুটো স্যান্ডউইচ, এক বাটি পাস্তা আর পাঁচ টুকরো চিকেন ফ্রাই সাবাড় করেছে সে। এই ছেলে খেতে পারে৷ সব খায়। কোনো বাছবিচার নেই। তার খাওয়ার স্টাইলও দারুণ, মুগ্ধ হওয়ার মতোন। খাওয়ার সময় মনে হয় একটা ছোটো বাচ্চা সময় নিয়ে খাচ্ছে। অথচ ছেলেটা একটা মা র্ডা রার। মুখ দেখে, হাসি দেখে বোঝারই উপায় নেই একাধিক মানুষকে সে টপকে দিয়েছে নিজের ইচ্ছেকৃত, অনিচ্ছাকৃত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইজহান বহুদিন পর ছোটো ভাইয়ের খাওয়া দেখে। তবে সে কিছু খায়নি।

এসব ক্যান্টিন-ফ্যান্টিনে সে খেতে পারে না। তার ধারণা ওরা না ধুয়েমুছে, নোংরা হাতে অস্বাস্থ্যকরভাবে একেক পদ তৈরি করে, যা খেলে নির্ঘাত সে টেবিল ভাসিয়ে বমি করে দেবে। ফাইভ স্টার ছাড়া তার জমে না। জমে না ইস্মিতার হাতের সুস্বাদু রান্না ছাড়াও। ইস্মিতার কথা মনে আসতেই তার একটু অস্থির লাগে। ভাবে, সে এখানে কী করছে? তার তো এখন বৌয়ের কোলে মাথা দিয়ে আধঘন্টা শুয়ে থাকার কথা। পেটে মাথা রেখে বাচ্চার নড়নচড়ন অনুভব করার কথা। আর মাত্র কিছুদিন, এরপর বাচ্চাটা বেরিয়ে আসবে, তার মা হয়ে। কিন্তু যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়? এসব ভেবে ইদানীং আতঙ্ক জমা হচ্ছে তার বুকের ভেতর! ইজহান আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনজানের দিকে তাকায়। ভালোভাবে পরখ করতে থাকে কলিজার সিঙারা খেতে থাকা ইনজানকে। এদিকে ওকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকায় ইনজান ধীরেসুস্থে সিঙারাটা শেষ করে, ওয়েট টিস্যুতে মুখ মুছে, রগ ভেসে থাকা হাতটা কপালে ঘষে সরু চোখে তাকায়। মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আসার পর একবারও জড়িয়ে ধরোনি। এখন কী দেখছ?”

কী দেখছে প্রশ্নের জবাবে ইজহান নিরুত্তরে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইনজানের দিকে। সম্পর্কে তার ছোটো ভাই। চার বছরের ছোটো। খুব আদরের আবার খুব অনাদরেরও। কত আবদার, কত বায়না সে মিটিয়েছে একসময়! আবার উল্টাপাল্টা কথা বা কাজ করলে মেরেছেও ভীষণ। ইহসানের নেওটা হয়ে ওর পিঠ পিছে লেগে থাকলেও এমন অনেক রাত গেছে যেখানে ইনজান ওর সঙ্গে সারারাত বসে গেইমস খেলেছে, জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। মাসের শেষরাত্রিতে টেরেসে বসে সস্তা ধরণের মাদকও সেবন করেছে দু’ভাই একত্রে। সেসব দিন পুরোনো হয়েছে বহু আগে। ইজহান টের পায় ইহসানের সাথে রেষারেষিটা বেশি থাকলেও আরসালানের সঙ্গে তার ভাব নেহাতই কম ছিল না। অথচ এই ভাইটার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বা স্বাভাবিক যোগাযোগ হয় না বহু বছর! একটা পরিচিত মানুষ এতটা অপরিচিত হয়ে যেতে পারে?

নিজের ভাইকে এমন পরপর লাগে? ভাইকে দেখে প্রতি মুহূর্তে বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁকা লাগছে ওর। বলিষ্ঠ শরীরে পরণে স্যুট। পায়ে শু। চওড়া কপাল, খাড়া নাক, গালের কাটা দাগ, ওয়েভি লং চুলের কাট, চাহনিতে তীব্রতা, হিংস্রতা সবকিছুই আগের মতো আছে। সামান্য স্বাস্থ্যবান আর গায়ের রঙের উজ্জ্বলতা আগের চেয়েও বাড়া ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি আরসালানের। ইজহান বসা থেকে উঠে ত্রস্ত পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ইনজান এক ঝটকায় ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে। আদুরে চোখে তাকায়। ইজহান ভাইয়ের চাওয়া বুঝে নিয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে সেখানে দুটো চুমু বসিয়ে দেয়। ইনজান চোখ বন্ধ করে ভালোবাসার স্পর্শটা উপভোগ করে। ইজহান ওভাবেই কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কতবছর পরের দেখা?”
“অলমোস্ট আট।”
“ফোন ক’বার করেছিলি?”
“ঊনপঞ্চাশ।”
“কাকে করেছিলি?”
“তেত্রিশ বার তোমার রাইভালকে। সাতবার লাভলি ফাদারকে, আটবার আমার প্রিয় ব্রাদার মানে তোমাকে।”
“আর একবার?”
“ল্যাভেন্ডারকে।”
“সেটা কে?”
“দুটো কেউটা জন্ম দিয়ে তোমাকে চাচা বানিয়ে দেওয়া মহোদয়া, তবে ঐ একবার যে কলটা করেছি সেটা মহোদয়া ধরেননি!”
কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধে ইজহানের কানে।

রাগে চোখ রক্তিম হয়ে যায়। চুলের মুঠি ধরে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করে, “ঐ! তোর ভাইয়ের বউ হয়।”
ইনজানের ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। সে একটু সোজা হয়ে বসে বলে, “সো হোয়াটটট? তোমরা ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্কে বিশ্বাসী না আমি। তাছাড়া ভালোবাসি বেগুণি ফুলকে।”
ইজহান ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ে। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে, “আর সৃজা, সে তোকে ভালোবাসে?”
“উহু! সে তো আমাকে ভালো করে চেনেই না, দেখেওনি সেভাবে। তবে ওর ভালোবাসা চেয়েছেটা কে? আমার চাই না ওর ভালোবাসা। আমার একার ভালোবাসা যথেষ্ট ওর জন্য।”
একটু থেমে বিরতি নিয়ে কফি সিপ নিয়ে সে বলে, “লাইফে এই একটা মেয়েই, যাকে আমি একটুও ছুঁতে পারিনি। তার আগেই তোমার বাপ আমাকে দেশ থেকে লাথি মেরে বিদায় করে দিলো। তাই বোঝো, আগ্রহটাও বেশি!”
রাগ লাগে ইজহানের। হঠাৎই সে বলে উঠে, “এতোই যখন আগ্রহ তাহলে বিয়ে করে নিলি না কেন?”
“কাম অন ব্রাদার। বিয়ে একটা ঠুনকো কাগজের স্বাক্ষরে মোহর মারা বন্দিদশা। সমাজের নামে, আইনের নামে, নৈতিকতার নামে একটা চুক্তি, যার মধ্যে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নেই। আমি এমন কোনো চুক্তি বিশ্বাস করি না।”
ইজহানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কথাগুলো শুনে। বিয়ের এমন বিকৃত ব্যাখা? অথচ ইস্মিতা সেদিন কী সুন্দর করে বলল, বিয়ে মানে শুধু একটা চুক্তি নয়।

এটা এক আত্মিক সম্পর্ক। ভালোবাসা, মায়া, মোহ, টান, দায়বদ্ধতা—যেসব গড়ে ওঠে একটা অদৃশ্য শক্তিতে, অদৃশ্য বন্ধনে, একটা শপথে। আর শপথ দলিলবদ্ধ করার আনুষ্ঠানিকতাই বিয়ে।। যার মূলমন্ত্রই একে-অপরকে ভালোবাসা। দু’জন থেকে তিনজন বা একাধিকজন হয়ে সারাজীবন এক হয়ে থেকে যাওয়া। আরসালান বোঝে এসব? বোঝে না। না বুঝেই এসব বলছে। অবশ্য সে নিজেও বুঝতো না। সে ভাবতো, বিয়ে মানেই ইস্মিতা তার হবে। শরীর, মন, নিঃশ্বাস, ইচ্ছা সবকিছুকে ঘিরে একমাত্র সে থাকবে। তাই যখন ইস্মিতা ওকে রিজেক্ট করে দেয়, পালিয়ে যায়, ওর মধ্যে তীব্র একটা আতঙ্ক জন্ম নেয়। তার পাশে আছি বলা ইস্মিতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে সে দু’রাত ঘুমাতে পারেনি, খেতেও পারেনি। ইজহানের চোখে ভেসে ওঠে পুরোনো স্মৃতিগুলো! একটু সময় পর রুদ্ধ স্বরে সে বলে ওঠে, “বিয়ে মানে চুক্তি না… এটা শপথ।

একসাথে মরার আগ পর্যন্ত একে অপরকে ভালোবাসার, ক্ষমা করার, অপেক্ষা করার শপথ। আর তুই সেটা ঘৃণায় ভরিয়ে দিয়ে নিজের লালসার নাম দিয়েছিস ভালোবাসা? তোর এই নাটকটা বন্ধ কর। এটা ভালোবাসা না… এটা নোংরামো। আমি বলছি, ভুল থেকে শিখে ওঠা পাপী হিসেবে।”
ইনজান ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। নিচু স্বরে বলে, “নীতিবিরুদ্ধ আরসালান ইনজান শেখের নীতিকথা সহ্য হয় না। তাই বোলো না। তাছাড়া আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক। যেখানে শুধু আমিই চাইব, আমিই পাব। যেখানে সামাজিক নিয়মের মোড়ক নেই তবে প্রবল আকর্ষণ আছে। সমাজ বলবে, এটা ভুল, এটা পাপ, কিন্তু আমি সমাজের নিয়ম মানতে আসিনি। আমি শিকারি, আর শিকার কখনো শিকারির অনুমতি নেয় না। তাই আমি সো কল্ড সমাজের তোয়াক্কা করি না।”

ইজহানের চোখে বিস্ময়, রাগ, ক্রোধ সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এতোটা পাপী তার ভাই? সম্পর্কের মূল্য দিচ্ছে না? তার যেন বমি পায় হঠাৎ। নিজেকে সামলে তীব্র গলায় বলে বসে, “দিস ইজ ঠু মাচ! অযথা ঝামেলা পাকাতে চাইছিস। ভালো হবে না তোর…”
“ভালো নামক বা ল—আমার সঙ্গে কখনো হয়েছে? হয়নি। তাই তোয়াক্কা করি না তোমার হুমকি।”
“ইউ’আর আ পিস অফ ফিলথ, ইওর ভাইল থটস মেইক মি ওন্ট টু কিল ইউ।”
ভাইয়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথা, গালিতে ইনজানের কিছু যায় আসে না। সে কফিতে সিপ নিতে ব্যস্ত। জীবনটা তার। আর এই জীবনে যা চেয়েও সে সবই পেয়েছে। আর যেগুলো পায়নি, দেওয়া হয়নি ওকে, যেটুকু বাকি থেকে গেছে সে নিজেই আদায় করে নেবে। নয়তো কেটেকুটে দেবে৷ ইজহানের রাগে লাল হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে সে একপেশে হেসে বলে, “তোমার সুন্দরীর দিকে তো নজর দিইনি, তুমি এতো রাগছ কেন?”
ইজহানের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়, সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয় ইনজানের গালে, “কারণ সে আমার টনা-মনার মা।”

ক্যান্টিনের স্টাফ থেকে শুরু করে খেতে আসা সবাই এই দুই সুদর্শন যুবকের কান্ডকারখানা দেখছিল এতোক্ষণ। তবে এ পর্যায়ে চড়ের শব্দ পেয়ে থমকে যায় তারা। মুহূর্তে থেমে যায় চামচের শব্দ, ঠোঁটের হাসি। সকলের কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাক হয় ওদের দিকেই। কেউবা গসিপের খোরাক খুঁজে পেয়ে ফিসফাস শুরু করে। কেউ খাওয়ায় মন দেয়। কিন্তু ইনজানের ভেতর এতটুকুও হেলদোল হয় না। সে অপমানে স্থির, ভয়ানকভাবে স্থির। চড় খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। তার চোখজোড়া রক্তবর্ণ, জ্বলছে প্রতিহিংসায়। হঠাৎ টাইয়ের নটটা খুলে, এক ঝটকায় পরণের স্যুটের ব্লেজারের অংশটা ছুঁড়ে ফেলে টেবিলের ওপর। এরপর ভেতরের সাদা শার্টের সবগুলো বোতাম একে একে খুলে আলগা করে বা-কাঁধের শার্টটা নামাতেই ব্যান্ডেজে আবৃত আংশটা বেরিয়ে আসে। ইজহান তখন রাগান্বিত, হতভম্ব! ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে বিচলিত ও গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “হোয়াট ইজ দিস?”
ইনজান মাথাটা পেছনে ঠেলে দেয়, ঘাড়টা টানটান করে সোজা করে বসে। চোখ দুটো পিশাচের মতো লাল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। কণ্ঠে বিদ্বেষ নিয়ে সে ইজহানকে বলে, “তোমার সেই টনা-মনার মায়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ব্রো আমাকে মেরে ফেলতে গেছিল। বুঝতে পেরেছ? আমাকে মারতে গেছিল। আমি, তার ভাই। তার মায়ের অংশ। যেই মাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বলে মুখে বুলি ফোটায়। সেই মায়ের অংশের বুকে ট্রিগার চাপতে একটুও
তার হাত কাঁপেনি। একটুও না…না, না..”

শেষ “না” টা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ইনজান টেবিলের ওপর এমন এক থাবা বসায় যে পুরো ক্যান্টিন কেঁপে ওঠে। টেবিলের উপর থাকা তৈজসপত্র কয়েকটা গড়িয়ে পড়ে ভেঙে যায়। কেউ কেউ চমকে ওঠে, কেউ বা পুনরায় হতবিহ্বল হয়। কেউ শোরগোল শুরু করে। পরিস্থিতি সামলাতে ভীত, হতচকিত এক ক্যান্টিন স্টাফ দৌড়ে এসে বিনীত গলায় বলে, “দয়া করে চিৎকার করবেন না স্যার… এটা হাসপাতালের ক্যান্টিন। পেশেন্টরাও এখানে খেতে আসে। প্লিজ, আপনি যদি আর্গুমেন্ট করতে চান, বাইরে—”
ইনজান বসা থেকে উঠে ঠাস করে স্টাফের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোর কথায়? তোর? তোর মতো নিচু আর দু-টাকার স্টাফ ঠিক করে দিবি আমি কোথায় গিয়ে আর্গুমেন্ট করব?”
চড়টা এতই জোরাল ছিল যে, টাল সামলাতে না
পেরে স্টাফটা পাশের টেবিলের উপর হুমরি খেয়ে পড়ল। টেবিলে দুটো যুবক বসে খাচ্ছিল। ভাত, তরকারি সব এবার ছিটকে তাদের গায়ে পড়ল। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকার পর, ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। যেহেতু দোষ স্টাফের নয়, তাই তারা গালি দিতে দিতে ইনজানের দিকে তেড়ে এল। কিন্তু ইনজান তাদেরকেও থাপ্পড় বসিয়ে দিল। একপ্রকার হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল সেখানে।

ইজহান এতক্ষণ রুক্ষ মূর্তিতে বসে ছিল, তার এসবে কিছু যায় আসে না। কারণ সে নিজেই এমন। তার নিজের পাগলামোতেও স্থান, কাল, সময় প্রাধান্য পায় না। এমন কাউকে কীভাবে সামলাতে হয় সে জানে না, সবসময় সবাই তাকেই সামলায়। কিন্তু এখন আরসালানের এই ক্রোধান্বিত অবস্থা তাকে সামাল দিতে হবে। বড়ো ভাইয়ের সামনে ছোটো ভাই এমন আচরণ করবে বিষয়টা অকোয়ার্ড লাগবে ভেবে উঠে এসে ভাইকে শক্ত হাতে আটকাল। ইনজান ততক্ষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছে। রাগে ফেটে পড়ছে
সে, “শুয়োরটা আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমার গায়ে? আমার! যেখানে তোমরা ছাড়া আমার বাপও আমাকে টোকা দেয়নি সেখানে এই শুয়োর দিয়েছে…ওকে তো আমি ছাড়ব না! ওর কলিজা কত্তবড়ো আমি আজ সেটা ছিঁড়ে দেখব…”

লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে ইনজান। বোঝাই যাচ্ছে সে শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও ক্রোধ কমে না ওর। ইজহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের অবস্থা দেখে। এই ছেলের শ্বাসটানের সমস্যা আছে। রাগ উঠলে যখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, তখন আরো বাড়ে সেটা। যদিও সে বিরক্ত তবুও দায়িত্বশীল ভাই হওয়ার মতো করে দাঁতে দাঁত চেপে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বলল, “গেট আ হোল্ড অফ ইয়রসেল্ফ, জান! এটা সিনক্রিয়েট করার জায়গা না!”
আমাকে আশেপাশে খেতে আসা সবাই তাকিয়ে ওদের দিকে। কয়েকজন তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, “খেতে আসছি তো না কি? এভাবে গ্যাঁজাচ্ছেন কেন ভাই? এটা গেঁজানোর জায়গা না। বাইরে ফুটুন…যত্তসব…”
আগুনে ঘি ঢাললে যেমন হয়, তেমনি তড়তড় করে মাথায় রক্ত উঠল ইনজানের। ঘাড় ফিরিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে সে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আধখোলা শার্টে কাঁধের ওখানে ব্যান্ডেজ নিয়ে ফুঁসতে থাকা সুদর্শন যুবকের দৃষ্টি দেখে লোকগুলো ভড়কে গেল। নিয়ন্ত্রণহারা ইনজান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আমি গ্যাজাচ্ছি? আর তোরা কী করছিস আমাকে নিয়ে গসিপ করা ছাড়া? তোদের মুরোদ কতটুকু আমার দেখা হয়ে গেছে ডাফারের দল!”
“আই সেইড স্টপ দিস ননসেন্স! চল এখান থেকে…!”

ইজহান প্রচন্ড রেগে ধমকে উঠল ভাইকে। ইনজান তাতে থামলো বটে তবে শাণিত দৃষ্টিতে সব ক’টাকে সে দেখে নিলো। তাকে নিয়ে আজেবাজে বলা? ওয়ার্ন করা? তার গায়ে হাত দেওয়া? তাকে ফুটতে বলা? দ্বিতীয়বার যদি এরা সামনে পড়ে, পিষিয়ে দেবে সে মাটিতে। এদিকে ম্যানেজার এসে হল্লা শুরু করায় ইজহান ভুড়িওয়ালা লোকটার মুখ বন্ধ করতে টাকার বান্ডিল ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছুঁড়ে মেরে ইনজানকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই বিরক্ত লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, “বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া পোলা, দাপট দেইখাই বোঝা যাইতেছে। দেখলেন কতগুলা টাকা ছুঁইড়া মারল? বলিহারি মা-বাপ, টাকার পাহাড়ে বড়ো করে অথচ পাবলিক প্লেসে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখায় না। যত্তসব…”

একপ্রকার টেনে-হিঁচড়েই ইনজানকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে ইজহান। তার মেজাজ বিক্ষিপ্ত, ক্রমেই সেটা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বহু কষ্টে ধৈর্য ধরে সে, যাতে এই সাইকোটা উত্তেজিত অবস্থায় কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না করে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ডিসপেনসারি থেকে ইনহেলার কিনে নিয়ে সে অশান্ত ইনজানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “মরার আগের নিঃশ্বাসটা নিয়ে নে।”

ব্লেজারটা ক্যান্টিনে ফেলে এসেছে, শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। একপাশের কাঁধ বেরিয়ে আছে, ব্যান্ডেজও সেখানে বাঁধানো। ইনহেলার প্রেস করে দু’বার পাফ নিয়ে ইনজান কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে, হালকা ভাবে হাত-পা ছেড়ে বসে থাকে। ওকে দেখতে এখন ঠিক আধুনিক যুগের যুবরাজের মতো লাগছে, যে ঘুম থেকে উঠেই শুনে রাজ্য হারিয়েছে। পরণের কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট (যেটা গায়ে ভালোভাবে জড়ানোরও সময় পায়নি) ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে নিতে পারেনি। ইজহান বিরক্ত হয়ে নিজের ভাবনা সরিয়ে দিল। বউয়ের মুখ না দেখা অবধি শান্তি পাচ্ছে না সে। তার আগে আরসালানের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সে এগিয়ে গিয়ে ইনজানের শার্ট ভালোভাবে গায়ে চড়িয়ে বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে হঠাৎ বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করে, “তোর মোটিভ কী? এখানে এসেছিলি কেন?”
ঝট করে চোখ খুলে তাকাল ইনজান। সে এখন একটু স্বাভাবিক। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে না। ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “তোমাদের বাপ-চাচা বানাতে গিয়ে আমার বেগুণি ফুল মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে আর আমি ওকে দেখতে আসব না? এতোটা পাষাণ নই আমি৷”

গা জ্বলা কথাবার্তা। ইজহান রাশভারি স্বরে বলে, “এতো মহানুভাবও হতে হবে না তোকে। কোথায় উঠেছিস সেখানে ফিরে গিয়ে ঘুম দে। রাত অনেক হয়েছে। এখন ঝামেলা করবি না। চল, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি তোকে।
ইনজান দ্বিরুক্তি করে না। বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে। পরক্ষণেই শক্ত মুখ করে বলে, “আই নিড সাম
ওয়াটার।”

গাড়িতে টেনে এনে বসিয়ে দিয়ে, দরজা লক করে ইজহান পাশের একটা স্টোরে মিনারেল ওয়াটারের বোতল আনতে যায়। ঠিক তিন মিনিটের মাথায় পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এসে দেখে গাড়িতে নেই ইনজান। লক করে যাওয়া স্বত্তেও গোপন ট্রিক্স ব্যবহার করে আনলক করে বেরিয়ে গেছে। ইজহান বুঝতে পারে তার ছোটো ভাইটি তাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছে। একটা ঝামেলা না বাঁধিয়ে সে ছাড়বে না। বিষয়টা বোধগম্য হতেই শখের প্রাডোটার গায়ে পরপর কয়েকটা লাথি বসিয়ে দিয়ে ইজহান তার ক্ষোভ উগড়ে দেয়, “কু* বাচ্চা! আমার বউ ছয় ঘন্টা ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে! তোর জন্য আমি ওর কাছে যেতে পারছি না, তোর তো রক্ষে হবে না! যদি আমি তোকে ধরতে পারি, টেনে ছিঁড়ে তোর কলিজা, হাড়গোড় এক করে ফেলব, বুঝলি?”
এতটা রাগের তীব্রতায়, ইজহানের শরীর কাঁপছে। চোখে জ্বলন্ত আগুনের তেজ নিয়ে সে ক্রোধান্বিত
হয়ে ডায়াল করে ইহসানের নাম্বারে।

গত আড়াই ঘণ্টা ধরে এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে বাচ্চাদের জন্য উপহার কিনে একে একে পুরো ক্যাব ভরে ফেলেছে ইহসান। কার্ডে যা ছিল, সব শেষ। অ্যাকাউন্ট এখন ঠান্ডা জমিন। এমনকি ক্যাবভাড়াও দিতে হয়েছে এলিজার থেকে চেয়ে নিয়ে। উপহারভর্তি ব্যাগগুলো নিয়ে এলিজাকে শ্যাওড়াপাড়ায় নামিয়ে দিয়ে, ওর কাছ থেকেই সামান্য ভাড়া চেয়ে রিকশা ধরেছে সে সোজা হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৭

কিন্তু যানজটে আটকে গেছে সে। একা সৃজাকে নার্সদের ভরসায় রেখে এসে সে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। মনটা কেমন করছে। দ্রুত পৌঁছানোর তাড়ায় সে যখন রিকশাওয়ালাকে তাগাদা দিতেই যাবে ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠল ওর। বিরক্ত সে স্ক্রিনে ইজহানের কল দেখে প্রথমে ধরতে চাইছিল না ওর আজেবাজে কথা শোনার জন্য। কিন্তু কী মনে হতেই না ধরেও পারল না। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল ইজহানের রুদ্ধশ্বাস, তীক্ষ্ণ গলা, “হা রা ম জাদাটা হসপিটালে এসেছে। আমার হাত থেকে পালিয়ে তোর বৌয়ের কাছে গেছে এখন, শিয়র।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৯