অশ্রুবন্দি পর্ব ৬০

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬০
ইসরাত জাহান ফারিয়া

কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালের অন্তহীন উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটিয়ে আজ এক সপ্তাহ হলো বাড়িতে আনা হয়েছে বাচ্চাদের। একটা সপ্তাহ চোখের পলকেই কেটে গেল তবুও, শেখ বাড়ির পরিবেশে এখনো নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি বাচ্চারা। এন.আই.সি.ইউ-র যান্ত্রিক শব্দ আর আলো ঝলমলে কেবিনের অভ্যস্ততা থেকে হঠাৎ করে অচেনা ঘর, অজানা পরিবেশ, কিছু নতুন মুখ সবই ওদের কাছে অচেনা, অস্বস্তিকর। দু-চারটা পরিচিত মুখ ছাড়া কেউ কাছে গেলেই ওদের চোখে ভেসে ওঠে রাজ্যের বিস্ময়, যা ধীরে ধীরে রূপ নেয় কান্না ও চিৎকারে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, নিঃস্তব্ধ পরিবেশ ওরা পছন্দ করে, কিন্তু নিজেদের কণ্ঠে নয়।

সামান্য কিছুতেই একজন কেঁদে উঠলে, আরেকজনও ঠিক তখনই শুরু করে দেয়। একচল্লিশ দিনের ছোট্ট পাখি দুটোর এমন অস্থিরতায় ইহসানের পিতৃ মন আইসক্রিমের মতো গলে একেবারে জল হয়ে যায়। সে দিন-রাত এক করে চেষ্টা করছে ওদের যাতে কোনো কষ্ট না হয়। খাওয়ানো, গোসল, ডায়াপার চেঞ্জ, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তার যত্নের ছাপ। তবু তার চেষ্টা বৃথা। দুই ভাইবোন নিজেদের মতো করে কান্নার দৌড়ে ব্যস্ত। একজন চমকে জেগে উঠলেই আরেকজনও তড়িঘড়ি কান্না শুরু করে দেয়। সৃজা আর ইহসানের রাতগুলো নিদ্রাহীন আতঙ্কে ঢাকা। সৃজার চোখে ঘুম নেই, অবসাদে সে নিজেও একসময় বাচ্চাদের সঙ্গে কেঁদে ফেলে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পর থেকেই তার শরীর ভেঙে পড়েছে। আজ তো বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পরেই যাচ্ছিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইহসান ছিল বলে রক্ষা। কিছু হয়নি বলে বাচ্চাদের নিয়ে অস্থির হতে গেলে দুটো ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে ইহসান। চেক করে দেখেছে, প্রেশার ফল করেছে মেয়েটার। ওজন একষট্টি থেকে নেমে এসেছে সাতচল্লিশে। চোখের নিচে গাঢ় কালি, রুক্ষ হয়ে যাওয়া চুল, আর ক্লান্তির ছাপ চোখে পড়ার মতো। শতবার বলেও এই মেয়েকে নিজের প্রতি সচেতন করাতে পারেনি ইহসান। আজ তাই বকাঝকা, রাগারাগি না করে চুপচাপ ফলের বাটি হাতে তুলে দিয়ে সন্ধ্যা থেকে একা হাতে বাচ্চাদের সামলাচ্ছে সে। সৃজাকে জোর গলায় মানা করে দিয়েছে সে যাতে নিজেত প্রতি মন দেয়, বাচ্চাদের খেয়াল সে বাপ হয়ে নিজেই রাখতে পারবে। সৃজা যদিও আপত্তি করছিল, সে শোনেনি। সময় নিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে, মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে আর আড়চোখে খুঁটে খুঁটে ফল খেতে থাকা সৃজাকে দেখছে। মেয়েটা তার সন্তানদের মা, অথচ ওদের নিয়ে চিন্তা করতে করতে কী হাল হয়েছে শরীরের! ইহসানের মোটেও মোটেও ভালো লাগছে না ওকে এভাবে দেখতে। ভেতরটা ভার হয়ে আছে তার নীরব দায়বোধে।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৃজার অবস্থা দেখে।
অতঃপর দীর্ঘক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, স্নেহভরা ফিসফিস কণ্ঠে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে গেয়ে মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে সবে শুইয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের নিঃস্তব্ধতা চুরমার করে দরজায় নক হলো। কড়া নাড়ার জোর শব্দে হকচকিয়ে উঠল সৃজা, ইহসান। বাচ্চাদের একপলক দেখে নিয়ে ইহসান সৃজার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই সৃজা হেসে ফেলল, “যাও, খুলে দাও। বড়োআব্বা এসে গেছে ওদের!”
ইহসান বিপরীতে কিছু বলতে যাবে কিন্তু দরজার বাইরে থাকা গমগমে স্বরে পুরুষালি কণ্ঠটা বলল, “এই!! এই!! দরজা খোল! এতক্ষণ লাগে কেন খুলতে? নিশ্চয় টনা-মনাকে ঘুম পাড়ানোর মতলব করছিস এখন, আমার কাছে দিবি না বলে? ধান্ধাবাজি বন্ধ করে ভালোয় ভালোয় খোল বলছি!”

দুটো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় আজ সারাদিন ব্যস্ততার সহিত অফিস করেছে ইজহান। যারজন্য বাচ্চাদের কোনো খোঁজ নিতে পারেনি সে। সেজন্যই মনটা বড্ড উচাটন হয়ে আছে তার। হাইজিনের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে না সে। বাড়িতে ফিরেই আগে গোসলটা সেরেছে সে, যাতে বাচ্চাদের কাছে গেলে ওদের কোনোরুপ সমস্যা না হয়। এখন থেকে ঠিক দুই ঘন্টা সে বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বসে থাকবে, হাঁটবে। নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে তার।
মানা করলেই শুরু করবে উল্টাপাল্টা কথার ঝড়। কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই ঝামেলা এড়াতে চায় ইহসান। আজকাল ওর সঙ্গে দ্বন্দ্বেও কম জড়ায়। উচাটন হয়ে দরজায় থাবা বসাতে থাকা পাগলকে শান্ত করতে সে দরজা খুলে দেয়। খুলতেই গলায় বাড়াবাড়ি উল্লাস, হাতে চকোলেট আর ঝাঁকুনি দেওয়া টয়স নিয়ে ঝড়ের গতিতে সোজা ঢুকে পড়ে ঘরে ইজহান।

ততক্ষণে অবশ্য বড়ো আব্বার গমগমে কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম থেকে উঠে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে দু-ভাইবোন। ছোটো বাচ্চাদের কীভাবে কোলে নিতে হয়, কীভাবে কোলে নিলে ওরা আরাম পায়, কীসব বললে খুশি হয়, হাসে, কোলে আসে প্যারেন্টিংয়ের বেসিক কিছু বিষয়ের উপর মিজুকে নিয়ে ট্রেনিং নিয়েছে ইজহান। প্রথম দু’দিন টনা-মনাকে কোলে নিতে না পেরে ইহসানের উপর রাগান্বিত হয়েই সে খুব ভালোভাবে এগুলো রপ্ত করে এসেছে। এখন দারুণভাবে দু’জনকে একত্রেও কোলে নিতে পারে সে। ইজহান সবগুলো গিফটস একপাশে রেখে তার টনার কপালে চুমু খেয়ে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। ঊষ্ণ কোলে জায়গা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কান্না থামিয়ে জুলজুল চোখে ইজহানের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা।

মুগ্ধ হয়ে গেল সে। চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে কয়েকবার ‘মাশাল্লাহ’ আওড়ে নিলো সে। ইচ্ছে করল এই আদুরে বাচ্চাটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে, একগ্লাস পানি দিয়ে টুপ করে খেয়ে নিতে। দু’হাতে ভালো করে বাচ্চাটাকে আগলে নিয়ে আদর করল সে সময় নিয়ে। এরপর ‘মনাকে’ রেখে সে তার ছেলেবাচ্চা অর্থাৎ ‘টনাকে’ কোলে নিয়ে বলল, “নিয়ে যাচ্ছি! আজ ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোয় ব্যস্ত ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে ওর দিকে তাকাল। সৃজাও বোকার মতোন তাকাল ইজহানের দিকে। এত ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে যাবে মানে? ওকে ছেড়ে সে রাতে থাকবে কেমন করে? একটুও ঘুম নামবে না ওর চোখে। এসব বাদ দিলেও পটি পরিষ্কার, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারগুলোও আছে! দু’জনে ফিডারে অভ্যস্ত তাও রাতে দু’বার সে নিজে ফিড দেয়।

রাতে তো একটুও ঘুমায় না, নিজেরাও জেগে থেকে৷ বাপ-মাকেও জাগিয়ে রাখে। ইস্মিতার এখন যা অবস্থা, তাতে করে মোটেও উচিৎ হবে না একটা দুধের শিশুকে সারারাত সামলানো। এসব ভেবেই সৃজা আপত্তি করে উঠল, “কিন্তু ভাইয়া, ও খুব জ্বালাবে। ভাবীর খুব সমস্যা হবে।”
ইজহানের পছন্দ হলো না কথাটা। তার চাওয়ার বিপরীতে আওয়াজ তোলায় সে সৃজাকে ধমক দিলো, “এই মেয়ে, বেশি কথা বলো কেন? সমস্যা হলে আমাদের হবে। তোমার তো কোনো সমস্যা হবে না। একদম চুপচাপ বসে থাকো। নিজে তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না আবার আমাকে বলে আমি না কি ওদের সামলাতে পারব না। হুহ! শুকিয়ে তো মরা মুরগী হয়েছ, এসেছে আমাকে বলতে…”

বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছেলেকে বুকে আগলে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল। এদিকে সৃজা হতভম্ব। মানে সে শুকিয়ে মরা মুরগীর মতো হয়ে গেছে? ভাইয়া এটা বলতে পারল? ও ইহসানের দিকে অপ্রস্তুত চোখে তাকাল। এই লোক তো এমনিতেই বোম হয়ে আছে, এখন ভাইয়ের কথায় না আবার তাল মিলিয়ে তাকে কথা শোনায়! এদিকে ইহসান বহুকষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। যদিও হাসার কথা না, তার উল্টো উচিৎ ইজহানের উপর মেজাজ খারাপ করা, কিন্তু তাও কেন যেন তার হাসি পাচ্ছে! কোনোমতে জিজ্ঞেস করল, “ছেলেকে চাই তোর?”
“ভাবীর সমস্যা হবে, বুঝছ না কেন?”
“আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। খুব জ্বালালে আমি না হয় গিয়ে নিয়ে আসব। শখ করে নিয়ে গেছে যখন, একরাত রেখে বুঝুক বাচ্চা সামলানো কত সহজ কাজ!”
ইজহানের কাছে রাখতে যে এই লোক রাজি হবে এটা ভেবেই সৃজার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল সে ইহসানের দিকে। শুকনো মুখ করে থাকা মেয়েটার চমকিত রুপ দেখে সে মৃদু হেসে কাছে এসে ওর নাকের ডগায় কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোকে দেখতে বোকা বোকা লাগছে!”

রাত দুইটা বাজে। চারপাশ নিস্তব্ধ, আকাশে পূর্ণিমার আলো। ঘরের লাইট অফ, হলদে আলোর একটা বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলছে। ইজহানের চোখ লাল, চুল এলোমেলো, গায়ে স্লিভলেস টি-শার্ট ঘেমে একাকার। আর কোলে তার ‘টনা’—যার এখন চোখ-মুখ রক্তবর্ণ, গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ইজহান তাকিয়ে আছে ছেলেটার মুখের দিকে হতবাক হয়ে। কান্না থামাতে কতকিছু করেছে সে? টয় দেখিয়েছে, পিঠ ঘষে দিয়েছে, গলা ফাটিয়ে ঘুমপাড়ানি গান গেয়েছে—কিন্তু কিছুতেই থামে না এই ত্যাদড় ছেলে! ফিডারটাও মুখে দিলেই ফেলে দিচ্ছে। ডায়াপার চেক করেছে ইহসান, এটাও পরিষ্কার। গরম লাগছে ভেবে সেটা খুলেই কাঁথা দিয়ে মুড়ে কোলে তুলে হেঁটছে এরপরেও আর কী চাই ছেলের? এই মুহূর্তে নিজেকে তার অসহায় মনে হচ্ছে। আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে ধমকও দিতে পারছে না সে। নয়তো কখন যে আছাড় মেরে বসতো হু নৌজ! ইস্মিতা চুপচাপ নিজের স্বামীকে নাকানিচুবানি দেখছে আর মনে মনে দোয়া করছে যাতে এই লোকের মাথা না বিগড়ায়!

ইজহানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বহুকষ্টে সে নিজেকে সামলাচ্ছে। এক পর্যায়ে চিৎকার বন্ধ করার জন্য ডায়াপার পরিয়ে মুখে ফিডার তুলে দিলো সে। কিন্তু কিছুতেই খেল না বাচ্চাটা। ইজহান হতাশ হয়ে মিনমিন করে বলল, “এই… কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? বড়ো আব্বা কত আদর করলাম বলো তো! তোমার বাপে জীবনে ওমন আদর করেছে? জানে এইসব? বাচ্চাদের কীভাবে কোলে নিতে হয় জানে? প্যাকেট করে কোলে রাখলেই যে হয় না তা জানে? উহু, কিছুই জানে না। আমি কত সুন্দর করে কোলে নেই বলো তো! ও তুমি তো আবার কথা বলতে পারো না, বলবে কেমন করে! তুমি তো একচল্লিশ দিনের বাচ্চা! ওকে ওকে, নো প্রবলেম। আমি কথা বলতে পারি, বড়ো আব্বা পারে…তোমার কিছু বলতে হবে সোনা, তুমি শুধু কান্নাকাটি বন্ধ করো….”

কিন্তু ইজহানের আদুরে কথায় তার আদরের ‘টনা’ মোটেও থামল না। সে আগের মতো কেঁদেই গেল। ইজহানকে দেখে মনে হলো এক্ষুনি তার চোখে ফেটে রক্ত বেরুবে। খুব বড়ো মুখ নিয়ে সে ইস্মিতাকে বলেছিল, সে ‘টনাকে’ সামলাতে পারবে। এইটুকু বাচ্চাকে সামলানো তার বা হাতের খেল। ‘মনাকে’ যেমন কান্নাকাটি করা অবস্থায় কোলে নিলেই থেমে যায়, ইজহান ভেবেছিল এই ‘টনাটাও’ এমন। কিন্তু এই মাঝরাতে, তার মনে হচ্ছে এই ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। এটা একদম ভেড়ার কপি। ভেড়া যেমন তাকে জ্বালায়, এর ছেলেটাও ওকে জ্বালানোর পণ করেছে। তাইতো থামছে না। নয়তো সকলের সামনে তার উঁচু গলা নিচু করবে কীভাবে? তাকে হেরো প্রমাণ করবে কীভাবে? ইস্মিতার কাছে যেন মুখ ছোটো না হতে হয় সেজন্য ওর দিকে তাকিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি এত আদর করলাম এরপরেও কাঁদতে হয়? একদম বাপের মতো হয়েছে ছেলেটা!”

ইস্মিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাই তোলার ভান কর‍তে করতে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে ও আপনার মতোই হয়েছে। আপনি যেভাবে আমাকে জ্বালান, ও ঠিক তেমন করেই আপনাকে জ্বালাচ্ছে। মানুষকে জ্বালালে তার কেমন লাগে একটু বুঝুন!”
ইজহান থমকে গেল, “আমি তোমাকে জ্বালাই?”
“আপনি জ্বালাবেন কেন? আপনি তো আমাকে কতো আদর করেন! আমাকে তো জ্বালায় এই পুঁচকুটার বড়ো আব্বা! জ্বালিয়ে হাড়-মাংস এক করে দেয়!”
“ওর বড়ো আব্বা তো আমিই।”
“তাহলে হয়তো আপনার কথাই বলছি আমি!”
ইজহান মুখ ভার করে বলল, “এতো না প্যাঁচিয়ে সোজাসাপ্টা বললেই হয় আমাকে আর তোমার ভালো লাগে না। কাহিনী করার তো দরকার নেই।”
“আসলেই তো, কাহিনী করার দরকার কী? আপনি নিজেই তো একটা কাহিনী।”
“আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে!”
“আমার খুব মজা লাগছে।”

ইজহান বিস্মিত হলো, “মজা লাগছে? আমাকে দেখে তোমার মজা লাগছে? সিরিয়াসলি? আমি এখন তোমার কাছে মজার খোরাক হয়ে গেলাম?”
“আপনাকে দেখে না, আপনাকে নাকানিচুবানি খেতে দেখে মজা লাগছে!”
“সে তো লাগবেই। আমার দিকে কী আর কারোর নজর আছে? আমি তো এখন একটা জোকার। যাকে মানুষ যেভাবে নাচায়, ওমনি নাচে। ভেড়ার এই ছেল্টাও নাচাচ্ছে, তুমিও নাচাচ্ছ! আমাকে দেখে মজা লাগবে না তো প্রেম প্রেম পাবে? আদর করতে ইচ্ছে করবে?”

ইস্মিতা কিছু বলল না। শুধু ওর ভার মুখের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ হাসলো। ইজহান তীক্ষ্ণ চোখে বউয়ের উপহাসের হাসি দেখেই গেল। তার দাম এখন দু-টাকা। দু’টাকার আবার মূল্য আছে নাকি? তাকে দেখে তার বউ হাসবে না তো কাছে ঘেঁষবে? সে এতো বাড়াবাড়ি ভাবনা ভাবে কেন? এতো আশা রাখে কেন? আচ্ছা সে কী দেখতে বিশ্রি হয়ে গেছে? বয়সের ছাপ পড়েছে চোখেমুখে? সে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? এজন্যই কি ইস্মিতা মুগ্ধ চোখে তাকায় না? কালই কি নিজের একটু কেয়ার নিয়ে আসবে? মিজুকে বলে একটা অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখবে কি এখনই?
ইজহান যখন নিজেকে নিয়ে ভাবনায় মত্ত ঠিক তখনি সে তার প্যান্টে গরম, অস্বস্তিকর কিছু অনুভব করল। ঘোরের থেকেই অস্বস্তি কাটাতে সে হাত দিলো তার প্যান্টে। কেমন একটা অদ্ভুত চটচটে কিছু একটা লাগল তার হাতে। টনক নড়তেই ভ্রু কুঁচকে কাঁথার নিচ থেকে হাতটা বের করে আনতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল!
“ওহ মাই গড! এসব কী! এ-তো হেগেমুতে শেষ…”

বলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ইজহান। একহাতে তাকে যন্ত্রণা দেওয়া ‘টনা’ আরেক হাতে ‘টানার’ পটি।
পটির গন্ধে ইজহানের মনে হচ্ছে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে, বমি পাচ্ছে! সম্ভব হলে সে এখনি কোথাও পালিয়ে যেতো। কিন্তু না, সে কাপুরুষ না। সে পালাবে না। বউয়ের কাছে ভাবমূর্তি রক্ষায় সে চোয়াল শক্ত করে, টিস্যু আর ওয়াইপস নিয়ে শুরু করল ভেড়ার ছেলের পটি পরিষ্কার করার প্রক্রিয়া। তখন ডায়াপারের দু’পাশের স্টিকি অংশদুটো ভালোভাবে না আটকানোয় এই অবস্থা! বিছানা নষ্ট, নিজের প্যান্ট নষ্ট, মনের অবস্থা নষ্ট। কান্নাকাটি বন্ধ করে ততক্ষণে ভদ্র হয়ে যাওয়া টনাকে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাবে ইস্মি হতভম্ব হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “পাগল হয়েছেন আপনি? ও ছোটো বাচ্চা, ওকে বাথরুমে নিয়ে পরিষ্কার করানো আপনার কাজ না। আপনি বোলে করে এখানেই পানি নিয়ে আসুন আর এখানেই পরিষ্কার করান। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি…তার আগে গিজারটা অন করুন।”

মহা ফ্যাসাদে পড়া ইজহান কী আর করবে! হিরো হতে গিয়ে বলদ হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে সে ইস্মিতার কথামতোই কাজ করল। একহাতে ভেজা তুলতুলে নরম কাপড় দিয়ে টনার কোমল শরীর পরিষ্কার করতে করতে ইজহান রুদ্ধ গলায় বলল, “বড়োআব্বা হতে চেয়েছিলাম রে বাপ। কিন্তু তোমার মতো বাচ্চা সামলানো তো রীতিমতো যুদ্ধ… যুদ্ধ!”
ইস্মি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, “যুদ্ধে জিতলেই না ভালোবাসার ভাগ পাবেন। ফ্রি ফ্রি তো কেউ দেবে না।”
“আমি তো তোমাকে ফ্রি-তেই ভালোবাসা দিই।”
“জোর করে গলায় ঝুলানোর শাস্তি।”

ইজহানের মেজাজ খারাপ হলো। ইদানীং এই মহিলা কথায় কথায় তার বুকে ছুঁড়ি বসায়, খোঁচা মারে। সে ভালো স্বামী বলেই এসব সহ্য করে টিকে আছে। অন্যকেউ হলে কবেই বউ পেটানো শুরু করতো।
কিন্তু আদরের বউ তার, এসব তো দূর ফুলের টোকা দিতেও তার আত্তা কাঁপে। ইজহান কথা বাড়াল না। গম্ভীর মুখ করে কাজ করতে লাগল। পটি পরিষ্কার করে সে নিজেও পরিষ্কার হলো। নষ্ট হয়ে যাওয়া জামাকাপড়, ডায়াপার সব ঘরের বাইরে ফেলে এলো। এরপর নতুন করে ফিডার বানিয়ে, খাইয়ে, কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ভেড়ার ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই
সে ক্ষান্ত হলো। খুব সাবধানে, একটুও শব্দ না করে টনাকে শুইয়ে দিয়ে ইজহান বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। ইস্মিতা খুব হাসলো তার
স্বামীর অবস্থা দেখে! নাকের ডগায় চুমু খেয়ে চুলগুলো টেনে দিলো নরম হাতে। ঘুমের ঘোরে ইজহান ওকে অস্ফুটস্বরে বলল, “এই টনাকে ছেলে বানাব না, অন্যকিছু বানাব। আমাকে মেয়ে দিও, ছেলে না।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৫৯

ভোরবেলা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বসার ঘরে আসতেই আজিজ শেখ একটা অদ্ভুত গন্ধের খোঁজ পেলেন। গন্ধটা শুঁকে শুঁকে সোফার কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখলেন সোফার উপর পড়ে আছে একটা গন্ধমাখা প্যান্ট, পাশে ব্লু ডায়াপার, পাশেই স্টিকি নোটে বড় বড় করে লেখা,
“এগুলো যে আগে দেখবে সে যেন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে।”
— ইজহান

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬১