অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসানকে খবরটা দিয়ে ইজহান তপ্ত মেজাজে আরসালানের গালে গুণে গুণে ছ’টা থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্য নিয়ে আবারও হসপিটালে প্রবেশ করল। কিন্তু কেবিনে পৌঁছে দেখল কক্ষ খালি। সৃজা নেই। বারান্দাতেও না। বালিশের ওখানে পড়ে আছে ওর ফোনটা। ইজহান উত্তেজিত হয়ে বাইরের লবি-ট্যারেসেও খুঁজে আসে, কিন্তু কোত্থাও পায় না সৃজাকে, না আরসালানকে। সে হতবুদ্ধি হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। ভেবেছিল আরসালান কিছু ঝামেলা করবে, সৃজার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে বা সত্যিগুলো বলে দেবে, কিন্তু সৃজাকেই যে তুলে নিয়ে যাবে এটা সে ভাবেনি! কিন্তু হসপিটালে এত লোকের আনাগোনার মধ্যে এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
সে বিভ্রান্ত।
এদিকে ইজহানের ফোন পেয়ে ইহসান যে কীভাবে হসপিটালে পৌঁছাল, সেটা সে নিজেও জানে না। তার মাথায় শুধু একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খাচ্ছে, ইনজান সেখানে আছে মানে সৃজার ক্ষতি করে দেবে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে যখন সে দেখল, আরসালান তো দূর সৃজাও কেবিনে নেই, ওদের বদলে সেখানে বসে আছে ইজহান; সে বিভ্রান্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সৃজা কোথায়?”
ইজহান ঠোঁট উল্টালো, “সব জায়গায় খুঁজে এসেছি, তোর বউ কোথাও নেই, না আছে আরসালান!”
“মানে?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইজহান বলল, “মানে আমি খুঁজে পাইনি ওদের। আই থিংক তোর ব… বউকে কিডন্যাপ করেছে!”
অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল ইজহান। শুনে ইহসানের মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথাই বলতে পারল না। টের পেল, তার বুকটা কাঁপছে। হার্টবিট দ্রুত হচ্ছে। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে ধারালো গলায় বলল, “এতো বড়ো হসপিটাল, সিকিউরিটি এতো কড়া তারমধ্য থেকে একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে এটা অসম্ভব! তাছাড়া পরিচিত হলেও কথা ছিল যে, সৃজা তার সাথে চলে যাবে! মেয়েটা তো ওকে চেনেই না৷ তাহলে স্বাভাবিকভাবে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। তুই ভালো করে সব জায়গায় দেখেছিস তো?”
ইজহান দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বোঝাল সে ভালোভাবে দেখে এসেছে, কিন্তু আসলেই কোথাও পায়নি। চোখদুটো বুজে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে ইহসান তাকাতেই দেখল সবকিছু তার কাছে অন্ধকার ঠেকছে। তার মাথা ঘুরছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কী করবে সে, কী করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছে না তার। ঠিক করল সিসিটিভি ফুটেজ গিয়ে চেক করবে। ইজহানও সায় দিলো ওর কথায়। কারণ সেও চিন্তিত। এতো বড়ো একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে তার ছোটো ভাই, বিষয়টা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে ইহসান যখনই আধখোলা স্লাইডিং ডোরটার দিকে পা বাড়াবে ঠিক তখনি সেটা বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ঢুকলো সৃজা। তার মুখে হাসি, বাইরে থেকে এক বৃদ্ধার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। তাকে বিদায় জানিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে সৃজা যখন পেছনে ঘুরল, তখন দু’ভাইকে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর হাসি উবে গেল। দু’জনের মুখই কেমন ফ্যাকাশে। একজন দাঁড়ানো অবস্থায় এবং অন্যজন বেডে বসা। ভাবভঙ্গি দেখে সৃজার সন্দেহ হলো যে, দু’জন হয়তো আবারও সংঘাতে জড়িয়েছে। সৃজা ইহসানের দিকে তাকিয়ে উদ্বেগজনিত কণ্ঠে বলল, “আবারও মারপিট করেছ? ভাইয়া আপনিও?”
ইজহান তখনো হতবিহ্বল। ভেবে পাচ্ছে না সৃজা এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কেন! এর মানে কী আরসালান এখানে আসেনি? মেয়েটাকে কিছু বলেনি? কিছু করেনি? তাহলে ডাফারটা ওকে ফাঁকি দিয়ে পালালো কেন? সে তো ওটাকে ওর ঠিকানায় পৌঁছে দিতেই যাচ্ছিল! কিছুই বুঝতে পারল না ইজহান। শুধু অস্ফুটস্বরে বলল, “মারপিট করিনি।”
“তাহলে আপনাদের এমন লাগছে যে?”
এই প্রশ্নের জবাব নেই ইজহানের কাছে। দিলোও না সে। বুঝল এখানে থেকে আর কাজ নেই। আরসালান সাইকোটা ওকে ঘোল খাইয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট। একে পেলে তো সে দেখে নেবে। সে শক্ত হয়ে বসে রইল। ইহসানই প্রশ্নটা করল, “তুই কোথায় ছিলি?”
“বাচ্চাদের ওখানে। খাইয়ে দিয়ে আসছিলাম। আসার পথে নাবিলা ম্যাম ডাকলেন। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।”
ইহসান রাগ চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ওর চাহনি দেখেই আচমকা ইজহান উঠে ধীরপায়ে দরজায় দিকে এগিয়ে গেল। উদ্দেশ্য মানে মানে কেটে পড়া।
“এই তুই দাঁড়া!”
পেছন থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ডেকে উঠল ইহসান।
ইজহান থেমে যায়, কিন্তু ফিরে না তাকিয়ে দাঁত ঘষে জিভ কাটে। হ্যাঁ, সে সব জায়গায় খোঁজ করেছে কিন্তু বাচ্চাদের ওখানে খোঁজ নেয়নি। ওখানে না খুঁজেই সে গাধামো করেছে! এখন ভেড়ার সামনে কী বলবে?
নিশ্চয় এখন ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেওয়ার মতলব করছে! কিন্তু সে তো এখন ঝামেলাঝাটিতে জড়াতে চায় না। অতি শ্রীঘ্রই ইস্মিতার কাছে ফিরতে চায়। নাহ! এখানে থাকলে আজ আর তার বাড়ি ফেরা হবে না। ইহসানের ডাক পরোয়া না করে একপ্রকার ছুটেই বেরিয়ে গেল সে। সৃজা শুধু নির্বোধের মতো ওদের কান্ড দেখে গেল।
খোঁজ না নিয়ে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে বলে আত্মা নাই করে দিয়ে এখন পগাড় পার হচ্ছে বেকুবটা! একটা থাপ্পড় দেওয়া দরকার ছিল ওটাকে। কিন্তু ইহসানের ক্লান্ত, অবসন্ন মস্তিষ্কটা বলল, ও ছিল বলেই ইনজান আজ এতদূর এসেও কিছু করতে পারেনি। তাই ওর প্রতি একটু হলেও কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তোমার, ভুল খবর দিলেও গাধামো সে করেনি তোমার মতো! ইহসান গভীর শ্বাস ফেলে নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সৃজাকে বুকে টেনে নিয়েই শান্তি কুড়ালো। এতক্ষণ দুনিয়ার সব ভয়ংকর ভাবনায় শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। অস্থিরতা গোপন করে সে সৃজাকে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেউ এসেছিল?”
“কে আসবে?”
“মানে তোর সঙ্গে দেখা করতে? আমি যাওয়ার পর?”
“না তো। কেউ আসার কথা ছিল? আর আসলেও আমি বলতে পারব না, তোমরা যাওয়ার একটু পর থেকেই আমি ওখানে ছিলাম।”
“উহু, কেউ আসার কথা ছিল না।”
ইহসান চোখদুটো বুজে নিলো। তার খামখেয়ালিপনার কারণে ইদানীং যেসব বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে তাতে অন্তত কোনো বিপদ যে ঘটেনি, এটাই স্বস্তির। তার স্বস্তিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই সৃজা বলল, “শুনো, একটা কথা বলার ছিল! নাবিলা ম্যাম বললেন, বাচ্চারা এখন স্টেবল আছে। ওদের রেসপিরেটরি সাপোর্ট আর লাগছে না, আর ফিডও সহ্য করছে ঠিকঠাক। ক্লিনিক্যালি ইমপ্রুভ করছে! দু-তিন দিনের মধ্যে ডিসচার্জ সম্ভব হতে পারে। ম্যাম চেয়েছিলেন তুমি গিয়ে একবার দেখা করতে।”
খবরটা শুনে ইহসানের মনে হলো একটা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার পর ঝুম বৃষ্টি নামার মতোন প্রশান্তি নেমেছে তার বক্ষপটে। ছোট্ট করে ‘হু’ বলে আরো কিছুক্ষণ সৃজাকে বুকে জড়িয়ে রাখল। চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “ইদানীং মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রেগে যাচ্ছি, অল্পতেই কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ছি। আর তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে তোকে।”
“কিছু হয়েছে তোমার? খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
“না, শুধু একটু ডিস্টার্ব।”
“আমাকে বলা যায়?”
“উহু! কিছু কিছু বিষয় বলা যায় না।”
“বললে হালকা লাগতে পারে।”
“তোর মুখ দেখলেই আমি হালকা হয়ে যাই। অন্য কিছুর দরকার পড়ে না।”
“তবুও বলবেই না?”
ইহসান প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “তখন ওভাবে রিঅ্যাক্ট করে বেরিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। সরি।”
সৃজা হাসি চেপে রেখে চোখদুটো হালকা রোল করে বলল, “তুমি আমাকে সরি বলছ? ভাইয়াকে বলো না যে?”
“তোর কাছে সরি বলতে আমার লজ্জা লাগে না। তোর কাছে নির্লজ্জ হয়েও আমি সরি বলতে পারি। অন্যদের কাছে পারি না।”
সৃজার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন একটা ভার নামল। অজান্তেই চোখের পলক থেমে গেল। কেমন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, মলিন আর অভিমানী গলা ইহসানের।অথচ লোকটার প্রতিটা কাজে, প্রতিটা কথায়, প্রতিটা অনুভবে কেন্দ্রেই সে। কিন্তু নিজের কষ্টগুলো সেভাবে কখনও প্রকাশ করে না ওর কাছে। সারাক্ষণ ওর প্রতিটা বিষয় নিয়ে মেতে থাকলেও অন্যসব যন্ত্রণাগুলো ভোগ করে একা একা। চাহিদাগুলোকেও করে উপেক্ষা। সৃজা ওর বুক থেকে মাথা তুলে কোমল, স্পষ্ট, দায়বদ্ধ দৃষ্টিতে ইহসানের চোখে চোখ রেখে তাকাল। এক হাত বাড়িয়ে ওর গালে রাখল। ইহসানের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু সেই শান্ত চোখের গভীরে অন্যরকম বিষন্নতা। কী নিয়ে এই বিষন্নতা পুষছে মনে? জিজ্ঞেস করলে তো বলবেই না বরং ঝাড়ি দিয়ে ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দেবে। সৃজা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ম্লান গলায় বলল, “আমি ভাবতে পারিনি ব্যাপারগুলো তোমার খারাপ লাগবে, কষ্ট দেবে। ভাইয়া আগ্রহ দেখাল বলে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা তোমার জন্য ভুল হয়ে গেল। তাই তোমাকে না জানিয়ে ওই ব্যাপারটার পারমিশন…সরি!”
“ইটস ওকে। বলিস, নাম রাখলে রাখুক। কিন্তু দাবি যেন না করে। আমি ওদের ব্যর্থ বাবা হলেও বাবা তো! ওরা আমার সন্তান, ওরা আমার একটা একটা তুই! আমি ভীষণ লোভী তোর জন্য, ওদের জন্য। ভালোবাসায় হ্যাংলা হয়ে গেছি। তাই ওভাবে চেয়ে বসলে আমি নিতে পারি না। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়…”
স্লাইডিং ডোরটা খোলাই ছিল, বাইরে চোখ পড়তেই ইহসানের চোয়াল শক্ত হলো। আচমকা সৃজাকে আরো জোরে নিজের বুকে টেনে নেয়। চওড়া বুকের আশ্রয়ে মাথা লুকিয়ে, সৃজা টের পায় পুরুষটার অভ্যন্তরীণ তাড়না। যে তার হৃদয়জয়ী, চোখের জল নিঃশব্দে গিলে ফেলা পুরুষ। যার জীবনে পদার্পণ করে, সংগ্রামী থেকে সে হয়ে উঠেছে স্নেহাসিক্তা, ভালোবাসায় নিঃশব্দে গলে যাওয়া এক নারী।
°
ম্লান দুটো হলদেটে বাতির আলোয় ডুবে আছে আশপাশটা। সারিবদ্ধ করে রাখা টবের পাতাগুলোর নড়াচড়াও কম। একেবারে নিঃশব্দ পরিবেশ।করিডোরটার এই পাশটা একটু বেশিই নির্জন। সেখানেই ওয়েটিং চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আরসালান ইনজান। তার বাঁ হাতটা দেয়ালের সঙ্গে ঠেকানো, আর ডান হাতে সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে। কড়া ঘ্রাণটা নাসারন্ধ্রে জ্বালাপোড়া ধরিয়ে দেওয়ার মতো। অথচ আরসালানের তাতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না। সে চুপচাপ বসে আয়েশী ভঙ্গিতেই একটু পরপর সিগারেটে টান দিচ্ছে। তার চোখদুটো স্থির হয়ে আছে লম্বা করিডোরের একেবারে শেষ মাথার কেবিনটাতে। যেটার আধা খোলা স্লাইডিং ডোরটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তার বড়ো ভাই তার ল্যাভেন্ডারের কপালে অসংখ্য চুমুর বন্যা বসিয়ে দিচ্ছে।
চোয়াল শক্ত করে অনেকটা ক্ষণ দৃশ্যটা দেখার পর আচমকাই আরসালান ঠোঁট চেপে ধরে হাসে। সেই সঙ্গে হাসে তার জ্বলজ্বলে চোখদুটোও। সিগারেটের ফিল্টারটা নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে, “তোমার দুর্বলতা আমার আনন্দের উৎস। তোমাকে আতঙ্কিত হয়ে গলে যেতে দেখলে অদ্ভুত শান্তি
পাই সেটা তুমি জানো ব্রাদার। ওকে এভাবে ছুঁচ্ছ তাতে আমার একটুও রাগ হচ্ছে না, কিন্তু তোমার সুখ দেখে হচ্ছে….ছাইচাপা আগুনের মতো রাগ!”
বিচিত্র হাসি ও তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টিতে কেবিনের ভেতরের ভালোবাসার দৃশ্যটা চোখের পাতায় বন্দি করে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কোনোরকম শব্দ ছাড়াই হাঁটতে হাঁটতে করিডোর পেরিয়ে এস্কেলেটরে চড়ে গ্রাউন্ডে নেমে আসে সে।
হাসপাতালের গেটের পাশে পাথরচূর্ণ ধূসর বর্ণের চকচকে রুবিকন জীপটা দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে এক লাফে উঠে বসে ইনজান। তখনি নাকে ঠেকে ফুলের মৃদু সুবাস, কোন ফুলের সুবাস এটা জানে না সে। হাওয়ায় ভাসতে থাকা ঘ্রাণটা পছন্দ হয় না তার। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে সে ড্রাইভিং সিটে বসা নীতিনের দিকে তাকায়। এখনো টের পায়নি তার উপস্থিতি। চোখ মুদে সাউন্ড সিস্টেমে বাজানো গানের সঙ্গে নিজেও গলা মেলাচ্ছে,
নারী জাতির কঠিন রীতি
বোঝেনা পুরুষের মতি
সদাই থাকে নিজেরে লইয়া।
তুমি করছো নারী রূপের বড়াই গো
রাধারমণে যায় কইয়া।
মান করে রাই, রইয়াছো ঘুমাইয়া।
প্রচন্ড এক থাবা বসিয়ে সাউন্ড সিস্টেমটা অফ করে দিতেই হকচকিয়ে উঠে নীতিন। পাশে নিজের অতিপ্রিয় ছোটো স্যার গাড়িতে এসে বসেও গেছে, অথচ সে টেরই পায়নি? অবশ্য যা জবরদস্ত গান শুনছিলো সে, উন্মত্ত না হয়ে কেউ পারে না কি? দুটো শুকনো ঢোক গিলে ছোটো স্যারের দিকে তাকিয়ে সে হাসল। বোকাবোকা হাসি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে স্টেয়ারিংয়ের উপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “স্যার, কই যাব? অ্যাপার্টমেন্টে?”
নীতিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকা আরসালান ইনজান শেখ তখন হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি জানালার দিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে তো তাকিয়েই। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখে জমে থাকা অন্ধকারটাকে বিদ্রুপ করে সে অসহ্য রকমের শীতল
কণ্ঠে বলে, “চলল…যেখানে আলোওওওও আছে, মিউজিকককক…. আর উদযাপননন করার জায়গা
আছে সেখানে…”
শব্দগুলো এমনভাবে লম্বা করে বলল, যেন প্রতিটা ধ্বনি স্নায়ুতে ছুরি চালাতে ব্যস্ত। নীতিন গলার ভেতর শুকনো থুতু গিলে বলে, “এইডা কোন জায়গা স্যার?”
“তোর শ্বশুরবাড়ি।”
একটু পরই বলে, “উহু, ক্লাবে।”
নীতিন চোখ বড়ো বড়ো করে চায়, “আপনের আব্বায় কিন্তু মানা করছে স্যার… শরীরডা এহনো ঠিক হয় নাই…”
কথাটা বলে শেষ করতে পারে না নীতিন। ইনজান এবার সরাসরি ওর দিকে তাকায়। একটা বিষাক্ত গর্জনের মতো ঠাণ্ডা হাসি ফুটিয়ে বলল, “লাত্থি মেরে বের করে দেব নীতু সোনা? যেভাবে আমার ভাই আমাকে ল্যাভেন্ডারের জীবন থেকে বের করে দিয়েছে? হু?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৮
কথার মানে বুঝতে না পারলেও, আশ্চর্য হলেও হুমকি শুনে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রুবিকনটা স্টার্ট দেয় নীতিন। নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা জীপটা ছেড়ে যায় রাস্তার দু’পাশের সারি সারি গাড়ি, পিচঢালা পথ আর আধুনিক হাসপাতালের ওই কেবিন, যেখানে একজোড়া কপোত-কপোতী একে-অপরকে চুমু খাচ্ছে!